সম্প্রতি ইউএসএআইডি প্রকাশিত 'সার্পোটিং জেন্ডার এন্ড আইসিটি: ওপারচুনিটি ফর দ্য উইম্যান অব বাংলাদেশ" শীর্ষক এক গবেষণাপত্রে উল্লেখ করা হয় আইসিটি বা টেলিযোগাযোগ খাতে নারীর সক্রিয় অংশগ্রহণ নারীর ক্ষমতায়ন ও সম-অধিকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে অবশ্য গুরুত্বপূর্ণ। তাছাড়া এ খাতে অংশগ্রহণে নারীর অভিজ্ঞতা, বিশেষত তথ্য প্রযুক্তিগত দক্ষতার প্রসার ঘটে, যা অর্থনৈতিক গতিপ্রবাহে নারীর অংশগ্রহণ বৃদ্ধি করে৷ এমনকি আইএলও রিপোর্ট-২০০১ এ অর্থনীতির উর্ধমুখী লেখচিত্রের সঙ্গে আইসিটিকে সামঞ্জস্য করে যে নিবন্ধটি উপস্থাপন করা হয়, সেখানেও নারীর অংশগ্রহণকে অতি গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বিবেচনা করা হয়৷ বিশ্ব গবেষণার এ তথ্য বাংলাদেশের ক্ষেত্রে কতোটা সামঞ্জস্য- এটা অন্য আলোচনা; তবে মানব উন্নয়নের সঙ্গে প্রযুক্তির উঠাবসা সংক্রান্ত গবেষণার এ দখিনা হাওয়া আমাদের একেবারেই ছুঁয়ে যায়নি- এ বক্তব্য কিছুতেই মেনে নেবার নয়৷ পাঠক, চোখ এখনই কপালে তুলবেন না, চলুন পড়ে নেয়া যাক আমাদের গাইবান্ধা সংবাদদাতা মশিয়ার রহমান খান ও গোলাম রসূল মারুফের এবারের মহিলা অঙ্গনের মূল ফিচারটি৷
সময়টা পাঁচশত বছর আগে, যখন রূপকথার গল্পের যুগ৷ রাজকন্যার ঘুম ভাঙাতে পঙ্খীরাজে উড়ে আসে রাজপুত্র, সোনার কাঠি-রূপার কাঠির ছোঁয়ায় জেগে উঠে রাজকন্যা৷ আর এখন সময়টা একবিংশ শতাব্দী, যুগটা তথ্য প্রযুক্তির৷ রাজকন্যারা এখন জেগে উঠেছে৷ পঙ্খীরাজে নয়, সাইকেলে চড়ে মানুষের পাশে এসে দাঁড়াচ্ছেন তারা, সঙ্গে তথ্য প্রযুক্তির জাদুর কাঠি। সে-ই রাজকন্যারা গাইবান্ধার সাঘাটা উপজেলার মানুষগুলোর কাছে হয়ে উঠেছেন 'তথ্য আপা'৷
সেদিন সকালে 'তথ্য আপা'র সনে
বসন্তের সকাল, বেশ পরিস্কার৷ সাঘাটা উপজেলার খামার ধনারুহা গ্রামের একটি বাড়ির আঙিনায় 'তথ্য আপা'র জন্য অপেক্ষা করছিলেন কয়জন নারী। এদের সবাই বিভিন্ন রোগ, গর্ভবতী মায়ের সমস্যা ও পরিবার পরিকল্পনা বিষয়ে কথা বলবেন 'তথ্য আপা'র সঙ্গে। কিছুক্ষণের মধ্যেই 'তথ্য আপা' রীতা আখতার সাইকেলে করে এসে পৌছলেন সেখানে৷ মাটিতে মাদুর বিছিয়ে বসে পড়লেন সবাই, মাঝখানে 'তথ্য আপা'৷ হাতে ল্যাপটপ৷ এক এক করে সবার সমস্যা শুনলেন তিনি৷ ল্যাপটপ ঘেঁটে সে সমস্যার সমাধান বের করে তাদের দিলেন৷ কাউকে দিলেন মুখে বলে আর কাউকে কাগজে লিখে৷ আর যে সমস্যার সমাধান ল্যাপটপ ঘেঁটে পেলেন না, দ্রুত হাতে তা টাইপ করে নিলেন ল্যাপটপে৷ কার্যালয়ে ফিরে বিশেষজ্ঞের মতামত সংগ্রহ করবেন ঐ বিষয়ে ৷ আর দু-একদিন পর সে সমস্যার সমাধান পৌঁছে দিবেন কাংক্ষিত প্রশ্নকর্তার কাছে৷
যে পথে যেভাবে যাত্রা শুরু
গ্রামের পশ্চাত্পতদ জনগোষ্ঠীকে ক্ষমতায়নের স্রোতে এক করার লক্ষ নিয়ে সাঘাটা উপজেলার মুক্তিনগর ও সাঘাটা ইউনিয়নের ২০টি গ্রামে ২০০৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে 'উদয়ন পল্লী তথ্য কেন্দ্র' কাজ শুরু করে৷ প্রকল্পটি বাস্তবায়নে বেসরকারি উন্নয়নমূলক সংস্থা 'উদয়ন'কে প্রযুক্তিগত সহায়তা দেয় ডি-নেট৷ আর আর্থিক সহযোগিতা করে 'মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন' ৷ বস্তুত এ সম্মিলনেই এগিয়ে যাচ্ছে মূল কার্যক্রম ৷ 'পল্লীতথ্য কেন্দ্র' স্থাপনের উদ্দেশ্য হচ্ছে স্বাস্থ্য, শিক্ষা, কৃষি, আইন, মানবাধিকার, দুর্যোগ ও সরকারি সেবাসহ মোট দশটি বিষয়ে জনগণের কাছে তথ্য পৌঁছে দেয়া ৷ এ জন্য ল্যাপটপে রয়েছে একটি তথ্য ভান্ডার ৷ এ প্রকল্প বাস্থবায়নের মূল ভূমিকায় যারা রয়েছেন তাদের দাপ্তরিক পদবী ইনফো-লেডি ৷ তবে দু ইউনিয়নের সব মানুষের কাছে তারা 'তথ্য আপা' বলে পরিচিত৷ প্রকল্পের আওতায় দুজন 'তথ্য আপা' বিশটি গ্রামে তথ্য সরবরাহের কাজ করে থাকেন৷ আর সমগ্র প্রকল্পটির তদারকের দায়িত্বে রয়েছেন একজন কেন্দ্র কর্মকর্তা ৷
'তথ্য আপা'দের দিনলিপি
বেসরকারি উন্নয়নমূলক সংস্থা 'উদয়ন' অফিসে স্থাপিত পল্ল তথ্য কেন্দ্র থেকে ল্যাপটপ নিয়ে সকাল নয়টার মধ্যে গ্রামে বেড়িয়ে পড়েন 'তথ্য আপা'রা ৷ তারপর হাজির হন কোনো এক গ্রামে ৷ কিছুক্ষণের মধ্যে জড়ো হতে থাকেন ঐ গ্রামের নারীরা ৷ নিজেদের সমস্যার কথা তুলে ধরেন তারা ৷ তথ্য আপা ল্যাপটপে রক্ষিত তথ্য ভান্ডারে খোঁজেন সে সমস্যার উত্তর৷ সঙ্গে সঙ্গে পেয়ে গেলে স্বস্তি ৷ মুখে জানিয়ে দেন কিংবা লিখে দেন সমস্যার সমাধান ৷ আর ল্যাপটপের তথ্য ভান্ডারে যে সমস্যার সমাধান থাকে না তা ল্যাপটপে লিখে আনেন 'তথ্য আপা' ৷ ই-মেইল করে পাঠান ডি-নেট ঢাকাস্থ কার্যালয়ে ৷ ডি-নেট তাদের নির্ধারিত বিশেষজ্ঞের সমাধানসহ দু-এক দিনের মধ্যেই তা ই-মেইলেই জানিয়ে দেন প্রত্যন্ত গ্রামে অবস্থিত তথ্য কেন্দ্রে এবং সে সমস্যার উত্তর যথারীতি 'তথ্য আপা'র মাধ্যমে পৌঁছে যায় সে-ই প্রশ্নকর্তা নারীর কাছে৷ বাড়িতে বসেই এ প্রত্যন্ত অঞ্চলের নারীরা পেয়ে যান সব সমস্যার সমাধান৷ কোথাও ছোটাছুটি করতে হয় না তাদের৷
সব তথ্য, সবার জন্য
শুধু নারীরাই নয়, পুরুষরাও যে কোনো সমস্যা নিয়ে কথা বলতে পারেন 'তথ্য আপা'র সঙ্গে ৷ কৃষি সমস্যার সমাধানও দিয়ে থাকেন তারা ৷ এমনিভাবে গত তিনবছরে মুক্তিনগর ও সাঘাটা ইউনিয়নের বিশ গ্রামের লোকজন, বিশেষ করে নারীদের কাছে 'তথ্য আপা' একজন প্রয়োজনীয় ব্যক্তি হয়ে উঠেছেন৷ তাই যে কোনোদিন যে কোনো সময় 'তথ্য আপা'র দেখা পেলেই আনন্দিত হয়ে উঠেন বিশ গ্রামের মানুষ৷ কারণ আর চিন্তা নেই, সমস্যা যেখানে, সমাধান নিয়ে সেখানেই হাজির 'তথ্য আপা'৷
'তথ্য আপা'দের কল্যাণে এখন মানুষ নানা রকম সমস্যার সহযোগিতা খুঁজে পাচ্ছেন, খুঁজে পাচ্ছেন নানামুখী তথ্য ৷ ফলে গ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষের কাছে তথ্য প্রযুক্তি হয়ে উঠছে এক পথ নির্দেশিকা ৷ এ বিষয়টি বর্তমানে কয়েকটি নির্দিষ্ট এলাকাতে সীমাবদ্ধ আছে, তবে সারা বাংলাদেশে ছড়িয়ে দেবার জন্যে প্রয়োজন সরকারি সহযোগিতা ৷ সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগের সমন্বিত প্রয়াসে এ প্রযুক্তি নির্ভর সেবা সারা বাংলাদেশে ছড়িয়ে দেয়ার কার্যক্রম গ্রহণ করা আবশ্যক৷ এতে একদিকে যেমন সমস্যা সমাধানে গ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলে তথ্য প্রবাহ থাকবে, তেমনি নারীর কর্মসংস্থানের যোগে, নারীর ক্ষমতায়নের তৈরি হবে নব মাত্রা ৷ সেদিনের প্রত্যাশায় চোখ রেখে সামনে তাকালে কতো সুন্দরই না মনে হয় ভবিষ্যতকে৷
(ফিচারটি আমাদের কার্যক্রমের উপর লেখা, যা গতকাল ০৩-০৪-২০১০ দৈনিক ইত্তেফাকে প্রকাশিত হয়েছে। ফিচারটির লিংক )
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।