আল্লাহ মহান, যাহা বলিব সত্য বলিব।
কওমি মাদ্রাসা নিয়ন্ত্রণে সরকারের কোন তৎপরতা নেই। কোন মন্ত্রণালয়ের অধীনে কওমি মাদ্রাসা চলছে, তাও জানে না শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা। কারা এ মাদ্রাসা চালাচ্ছে, কওমি মাদ্রাসার অর্থায়নের উৎস কী, মাদ্রাসায় কী পড়ানো হচ্ছে কিংবা কারা পড়াচ্ছে, সে সম্পর্কেও কোন তথ্য নেই শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে। অভিযোগ আছে, কওমি মাদ্রাসায় ধর্মীয় শিক্ষা পাঠদানের নামে চলে জঙ্গিবাদের চর্চা ও দেশবিরোধী কর্মকা-।
কওমি মাদ্রাসার ছাত্রদের ব্যবহার করা হচ্ছে অপরাজনীতি ও উগ্রধর্মীয় কাজে। এসব প্রশ্নে শিক্ষার্থীদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য ২০১০ সালে রাজধানীসহ জেলা পর্যায়ের বড় বড় কলেজে মতবিনিময় সভাও করেছিল শিক্ষা মন্ত্রণালয়। কিন্তু আমলাদের গাফিলতির কারণে গত এক'দেড় বছর ধরে এ কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে।
কওমি মাদ্রাসার বিষয়ে জানতে চাইলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (কারিগরি ও মাদ্রাসা) মুহাম্মদ আতোয়ার রহমান সংবাদকে বলেন, 'কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীভুক্ত নয়। কাজেই কওমি মাদ্রাসা সম্পর্কে আমাদের কাছে তথ্য-উপাত্ত নেই'।
তিনি জানান, 'কওমি মাদ্রাসা নিয়ন্ত্রণে কোন আইন না থাকায়, এ বিষয়ে অন্য মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতাও নেয়া যাচ্ছে না'। যদিও শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ গত বছর জাতীয় সংসদের এক প্রশ্নোত্তর পর্বে জানিয়েছিলেন, দেশে প্রায় ২৪ হাজার ৯০০ কওমি মাদ্রাসা আছে। কিন্তু কওমি মাদ্রাসার ছাত্র সংখ্যা সম্পর্কে কোন তথ্য দিতে পারেননি তিনি।
কওমি মাদ্রাসা বোর্ড নামে দেশে কমপক্ষে ১৯টি বেসরকারি সংস্থা রয়েছে। মাদ্রাসাগুলো যারা পরিচালনা করেন তারা নিজেরাই এই বোর্ড গঠন করেছেন এবং নিজেরাই বোর্ড পরিচালনা করেন।
সরকারের সঙ্গে এর কোন সম্পর্ক নেই।
কওমি মাদ্রাসা বোর্ডের কর্মকর্তারা জানান, প্রতিটি কওমি মাদ্রাসায় গড়ে ১০০ থেকে ১৫০ জন ছাত্র আছে। এ হিসেবে ২৪ হাজার ৯০০ কওমি মাদ্রাসায় ২৫ থেকে প্রায় ৩৫ লাখ ছাত্র আছে।
মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড সূত্র জানায়, দেশে দু'ধরনের মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থা চালু আছে, আলিয়া ও কওমি মাদ্রাসা। আলিয়া মাদ্রাসা পরিচালিত হয় মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের অধীনে, যা সরকার স্বীকৃত।
তবে কওমি মাদ্রাসার ওপর সরকারের কোন নিয়ন্ত্রণ নেই। বর্তমানে দেশে সরকার স্বীকৃত আলিয়া মাদ্রাসা আছে ১৬ হাজার ২৭০টি। এরমধ্যে দাখিল, আলিম, ফাজিল ও কামিল স্তরের এমপিওভুক্ত মাদ্রাসা হলো ৭ হাজার ৫৯৭টি। আলিয়া মাদ্রাসায় সরকার স্বীকৃত পাঠ্যক্রম অনুশীলন করা হয়।
কওমি মাদ্রাসা সম্পর্কে সম্মিলিত ইসলামী জোটের সভাপতি হাফেজ মওলানা জিয়াউল হাসান সংবাদকে বলেন, 'কওমি মাদ্রাসা অবশ্যই সরকারের নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে।
কারণ কারা এসব মাদ্রাসায় পড়ছে, কী পড়ানো হচ্ছে, পড়ালেখা শেষ করে ছাত্ররা কোথায় যাচ্ছে, মাদ্রাসার অর্থের উৎস কী, বিদেশিরাই কেন তাদের অর্থের জোগান দিচ্ছে এবং দান-খয়রাত করে হাজার হাজার মাদ্রাসা কিভাবে চলছে- তা জনগণের জানার অধিকার আছে'।
বিশিষ্ট এই ইসলামী চিন্তাবিদ বলেন, 'কওমি মাদ্রাসার ছাত্রদের জঙ্গি প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকে কয়েকটি বিদেশি রাষ্ট্র। এসব মাদ্রাসায় উত্তোলন হয় না জাতীয় পতাকা, পালন করা হয় না কোন জাতীয় দিবস'।
জানা গেছে, কওমি মাদ্রাসা সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ ও খোঁজ-খবর নিতে ২০০৯ সালে জেলা প্রশাসকদের (ডিসি) চিঠি দিয়েছিল শিক্ষা মন্ত্রণালয়। কয়েকজন ডিসি এ সম্পর্কে দায়সারাভাবে পৃথক পৃথক প্রতিবেদনও দিয়েছিল শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে।
কিন্তু এসব প্রতিবেদন আলোর মুখ দেখেনি। ২০১০ সালের শেষে দিকে এ বিষয়ে তাগাদাপত্রও দেয়া হয়েছিল ডিসিদের। তাতেও কোন কাজ হয়নি। পরবর্তী সময়ে মাঠ পর্যায়ে গোয়েন্দা সংস্থার সহযোগিতায় এ বিষয়ে প্রতিবেদন প্রণয়নের জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়েও চিঠি দেয়া হয়েছিল শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে।
জঙ্গিবাদ প্রতিরোধ কার্যক্রম
জঙ্গিবাদ সম্পর্কে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহের জন্য মাউশির মহাপরিচালকের নেতৃত্বে একটি কমিটি আছে।
কিন্তু এ কমিটির কার্যক্রম চলছে ঢিমেতালে। এ কমিটিকে অধিকতর সক্রিয় করতে অর্থাৎ জঙ্গিবাদ প্রতিরোধে সারাদেশের মাঠ পর্যায়ের স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসা থেকে সংশ্লিষ্ট তথ্য-উপাত্ত ও কার্যক্রম সংগ্রহ করতে গত বছরের ২৩ ডিসেম্বর মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদফতরকে (মাউশি) নির্দেশ দেয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এ বিষয়ে প্রতিবেদন দেয়ার জন্য পরবর্তীতে গত ২৬ মার্চ ফের নির্দেশ দেয়া হয় মাউশি কর্তৃপক্ষকে। এখন ওই নির্দেশ অনুযায়ী প্রতিবেদন তৈরির কাজ করছে মাউশি কর্তৃপক্ষ।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে মাউশির মহাপরিচালক প্রফেসর ফাহিমা খাতুন সংবাদকে বলেন, 'জঙ্গিবাদ প্রতিরোধ সংক্রান্ত বিষয়ে কার্যক্রম চলছে'।
তিনি বলেন, 'যেসব প্রতিষ্ঠানে অনুদান (এমপিও) দেয়া হয়, সেসব মাদ্রাসা সম্পর্কে খোঁজখবর নেয়া আমাদের দায়িত্বের মধ্যেই পড়ে। মাদ্রাসায় ধর্মীয় শিক্ষা পাঠদানের আড়ালে অন্যকিছু হচ্ছে কী না তা অবশ্যই জানা প্রয়োজন। কোন শিক্ষক বা ছাত্র যদি সমাজ ও রাষ্ট্রবিরোধী কার্যক্রমে জড়িত থাকে, তাদের বিরুদ্ধে অবশ্যই ব্যবস্থা নেয়া হবে'।
ভিন্ন ধারায় পরিচালিত কওমি মাদ্রাসার শিক্ষার্থীর সংখ্যা সম্পর্কে সরকারের কাছে তথ্য নেই। কোন বোর্ডের অধীনে কওমি মাদ্রাসা পরিচালিত হচ্ছে কি না সে সম্পর্কেও সরকার অন্ধকারে আছে।
তবে সিলেট, গোপালগঞ্জ, ফরিদপুর, মানিকগঞ্জ, মৌলবীবাজার, চট্টগ্রাম, বাহ্মণবাড়ীয়া, কিশোরগঞ্জ, ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা, রাজশাহী, হবিগঞ্জ জেলায় কওমি মাদ্রাসা সবচেয়ে বেশি বলে জানা গেছে। এসব মাদ্রাসার শিক্ষার্থী ও শিক্ষক সম্পর্কেও সরকারের কাছে কোন তথ্য-উপাত্ত নেই। কওমি মাদ্রাসায় বাংলা, ইংরেজি, ইতিহাস ও বিজ্ঞানের পাঠদান নিষিদ্ধ।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ড. মমতাজ উদ্দীন পাটোয়ারী সংবাদকে বলেন, 'কওমি মাদ্রাসা নিয়ন্ত্রণ ও সংস্কার জরুরি। কিন্তু সংস্কারের মূল বাধা হলো কওমি মাদ্রাসার শিক্ষকরা।
তারা পুরনো ধ্যানধারণা ও শিক্ষাদীক্ষায় শিক্ষিত। তাদের ধারণা- মাদ্রাসা সরকারের নিয়ন্ত্রণে গেলে সবাই চাকরি হারাবেন। এই অমূলক আশঙ্কার ওপর ভিত্তি করেই কওমি শিক্ষকরা সরকারের অধীনে যেতে নারাজ'।
তিনি আরও বলেন, 'সরকারের উচিত হবে- প্রথমে কওমি শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের আওতায় আনা। কারণ প্রশিক্ষণ না থাকায় আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থা সম্পর্কে তারা একেবারেই অন্ধকারে আছে।
এই অজ্ঞতা থেকেই তারা ধর্মকে রাষ্ট্রবিরোধী কাজে ব্যবহার করছে'।
উল্লেখ্য, ১৩ দফা বাস্তবায়নে সারাদেশের কওমি মাদ্রাসা থেকে হাজার হাজার ছাত্র এনে গত ৫ মে রাজধানীর শাপলা চত্বরে হেফাজতে ইসলাম সমাবেশ করে। শিশু ছাত্রদের দিনব্যাপী নৈরাজ্যে ব্যবহার করা হয়। এরপরই কওমি মাদ্রাসা নিয়ে বিতর্ক নতুন করে দানাবাঁধে। গত সপ্তাহে রাজধানীতে অনুষ্ঠিত এক গোলটেবিল বৈঠকে বিশিষ্ট নাগরিকরা আইন করে কওমি মাদ্রাসা সরকারের নিয়ন্ত্রণে নেয়ার দাবি জানান।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানায়, উগ্র সাম্প্রদায়িক তৎপরতা বন্ধ ও জঙ্গিবাদের ভয়াবহ বিস্তার রোধে কওমি মাদ্রাসাকে নিয়ন্ত্রণে আনা জরুরি। কারণ ধর্মীয় শিক্ষা বিস্তারের নামে মাদ্রাসাগুলো রাষ্ট্র ও সমাজবিরোধী যে ধরনের অপকর্মে লিপ্ত। বিভিন্ন মাদ্রাসার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয় স্থিতিশীলতা বিনষ্ট, ধর্মীয় জঙ্গিবাদে মদদ, জেহাদি বই পাঠদান, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বানচালের ষড়যন্ত্র, ভারত ও মার্কিন যুদ্ধরাষ্ট্রবিরোধী মনোভাব গড়ে তোলা এবং সর্বোপরি বাংলাদেশকে উগ্র ইসলামী রাষ্ট্রে পরিণত করার কর্মকা-ের আলামত পেয়েছেন গোয়েন্দা সংস্থাগুলো। কওমি মাদ্রাসায় জাতীয় সংগীত বাজানো, জাতীয় পতাকা উত্তোলন ও বিভিন্ন জাতীয় দিবস পালনও নিষিদ্ধ। তাছাড়াও কওমি মাদ্রাসার কারিকুলাম জীবনঘনিষ্ঠ নয়, পরকালমুখী।
সমাজের দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে টেনে এনে সহজেই তাদের এই শিক্ষা দিয়ে প্রভাবিত করা যায় বলে মনে করছেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা।
শিক্ষা মন্ত্রণালয় জানায়, ২০১০ সালের ১০ আগস্ট প্রকাশ করা বিশ্বব্যাংকের এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, অনিয়ন্ত্রিত কওমি মাদ্রাসার সঙ্গে বাংলাদেশে জঙ্গি নাশকতার সম্পর্ক আছে। প্রচলিত শিক্ষানীতি এবং রাষ্ট্র স্বীকৃত সব ধরনের নীতিমালার বাইরে কওমি মাদ্রাসা ধর্মীয় শিক্ষার নামে কি করছে তা জরুরি ভিত্তিতে খতিয়ে দেখা জরুরি। দেশের কওমি মাদ্রাসার ৮২ শতাংশ এবং আলিয়া মাদ্রাসার ৪২ শতাংশ শিক্ষকের কোন প্রশিক্ষণ নেই। বেসরকারি সাধারণ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের চেয়ে মাদ্রাসার ছাত্রছাত্রীরা ইংরেজি এবং গণিতে অপেক্ষাকৃত কম মেধাবী বলেও ওই প্রতিবেদনে মন্তব্য করা হয়।
মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা আধুনিক শিক্ষার সুযোগসুবিধা থেকে বঞ্চিত। প্রতিবেদনে কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থাকে আধুনিক শিক্ষার সঙ্গে যুক্ত করার সুপারিশ করেছিল বিশ্বব্যাংক। পাশাপাশি শিক্ষকদের আধুনিক ও উন্নত প্রশিক্ষণ প্রদান জরুরি বলেও সুপারিশ করা হয়েছিল প্রতিবেদনে। Click This Link ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।