স্বাধীনতা নিয়ে কিছু একটা লিখতেই হবে ,নিজের ভিতরে এ এক অদ্ভুত তাগিদ । কি লিখব , কিভাবে লিখব কোথা থেকে শুরু করব কিছুই ঠিক করতে পারছিনা । স্বাধীনতা যুদ্ধে আমার নিজের অভিগ্ঞতা নাকি খাঁচার পাখিটি যেদিন ছেড়ে দিলাম সেদিনের কথা দিয়েই শুরু করব আজ আমার এই স্বাধীনতার উপাখ্যান !
যুদ্ধের অভিগ্ঞতার কথা যদি বলি ,তখন খুবই ছোট ছিলাম । বৈগ্ঞানিক মতে ঐ বয়সের স্মৃতি কালের গর্ভে বিলীন হ’য়ে যাবারই কথা তবু ও ঘটনার তীব্রতা বা আকষ্মিকতার কারণে আমার স্মৃতির বইএর প্রথম পাতা জুড়েই ভুঁই ফোরের মত জেগে আছে দু একটি ছিন্ন বিচ্ছিন্ন ঘটনা । না তেমন বিশেষ কিছুই না ।
সবাইকে নিয়ে দুরের কোন গ্রামে চলে যাওয়া ,হঠাত করে কোন হেলিকাপটারের শব্দ শুনে হুড়মুড় করে কোন গুহার ভিতর ঢুকে যাওয়া । আচ্ছা তখন কি আমার গুহায় থাকতে ভালো লাগত নাকি সারা আকাশ জুড়ে আলোড়ন তোলা সেই বাহনটিকে দেখতে মন চাইতো?তবে হ্যাঁ একবার আমি বের হয়ে এসেছিলাম চুপি চুপি একা একা । কেন? মনে নেই । শুধু মনে আছে বিশাল এক জন্গল কিম্বা বাগান , ছোট বড় নানা রকম গাছগাছালি, কিছুটা অন্ধকার কোথাও কেউ নেই , ছোট্ট এই আমি দুহাতে ফ্রকের কুচি শক্ত করে ধরে কেমন অসহায় আর বিভ্রান্তের মত খুঁজে বেড়াচ্ছি কাউকে । কাকে আবার ? মামণিকে ।
মামণির সাহায্য ছাড়া অতটুকুন ছোট্ট মেয়ে কিছুই যে করতে পারে না । আজ ও আমি চোখ বুঁজলেই সেই অসহায় বিভ্রান্ত শিশুটিকে দেখতে পাই ।
আর খাঁচার পাখী ছেড়ে দেবার যে কথাটি বলেছিলাম , সেটাতো সেদিনের ঘটনা । পৃথিবীতে সোনার খাঁচার ও যেমন অভাব নেই ,সোনার দানার ও নেই কোন অভাব । সোনার পাখী সোনার খাঁচায় সোনার দানা খায়-- আহা, কত কাব্যিক ।
কিন্তু এমন একটি দৃশ্য আমার হৃদস্পন্দন বন্ধ করার উপক্রম করে । নিজেকে পরাধীন মনে হয় অমানবিকতার কাছে । আবার সেই অসহায় আর বিভ্রান্ত শিশুটি এসে ভর করে আমার মাঝে । কিনতু বললেই কি আর হয় ! তবে সেবার হয়েছিল - সোনার পাখীর সোনার খাঁচা খুলে দেবার সেই স্বর্ণালী সুযোগ । দিলে কী হবে পাখী যে উড়তে ভুলে গিয়েছে ।
বনের পাখীরা কিচির মিচির করে ওকে কি বলছে ওই জানে । খাঁচার পাখি বলে, ‘হায় মোর শকতি নাহি উড়িবার’। শুধু ছটফট করছে আর ফিরে ফিরে আসছে খাঁচাটির কাছে । অবশেষে অরিন্দম --মিলে গেল মিশে গেল হাওয়ার সাথে সাথে । আহা কি আনন্দ আকাশে বাতাসে ।
এলো স্বাধীনতা -- মানুষের পাখীর প্রকৃতির ।
একটি রাষ্ট্রের স্বাধীনতা ও ঠিক তেমনি । স্বাধীনতা ও সার্ব্ ভৌমতার সহ অবস্থান জরুরী । ভৌগলিক স্বাধীনতা অর্জ্ ন করলেই যে সার্বভৌমত্ব অর্জিত হয়ে যাবে তেমন কিনতু না । অশিক্ষা কুশিক্ষা অভাব থেকে মুক্তি এলেই আসে সার্বভৌমত্ব ।
আসে শোষণ থেকে মুক্তি । ফিরে আসে আত্ম গরিমায় গর্বিত সেই মহান রত্ন আত্মসন্মান বোধ । সার্বভৌমত্বের জন্য আরো বেশী সাধনা প্রয়োজন । ঠিক খাঁচার পাখীটির মত পরাধীনতার বিষ বাষ্প গ্লানি রন্ধ্রে রন্ধ্রে বাঁধে বাসা।
আমাদের দেশের দিকে যদি আমরা তাকাই দেখতে পাব পরাধীনতার স্বাধীনতা পরাধীনতার রাহু গ্রাস ।
আমরা আজ ও সেই দুশো বছরের বৃটিশ শাষণ তার’পর পাকিস্তানীদের শোষণের প্রভাব থেকে বের হয়ে আসতে পারিনি । এখন ও আমরা নিজেরা নিজেদেরকে প্রতিভাবান বা সৃষ্টিশীল ভাবতে ভয় পাই । যতক্ষণ পর্যন্ত না একজন বিদেশী এসে স্বীকৃতি দেন । আমরা ভাষার জন্য যুদ্ধ করেছি কিন্তু(নাকি সে জন্যেই , বিদেশীদের দ্বারা অবদমিত হয়েছিল বলে) অনেকেই ‘বাংলা জানি না’ বলতে গর্ব্ বোধ করি । কে কত ইংরেজী জানি বা অন্য দেশীয় ভাষা জানি তা নিয়ে গর্বিত হই ।
আমি বলছি না । বিদেশী ভাষা আমরা শিখবনা । বিশেষ করে এই বিশ্বায়নের যুগে ইংরেজী তো শিখতে ই হবে নিজেকে আন্তর্জাতিক মানে উন্নিত করার জন্য । বিকিয়ে দেবার জন্য নয় । হাতে হাত ধরে বন্ধুর মত চলা আর কারো আধিপত্য মেনে নেওয়া কখনোই এক কথা নয় ।
ফ্রান্সের কেউ সহজে মুখ থেকে ইংরেজী শব্দ বের করে না । ইংরেজী উচ্চারণে ফ্রেন্চ, প্রশ্নই আসে না । আমরা বিকৃত উচ্চারণে বাংলা বলি। একজন বিদেশী যেভাবে বলে সেভাবে বলতে চেষ্টা করি। এটা হীণমন্যতারই পরিচয় ।
পৃথিবীর অন্যান্য দেশে এর উল্টোটা ঘটে । ওরা পারলে ও অন্যের ভাষা নিজের মত করে বলে । । বৃটিশরা যশোর কে jessore বলতো । ঢাকা কে Decca. আমি অনেক বাঙালীকে , এখন ও যশোর কে য়েশোর বলতে শুনেছি ।
অবচেতন মনে সে এখন ও পরাধীন ।
আমরা সুযোগ পেলেই অন্যকে দোষারোপ করি আমাদের ব্যর্থতার জন্য । এ অপসংস্কৃতি নিয়ে এলো ও আমাদের রসাতলে ডুবিয়ে দিল এমন কত কী ! নিজের ভূমিকা ও দায়িত্ব হীনতার কথা এড়িয়ে যাই । কেন আমাদের নতুন প্রজন্ম নিজস্ব সংস্কৃতি থেকে দূরে সরে যাচ্ছে ? হাজারো কারণ আছে তবে যদি আমরা মূল কারণটি কি গভীর ভাবে ভেবে দেখি উত্তরে সে একই--পরাধীনতার রাহু গ্রাস । আমরা অবচেতন মনে চাই আমাদের সন্তান বাঙালি না হোক--সে জাতে উঠুক যা খুশী তাই হোক বাঙালী না হোক ।
কচি শিশুর মুখ থেকে বাংলা শব্দ বের হলে উচ্ছাসিত হয়ে তাকে উতসাহিত করার পরিবর্তে হা করে তার মুখের দিকে তাকিযে থাকি । কান পেতে রই কখন একটি ইংরেজি শব্দ সে বলবে । ওই যে শুরু হ’লো বাবা মাকে খুশী করতে বাংলাকে অবগ্ঞা করা সেটা সে ধারণ করে চলে নিজের অজান্তেই ।
আমরা বাইরে লোকদেখানো হা হুতাশ করি । মনে মনে খুশী ই হই কিম্বা প্রকাশ্যে গর্ব্ করে বলি দেশ এখন অনেক উন্নত হয়ে গিয়েছে সবাই ইংরেজী বলে ইটালিয়ান খাবার খায় মেয়েরা জিন্স পড়ে, কিছু কিছু পার্টিতে গেলে তো বোঝার ই উপায় নেই ওটা বাংলাদেশ না আমেরিকা ।
এই হচ্ছে আমাদের উন্নতির মাপকাঠি । । একটি মেয়ের পশ্চিমের পোষাক পড়লো নাকি দক্ষিণের পোষাক পড়লো সেটা জরুরী নাকি তার সামাজিক অর্থনৈতিক অবস্থান নিজস্ব ও সামাজিক মূল্যবোধ বেশী জরুরী ?পশ্চিমা দুনিয়ার খোলস পড়ে আমরা কোথায় , কতদূর যেতে চাই? কোথায় তাদের মূল্যবোধ আর কোথায় আমাদর মূল্যবোধ । কেন এ বৈষম্য ? হীণমন্যতা । কেন এ হীণমন্যতা? পরাধীনতা ।
শিকলের দাগ আমাদের অস্থিমজ্জায় মিশে আছে । হৃদয়ের গহিনে তার বসবাস । স্বাধীনতা শুধুই একটি শব্দ নয় শুধু ই একটি মানচিত্র নয় । একটি অনুভূতি যাকে অনুভব করতে হয় সমস্ত হৃদয় দিয়ে । ধারণ করতে হয় চেতনায় তবেই তাকে ভোগ করা যায় ধরে রাখা যায় ।
হতাশ হবার কিছু নেই । ঠিক খাঁচার পাখীটির মত , একদিন আমরা ও ।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।