অবিরাম ছুটে চলা পথ থেকে পথে
ট্যুরিস্ট ভিসা নিয়ে বাংলাদেশে বেড়াতে এসে রাজধানীর অভিজাত মার্কেট ও বাণিজ্যমেলায় স্টল নিয়ে অবৈধভাবে ব্যবসা করছেন ৫ শতাধিক পাকিস্তানি নাগরিক। এ দেশে ব্যবসা করে অবৈধ পথে পাকিস্তানে টাকা পাঠানোর পাশাপাশি জঙ্গি সংগঠনকে আর্থিক সহায়তা দেওয়ার অভিযোগও রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে।
বাংলাদেশের একাধিক ব্যবসায়ী জানান, রাজধানীর ইস্টার্ন প্লাস, খদ্দরবাজার, নবাবপুর রোড, চাঁদনী চক মার্কেট, এলিফ্যান্ট রোডের সুবাস্তু এরোমা ও বলাকা সুপার মার্কেটসহ বিভিন্ন অভিজাত বিপণিবিতানে ২ শতাধিক পাকিস্তানি নাগরিক অবৈধভাবে ব্যবসা করছেন। এছাড়া রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের বিহারি অধ্যুষিত এলাকায় ব্যবসা করছেন আরও তিন শতাধিক পাকিস্তানি নাগরিক। কেউ কেউ দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশে থাকার সুবাদে জাতীয় পরিচয়পত্র ও বাংলাদেশের পাসপোর্ট নিয়েছেন বলেও জানা গেছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, নিজাম নামে এক পাকিস্তানি নাগরিক ট্যুরিস্ট ভিসায় বাংলাদেশে এসে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যমেলা ও চট্টগ্রাম বাণিজ্যমেলাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকার বাণিজ্যমেলায় স্টল নিয়ে কোটি কোটি টাকার ব্যবসা করছেন। সম্প্রতি ঢাকা আন্তর্জাতিক বাণিজ্যমেলায় পুরো একটি প্যাভিলিয়ন এবং বিভিন্ন প্যাভিলিয়নে ৪৮টি স্টল বরাদ্দ নিয়ে ব্যবসা করেছেন। নিজামের মতো মোহাম্মদ মঞ্জুর আলমসহ অনেক পাকিস্তানি নাগরিক ট্যুরিস্ট ভিসায় বাংলাদেশে এসে এখানে মেলায় প্যাভিলিয়ন ও স্টল নিয়ে ব্যবসা করেন। তারা কোটি কোটি টাকার ব্যবসা করলেও এ টাকা হুন্ডির মাধ্যমে পাকিস্তান পাঠানো হয় বলে সংশ্লিষ্টরা জানান। মে মাসের প্রথম সপ্তাহে সিলেটে বাণিজ্যমেলায়
স্টল বানানোর জন্য মঞ্জুর আলমসহ (পাকিস্তানি পাসপোর্ট নং-এ-৯০৯৫০৩৪ ) বেশ কয়েকজন পাকিস্তানি নাগরিক ইতিমধ্যে বাংলাদেশে এসেছেন।
করাচি ডেপুটি হাইকমিশন থেকে মঞ্জুর আলমের নামে ২০০৯ সালের ১০ অক্টোবর ২ মাসের জন্য ইস্যু করা ট্যুরিস্ট ভিসা নং-সিওএনএস-১১৬১০/০০৯/টি। বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা জানান, কোনো বিদেশি নাগরিক এ দেশে শুধু ট্যুরিস্ট ভিসা নয়, বিজনেস ভিসা নিয়ে এ দেশে এলেও তিনি কোনো মালামাল বিক্রি বা দোকান নিয়ে ব্যবসা করতে পারবে না। তিনি কেবল এ দেশের মালামাল আমদানি করতে পারবেন; কিন্তু মঞ্জুর আলমসহ একটি বড় চক্র দীর্ঘদিন ধরে অবৈধভাবে ব্যবসা করছেন। বিভিন্ন বাণিজ্যমেলায় প্যাভিলিয়ন নিয়ে সেখানে স্টলের নামে ৪০ শতাংশ শুল্কমুক্ত কাপড় ও অন্যান্য পণ্য আমদানি করে তার একটি বড় অংশ বাইরে কমমূল্যে বিক্রি করে দেন। মেলার ৪০ শতাংশ শুল্কমুক্ত পণ্য বাজারে বিক্রি করে দেওয়ায় সরকার বছরে কয়েকশ' কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতির পাশাপাশি বাংলাদেশি ব্যবসায়ী যারা বৈধভাবে পাকিস্তান থেকে পণ্য আমদানি করছেন তারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন বলে ব্যবসায়ীরা জানান।
শান্তিনগর ইস্টার্ন প্লাস বিপণিবিতানের পঞ্চম তলায় আহমেদ এন্টারপ্রাইজের মালিক পাকিস্তানের নাগরিক আসিফ ২২ বছর ধরে ঢাকায় ব্যবসা করছেন। কাপড়, থ্রিপিস, ওড়নাসহ পাকিস্তানি বিভিন্ন কাপড়ের ব্যবসা করেন তিনি। আসিফের বাড়ি পাকিস্তানের করাচিতে। একইভাবে খদ্দরবাজারের সিরাজ এন্টারপ্রাইজের মালিক পাকিস্তানের নাগরিক সেকেন্দার প্রায় একযুগ ধরে ঢাকায় থেকে পাকিস্তানি কাপড়ের ব্যবসা করছেন। প্রতি মাসে একাধিকবার পাকিস্তান হয়ে দুবাই যান তিনি।
এ দেশে স্থায়ী কোনো ঠিকানা না থাকলেও তিনি বাংলাদেশি পাসপোর্ট নিয়েছেন বলে সংশ্লিষ্টরা জানান। চাঁদনী চক মার্কেটের এভারগ্রিন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মালিক পাকিস্তানি নাগরিক হানিফ বাবুও ব্যবসা করতে করতে এখন বাংলাদেশের স্থায়ী বাসিন্দা হয়ে গেছেন। তিনি বাংলাদেশ ইম্পোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন অব পাকিস্তানি গুডসের সভাপতি হয়েছেন। নিজেকে বৈধ ব্যবসায়ী দাবি করে হানিফ বাবু বলেছেন, ট্যুরিস্ট ভিসায় পাকিস্তানি নাগরিকরা এ দেশে এসে মেলার নামে মালামাল আমদানি করে মার্কেটগুলোতে কম দামে বিক্রি করায় বৈধ ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। কোটি কোটি টাকা ইনভেস্ট করে বৈধ দোকানদাররা ব্যবসা গুটিয়ে ফেলতে বসেছেন অবৈধ ব্যবসায়ীদের কারণে।
পাকিস্তানিদের এ দেশে অবৈধভাবে ব্যবসা বন্ধের দাবি জানান তিনি।
পাকিস্তানে বাংলাদেশ দূতাবাসের কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করে তারা মাল্টিপোল ভিসা নেন বলে জানা গেছে। ২০০৯ সালে পাকিস্তানের করাচি ডেপুটি হাইকমিশন থেকেই প্রায় ১৪ হাজার ভিসা দেওয়া হয়েছে। অথচ বাংলাদেশে পাকিস্তান দূতাবাস বছরে দুই থেকে আড়াই হাজারের বেশি ভিসা দেয় না। পাকিস্তানের ভিসা পেতে ব্যবসায়ীদের নানা হয়রানির শিকার হতে হয় বলে ব্যবসায়ীদের অভিযোগ।
পাকিস্তানি ব্যবসায়ীরা বাংলাদেশে আসার সময় সিগারেট, আমদানি নিষিদ্ধ ওষুধ ও জাল মুদ্রাসহ অবৈধ মালামাল নিয়ে আসে বলে সংশ্লিষ্টরা জানান।
গত ৭ এপ্রিল রাজধানীতে পাকিস্তানের নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন লস্কর-ই-তৈয়বার সদস্য মুবাশ্বের শহীদ ইয়াহিয়া গ্রেফতার হয়। তিনি এদেশে জাল টাকা ও বায়িং হাউসসহ বিভিন্ন ধরনের ব্যবসা করতেন। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, ইয়াহিয়া গ্রেফতার হওয়ার পর পাকিস্তানের যেসব নাগরিক বাংলাদেশে নিয়মিত যাতায়াত করে বা দীর্ঘদিন ধরে বসবাস করছেন তাদের বিষয়ে গোয়েন্দা সংস্থাগুলো খোঁজ খবর নিচ্ছে। ব্যবসার আড়ালে তারা জঙ্গি তৎপরতার সঙ্গে জড়িত কি-না তাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব (ইমিগ্রেশন) মোঃ শফিকুল ইসলাম বলেন, ট্যুরিস্ট ভিসা নিয়ে ব্যবসা করার কোনো সুযোগ নেই। কোনো বিদেশি নাগরিকের বিরুদ্ধে এ ধরনের অভিযোগ পাওয়া গেলে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উপ-সচিব (ইমিগ্রেশন-২) কাজল ইসলাম বলেন, ভিসা নীতিমালা অনুযায়ী কোনো ব্যক্তি কেবল বিজনেসম্যান ক্যাটাগরির ভিসা নিয়ে এলে ব্যবসায়িক কাজ করতে পারেন। তবে দোকান নিয়ে ব্যবসা বা মালামাল বিক্রি নয়, পণ্য আমদানির কাজ করতে পারেন। ট্যুরিস্ট ভিসায় এসে ১৫ দিন থেকে তিন মাস অবস্থান করা যায়।
তবে ব্যবসা করার আইনগত কোনো সুযোগ নেই।
এ ব্যাপারে পাকিস্তানি নাগরিক মোহাম্মদ মঞ্জুর আলম বলেছেন, ট্যুরিস্ট ভিসা নিয়ে অনেকে ব্যবসা করছেন ঠিক, তবে সবাই করছেন না। তিনি মাঝে মধ্যে ট্যুরিস্ট ভিসায় আসেন এ কথা স্বীকার করে বলেছেন, বিজনেস ভিসা নিয়েই তিনি ১৫ বছর ধরে বাংলাদেশে ব্যবসা করছেন। ইপিবির আমন্ত্রণে তিনি বিভিন্ন মেলায় প্যাভিলিয়ন বানিয়ে ব্যবসা করেন। তবে এসব ব্যবসার টাকা বৈধভাবে পাকিস্তানে পাঠানোর কোনো প্রমাণ আছে কি-না তা জানতে চাইলে বিষয়টি এড়িয়ে যান তিনি।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।