আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

রূপকথা নয়!

আমার খুব কষ্ট হয়, যখন RAJAKAR বানানটা বাংলা বর্ণমালায় লিখা হয়। এটা বর্ণমালার জন্য অপমান।

আমি ওকে জিগ্যেস করলাম, 'ওটা কি'? রূপাই বললো, 'ওটা তোর'। -'আমার তাহলে ঝুলিয়ে রেখেছিস কেন? দিয়ে দিলেই পারিস!' -উঁহু। এখন দেবনা।

এই বলে সে মিটিমিটি হাসতে লাগলো। ওর নাম রূপকথা। কেউ ডাকে রূপা, কেউ বা কথা। আমি যখন যা খুশি-তাই ডাকি। আমার বন্ধু রূপাই।

কিংবা রূপকথা। বন্ধুদের আড্ডার ভীড়ে, কখন যেন আমাদের মধ্যে তৈরি হয়েছিল অদ্ভুত এক বন্ধুত্ব। বন্ধুর চেয়ে বেশি, কিন্তু প্রেমের নয়। যদিও অসংখ্য টিপ্পনির মাঝেও আমাদের সম্পর্কটা ছিল অনেক বেশি অনুভূতির। ও আমাকে চিঠি লিখত।

আমিও লিখতাম। বছরে দুটো করে। আমি লিখতাম আমার জন্মদিনে, আর ও লিখত ওর জন্মদিনে। তখন তো আর মোবাইল কিংবা ইন্টারনেটের সময় নয়, যে চাইলেই কথা হবে! তাই আমাদের সবকিছু যেন ঠাঁই পেত চিঠির আদরে। আমি ২৪ পৃষ্ঠা লিখলে, ও লিখত ২৫ পৃষ্ঠা।

আর দেখাও হত বছরে দু'বার কি তিনবার। আমাদের অনুভূতিরা যতই কাছাকাছি আসছিল, আমাদের দেখা হওয়ার প্রয়োজনীয়তাটা ততই কমে যাচ্ছিল। একজনের ভাবনার অপূর্ণতা যে অন্যজন পূর্ণ করে দিতে জানি! ওর ঘরটা আমার দেখার খুব শখ-একদিন জানালাম ওকে। জানতাম, ওর ঘরে কারোরই প্রবেশাধিকার নেই। ও সাফ না করে দিল।

এত শক্ত করে কেউ না করে? আমি মৃদু তিরষ্কার করলাম। 'তুই তো লৌহমানবী'। ও হাসল। বললো, 'আচ্ছা যা, একদিন দেখাব'। ওর ঘরে ঢুকে, আমি বাকরূদ্ধ।

পুরো সাদা একটা ঘর, এমনকি আসবাব গুলোও সাদা। একপাশে একমানুষ সমান একটা আয়না। খাটটা রয়েছে ঘরের মাঝখানে। বিশাল। অনায়াসে দশজন মানুষের ঠাঁই হবে।

আমি বললাম, 'এত্ত বড়'? ও বললো, ফুটবল টিম বানানোর ইচ্ছে আছে। ঘরের কোনে কি একটা ঝুলছে। আমি ওকে জিগ্যেস করলাম, 'ওটা কি'? রূপাই বললো, 'ওটা তোর'। -'আমার তাহলে ঝুলিয়ে রেখেছিস কেন? দিয়ে দিলেই পারিস!' -উঁহু। এখন দেবনা।

এই বলে সে মিটিমিটি হাসতে লাগলো। আমি চুপ। ও বললো, 'তোর জন্য ওই শান্তিনিকেতনী ব্যাগটা কিনে রেখেছি। যেদিন দেখব, তোকে দিয়ে কিচ্ছু হবেনা, ওই ব্যাগটা তোর হাতে দিয়ে দেব। ভেতরে একটা ডায়েরী আছে।

আর যাবার সময় একপ্যাকেট সিগারেট, একটা দেয়াশলাই, আর কিছু জারুল ফুল দিয়ে দেব। ' এই টুকু বলে সে উঠে গিয়ে ব্যাগটাতে হাত বুলিয়ে এল। তারপর বলল, তুই এটা নিয়ে দক্ষিণ দিক বাদে, যে কোন দিকে হাঁটতে শুরু করবি। যতক্ষণ না সমুদ্রের দেখা পাস, থামবিনা। তারপর সমুদ্রের সামনে বসে, এই ডায়েরীটা পুরো করে চিঠি লিখবি আমাকে।

আমি বললাম, 'দক্ষিণের সমুদ্র কি দোষ করল'? ও বললো, 'দক্ষিণে তো চেনা সমুদ্র'। 'তোর দরকার অচেনা সমুদ্র'। আমি বললাম, 'তোর চিঠি নে'। ও বলল, 'চিঠি দিয়ে, তুই চলে যা'। -'আমার খুব দেখার ইচ্ছে, আমার চিঠি তুই কিভাবে পড়িস'।

-'দেখতে হবেনা'। এখন যা তুই'। আমি চলে আসছিলাম। পেছন থেকে ও ডাকল, 'শোন'। আমি দরজার কাছে গিয়ে ঘুরে তাকালাম।

রূপকথা বললো, 'আমার একটা সাদা ড্রেস আছে জানিস? আমি তোর চিঠি পড়ার সময়, ওই ড্রেসটা পড়ি। তারপর খাটের মাঝখানে বসে তোর চিঠি খুলি। একবার পড়ি, তারপর কুটি কুটি করে ছিঁড়ে ফেলি চিঠিটা। তারপর আমার চারপাশে বিছানায় ছড়িয়ে দেই। সাদা বিছানার উপর, ছেঁড়া চিঠির টুকরো গুলোকে আমার জুঁই ফুলের মত মনে হয়।

জানিস, আমি সেই ফুলের গন্ধও পাই!' এইটুকু বলে, সে বলল, চিঠি পড়া দেখতে চেয়েছিলি না? এবার নিশ্চয়ই দেখতে পাবি'! 'Close your eyes & try to see.' আমি কিছু না বলে চলে এলাম। কখনো কখনো না বলাতেও অনেক বেশি কিছু বলা হয়ে যায়। আমি উদভ্রান্তের মত ঘুরতে থাকি রাস্তায় রাস্তায়। রূপকথার মৃত্যুসংবাদ শুনলাম যখন, তখন আমি ঢাকায়। আমার এক বন্ধু এসে খবরটা দিল।

কেন যেন অবাক হলাম না। কে জানে, হয়তো অবচেতন মন গোপনে প্রস্তুত হয়ে আছে! -কি হয়েছিল? -'জ্বর। সন্ধ্যা থেকে। রাতে হঠাৎ করে এত বেড়ে গেল, ডাক্তারের কাছে নেবার আগেই শেষ। ' আমার বন্ধু বললো, 'চল, যাবিনা'? রূপাকে এখনো কবরে নামানো হয়নি।

তোর জন্য সবাই অপেক্ষা করছে'। আমি বললাম, না। আমি যাব না। -'কি বলছিস, ভেবে বলছিস? পরে কিন্তু আফসোস করবি! শেষ দেখা। ' আমি বললাম, 'এখন যদি না দেখতে যাই, তাহলে আমাদের শেষবার যখন দেখা হয়েছিল, ওটাই তো শেষ দেখা হবে-তাইনা? আমি রূপকথার জীবিত মুখটাই মনে রাখতে চাই'।

তুই যা। আমার বন্ধু চলে গেল। আমার তখন প্রচন্ড ঘুম পাচ্ছিল। আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। পরিশিষ্টঃ রূপকথার মা'র সাথে একদিন দেখা হয়ে গেলো আচমকা।

খালাম্মা আমাকে দেখেই কেঁদে ফেললেন। বললেন বাসায় এস। ওইদিন সন্ধায় গেলাম ওদের বাসায়। খালাম্মা একথা সেকথার পর বললেন, 'বাবা, তুমি চিঠিতে কি এত লিখতে যে, রূপা পড়ে চিৎকার করে কাঁদতো?' আমি বললাম, 'রাস্তায় যদি কখনো হোঁচট খেতাম, তাহলে আমি আমার ব্যাথার কথা না লিখে, পাথরটির ব্যাথার কথা লিখতাম'। খালাম্মা বললেন, ওর রূমে যাবে? আমি মাথা নেড়ে সায় জানালাম।

খালাম্মা রূম খুলে দিলেন। বললেন, 'প্রতিদিন ঘরটা পরিষ্কার রাখি। মেয়েটা খুব গোছানো ছিল তো!' আমার'ও তাই মনে হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল, হয়তো রূপকথা কাছেই আছে! এক্ষুণি এসে পড়বে! আমার চোখ পড়লো ঘরের কোনে। ব্যাগটা আছে ওখানেই।

চুপচাপ তাকিয়ে আছি ব্যাগটার দিকে। কানে ভাসছে রূপকথার শেষ কথা গুলোঃ 'দক্ষিণে তো চেনা সমুদ্র'। 'তোর দরকার অচেনা সমুদ্র'।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।