.......অতঃপর মৃত্যুর প্রতীক্ষা
দশ দিনের ছুটি নিয়ে ইটালি গিয়েছিল ফেডরিক। ল্যাবে ফিরে আসতে না আসতেই আবার লাপাত্তা। তাই দেখা হতেই, "কী, বেশ ফুরফুরে লাগছে, তাই না?" খুব খুশি খুশি দেখালো তাকে। একটা পেপার জমা দেয়ার ডেডলাইন ধরার চেয়ে এই ছুটিটা বরং তার বেশি দরকার ছিল। তারপরেই দেখালো আইসল্যান্ডের ছাই মেঘের দৃশ্যটি,
-ভাগ্যিস আগে আগে চলে এসেছি, দেরি করলে আরো কটা দিন আটকে যেতাম।
তার হাই স্কুল শিক্ষক বাবার কথা বলল, বাবা জোর দিয়েছেন জীবন উপভোগ করতে। পিএইচডি করার নামে বছরের পর বছর কম্পিউটারের সামনে বসে কাটিয়ে দেবার কষ্টকর মুহূর্তগুলো পরে হয়ত আর অনুভূত হবেনা। কিন্তু এক সপ্তাহ কাটানো সুখ স্মৃতিগুলো পরে প্রায়শই রঙিন থাকবে।
-তারপর, তুমি তো এত দিন আছ এদেশে, একদিনও ছুটি নিলেনা, কোথাও ঘুরতে গেলেনা!
ফেডরিকের দিকে আর তাকিয়ে থাকতে পারলামনা। 'তোমার জীবন', 'তোমার পছন্দ', 'কারো কিছু বলার নেই'--জাতীয় অভয় দিতে লাগল সে।
উল্টো তাকে আমার কিছু দেশীয় দায়বদ্ধতা ও সীমাবদ্ধতার কথা স্মরণ করিয়ে দিতে হয় বারবার। ডিগ্রি হলে একেবারেই দেশে চলে যাব, ঘুরে বেড়ানোর মত বিলাসিতা আমার জন্য নয়। "লাক্সারি অফ লেইজার" বনাম "লিবার্টি অফ লেইবারের" কথাটা মাথায় টনটন করতে থাকল। আমি বিরতিহীনভাবে কাজ করে যাবার স্বাধীনতাটা উপভোগ করি হয়ত।
আমার আন্তরিক সৌজন্য প্রকাশ প্রায়শই এদের কাছে গুরুতর অনধিকার চর্চার পর্যায়ে গিয়ে দাড়ায়।
ফেডরিক সেদিন বলেই রেখেছিল, আজ তার বান্ধবী ল্যাবে আসবে দেখা করতে। অন্যের ব্যক্তিগত প্রসঙ্গ এড়াতে আমি তাই অন্যখানে গিয়ে কাজ করছিলাম। বহু পরে ফিরে গিয়ে দেখি ফেডরিক তখনও বান্ধবীর সাথে । আমাকে দেখা মাত্রই পরিচয় করিয়ে দিল ক্যাথরিনের সাথে। খানিকটা অপ্রস্তুত হয়ে, 'হ্যালো' বলেই আমাদের দেশীয় কায়দায় জানালাম,
-তোমার কথা শুনেছি ফেডরিকের কাছে অনেক! [হাসিমুখ]
অপরিচিত কিন্তু নাম শোনা মানুষের সাথে তাৎক্ষণিক পরিচয় পর্বে এর চেয়ে বেশি কিছুর বলার চিন্তা মাথায় আসেনি, কিন্তু দ্রুত একটা কিছু বলে পরিচয় পর্বটা মার্জিত করার তাগাদা ছিল।
পরেই দেখলাম ঘরে উপস্থিত মানুষগুলো থতমত খেয়ে দাড়িয়ে আছে। ফেডরিক রীতিমত অপমানিত। আমিও ভীষণ বিব্রত হয়ে অপরাধবোধে ভুগছি, না জানি কী ভীষণ অন্যায় করে ফেলেছি। পরে জানলাম এদের কাছে গার্লফ্রেন্ড বিষয়টি একান্ত ব্যক্তিগত, ফেডরিকের কাছে তার বান্ধবীর কথা শোনাটা যেমন অনধিকার চর্চা, তেমনি তার বান্ধবীকে জানানো যে, "আমি তার কথা আগে শুনেছি" এটা আরো বড় মাত্রার অভদ্র আলাপ। অথচ আমাদের দেশীয় পরিচিত হবার কায়দাটা এমনি, সেটি একান্তে ফেডরিককে বুঝিয়ে খুব উপকার হল বলে মনে হলনা।
কথা প্রসঙ্গে মিতালি একবার বলেছিল, আমি নাকি নিজের জীবন থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছি। বিপরীত জেন্ডারের সাথে খুনসুটির নামে আবেগ চর্চা, কিংবা ভদ্রলোকি সামাজিকতার চর্চা কোনটাই অলসতা ও আগ্রহের অভাবে করা হয়ে উঠেনি। ব্যাপারটি মিতালির চোখে পড়েছিল,
-আপনাকে এতদিনে একবারও হাসতে দেখলামনা!
হাসি দেবার মত প্রসঙ্গ উঠেনি অথবা মুগ্ধ বা আনন্দিত হবার স্নায়ুবিক ক্ষমতাগুলো অনভ্যেসের কারণে শুকিয়ে গিয়েছে হয়ত। তাই, আনন্দ করার বিরল মুহূর্ত এলে চোখে পানি আসে হাসিমুখের বদলে। রাত করে ঘরে ফিরে ক্লান্তি আমাকে ঘুম পাড়িয়ে দেয়, জীবন নিয়ে ভাববার সময় কোথায়?
তারপরেও ফ্রিজ ভর্তি খাবার-পানীয়, ফেনা ওঠা বাথটাবের গরম পানিতে গা এলিয়ে শুয়ে থাকা কিংবা বর্ষার ঠান্ডা আলো আধারি দিনে ফায়ার প্লেসের আগুনে নিজের অজ্ঞাতসারে দৈহিক সুখগুলো যাপন করছি।
কিন্তু আমার দৈহিক অবসরের মুহূর্ত গুলোতেও দুশ্চিন্তা ভর করে, অনাগত ভবিষ্যত মনটাকে অস্থির রাখে সবসময়। সেটি ভুলতে আবার কাজে ফিরে যাই, এই চক্রের মাঝে সর্পিল আকারে ঘুরে ঘুরে জীবনটাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছি নিশ্চিত মৃত্যুর দিকে।
তাই একটা সজ্ঞান মানসিক বিরতি দরকার ভীষণ, দরকার পুরোপুরি ভাবনা মুক্ত কিছু প্রহর।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।