আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

রশীদ তালুকদার

গুণীজন

মানুষের চোখের তারায় হরহামেশাই বন্দি হয় নানান রকম দৃশ্য৷ আবার তা মুছেও যায়৷ তবে এমন কিছু দৃশ্য বা প্রিয় মানুষের মুখ আছে যা ব্যক্তির হৃদয়কে আলোড়িত করে৷ আর তা হয়তবা আজীবন চিরসজীব হয়ে থাকে ব্যক্তির স্মৃতিপটে৷ তবে মনের ফ্রেমে আঁকা ছবি একান্তই নিজের৷ অন্যকারো সাথে এই ছবির সুখ দুঃখ, হাসি কান্না, কষ্ট, ঘৃনা, ভালবাসা, আবেগ অনুভূতি ভাগ করা যায়না৷ কারন সে ছবি কাউকে দেখানো যায়না৷ একারণেই কোন বস্তু বা ঘটনার সত্যতা, বাস্তবতাকে যুগের পর যুগ ধরে রাখতে, একটি ছবির আবেদন ব্যক্তি পরম্পরায় চিরন্তন করে রাখার চিন্তা থেকেই হয়ত ক্যামেরার উদ্ভব৷ ছবি যেমন ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি সংরক্ষণ করে তেমনি মানুষের আবেগ অনুভূতিও জাগ্রত করে৷ এমন কি মানুষের চিন্তা চেতনা, বোধবুদ্ধিকেও পাল্টে দিতে পারে৷ তবে এমন কোন বস্তু, ঘটনা বা কাহিনী যা ইতিহাস ঐতিহ্যের ধারক বা মানবীয় অনুভূতির বহিঃপ্রকাশ ঘটায় এমন ছবি ক্যামেরায় ধারণ করার জন্য চাই অনুসন্ধ্যিত্‍সু, সৌন্দর্যপিপাসু ও সৃজনশীল চোখ৷ এমনই এক অনুভূতিশীল শিল্পী মনের অধিকারী রশীদ তালুকদার৷ ক্যামেরার ফ্রেমে তিনি বন্দি করেছেন অনেক ইতিহাস, বাস্তবতা, মানবতা৷ ছবি দিয়ে তিনি প্রকাশ করেছেন অনেক সত্যকে৷ তাঁর ছবি বলেছে অনেক নির্যাতিতদের অব্যক্ত কথা৷ ক্যামেরার পেছনে থেকে যে মানুষটি দিনের পর দিন জাতির জন্য মানুষের জন্য কাজ করে চলেছেন নিরবধি তাঁর জীবন ঘিরেও রয়েছে নানান ঘটনার বৈচিত্র৷ জন্ম ও বংশ পরিচয় trans ১৯৩৯ সাল৷ ভারতের বজ বজ চব্বিশ পরগনায় সবেমাত্র শীতের শুষ্ক হাওয়া বইতে শুরু করেছে৷ এমনই একদিন ২৪ অক্টোবর আব্দুল করিম তালুকদার ও রহিমা খাতুনের সূর্য সন্তান রশীদ তালুকদার জন্ম গ্রহণ করেন৷ চাকুরীর কারণে স্টেশন মাস্টার বড় বাবু আব্দুল করিম তালুকদারের ছিল অনেকটা যাযাবর জীবন৷ তাই তাঁর পিতৃলয় মাদারীপুর হওয়া সত্ত্বেও রশীদ তালুকদারসহ তাঁর প্রতিটা সন্তানই ভিন্ন ভিন্ন জায়গায় জন্ম গ্রহণ করেন৷ কাঞ্চনজংঘা পাহাড়ের চূড়ায় যখন সূর্যের আলো ঠিকরে পড়ে তখন চূড়াটাকে মনে হয় যেন এক টুকরো স্বর্ণখন্ড৷ বাবা আব্দুল করিমের মনে হয়েছিল তাঁর ছেলেও সূর্যের আলোয় এমনই সোনার টুকরো হয়ে উঠবে৷ তাই তাঁর বাবা তাঁকে কাঞ্চন বলে ডাকতেন৷ চার ভাই চার বোনের মধ্যে কাঞ্চন ছিল বড় ছেলে৷ তবে সবার বড় ছিল তাদের প্রিয় বোন মন্টু, যাকে তাঁরা দিদি বলে ডাকতেন৷ তালুকদার বংশের ছেলে হওয়ায় খুব ছোটবেলায়, যখন তিনি ভাল করে কোন কিছু বুঝতেই শেখেননি, তখন তিনি একবার প্রজাদের কাছ থেকে খাজনা তুলেছিলেন৷ যদিও সেই খাজনা তোলার আয়োজনে তিনি ছিলেন একটা শোপিস্ মাত্র৷ মাদারীপুর জেলার কালকীনি থানা, এরই একটা ছোট্ট গ্রাম দক্ষিণ রমজানপুর, তাঁর দাদার বাড়ি৷ বংশের ছেলে হিসেবে তিনি এখানেই খাজনা গ্রহণ করেছিলেন৷ চার ভাই চার বোনের মধ্যে রশীদ তালুকদার ছিলেন সবার অত্যন্ত আদরের৷ তবে তিনি মনে করেন, তিনি বৃশ্চিক রাশির জাতক হওয়ায় তিনি ছিলেন বাবা-মায়ের জেদি ও একরোখা ছেলে৷ প্রথম স্কুলে যাওয়া trans যশোরের ঝিকর গাছায় তাঁরা বছর খানেক ছিলেন৷ সেখানে 'এম ই প্রাথমিক বিদ্যালয়ে' তিনি ভর্তি হন৷ রেললাইনের নিচ দিয়ে মাইলখানেক দূরে ছিল স্কুল৷ এখানে ছিল মাটির একটি ঘর৷ এই ঘরের চারপাশ ঘিরে ছিল অসংখ্য কলা গাছ ৷ এই ঘরটাই ছিল এম ই স্কুল, শিশু রশীদ তালুকদারের প্রথম স্কুল৷ প্রাথমিক স্তরের সবগুলো ক্লাস এই একটি কক্ষেই হত৷ তিনি ছিলেন প্রধান শিক্ষকের অত্যন্ত প্রিয় ও স্নেহের পাত্র৷ তিনি প্রধান শিক্ষকের কাঁধে চড়ে স্কুলে যেতেন৷ কলার ছড়ায় যখন পাক আসত তখন তিনি তা স্কুলের আলমিরার সাথে দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখতেন৷ সম্পূর্ণ পেকে গেলে সবাইকে খেতে দিতেন৷ প্রধান শিক্ষক ভীষণ রকম স্নেহপরায়ন ছিলেন৷ যশোরে এক বছর থাকার পর ১৯৪৫ সালে তাঁর বাবা বদলী হন গদখালী স্টেশনে৷ সেখানে তিনি 'টাওয়ার এম ই প্রাথমিক বিদ্যালয়ে' ২য় শ্রেনীতে ভর্তি হন এবং ৫ম শ্রেনী পর্যন্ত তিনি ঐ স্কুলেই পড়ালেখা করেন৷ এরপর আবার বদলী হওয়ার পালা৷ তার বাবা খুলনা দৌলতপুর স্টেশনে বদলী হয়ে আসেন৷ এখানে 'মহসীন উচ্চ বিদ্যালয়'এর সংশ্লিষ্ট প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তিনি পঞ্চম শ্রেনীতে ভর্তি হন৷ এভাবেই তাঁর পড়ালেখার প্রথম স্তর নানান বৈচিত্রময় ও বিচিত্র পরিবেশের ভেতর দিয়ে শেষ হয় এবং শুরু হয় তাঁর বেড়ে ওঠা৷ মাধ্যমিক বিদ্যালয় trans বাবা স্টেশন মাস্টার হওয়ায় তাঁদের ছিল যাযাবর জীবন৷ বিভিন্ন জায়গায় বাসস্থান স্থানান্তরিত হওয়ার সাথে সাথে তাঁদের স্কুলও পরিবর্তিত হত৷ ১৯৫২ সাল, রাজশাহীর লোকনাথ হাই স্কুলে ৬ষ্ঠ শ্রেনীতে পড়ুয়া ১৩ বছরের এক দূরন্ত কিশোর রশীদ তালুকদার৷ সময়টা ভীষণ রকম বেয়াড়া আর ছটফটে৷ মনের পিঠে যেন পাখনা লাগানো, মনটাকে পোষ মানানো যায় না কোন মতেই৷ এবড়ো থেবড়ো রাস্তা, হেঁটেহেঁটে স্কুলে যাওয়া, দৌড়াদৌড়ি, দুষ্টুমি, বাঁদরামি সবই ভালো লাগে৷ শুধু স্কুলের বই'র পাতায় মন বাঁধা যায় না৷ এমনই করে দূরন্ত কৈশোরের সাথে ছুটে বেড়ায় মন৷ আর এভাবেই কেটে যাচ্ছিল সময়৷ পড়ালেখায় জলাঞ্জলি ভেবে মূর্খ বোলো না trans রাজশাহী শিউলের মাঝখান দিয়ে সাহেব বাজার হয়ে স্কুলে যেতে হত৷ স্কুলে যাওয়ার পথে আলুপট্টির এক পাশে ছিল কল্পনা সিনেমা হল৷ এর উল্টো দিকে ছিল তারাপদ'র বিখ্যাত চায়ের দোকান৷ ভাঙ্গা কিন্তু পাকা দোকান৷ এই দোকানের চিলেকোঠায় মরহুম মোতাহার হোসেন তার স্টার স্টুডিও গড়ে তুলেছিলেন৷ সেই সময়ে হিটার ছিল না, স্টুডিওতে কাচের সাথে ছোট ছোট ফটো লাগিয়ে রোদের মধ্যে শুকাতে দিত৷ এমনই একদিন স্কুলে যাওয়ার পথে হঠাত্‍ ক্যামেরার সাটারের মত চোখের তারায় বন্দি হয়ে যায় সেই ছবিগুলো৷ কেমন করে একটা কাগজের উপর মানুষের প্রতিচিত্র হুবহু দৃশ্যায়িত হয় তা তাঁকে ভাবিয়ে তোলে৷ তাঁর উত্‍সুক মন ঝুঁকে পড়ে ফটোগ্রাফির দিকে৷ কৌতূহলী মনের তৃষ্ণা কেবল বেড়েই চলে৷ তাঁর খুব ইচ্ছা হয় ফটোগ্রাফী শেখার৷ কিন্তু তাঁর বাবা সেই সময়ে রাজি হন না৷ পিতাদের চিরন্তন চিন্তা থেকে তাঁর বাবার চিন্তাও ব্যতিক্রম ছিল না৷ ফটোগ্রাফী যে একটা আর্ট, একটা শিল্প তা ছিল সকলের অজানা৷ পড়ালেখাকেই তাঁর বাবা প্রাধান্য দিয়েছিলেন৷ সাধারন মানুষ মনে করত যারা বখাটে হয়ে যাওয়া, বেয়াড়া ছেলে তাঁরাই ফটোগ্রাফি শেখে৷ তাই আর দশটা বাবার মতই তাঁর বাবাও চেয়েছিলেন ছেলে পড়ালেখা শিখে মানুষের মত মানুষ হক৷ প্রথম হাতেখড়ি trans অবশেষে কিশোর কাঞ্চন (রশীদ তালুকদার ) তাঁর ইচ্ছাকে বাস্তব রূপ দিতে উদ্যোগী হয়৷ আলুপট্টির স্টার স্টুডিওর মালিক মোতাহার হোসেনের সাথে দেখা করেন৷ কিন্তু মোতাহার হোসেনকে রাজি করানোও সহজ ছিলনা৷ প্রথম দিনেই তাঁর ওস্তাদ মোতাহার হোসেন তাঁকে বের করে দেন৷ যে ছেলের মুখের আদল জুড়ে শিশুতোষ ভাব ছড়িয়ে আছে তাঁকে কোন কাজ দিতে ওস্তাদের মন স্বীকৃতি দেয় নি৷ তাই তিনিও তাঁকে পড়ালেখায় মন দিতে বলেন৷ কিন্তু দুরন্ত সেই কিশোরও হাল ছাড়বার পাত্র ছিলেন না ৷ দিনের পর দিন সে তাঁর ওস্তাদের দারস্থ হতেই থাকল এবং শেষ পর্যন্ত তাঁর মন নরম করতে সক্ষম হল৷ তবে তিনি শর্ত জুড়ে দেন, 'যদি তুমি তোমার বাবাকে রাজি করাতে পার তাহলে এস'৷ কিন্তু বিষয়টি কিশোর কাঞ্চনের জন্য প্রায় অসম্ভব ছিল৷ এক্ষেত্রেও সে চেষ্টার ত্রুটি করেনি৷ প্রথমে মা'র মাধ্যমে বাবা কে রাজি করানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়৷ এরপর সে অন্য উপায় খুঁজে বের করে৷ বড় বোন মন্টুর প্রতি বাবার হৃদয় ছিল বরাবরই আস্থাশীল৷ ভাইয়ের আবদার বোন ফেলতে পারে না৷ মন্টু আব্বার কাছে গিয়ে কাঞ্চনের ইচ্ছার কথা জানায় এবং শেষ পর্যন্ত তার বাবার মন গললো৷ ইচ্ছা পূরণের আশায় এবার বালক কাঞ্চন নব উদ্যোমে আবার স্টার স্টুডিওতে যায়৷ ওস্তাদ মোতাহার হোসেনের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়৷ এরপরও ওস্তাদ তাঁকে ফিরিয়ে দেন, তার কথা বিশ্বাস করেন না ওস্তাদ৷ তখন তিনি সাক্ষ্য প্রমাণ হিসাবে বড় দিদিকে নিয়ে যান৷ বড় বোন মন্টু মোতাহার হোসেন কে জানান যে, বাবা কাঞ্চনকে কাজ শেখার অনুমতি দিয়েছেন৷ এবার তিনি কাজ শেখানোর প্রতিশ্রুতি দেন৷ তবে অবশ্যই লেখাপড়ার পাশাপাশি৷ এখান থেকেই প্রথম ফটোগ্রাফীতে তাঁর যাত্রা শুরু হয়৷ শিক্ষানবীশ trans ১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্ত হয়৷ ১৯৫২ সালের অক্টোবর মাস থেকে ভারতে আসা যাওয়ার জন্য পাসপোর্ট প্রথা চালু হয়৷ এ কারণে ছবি তোলার প্রয়োজনীয়তা অনেক গুণ বেড়ে যায়৷ সংকট দেখা দেয় স্টুডিওর৷ এ সুযোগে প্রায় সবখানে নতুন নতুন স্টুডিও গড়ে ওঠে৷ কিন্তু অভাব রয়ে যায় কলাকুশলীর৷ শিক্ষিত লোকজনের এ পেশায় তেমন আগমন হয়নি৷ স্টুডিওর কাজ ছিল বাঁধাধরা নিয়মের৷ শিল্প সৃষ্টির মাধ্যম হিসেবে এর তেমন ব্যবহার তখন ছিলনা৷ কলাকুশলী তৈরির ক্ষেত্রে প্রশিক্ষণ প্রদানের জন্য প্রতিষ্ঠান নেই৷ ভরসা শুধু প্রবীণরা, তাঁদের কাছ থেকে অনুজরা হাতে কলমে ডার্করুম ও অন্যান্য কাজ শেখে৷ এ অবস্থায় ডার্করুমে-যে কাজ করছে সে আর অন্য কোন কাজ তেমন শেখেনি বা শেখানো হয়নি৷ একজন ডার্করুম কর্মীর কাছে ক্যামেরা দিয়ে ছবি তোলার পর্যায়ে উন্নীত হতে অনেক বছর সময় লেগে যেত৷ স্টার স্টুডিও'র বিপরীত দিকে ছিল 'দৈনিক বার্তা' নামে একটি সংবাদপত্রের অফিস৷ দৈনিক বার্তার পাশেই ছিল একটি পানির ট্যাংকি, যেটাকে পানির ঢোপ কল বলা হত৷ শুরুতে তাঁকে ওস্তাদের নির্দেশমত বালতিতে করে পানি নিয়ে আসতে হত পানির ট্যাংকি থেকে৷ সেই পানির বালতি টেনে নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে চিলেকোঠায় উঠতে হত৷ এভাবেই কেবল পানি টানতে টানতে দুই বছর কেটে যায়৷ ছবি ধোয়ার কাজে পানি লাগতো৷ তখন এত প্রযুক্তি ছিলনা৷ ছবি ধুয়ে শুকাতে হত৷ স্কুলের পড়াশুনাও একেবারে ছেড়ে দেননি৷ ১৯৫৪ সাল, তিনি তখন অষ্টম শ্রেনীর ছাত্র৷ পড়ালেখায় যথেষ্ট ভাটা পড়ে গিয়েছে৷ পড়ালেখা ঝিমিয়ে পড়লেও, এ বছরই প্রথম তাঁর কাজের শুরু হয়৷ তিনি ডার্ক রুমে প্রবেশ করার অনুমতি পান৷ তাঁর ওস্তাদ তাঁকে বলেন, 'রশীদ, তুমি কালকে থেকে ডার্ক রুমে যেও'৷ তবে কাজের প্রথম দিনটা মোটেই সুখকর ছিল না৷ প্রথম দিনেই তিনি একটি অঘটন ঘটিয়ে ফেলেন৷ প্রথম দিকে তাঁর হাত ততটা চালু ছিলনা৷ প্রয়োজনের চেয়ে অনেক বেশি সময় কেমিক্যালসের ভেতর থাকায় ছবি কালো হয়ে যায়৷ রাগ দমন করতে না পেরে তাঁর ওস্তাদ তাঁর গালে থাপ্পর দেন৷ এতে বালক মন অনেক অভিমানী ও জেদী হয়ে উঠে৷ সেই সাথে কাজের প্রতিও তিনি যত্নশীল হয়ে উঠেন৷ এদিকে ওস্তাদের মনও তাঁর প্রতি সদয় হয়ে উঠে এবং তখন প্রথমবার তাঁর বেতন হিসেবে ২০ টাকা নির্ধারিত হয়৷ ভালবাসার পান্না হিরা trans ১৯৫৪ সালের দিকে তাঁর বাবা বদলী হয়ে ময়মনসিংহে চলে যায়, সঙ্গে যায় তাঁর পরিবার৷ কিন্তু পরিবার থেকে সে বিচ্ছিন্ন হয়ে রয়ে গেল স্টার স্টুডিওতে৷ ততদিনে স্টার স্টুডিও সাহেব বাজার বড় মসজিদের কাছাকাছি বেশ বড় একটা জায়গা নিয়ে গড়ে উঠেছে৷ যেখানে ডার্করুম ছিল তার উপর একটি কাঠের দোতালা মতন ছিল৷ সেখানে তাঁর ওস্তাদ ও তিনি একসাথে রাত্রি যাপন করতেন৷ কল্পনা সিনেমা হলের পাশের গলিতে ছিল ওস্তাদের বাড়ি৷ সেখানেই তিনি খেতেন৷ ভালবাসা আর মায়ার প্রগাঢ় বাঁধনে ওস্তাদ তাঁকে জড়িয়ে ফেলেন৷ রক্তের সম্পর্ক না থাকলেও গড়ে ওঠে নিবীড় আত্মার সম্পর্ক৷ তিনি স্টুডিওর কর্মচারী হিসেবে পরিচিত ছিলেন না৷ সবাই তাঁকে মোতাহারের ছোট ভাই বলেই জানত এবং মোতাহারের ছোট ভাই বলত৷ কিন্তু এখান থেকে একদিন বাঁধন মুক্ত হয়ে এক অজানার উদ্দেশে রওনা হন৷ শহর থেকে শহরে trans \\'আমি এক যাযাবর, পৃথিবী আমাকে আপন করেছে, ভুলেছি নিজের ঘর\\ ভুপেন হাজেরিকার এই গানের মতই তাঁর আপন পর বলে কিছু ছিল না৷ পথ থেকে পথে, শহর থেকে শহরে-সকল মানুষই ছিল তাঁর আত্নার আত্নীয়৷ রাজশাহী থেকে এক বুক ব্যথা নিয়ে পথে পথে ঘুরে বেড়াতে লাগলেন তিনি৷ সমুদ্রের বুকে এই ব্যথা বিলীন করে দিতেই হয়ত নিজের অজান্তেই, মনের টানে পৌঁছে গেলেন কঙ্বাজার৷ পাহাড় আর সাগরের মাঝখানে ছোট্ট সবুজ সজিব একটি গ্রাম কলাতলি৷ সেখানে জ্যাঠা নামে পরিচিত এক দুধ বিক্রেতার বাসায় তিনি থাকতেন এবং বিনিময়ে জ্যাঠার ছেলে কুদ্দুসকে পড়াতেন৷ তিনি আবার নতুন করে কঙ্বাজার হাইস্কুলের ৬ষ্ঠ শ্রেনীতে ভর্তি হন৷ দেড় মাইল হেঁটে স্কুলে যেতে হত৷ কিন্তু স্কুলের প্রথম দিনেই ঘটে যায় এক অপ্রীতিকর ঘটনা৷ তাঁর পাশে বসেছিল এক বার্মিজ মেয়ে ডলি৷ অংকের সমাধান না হওয়ায় তিনি অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে খাতা ছুড়ে ফেলতে গিয়ে তাঁর হাতের ধাক্কা লাগে ওই মেয়েটির গায়ে৷ মেয়েটি শিক্ষকের কাছে অভিযোগ করে তাঁর বিরুদ্ধে৷ শাস্তি হিসেবে তার জন্য ১০০ বেত নির্ধরিত হয়৷ বেতের আঘাতে জর্জরিত হয়ে শেষ পর্যন্ত তিনি জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন৷ তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়৷ এর ফলাফল অবশ্য তাঁর জন্য শুভ হয়৷ এই ঘটনার পর ওই বার্মিজ পরিবার তার প্রতি অত্যন্ত সহানুভূতিশীল হয়ে উঠে৷ তাঁরা বুঝতে পারে ঘর ছাড়া এই ছেলের মন শরত্‍কালের আকাশের মতই স্বচ্ছ আর পরিষ্কার৷ এরপর তিনি যতদিন কঙ্বাজার ছিলেন ওই বার্মিজ পরিবার হয়েছিল তাঁর অনেক আপনজন, অনেক প্রিয়, অনেক কাছের৷ ১৯৫৪ সালে তিনি কঙ্বাজার হাই স্কুল থেকে মেট্রিক পরীক্ষা দেন কিন্তু তিনি অকৃতকার্য হন৷ ঐ সময়ে তার ইপিআর'এর এক ভদ্রলোকের সঙ্গে পরিচয় হয় যিনি 'ঠাকুর' নামে পরিচিত ছিলেন৷ পাঞ্জাবিরা বলত ঠাকরা৷ ঠাকুরা তাঁকে অত্যন্ত ভালবাসতেন৷ তার বাসস্থান ছিল সিলেটে৷ ঠাকুরা তাঁকে সিলেটের বলদী গ্রামে নিয়ে যান৷ সেখানে তিনি আবার 'রাজা হাই স্কুলে' ভর্তি হন৷ ১৯৫৬ সালে তিনি ঐ স্কুল থেকে মেট্রিক পরীক্ষা দেন৷ শুধু অংকে পাশ মার্কস না থাকায় তিনি কম্পারমেন্টাল চান্স্ পান৷ এরপর শুধু অংক পরীক্ষা দিয়ে তিনি তৃতীয় বিভাগ নিয়ে মেট্রিক পাশ করেন৷ গৃহের প্রতি টান trans মেট্রিক পাশের পর সিলেটের জীবন তার কাছে একঘেয়ে হয়ে ওঠে৷ মা-বাবা, ভাই-বোন আর বাড়ির জন্য তাঁর মন ভীষণ উতলা হয়ে ওঠে৷ রক্তের আর ভালবাসার এক তীব্র টান তাঁকে ব্যাকুল করে তোলে৷ চেনা দুঃখ, চেনা সুখ মাখা পরিবারের হারানো মানুষগুলোকে ফিরে পাওয়ার জন্য হন্নে হয়ে উঠেন৷ সিলেট স্টেশনের এক কর্মকর্তার কাছ থেকে তিনি তাঁর পরিবারের খোঁজ পান৷ তিনি জানতে পারেন তাঁর বাবা খুলনা স্টেশনে আছেন৷ সিলেট থেকে পালিয়ে, কাউকে কিছু না বলে তিনি খুলনা রওনা হন৷ এরপর খুলনা পৌঁছে স্টেশন কোয়ার্টারের বাসায় বাসায় তিনি তাঁর পরিবারের খোঁজ করতে থাকেন৷ ভাগ্য তাঁর সহায় হয়৷ মেজো বোন দেলোয়ারা চাল খেতে পছন্দ করত৷ চাল খেয়ে থুতু বাইরে ফেললে, থুতু গিয়ে পড়ে ঠিক তারই গায়ে৷ জানালা দিয়ে মেজ বোনের চাল খাওয়ার ভঙ্গি দেখেই তিনি বুঝে ফেলেন, তার বহু প্রতিক্ষিত, কাঙ্খিত আপনজনদের তিনি পেয়ে গেছেন৷ এরপর কেবল আপনজনদের সাথে ভালবাসাবাসি৷ কান্নাকাটি আর সুখ দুঃখের বিনিময়৷ বাড়ির সবাই এমন আচরণ করতে লাগল যেন তাঁদের হারিয়ে যাওয়া অতি মূল্যবান কোন ধন রত্ন তাঁরা ফিরে পেয়েছে৷ মায়ের দৃষ্টিশক্তি ছিলনা৷ তাই তিনি ছেলের শরীর, হাত, পা হাতরে হাতরে দেখতেন সত্যি এটাই তাঁর আদরের কাঞ্চন কিনা৷ ছোটবেলায় চিড়িয়াখানায় বাঘের খাচার সামনে দাঁড়ালে বাঘ তার হাতে খামচা দিয়ে জখম করেছিল৷ তার মা নেড়েচেড়ে দেখতেন সেই দাগটা আছে কিনা৷ অন্য ভাইবোনদের ডেকে দেখাতেন, দেখতো ওর পায়ের তিল আছে কিনা৷ তাঁর মা যদিও বুঝতে পারে এটাই তার কাঞ্চন তবুও বার বার তার মুখ, চোখ ধরে ধরে দেখতো৷ ছিঁড়ে যায় আশা trans ১৯৫৭ সালে তাঁর বাবা আবার বদলী হয়ে খুলনা থেকে রাজশাহী চলে আসেন৷ এ যেন আবার পেছনে ফেরা৷ আবার তিনি তার ওস্তাদ মোতাহার হোসেনের সাথে দেখা করেন এবং স্টার স্টুডিওতে চাকরী নেন৷ ১৯৫৭ সালে (সম্ভাব্য) তিনি আবার স্টার স্টুডিওতে কাজে মন দিয়েছেন৷ হঠাত্‍ একদিন তাঁর চোখ আটকে যায় একটি দৈনিক পত্রিকার একটি বিজ্ঞপ্তিতে৷ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে একজন ফটোগ্রাফার নিয়োগের জন্য সার্কুলার দেয়া হয়েছে৷ কিন্তু ময়মনসিংহ যাওয়ার মত পর্যাপ্ত টাকা তাঁর হাতে সেই মুহূর্তে ছিল না৷ মনের ইচ্ছা বাবা-মা কে জানালেন তিনি৷ অবশেষে তাঁর পরীক্ষা দিতে যাওয়ার খরচ যোগাতে তাঁর মায়ের দুল বন্ধক রাখতে হয়৷ দুল বন্ধক রেখে ১৩০ টাকা যোগাড় হয়৷ এক বুক আশা আর এই সঞ্চয় নিয়ে তিনি রাজশাহী থেকে ময়মনসিংহের কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে হাজির হন ৷ পরীক্ষা দেন৷ পরীক্ষায় তিনি প্রথম হন৷ কিন্তু নিয়োগ দেয়া হয় নায়েব উদ্দিন সাহেব কে৷ এমন স্বজন প্রীতি, সাজানো নাটকের সাথে তাঁর ভেঙ্গে যাওয়া আশা আর মায়ের দেয়া কষ্টের টাকা তাঁর হৃদয়টাকে ভেঙ্গে খান খান করে দেয়৷ তিনি ভয়কে তুচ্ছ করে বোর্ড মেম্বারদের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়৷ ধিক্কার জানিয়ে আসে নোংরা কাজের দোসরদের৷ পথেই মেলে ঠিকানা trans ভেঙ্গে যাওয়া স্বপ্ন কিভাবে জোড়া দেয়া যায় তাই যখন তিনি ভাবছিলেন, তখন পরিচয় হয় আর্কিওলজির ফটোগ্রাফার মতিউর রহমান, ফিসারির ফটোগ্রাফার দীন মোহাম্মদের সাথে৷ এই দু'জনও ছিল ওই দিনের চাকুরীর প্রাথী৷ মতিউর রহমান থাকতেন ঢাকায় ঢাকেশ্বরীতে একটা ম্যাচে৷ মতিউর রহমানের সাথে কথা বলে তার ভাল লাগে এবং দু'জনের মতের মিল হয়৷ তাঁদের ভাল বন্ধুত্ব হয়ে যায় এবং সিদ্ধন্ত হয় তিনি বন্ধু মতির ম্যাচে গিয়ে থাকবেন৷ এরপর তাঁরা ঢাকায় ফিরে আসেন ময়মনসিংহ থেকে৷ কিন্তু তিনি ৫/৭ দিন ম্যাচে থাকার পর তাঁর থাকা খাওয়া নিয়ে আর সবার মধ্যে গুঞ্জন ওঠে৷ তাঁর মনটা আবার ভীষণ খারাপ হয়ে যায়৷ মনের পীড়ায় তিনি যখন ভাবছেন কি করবেন, তখন দৈবক্রমে দেখা পেলেন তার এক বন্ধুর৷ ১৭ নং পুরানা পল্টনের রিজভি নামে তাঁর এই বন্ধু ছিলেন টেলিফোন ডিপার্টমেন্টের সুপারভাইজার৷ এছাড়াও পুরানা পল্টনে রিজভি ফটোগ্রাফারস নামে তাঁর একটা স্টুডিও ছিল৷ এখানে তিনি কাজ শুরু করেন৷ স্টুডিওতে একটু ফাঁকা জায়গা ছিল সেখানে তাঁর থাকার বন্দবোস্ত হয়৷ এভাবেই সময় বয়ে চলে কিন্তু বেতন বাড়ে না৷ কয়েক মাস কাজ করার পর তাঁর আর ভাল লাগে না৷ বিয়েবন্ধন আর ভালবাসা trans ইতিমধ্যে তিনি ২০ বছরের যুবক হয়ে উঠেছেন৷ বাবা-মায়ের মনে হল ছেলেকে বিয়ে দিতে হবে৷ বাবা আর মায়ের মন রক্ষা করতে এক চাচার সঙ্গে তিনি যান বরিশালের তক্কানামক গ্রামে মেয়ে দেখতে৷ মেয়ে দেখা শেষ করে বাড়ি ফেরার পথে এক বাড়িতে পানি খেতে গিয়ে সেই বাড়ির এক মেয়ে হালিমা খাতুনকে ভাল লেগে যায়৷ মামার বাড়িতে মানুষ হওয়া পিতৃহীন হালিমা তিন ভাই বোনের মধ্যে বড়৷ আশ্রিত ছিল বলেই হয়ত বেকার রশীদ তালুকদারের সাথে বিয়ে দিতে আপত্তি করেনি৷ যদিও হালিমা দেখতে ছিল তার ময়ের মতই অপ্সরা৷ অবশেষে ১৪ বছরের কিশোরি হালিমার সাথেই তাঁর বিয়ে হয়ে যায় পারিবারিক সম্মতিতে৷ বিয়ের আগে যে মেয়ের রূপ দেখেই কেবল তিনি মুগ্ধ হয়েছিলেন, সেই মুগ্ধতা ভালবাসায়, আস্থায়, মায়ায় রূপ নিতে খুব বেশি সময় লাগেনি৷ দায়িত্ব, কর্তব্য, ভালবাসা, মায়া, স্নেহ দিয়ে তার স্ত্রী হালিমা রশীদ তার পরিবারকে বেঁধে রেখেছেন৷ তাঁর বিয়ের প্রথম জীবনে তিনি তাঁর পরিবার নিয়ে অনেক কষ্ট করেছেন৷ টাকা পয়সা ছিলনা, থাকার তেমন কোন ভাল জায়গা ছিলনা৷ এর মধ্যেই তাঁর স্ত্রী তিল তিল করে তাঁদের বর্তমান বাসস্থান গড়ে তুলেছেন৷ তাঁদের ভালবাসার ফসল তাদের সোনার টুকরো তিন ছেলে-মেয়ে৷ তবে ছেলে মেয়েরা কেউ তাদের বাবার পেশায় আসেনি৷ বড় ছেলে মিজানুর রশীদ বিজনেসম্যান, ৪ বছরের একটি ছেলে ও স্ত্রীসহ বর্তমান ঢাকার বাসাবোর বাড়িতে বাবার সাথে থাকেন৷ মেজ মেয়ে শাহানা চৌধুরী তিন মেয়ে ও এক ছেলে নিয়ে স্বামীর সাথে আমেরিকা থাকেন৷ তাদের একটি কালার ল্যাব আছে৷ তিন সন্তানের জননী ছোট মেয়ে সোনিয়া আরিফও তার স্বমীর সাথে হংকং থাকেন৷ তাঁর স্ত্রী হালিমা রশীদ ২৩ মে, ২০০৮ সালে পরলোক গমন করেন৷ দীর্ঘ ৫৫ বছর সংসার জীবনে একসাথে থাকার পর তাঁর স্ত্রী হালিমা খাতুনের এই চলে যাওয়াটা তাঁকে শোক সাগরে ভাসিয়ে নিয়ে গেছে৷ কর্ম জীবনে প্রবেশ এবং সামনে এগিয়ে যাওয়া trans প্রেস ইনফরমেশন ডিপার্টমেন্ট (পিআইডি)'এর ডিরেক্টর আনোয়ার সাহেবের সাথে তাঁর পরিচয় হয়৷ তিনি ছিলেন অত্যন্ত প্রভাবশালী ব্যক্তি৷ ১৯৫৯ সালে তিনি আনোয়ার সাহেবের সহযোগিতায় ফটো টেকনিশিয়ান হিসেবে কাজে প্রবেশ করেন ৮০ টাকা বেতনে৷ ১৯৬০ সাল সংবাদ পত্রের জন্য বিশেষ গুরুত্ব বহন করে৷ এ বছরে সংবাদপত্রসেবীদের জন্য ওয়েজ বোর্ড গঠন করা হয় অর্থাত্‍ সাংবাদিকসহ অন্যান্যদের জন্য বেতন কাঠামো স্থির করা হয়৷ ফলে নিজস্ব ফটোগ্রাফারপদ তৈরি হয়৷ রিপোর্টার ফটোগ্রাফার উভয়কে একই পদমর্যাদা দেয়া হয়৷ ফলে বেতনও একই গ্রেডে৷ ফটোগ্রাফারদের যোগ্যতার মাপকাঠি ছিল ফটো তোলা সহ ফিল্ম ডেভেলপ বা এক কথায় ডার্করুমের সব কাজ জানা৷ ফটো তুলতে জানার মধ্যে প্রকারভেদ থাকা স্বাভাবিক৷ এ কারণে সংবাদচিত্র ধারণের জন্য যথেষ্ট কষ্ট, ত্যাগ ও প্রচুর সময় ব্যয় করে তাদেরকে কাজের মাধ্যমে শিখতে হয়েছে৷ ১৯৬২ সালের ২৪ অক্টোবর তিনি প্রথম দৈনিক পত্রিকা সংবাদে ফটো জার্নালিস্ট হিসাবে জয়েন করেন৷ তখন সংবাদের এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর ছিলেন শহিদুল্লাহ কায়সার৷ প্রথম দিনেই শহিদুল্লাহ কায়সার তাঁকে একজন আহত মানুষের ছবি তোলার অ্যাসাইনমেন্ট দেন৷ কিন্তু সেই সময় ছবি তোলা ছিল অত্যন্ত কঠিনতর একটি কাজ৷ মোজাম্মেল হোসেন নামে এক ভদ্রলোক আওয়ামি লীগ কর্মী ছিলেন ৷ মুসলিম লীগের হাতে তিনি প্রহৃত হন৷ ঢাকা মেডিকেল থেকে আহত মোজাম্মেল হোসেনের ছবি তুলতে হবে৷ সংবাদের অন্য একজন ফটোগ্রাফার আব্দুল মতিন তাঁর সাহয্যে এগিয়ে আসেন৷ আব্দুল মতিন তাঁকে বলেন,'তুমি এভাবে পারবেনা, মেডিকেল কলেজের একটি ছাত্র সংগঠন আছে ওদের সাথে কথা বল৷' তখন তিনি মেডিকেল ছাত্র সংগঠনের প্রেসিডেন্ট সেক্রেটারি রুহুল হকের সঙ্গে দেখা করেন৷ তাঁর সহায়তায় রশীদ তালুকদার গলায় টেথিস্কোপ, গায়ে ডাক্তারী এ্যাপ্রোন পরে মেডিকেলের ভেতর প্রবেশ করেন৷ তাঁকে আগে থেকেই বলে দেয়া হয় ওয়ার্ডে ঢুকে প্রথমেই যাকে চিকিত্‍সা দেয়া হবে সেই মূল ব্যক্তি৷ কিন্তু ঝক্কি দেখা দিল ছবি তোলার সময়৷ তখন নিয়ম ছিল ফিল্মের ১ম ও ১২তম নং ছবিকে বিশ্বাস করা যাবেনা৷ ১ম ছবিটা ঠিকমত তুলতে পারেন, তবে ২য় ছবি তোলার সময় প্রচন্ড আলোড়ন সৃষ্টি হয়৷ ধর ধর বলে সবাই চারপাশ থেকে চিত্‍কার শুরু করে দেয়৷ প্রান বাঁচানোর জন্য তিনি দৌড়াতে শুরু করেন৷ কিন্তু তিনি কোথায় কিভাবে কোনদিকে দৌড়াচ্ছেন সে দিকে তাঁর কোন হুশ ছিলনা৷ এক পর্যায়ে তিনি দেখেন গেটের কাছে পৌঁছে গেছেন৷ এভাবে তিনি তাঁর প্রথম এ্যাসাইনমেন্টে সফলকাম হন অনেক বিপদ অতিক্রম করে৷ এরপর তাঁকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি৷ কেবল সামনে এগিয়ে যাওয়৷ তার কাজের প্রতি কর্তব্যবোধ, নিষ্ঠা ও সাধনা বিশেষ পরিচিতি এনে দেয়৷ যুদ্ধের তান্ডবলীলা trans ১৯৭১- এ শুরু হয় মুক্তির লড়াই৷ চারপাশে কেবল ধ্বংস, ক্রন্দন, হাহাকার, আহাজারি আর জ্বালাও পোড়াও৷ পত্রিকা অফিসগুলোও সব পুড়িয়ে দেয়া হয়৷ এসময় তিনি প্রফেশনাল কাজ থেকে কিছুটা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন৷ কিন্তু তার চেয়েও অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজে তিনি তাঁকে নিয়োজিত করেন৷ তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের আইডি কার্ড করে দিতেন৷ হাজার হাজার আইডি কার্ড করে দিয়ে তিনি মুক্তিসেনাদের পাকিস্তানীদের মরনফাঁদ থেকে বাঁচাতে সহযোগিতা করেছেন৷ এছাড়াও তিনি মুক্তিসেনাদের বাড়িতে থাকতে দিয়ে ও অন্যান্য সকল প্রকার সহযোগিতা করে মুক্তিযুদ্ধের সাথে নিজেকে সক্রিয় রেখেছেন৷ আর তাঁর ক্যামেরা তো ছিল তার সকল সময়ের সঙ্গি৷ যুদ্ধের পর তিনি ১৯৭৫ সাল থেকে প্রায় তিন দশক সিনিয়র প্রেস ফটোগ্রাফার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন৷ আলোচিত ও বহুল প্রচারিত আলোকচিত্র trans আজকের আলোকচিত্র আগামীদিনের ইতিহাসের পাতা৷ রশীদ তালুকদারের ছবিতে পাওয়া যায় জীবনের কথা, সমস্যার কথা, প্রাকৃতিক দৃশ্য এবং জনসাধারণের কৃষ্টি ও সংস্কৃতির নিদর্শন৷ তাঁর ছবিতে বিষয়বস্তুর যে বিচিত্র সমাহার তা আর অন্য কোন আলোকচিত্র শিল্পীর ছবিতে তেমন দেখা যায়না৷ তাঁর ছবি দেখলে বোঝা যায় অভিজ্ঞতার স্বাক্ষর কাজ করছে৷ ঠিক সময়মত তিনি তাঁর ক্যামেরার সাটার ক্লিক করেছেন৷ তাঁর বিখ্যাত, বহুল প্রচারিত ও মুদ্রিত এমন কিছু ছবি রয়েছে যা ইতহাসের সত্যতাকে ধারণ করছে যুগ যুগ ধরে৷ তার অনেক ছবির মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি ছবির কথা না বললেই না৷ তাঁর এমনই একটি আলোকচিত্র যা সময় এবং কালকে অতিক্রম করে বারবার ইতিহাসকে নাড়া দেয়, আমাদের অতীতকে স্মরণ করিয়ে দেয়, ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের সময় মিছিলে শ্লোগানরত নিহত টোকাই'এর ছবিটি৷ গণঅভ্যুত্থানের শেষ মিছিল ছিল এটি৷ আইয়ু্ব খানের ছবিতে জুতার মালা পড়িয়ে ছাত্র ইউনিয়নের এই মিছিলটি যখন শিক্ষা ভবনের মোড়ে এসে পৌঁছায় তখন রশীদ তালুকদারের চোখ আটকে যায় এই শীর্ণ টোকাই'এর উপর৷ টোকাইটির চোখের ও মুখের প্রতিবাদী ভাষা সারা দেশের নিপীড়নের কথা মনে করিয়ে দেয়, অন্যকে প্রতিবাদ করতে আহবান জানায় এবং অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে ডাক দেয়৷ এ ধরণের আহবান শাসকগোষ্ঠির কোনভাবেই কাম্য নয়৷ তাই দৃশ্যটি ক্যামেরাবন্দি করে তিনি পিছন ফিরে ঘুরে দাঁড়াতেই শাসকগোষ্ঠির পক্ষ থেকে ইপিআর কতৃক গুলিবিদ্ধ হয়ে ছেলেটি নিহত হয়৷ কিন্তু তার ক্যামেরার ফ্রেমে সেই সময়ের নির্ভিক সাহসী প্রতিবাদ জীবন্ত হয়ে আছে, থাকবে৷ ঐতিহাসিক ৭ মার্চের বিশাল সমাবেশে বঙ্গবন্ধুর আঙুল উঁচিয়ে ভাষণ দানের মুহুর্তটিও তিনি অসাধারণ দক্ষতায় ক্যামেরায় বন্দি করে ফেলেন৷ বঙ্গবন্ধুর ছবিটি তাঁর তেজোদীপ্ত আত্মপ্রত্যয়, দৃঢ় অবস্থান, কঠিন সংগ্রামের শপথকে যেন প্রকাশ করছে৷ স্বাধীনতা সংগ্রামের পটভূমি এ ছবির মাধ্যমে সংরক্ষিত হয়৷ বাংলার মানুষের উপর হাত চালাতে যাদের বুক কাঁপেনি এতটুকুও, যুদ্ধের পর সেই রাজাকারদের ওপরে চলেছে প্রতিশোধের পালা৷ ১৯৭১ এর ১৬ ডিসেম্বর একজন রাজাকারকে হত্যার দৃশ্য তার ক্যামেরায় বন্দি হয়ে যায়৷ তাঁর সাথে ছিলেন আরেকজন মার্কিন চিত্রগ্রহক, তিনিও সেই দৃশ্যটি ক্যামেরায় ধারণ করে পুলিত্‍জার পুরষ্কার অর্জন করেন৷ কিন্তু গুণগত ও আবেগগত দিক থেকে মার্কিন চিত্রগ্রাহক মিশেলের ছবিটি ছিল অনেক নিম্নমানের৷ সেই সময়ে যোগাযোগ ব্যবস্থার সুবিধা না থাকায় ও প্রচারের অভাবে তাঁর আলোকচিত্রটি আড়ালে থেকে যায়৷ উল্লেখিত ছবিগুলো ছাড়াও ঊনসত্তর সালের গণঅভ্যুত্থান থেকে শুরু করে সত্তর সালের সাধারণ নির্বাচন এবং ফলাফল, অসহযোগ আন্দোলন, একাত্তরের যুদ্ধ, যুদ্ধ পরবর্তী হাহাকার, আহাজারী, কান্না, মানুষের দুঃখ-দুর্দশা, মানবিক অনুভূতি, নারী আন্দোলন, বিভিন্ন সংগ্রাম ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয়বস্তু তিনি তাঁর ক্যামেরার মাধ্যমে মানুষের সামনে আবেদনময় করে উপস্থাপন করে তুলেছেন৷ মানুষের আবেগ অনুভূতিকে জাগ্রত করে তুলেছেন৷ সেই সাথে তাঁর আলোকচিত্র ইতিহাসের সাক্ষি তথা প্রমাণিত দলিল হয়ে থাকবে যুগ যুগ ধরে৷ ব্যবহৃত ক্যামেরা trans তিনি বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ধরণের ক্যামেরা ব্যবহার করেছেন৷ তাঁর ব্যবহৃত প্রথম ক্যামেরা আইস্যুলেট ক্যামেরা৷ এছাড়া রোলিকর্ড, রোলিফ্লেঙ্ ক্যামেরা তিন ব্যবহার করেছেন৷ ষাটের দশকের শেষ দিক থেকে তিনি ১৩৫ মি.মি. ক্যামেরা ব্যবহার করেন৷ বলতে গেলে তিনি এ ধরণের ক্যামেরা ব্যবহারের ক্ষেত্রে ফটো জার্নালিস্টদের মধ্যে পথপ্রদর্শক৷ প্রেস ফটোগ্রাফারদের ধারণা ছিল ছোট ফ্রেমে (১৩৫মি.মি.) ছবি তোলা হলে উক্ত নেগেটিভ দিয়ে ছবি বড় করা যায় না৷ ছবির গুণাগুণ নষ্ট হয়, ছবির গ্রহণযোগ্যতা থাকে না৷ তাই ১২০ রোল ফিল্ম দিয়ে ছবি তুলতো৷ সত্তর দশকের মাঝামাঝির পরে তাদের মধ্যে কেউ কেউ ১৩৫মি.মি. ক্যামেরার প্রচলন শুরু করেন এবং দশক শেষ হওয়ার আগে প্রত্যেকেই ১৩৫ মি.মি. ক্যামেরা ব্যবহারে উত্‍সাহিত হয়ে উঠেন৷ গুণীজন সংবর্ধনা trans তাঁর কাজের মূল্যায়ন হিসেবে তিনি সর্বমোট ৭২ টি সংর্ধনা পান৷ বাংলাদেশের বিভিন্ন সোসাইটি ও সংস্থা কর্তৃক, জাপন, ইউনেস্কো, থাইল্যান্ড ও অন্যান্য দেশ কর্তৃক একাধিকবার পুরষ্কার লাভ করেন৷ ফ্রান্সে জাতিসংঘ আয়োজিত 'নিরাশ্রয়ের জন্য আশ্রয়' শীর্ষক প্রতিযোগিতায় এক সাথে ৬টি পুরষ্কার অর্জন করেন৷ ইংল্যান্ডে মুসলিম ওয়ার্ল্ড শীর্ষক প্রতিযোগিতায় ২য় স্থান, জার্মন ডিডিআর থেকে ডিপ্লোমা, জাপান ফটোগ্রাফিক সোসাইটি ও আসহাই সিমবুন পত্রিকার যৌথ উদ্দ্যোগে আয়োজিত প্রতিযোগিতায় পর পর দুইবার পুরস্কৃত হন৷ পূরবী পদক-৯৩, ঋষিজ শিল্পগোষ্ঠী-৯০ অর্জন করেন৷ ১৯৭৮ সালে বিগ্ঞন যাদুঘর, ১৯৮২ সালে বিপিএস তাকে স্বর্ণপদক প্রদান করেন৷ জাতীয় যাদুঘর কর্তৃক দুইবার বিশেষ পুরষ্কার লাভ করেন৷ বাংলাদেশ প্রেস ইনষ্টিটিউটসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান কর্তৃক আলোকচিত্র প্রতিযোগিতায় একাধিকবার পুরষ্কার লাভ করেন৷ বাংলাদেশ শিল্প ব্যাংকের ম্যানেজিং ডাইরেক্টর রশীদ তালুকদারের কৃতিত্বের জন্য বিভিন্ন স্থানে প্রশংসাপত্র প্রেরণ করেন৷ এছাড়াও তিনি উল্লেখযোগ্য অনেক সম্মাননা অর্জন করেছেন৷ ১. পৃথিবীর শত ব‍ছর পুরাতন ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক সাউথ ইষ্ট এশিয়ার উপর এন সাইক্লোপিডিয়াতে তার তোলা বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের ঐতিহাসিক ছবিটি জুরি বোর্ড কর্তৃক অনুমোদন লাভ করে৷ তাঁর তোলা এই ছবিটি বাংলাদেশের ইতিহাসকে যেমন ধারণ করে রেখেছে তেমনি বাংলাদেশের জন্য বয়ে এনেছে এক অসামান্য গৌরব৷ ২. শেরেবাংলা স্মৃতি পুরস্কার কেন্দ্রীয় ইয়থফ্রন্ট, ঢাকা৷ ৩. কাপঃ রোটারেক্ট ক্লাব কসমোপলিটন, ঢাকা৷ ৪. বাংলাদেশ এ্যাষ্ট্রোলজি পামিষ্ট ফেডারেশন, ঢাকা৷ ৫. রংধনু, ললিতকলা একাডেমি৷ ৬. নাট্যসভা গুণীজন সংবর্ধনা৷ ৭. কথক একাডেমি কর্তৃক গুণীজন সংবর্ধনা৷ ৮. আজীবন সদস্য বাংলাদেশ ফটোগ্রাফী সোসাইটি কর্তৃক সম্মানসূচক ফেলোশীপ প্রদান-৯২৷ ৯. এল পি বি এস (প্রফেশনাল যোগ্যতা বাংলাদেশ ফটোগ্রাফী সোসাইটি)৷ ১০. বাংলাদেশ ফটোগ্রাফী সোসাইটি কর্তৃক অনারী মেম্বারশীপ প্রদান৷ ১১. ১৯৮৯ সালে 'রূপসি' পুরস্কার লাভ ও ইন্দোসুয়েজ পুরস্কার লাভ৷ ১২. ময়মনসিংহ আলোকচিত্র সংসদের ৩য় জাতীয় প্রতিযোগিতায় ২টি পুরস্কার লাভ৷ ১৩. হিরাঝিল সংসদ কর্তৃক গুণীজন সংবর্ধনা-৯১৷ ১৪. ইত্তেফাক সম্পাদক কর্তৃক দুইবার প্রশংসাপত্র প্রদান৷ ১৫. সংকলন গণঅভ্যুত্থান ধীপ্র গাথা, ঢাকা, ০১.১১.৬৯৷ ১৬. জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ষোড়শ ব্যাচ কর্তৃক সংবর্ধনা জ্ঞাপন৷ ১৭. জাহানারা বেগম মেমোরিয়াল এন্ড ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট কর্তৃক ফুটবলার আসলামের ক্রীড়া নৈপুণ্যের উপর আলোক গুণীজন সংবর্ধনা জ্ঞাপন(২৬.১১.৯১) চিত্র প্রতিযোগিতায় প্রথম পুরস্কার-স্বর্ণপদক৷ ১৮. ইউনেস্কো কর্তৃক আয়োজিত দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াতে নারী নির্যাতন ও তার প্রতিকার প্রতিযোগিতায় প্রথম পুরস্কার লাভ-৯৬৷ ১৯. নারায়ণগঞ্জ ফটোগ্রাফিক সোসাইটি কর্তৃক প্রথম স্থান আলোকচিত্র প্রতিযোগিতায় রঙ্গিন বিভাগে দ্বিতীয় স্থান৷ ২০. চট্টগ্রামে ফটোগ্রাফিক সোসাইটি কর্তৃক ২১শে পদক প্রদান-৯৬৷ ২১. সম্মিলিত নারী সমাজ কর্তৃক আলোকচিত্র প্রদর্শনীতে অধিকাংশ তাঁর ছবি স্থান পায়৷ ২২. ক্যামেরা রিক্রিয়েশন কর্তৃক ভাসাণীর বুকে বঙ্গবন্ধুর ছবি প্রথম পুরস্কার লাভ করে৷ ২৩. বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন অব এশিয়া প্রেসফটো প্রতিযোগিতায় পুরস্কার লাভ-২০০২৷ ২৪. বিপিএস রজত জয়ন্তী পদক লাভ-২০০২৷ ২৫. জেপিএস কর্তৃক ম্যান অব দি ইয়্যার-২০০২৷ ২৬. আমরা কুঁড়ি ফটোসাংবাদিকতার জন্য এওয়ার্ড-২০০৩৷ ২৭. অনন্যা পত্রিকা কর্তৃক বিশেষ সম্মাননা পুরস্কার লা

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.