আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সিক্সে পড়ার বয়স !



সিক্সে পড়ার বয়স ! গুণীজন বলে থাকেন শিক্ষার কোন বয়স নেই। এ মর্মে একটি হাদিসেও বলা হয়েছে যে, দোলনা থেকে কবর পর্যন্ত শিক্ষা বা জ্ঞান অর্জন কর। তবে পৃথিবী প্রায় সব দেশেই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার একটি বয়স আছে। যতদূর জানি আমাদের দেশে প্রথম শ্রেণীর জন্য ছয়ের অধিক (৬+) বয়সকে স্ট্যান্ডার্ড বয়স হিসাবে ধরা হয়। ইউরোপের অধিকাংশ দেশে শিক্ষা শুরুর বয়স হলো ৬ এবং ৭।

তবে ঢাকা শহরের স্বনামধন্য স্কুলগুলোর চিত্র ভিন্ন। বয়স লুকিয়ে সেখানে বয়স্ক শিশুকেই ভর্তি করা হয়। এটি করা হয় মূলত ভর্তি যুদ্ধে বিজয়ী হওয়ার জন্য। বয়স লুকানোর সংখ্যা কত হবে তা সঠিকভাবে বলা মুশকিল তবে আমার ধারণা নাইনটি পার্সেন্ট তো হবেই। অভিভাবকগণ এটিকে কোন অনৈতিক কাজই মনে করেন না।

শুধু তাই না এ গলদ কাজটি করার জন্য একশ্রেণীর শিক্ষক ইন্ধন দিয়ে থাকেন। আমার বাচ্চাদের প্রকৃত জন্ম তারিখ দিয়ে যখন জন্ম নিবন্ধন করালাম তখন অনেকেই আমাকে বলদ ভাবতে শুরু করল। ভর্তি যুদ্ধের প্রায় একবছর আগ থেকেই বাসাবাড়িতে যুদ্ধাবস্থা বিরাজ করে। বাড়িতে আত্মিয়-স্বজনের আসা নিষেধ। উদ্বেগ উৎকন্ঠায় ভরপুর প্রতিটি মুহুর্ত।

বেচারা সৈনিকের কোচিং টু হাউজ মার্চ-প্যারেড করতে করতেই কাহিল অবস্থা। সৈনিকের মায়ের অবস্থা আরো কাহিল। নাওয়া নেই, খাওয়া নেই, কর্তার প্রতি খেয়াল নেই, শুধু যুদ্ধের পরিকল্পনা। ভাল শিক্ষক, মানসম্মত নোট, অব্যর্থ সাজেশন প্রভৃতি যুদ্ধাস্ত্র সংগ্রহ এবং অন্যান্য সেনাপতিদের সাথে নিয়মিত কূটনৈতিক যোগাযোগ রাখতে গিয়ে সৈনিকের মা'র ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা। এসব নিয়ে কর্তার কোন মাথা ব্যাথা নেই।

হয়তো বা সেনাপতি কখনো ক্লান্ত শরীরটাকে বিছানায় আলতোভাবে এলিয়ে দিয়ে ভাবে কেন যে ওকে পেটে ধরে ছিলাম! ভাল স্কুলে ভর্তির আশায় আমার মেয়েকে কোচিং এ ভর্তির জন্য পাঠালাম আমার বন্ধুর মেয়ের সাথে। বন্ধুর মেয়ের চেয়ে আমার মেয়ে দু'তিন মাসের বড়। তবে ওর চেয়ে বেশ লম্বা। এই লম্বার জন্য আমাকে ছোট বেলা বেশ মানসিক অত্যাচার সহ্য করতে হয়েছে। কারণ বাজার দরের চেয়ে বাড়ন্তের মাত্রা ছিল অনেক বেশী ফলে মাঝে মাঝেই কানে আসতো হায় হায় এতবড় ছেলে ক্লাস থ্রিতে পড়ে! তখন ভাবতাম শালার কেন যে বাট্টু হলাম না! এখন আমার মেয়েকেও এই মানসিক অত্যাচার সহ্য করতে হচ্ছে।

কোচিং এর ম্যাডাম দেখে শুনে আমার মেয়েকে দেখিয়ে বললেন ওকে দিন ক্লাস ফোরের জন্য আর বন্ধুর মেয়েকে দেখিয়ে বললেন ওকে দিন ক্লাস থ্রির জন্য। ম্যাডামকে বলা হলো, ওদের দু'জনের বয়সের তেমন পার্থক্য নেই। ম্যাডাম বললেন, আসলে ওতো গায়ে-গতরে বেশ বড় হয়ে গেছে তাই ওকে ফোরের জন্যই দিন। মেয়েকে ক্লাস ফোরের জন্যই কোচিং এ দিলাম। কিন্তু পড়া-শুনার প্রেসারের কথা ভেবে চিন্তিত ছিলাম আবার মেয়ের বাড়ন্তের গতি দেখেও চিন্তিত ছিলাম কারণ তাকে যে এই বেড়ে যাওয়ার জন্য অনেক কথা শুনতে হবে! আল্লাহর রহমতে মেয়েটি ভর্তি যুদ্ধে বিজয়ী হয়ে মতিঝিলের একটি স্কুলে ক্লাস ফোরে ভর্তি হয়।

এ জন্য আমি কোচিং এর ম্যাডামের নিকট চির কৃতজ্ঞ। মেয়েকে বলে দিলাম, মা ক্লাসের প্রথম বেঞ্চে বসবা এবং টিচারদের কথা মন দিয়ে শুনবা। কয়েকদিন পর মেয়ে বলল, বাবা ম্যাডাম আমাকে সামনের বেঞ্চে বসতে দেয় না। আমি নাকি বড় হয়ে গেছি তাই পিছনের ছোটদের (!) সমস্যা হয়। কিন্তু বাবা পিছনের বেঞ্চের মেয়েরা বেশী কথা বলে।

ওদের কথার জন্য ম্যাডামের কথা ঠিকমত শুনতে পারি না। আমার ভয় হয় বড় হওয়ার ভয়ে মেয়েটা আবার খাবার-দাবার বন্ধ করে না দেয়! কয়েকদিন পর রাতে খাবারের সময় মেয়ে বললো, বাবা আজ অন্যান্য মেয়েদের মায়েরা আমাকে দেখে বলল, এতবড় মেয়ে ক্লাস ফোরে পড়ে! হেসে বললাম, মা ওরা তো আর তোমার বয়স কত জানে না তাই একটু (?) ভুল করেছে। কিছু মনে করো না। ছোট বেলায় আমাকেও এরকম বলতো আমি কিছুই মনে করতাম না। এ কথা বলে মেয়েকে শান্তনা দিলেও মনে মনে ভাবলাম কতবড় সাঙ্ঘাতিক ননসেন্স ঐ অভিভাবকরা! এসব কথার যে মানসিক যন্ত্রনা তা আমি হারে হারে টের পাই।

তাই মেয়েকে বিভিন্নভাবে মানসিক সাপোর্ট দিয়ে যাচ্ছি। সাধারণত মানুষের বিশেষ করে বাচ্চাদের চেহারা, শরীরের গড়ন ও দাঁত দেখে এবং কন্ঠ শুনে বয়স আন্তাজ করা যায়। দিন তারিখ হুবহু না মিলাতে পারলেও যাদের মাথায় হালকা পাতলা ঘিলু আছে এবং তরকারি মুখে দিয়ে লবণের পরিমাণ বুঝতে পারে তারা কাছাকাছি বয়স বলতে পারে। এমনকি অনেকে পশু-পাখি দেখেই বয়স বলে দিতে পারে। তবে যাদের মাত্রাজ্ঞান কম তারা বহু কসরত করে গরু-ছাগলের দাঁত দেখেই তবে বয়স ঠাহর করে।

দু'চারদিন হলো মেয়ের ক্লাস পরীক্ষা শুরু হয়েছে। আমার মেয়ে পড়ে ডে শিফটে। মর্নিং শিফটের ম্যাডাম পরীক্ষায় গার্ড দিতে এসে সকলের সামনেই মেয়েকে বলল, এই মেয়ে তোমার তো সিক্সে পড়ার বয়স তুমি ফোরে পড়ছ কেন? মেয়েটির সহজ সরল উত্তর ম্যাডাম আমার বয়স কম, লম্বা হয়েগেছি। রাতে অফিস থেকে ফেরার পর মেয়েটি যখন আমাকে এসব কথা বলল, তখন হঠাৎ করে মেয়েকে শান্তনা দেয়ার ভাষা খুজে পাচ্ছিলাম না। এ কথা যে কত বড় মানসিক অত্যাচার তা কি ঐ মহান শিক্ষকের রাডারে একবারও ধরা পড়ে নি? কেন যে ননসেন্সগুলি শিক্ষকতার মত মহান পেশায় আসে তা ভেবে আমি চিন্তিত।

শুধুমাত্র জঠর জ্বালা নিবারনের জন্য শিক্ষকতার মত মহান পেশায় আসা উচিত নয়। সমবয়সীদের চেয়ে বেড়ে যাওয়ার দুঃখ কলেজে ভর্তি হওয়ার পর আমার জন্য আর্শিবাদ হয়ে দেখা দেয়। বিশেষ মহলে কদর বেড়ে যায়। যে উচ্চতার জন্য একসময় কষ্টবোধ হতো আজ সে উচ্চতার জন্য গর্ববোধ করছি। কলেজের বারান্দার ওয়ালে উচ্চতা মাপের জন্য কয়েকটি দাগ কেটে সেখানে দাড় করিয়ে ছেলেদের উচ্চতা মেপে হাবিলদার মুজিবর সাহেব বিএনসিসিতে ভর্তি করছেন।

বিমল বাবু স্যার পাশে দাড়িয়ে তদারকি করছেন। আমি দাড়াতেই হাবিলদার সাহেবের চোখ বড় বড় হয়ে উঠে এবং অপলক দৃষ্টিতে আমার মাথার দিকে তাকিয়ে আছেন হয়তো বা মনে মনে বলছেন, একি! সব দাগ ছাড়িয়ে, তালগাছ দাড়িয়ে! বিমল বাবু স্যারের দিকে মুজিবর সাহেব তাকাতেই স্যার হেসে উঠলেন। মনে মনে ভাবলাম এক সময়ের আমার কষ্টের উচ্চতা আজ আমার ছাতি উঁচু করে দিলো। আমার মেয়ের উচ্চতাও হয়তো বা কখনো তার জন্য আর্শিবাদ হয়ে দেখা দিবে কিন্তু ততদিনে ননসেন্স মানুষগুলোর মানসিক অত্যাচার থেকে সে রেহাই পাবে তো?

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।