আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ইতালীর পাদভাতে একদিন



রাতে সালেহ ভাইয়ের বাসায় থেকে পরদিন সকালে নাস্তা করে বের হলাম। প্রথমে সালেহ ভাইয়ের বিশ্ববিদ্যালয়ে, ইউনিভার্সিটি অব রোম এটা আবার লা স্পেনজা নামেও পরিচিত, বিশাল ক্যাম্পাস। বিশাল এবং অনেক পুরোনো সব ভবন। ভাইয়ের রুমে গিয়ে সেখানে মেইল চেক করে আমি টার্মিনির দিকে যাব। ভাই আজকে অনেক ব্যস্ত থাকবেন।

আমাকে বললেন আজকে রোম একটু ঘুরে দেখতে। তবে আগামীকাল উনি সারাদিন আমার সাথে থাকবেন। আমি ভাইয়ের সাথে চা খেয়ে টার্মিনির দিকে হাটতে লাগলাম। ১২/১৫ মিনিটের মধ্যে আমি টার্মিনিতে পৌছালাম। এরপর কি করি।

আমার একটা খালাতো ছোট ভাই থাকে পাদভা নামক একটি শহরে। রোম থেকে ৪০০ কিলোমিটার দুরে। আমি ওকে আসতে বলেছিলাম। এবার ওর খোঁজ নিতে হবে। আর বাসায়ও কথা বলতে হবে, জানানো হয়নি আমি ঠিকমত ইতালিতে পৌঁছেছি।

অনেক বাংলাদেশিদের দোকান। একজনকে জিজ্ঞেস করলাম বাংলাদেশে ফোন করবো, কোনদিকে ফোনের দোকান। সে দেখিয়ে দিল। আমি দোকান থেকে বাংলাদেশে কথা বললাম। এর পর খালাতো ভাই গোলাপ এর সাথে কথা বললাম।

গোলাপ জানালো সে আসতে পারবে না। আর গতকাল থেকে আমাকে জানানোর চেষ্টা করেছে কিন্তু আমার মোবাইল বন্ধ থাকায় জানাতে পারে নাই। এর পর আমি টার্মিনিতে গেলাম পাদভা যাওয়ার ট্রেন এর খোঁজে। গিয়ে চার্ট দেখলাম। সুন্দর গোছানো একটি চার্ট।

চার্ট দেখেই বলা ট্রেনের সময় সম্পর্কে সবকিছু বলা সম্ভব। কোন কোন স্টেশনে ট্রেন কতটার সময় দাড়ায়, আসা ও যাওয়ার সকল তথ্য। চার্টে দেখলাম কোন কোন ট্রেন পাদভাতে যায়। কিন্তু টিকেট কোথা থেকে কাটতে হয় সেটা তো জানি না। প্লাটফর্ম এ অনেক খুজলাম, পরে না পেয়ে এক বাংলাদেশি কে জিজ্ঞেস করলে সে বললো টিকেট কাউন্টারের অবস্থান।

আমি আসলে ঐদিকে খুজি নাই। পরে সেখানে গিয়ে দেখি বিশাল লম্বা লাইন। আমার সামনে প্রায় একশত লোক লাইনে দাড়িয়ে। আমিও দাড়ালাম। না জানি কতক্ষণ লাগে।

না বেশিক্ষণ লাগলো না ১৫/২০ মিনিটেই আমি টিকেট কাউন্টারে গিয়ে টিকেট কাটতে পারলাম। তবে আমি ভেবেছিলাম কাছেই হবে। কিন্তু না কাছে নয় প্রায় চারশ কিলোমিটার, টিকেটের দাম ৫৯ ইউরো। দ্রুত গতির ট্রের ইউরো লাইন এ যাব। কিন্তু পরবর্তী ট্রেন দুপুর ১২.৫০।

এখন কেবল সাড়ে ১০ টা বাজে। কি আর করা। তাই কাটলাম। এরপর সালহ ভাইকে জানানো দরকার আমি পাদভা যাচ্ছি। সাইবার ক্যাফেতে বসে ওনাকে জানালাম।

এরপর টার্মিনির আশেপাশে একটু ঘুরে দেখলাম। বেশ বড় টার্মিনাল। পাশাপাশি বাস ও ট্রেন টার্মিনাল। তবে বাস আসছে আর যাচ্ছে কোথাও বেশিক্ষণ থাকছে না। একটু পর পর ফুটপাথে দোকান, অনেকটা ঢাকার গুলিস্তানের মত।

গুলিস্তানে অনেক দোকান এখানে একটু কম। চেহারা সুরত দেখতে প্রায় অধিকাংশ দোকানী বাংলাদেশিদের মত। আবার অনেকেই মোবাইলে বাংলায় কথা বলছে। আমি দু’এক জনের সাথে বাংলায় কথাও বললাম। এরপর আশে পাশে ঘুরতে ঘুরতে বিভিন্ন দোকান দেখতে দেখতে প্রায় সাড়ে ১২ টা বাজলো।

আমি ট্রেন এর প্লাটফরমে গেলাম। সেখানে ১ নম্বর লাইনে আমার ট্রেন আসবে। আমি গিয়ে দেখি একটা ট্রেন। আমি ভাবলাম সেটাই আমার ট্রেন হবে হয়তো। কিন্তু না।

সেটা অন্য ট্রেন। সেটা যাওয়ার পরে আমার ট্রেন আসলো। আমি ৮ নম্বর বগির ৮৮ নম্বর সিটে গিয়ে বসলাম। আর ভাবছিলাম পাদভার কথা, কেমন শহর। ভেবেছিলাম গোলাপ আসবে কিন্তু সে না আসায় আমাকে যেতে হচ্ছে।

গোলাপ ইতালিতে বসবাস কারী অর্ধ লক্ষাধিক অবৈধ বাংলাদেশিদের একজন। জীবনের প্রয়োজনে আজ এখানে। কবে বৈধভাবে কাজ করার অনুমতি পাবে, তারপর দেশে যেতে পারবে, তার নিশ্চয়তা নেই। আমি না গেলে ওর সাথে হয়তো আগামী ৪/৫ বছর দেখা হতো না। পাদভা থেকে রোম আসা যাওয়ার জন্য যে ১২০ ইউরো লাগবে সেটা ওর কষ্টের উপার্জনের কাছে অনেক।

ফুটপাথে খেলনা, ছাতা, পুতল এসব বিক্রি করে। আবার মাঝে মাঝে পুলিশরা কেড়েও নেয়। তখন আসলও যায় লাভও যায়। যাইহোক ১২০ ইউরো উপার্জন করতে আমার তেমন কষ্ট হয়নি তাই আমার কাছে ১২০ ইউরোর চেয়ে ওকে দেখাটাই অনেক বড়। আমার পাদভা যেতে সময় লাগবে প্রায় ৪ ঘন্টা।

আমি ৪ টার পরপর সেখানে পৌছাবো। গোলাপকে বলেছি স্টেশনে আসতে। ইউরো স্টার ট্রেনটি ইন্টারন্যাশনাল ট্রেন। এসি, সুন্দর সিট তবে দ্বিতীয় শ্রেনীতে ইজি সিট নেই, ফিক্সড সিট। মন্দ লাগেনি চার ঘন্টা।

টার্মিনি থেকে বের হয়েই দেখলাম পাহাড়, অনেক দুরে আবার কাছেও। পাহাড় কেটে টানেল তৈরি করেছে। সেইসব টানেলের মধ্য দিয়ে প্রায়ই অতিক্রম করছি। আমার দুরে দেখার বিঘœ ঘটাচ্ছে। একটা বিষয় ভালোভাবে খেয়াল করলাম ইউরোপে ট্রেন ক্রোসিং খুব কম দেখেছি।

সব ক্রসিং এ আন্ডারপাস অথবা ফ্লাইঅভার আছে বাস, কাভার্ড ভ্যান ও মোটর গাড়ির জন্য। চারটার দিকে পাদভাতে পৌঁছলাম, স্টেশন থেকে বের হয়ে দেখি একটি রাস্তা, কোন যানবাহন পার্কিং নেই, দোকান নেই। বুঝলাম স্টেশনের পিছনে এসেছি। কেননা ইউরোপের অধিকাংশ স্টেশনে প্রবেশ পথে টিকেট কাটার মেশিন এবং স্টেশনের বাইরে বাস স্টাপজ, ট্যাক্সি স্ট্যান্ড থাকেই। উল্টোপথে বের হয়ে দেখলাম প্রবেশপথ।

কয়েক মিনিট দেখলাম কিন্তু গোলাপকে পেলাম না। একটু এগিয়ে রাস্তা পার হয়ে একটি ফোনের দোকানে প্রবেশ করলাম। চাইনিজ দোকান। আমি ইংলিশ এ বললাম সে চাইনিজ ও উত্তর দেয়। কি মুশকিল! শেষে সে একটা কার্ড দিল এক ইউরোর সেটা দিয়ে ওর দোকানেই ফোনে কথা বলা যায়।

সেটা দিয়ে কথা বললাম গোলাপের সাথে। গোলাপ স্টেশনের প্লাটফরম এ আছে। ওকে বাস স্টপেজ এ আসতে বললাম। আমিও দোকান থেকে বের হয়ে বাস স্টপেজ এ গেলাম। গোলাপের সাথে দেখা হল।

স্বাস্থ্য আগের চেয়ে ভালো হয়েছে মনে হলো। আমাকে দেখে সুন্দর একটা হাসি দিল। কৃত্রিম হাসি নয়। আসলে ওকে দেখতেই তো এই চার ঘন্টার জার্নি করা। ওকে বললাম আমি ৭টার ট্রেনে রোমে যাব।

হাতে সময় আছে মাত্র আড়াই ঘন্টা। এখন কই যাবি চল। সে আমাকে যেতে দিবে না। আমি তো আবার এদিকে সালেহ ভাইকে রাত ১১ টায় টার্মিনিতে আসতে বলেছি। এরপর দু’ভাই মিলে বের হলাম।

গোলাপ আমার জন্য কিছূ বাজার খরচ করেছে দেখালাম। সেগুলো একটা দোকানে রেখে এসেছিল। আমরা সেগুলি নিয়ে ট্রামে করে ওযেখানে থাকে সেই বাসার দিকে যাচ্ছি। গোলাপ আমাদের দূরসম্পর্কের এক বোনের কাছে থাকে। ট্রামে করে সেখানে যেতে ৩০ মিনিট সময় লাগলো।

সেখানে গিয়ে আপার সাথে পরিচয় হলো। আপার একটা মেয়ে আছে নাম প্রিংয়াংকা, বয়স ৩/৪ বছর হবে। এই বয়সের বাচ্চাদের আমার খুব ভালো লাগে। প্রিয়াংকার সাথে একটু মজা করলাম। আপাকে বললাম যাব কিন্তু আপাও যেতে দিবে না, দুলাভাইকে ফোন দিয়ে আমার সাথে কথা বলিয়ে দিল।

এবার দুলাভাইকে যাব বললাম কিন্তু উনি বললেন না আজ না, পরদিন সকালে ৬ টায় ট্রেন আসে সেটাতে যেতে। শেষে কি আর করা, থেকে গেলাম, সালেহ ভাইকে ফোন দিয়ে বললাম যে আজ যাব না। এরপর গোলাপ এবং আমি আবার স্টেশনে গেলাম সেখানে পরদিন সকাল ৭টায় একটি ট্রেন আছে সেটার টিকেট কাটলাম, ১১ টায় টার্মিনিতে পৌছাতে পারবো। টিকেট কাটার পরে সালেহ ভাইকে ফোন দিয়ে সময়টা জানিয়ে দিলাম। পরে আমরা দি ব্যাসিলিকা অব স্ট. গুইস্টাটিনা, রোমান সভ্যতার সকল বিখ্যাত ব্যক্তিকে এই পার্কে রাখা আছে, সামারে প্রতিদিন এই খানে কয়েক হাজার পর্যটক আসে।

এই শহরটি রোমের মত নয়। একটু পরিস্কার পরিচ্ছন্ন। অনেকটা জার্মান শহরগুলির মত। অধিকাংশ বিল্ডিং এ আধুনিকতার ছোয় আছে। ট্রামগুলিও অনেক সুন্দর।

রোমের ট্রামের অবস্থা তো ভয়াবহ রকম খারাপ। দেখতে শত বছরের পুরোনো মনে হয়। আমাদের দেশের লোকাল ট্রেনের মত। সত্য বললে ইউরোপের যে একটা বিশেষ ভাব আছে ট্রেন, ট্রাম কিংবা বাসে, সেই ভাবটা রোমের ট্রামে নেই। পাদভাতে থাকাটা ভালোই হয়েছে।

একটা শহর দেখতে পারলাম। এক একটা শহরের পরিবেশ, সংস্কৃুতি, রাস্তা, বিল্ডিং, দেখার স্থান ভিন্ন ভিন্ন। আর এসব দেখার পর আমরা বাসায় ফিরে গেলাম। সেখানে গোলাপের ব্যবসার উপকরন দেখলাম। এরপর বাসায় ঢুকলাম।

বাসায় যাওয়ার একটু পরে দুলাভাই আসলো। এরপর হাতমুখ ধুয়ে খেতে গেলাম। অনেক দিন পর ইলিশ মাছের স্বাদ পেলাম। ইলিশ মাছের মাথা দিয়ে সবজি রান্না করেছে। আর গরুর মাংস ছিল।

পেট ভরে ভাত খেয়েছি। আপাকে এত সুন্দর রান্নার জন্য ধন্যবাদ জানানো হয়নি। উচিৎ ছিল। এরপর একটু টেলিভিশন দেখলাম। বাংলা চ্যানেল।

এরপর ঘুম। পরদিন সকালে ৬ টায় আমরা রওয়ানা দিব। সকাল সাড়ে ৫ টায় উঠলাম। ভাত ও চা খেয়ে আপার কাছে বিদায় নিয়ে রওয়ানা দিলাম। দুলাভাই প্রাইভেট কারে করে আমাকে স্টেশনে দিয়ে গেল।

গোলাপও থাকলো আমার সাথে, দুলাভাই চলে গেল। গোলাপ সহ স্টেশনে গেলাম। এখনকার সকালগুলো খুবঠান্ডা হয়। আর শীতের সকালের কথা নাই বললাম। গোলাপের দিকে তাকাচ্ছি।

আমার দৃষ্টিকোন থেকে দেখলে ভালোই তো আছে, ইউরোপে থাকছে। যে বাসায় থাকে ভালোই আছে। থাকার ব্যবস্থা ভালো, খাবার বন্দোবস্তও ভালো। আর ওর দৃষ্টিকোন থেকে দেখলে, ভাই আসলো আবার চলেও যাচ্ছে। আমি কবে যে দেশে যেতে পারবো? ওর দিকে তাকাচ্ছি দেখি ওর চোখ ছলছল করছে।

বেশি কথা বললাম না। শুধু বললাম, অনেক কষ্ট করে এসেছিল, আছিস। অনেকে এত ভালো থাকতে পারে না। আর একটু কষ্ট কর, তোর বৈধ কাগজপত্র হয়ে গেলে দেশ থেকে ঘুরে আসিস। আর তুই তো একা না আশে পাশে তো অনেক বাংলাদেশি।

দেশের সব কিছুই এখানে পাওয়া যায়। ব্যস্ত থাকবি খারাপ কম লাগবে। আর দেশে তো আমরা আছি। গোলাপ কিছুই বললো না, শুধু বললো দোয়া করেন ভাই। আমি যতটা অনুমান করেছিলমা তার চেয়ে ভালো আছে, ভালো সুবিধা পাচ্ছে এইটা ভেবেই আমি একটু খুশি হয়েছি।

কষ্ট তো দেশেও করতে হবে আর এখানে তো করতেই হবে। তবে এখানে নিরাপত্তা ভালে। থাকুক এসেছ যখন এই দেশে।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.