সম্পাদকদের বিবেকের দায় ও কর্ণেল তাহের হত্যাকাণ্ডের বিচার
ফকির ইলিয়াস
===========================================
আমাদের চারপাশে এখন জমাট অন্ধকার। এই অন্ধকারের মাঝেই দেশের কয়েকজন
বিশিষ্ট সম্পাদক, জাতিকে আরও কালোধোঁয়া উপহার দিয়েছেন। তারা মাহমুদুর রহমান
নামক একজন সম্পাদকের মুক্তি দাবী করেছেন। না- আমি তাকে 'বাইচান্স এডিটর'
বলতে চাই না। তিনি সম্পাদক।
বিএনপি-জামাত সমর্থিত 'আমার দেশ' দৈনিকের
সম্পাদক। কেন তিনি জেলে ? কী করেছিলেন তিনি ? এ বিষয়গুলোর একঝলক
দেখা দরকার। তিনি পবিত্র ক্বাবা শরীফের গিলাফ পাল্টানোর দৃশ্যকে খুবই মিথ্যার
আশ্রয়ে সংবাদ ছেপেছিলেন। তিনি অনবরত তার দৈনিকে ধর্মীয় উসকানি দিয়ে লীড
নিউজ করেছিলেন। তিনি চরম মিথ্যা লিখে দেশের মানুষকে বিভ্রান্ত করে একটা
সামাজিক দ্বন্ধ তৈরি করার প্রয়াসী ছিলেন।
আমরা পাঠক হিসেবে সেগুলো দেখেছি।
আর আইনী ব্যবস্থার কথা ভালো জানে সরকার পক্ষ।
আমার কথা হচ্ছে- এই যে কাজগুলো তিনি করেছিলেন তখন কী ঐ মাননীয় ১৬ সম্পাদক তাকে বাধা দিয়েছিলেন ? এর বিপক্ষে জোরালো কলম ধরেছিলেন ?
না -ধরেন নি। তখন তাদের এই 'সহযোদ্ধা'র কর্মকাণ্ড কী তারা দেখেন নি ?
সম্পাদকদের বিবৃতির জবাবে দেশের বুদ্ধিজীবীরা কথা বলেছেন। তারা বলেছেন,
সম্পাদকবৃন্দ বিবেকবানের দায়িত্ব পালন করবেন সেটাই প্রত্যাশা।
তারা কী তা করেছেন ?
হেফাজতে ইসলামের প্রচার সম্পাদক আনম আহমদউল্লাকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, আপনি কী ব্লগের লেখাগুলো পড়েছেন ? এর জবাবে তিনি বলেন- “গণজাগরণ মঞ্চের ব্লগাররা মহানবী (স) এবং ইসলাম নিয়ে অবমাননাকর লেখা লিখেছেন বলে শুনেছি। আমি দেখিনি। কর্মীরা দেখেছেন। ব্লগাররা কী লিখেছে তা না দেখলেও পরে ‘আমার দেশ’ পত্রিকায় তা পড়েছি। সেখানে পড়েই আমরা জেনেছি যে, ব্লগাররা তাদের ব্লগে মহানবীকে (স) নিয়ে খারাপ কথা বলেছে।
”
ব্লগে গণজাগরণ মঞ্চের ব্লগারদের মহানবীর বিরুদ্ধে কোন লেখা আপনি নিজে পড়েছেন কিংবা দেখেছেন? এমন প্রশ্নের জবাবে তরুণ প্রজন্মকে নাস্তিক বলে আন্দোলনে নামা হেফাজতে ইসলামের প্রচার সম্পাদক আনম আহমদউল্লা এভাবেই বলছিলেন তাঁদের রাজপথে নামার কারণ। নিজে দেখেননি ব্লগারদের কোন লেখা, তবে আমার দেশে লিখেছে তা থেকেই আন্দোলন। তবে কেবল তিনিই নয়, এই সংগঠনসহ গণজাগরণ মঞ্চের বিরুদ্ধে আন্দোলনকারী ইসলামী দলগুলোর প্রতিটি নেতাকর্মীরই উত্তর একই। কেউ দেখেননি ব্লগাররা কী লিখেছে। প্রত্যেকেই বলছেন, আমি না অন্যরা দেখেছে।
কে দেখেছে তাও বলতে পারছেন না তাঁরা। এভাবেই মিথ্যা প্রচারের ওপর ভর করে দেশ ও বিদেশে যুদ্ধাপরাধীর পক্ষে চলছে নানা অপতৎপরতা।
পবিত্র ধর্ম ও মুক্তিযুদ্ধ, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, জামায়াত নিষিদ্ধের দাবিতে জেগে ওঠা তরুণ প্রজন্মসহ প্রগতিশীল আন্দোলন নিয়ে বিকৃত আর মিথ্যা তথ্য ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে বিশ্বব্যাপী। ধর্মের বিকৃত ব্যাখ্যা দিয়ে যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষে সাফাই গেয়ে শান্তিপ্রিয় সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করার অপকৌশল নিয়েছে জামায়াত-শিবির ও তার সহায়তাপুষ্ট দেশী-বিদেশী চক্র। স্বাধীনতাবিরোধী গণমাধ্যম, ফেসবুক, ব্লগ, টুইটারসহ বিভিন্ন ওয়েবসাইটে মিথ্যা তথ্য ছড়িয়ে ক্ষেপিয়ে তোলা হয়েছে সাধারণ মুসল্লিদের।
যুদ্ধাপরাধের বিচারের দাবিতে আন্দোলনরত বিভিন্ন ধর্ম, মত ও শ্রেণীপেশার লাখো কর্মী-সমর্থককে ‘নাস্তিক’ প্রমাণ করতে ব্যবহার করা হচ্ছে মিথ্যা তথ্য ও ছবি। ঘাতক সাঈদীকে চাঁদে দেখার অপপ্রচার চালিয়ে নৃশংসতাই শেষ নয়, করা হচ্ছে পবিত্র কাবা শরীফের ইমামদের ছবি জালিয়াতির মতো অপরাধ। ফেসবুকে জামায়াত-শিবিরের পক্ষে একটি ভিডিও পোস্ট করা হয়েছে। ‘পবিত্র কাবা শরীফে সাঈদী সাহেবের জন্য হাজীদের দোয়া’ হিসেবে ভিডিওটিকে উপস্থাপন করা হয় । এসব কাজের নেপথ্য নায়ক কারা - তা খুঁজে দেখার সময় এসেছে।
যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ইস্যুতে পবিত্র কাবা শরীফের ইমামদের মানববন্ধন- এমন মিথ্যা সংবাদ প্রকাশের ঘটনা ঘটেছে আমার দেশ ও সংগ্রাম পত্রিকায়। পরে সোস্যাল মিডিয়ায় চাতুরীর বিষয়টি ধরা পড়ে গেলে সংবাদ দুটি অনলাইন থেকে প্রত্যাহার করে নেয় পত্রিকা দুটি। আমার দেশের সপ্তম পাতায় নিউজটির শিরোনাম ছিল- ‘আলেমদের নির্যাতনের প্রতিবাদে কাবার ইমামদের মানববন্ধন। ’ পত্রিকাটির অনলাইন সংস্করণেও দেখা যায় সংবাদটি। এছাড়া জামায়াতের মুখপত্র দৈনিক সংগ্রাম পত্রিকার অনলাইনেও এ বিষয়ে সংবাদ ছাপা হয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়, বিতর্কিত ট্রাইব্যুনালের নামে বাংলাদেশের আলেমদের ওপর যে নির্যাতন চলছে তার প্রতিবাদে বাদ জুমা কাবার খতিব বিখ্যাত ক্বারী শাইখ আবদুর রহমান আল সুদাইসির নেতৃত্বে মানববন্ধন করেছে ইমাম পরিষদ। ’ এই সংবাদের সঙ্গে আরবী ব্যানার হাতে একটি ছবিও ছাপা হয়। এরপর নাসিম রূপক নামে ব্লগার ও ফেসবুক এ্যাক্টিভিস্ট “যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচাতে ‘দৈনিক আমার দেশ’ ও ‘সংগ্রাম’ পত্রিকার নির্লজ্জ মিথ্যাচার” শিরোনামে ফেসবুকে একটি নোট লেখেন। তিনি অনুবাদ করে দেখিয়ে দেন, যে পত্রিকা থেকে ছবিটি নেয়া হয়েছে তার নিচের ক্যাপশনে আরবীতে স্পষ্ট ভাষায় লেখা আছে ঈদ-উল-আযহা উপলক্ষে খতিব পবিত্র কাবা শরীফের গিলাফ পরিবর্তন করছেন। এরপর দৈনিক সংগ্রাম তাদের সংবাদটি প্রত্যাহার করে দুঃখ প্রকাশ করে।
আমার দেশ তাদের লিংক থেকে সংবাদটি সরিয়ে ফেলে। এভাবে মিথ্যার বেসাতি সাজিয়েছিলেন
এই মাহমুদুর রহমান। দেশের মহান সম্পাদকরা কী তার পরও এই মাহমুদুর রহমানের
বিচার না চেয়ে মুক্তি দাবী করবেন ? এভাবেই ভুলুন্ঠিত হবে জাতির বিবেক ?
॥ দুই ॥
কিছু কিছু সংবাদ আছে গোটা জাতিকে আশান্বিত করে। উজ্জীবিত করে। তেমনি একটি সংবাদ গোটা জাতিকেই বিশেষভাবে আপ্লুত করেছে।
বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী ও বিচারপতি শেখ মো. জাকির হোসেনের আদালতে ২০১১ সালের ২২ মার্চ দেয়া কর্ণেল তাহের হত্যাকাণ্ডের রায়ের পূর্ণাঙ্গরূপ গেল সোমবার প্রকাশিত হয়েছে।
বীর মুক্তিযোদ্ধা কর্নেল তাহেরের মৃত্যুর ৩৪ বছর পর সামরিক ওই বিচারের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ২০১০ সালের ২৩ অগাস্ট হাইকোর্টে রিট আবেদন করেন তাহেরের স্ত্রী লুতফা তাহের, ভাই আনোয়ার হোসেন, আরেক ভাইয়ের স্ত্রী ফাতেমা ইউসুফ।
প্রকাশিত রায় থেকে এই জাতি জেনেছে,কর্নেল আবু তাহেরকে হত্যার পরিকল্পনা করেই সামরিক আদালতে তার বিচার সাজিয়েছিলেন জিয়াউর রহমান।
বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর দেশের রাজনীতির ওই যুগসন্ধিক্ষণে গোপন আদালতে ওই বিচারকে অবৈধ ঘোষণা করে হাই কোর্টের দেয়া রায়ের অভিমতে একথা বলা হয়েছে।
মাননীয় আদালত বলেছেন,তৎকালীন সামরিক শাসক জিয়াউর রহমানের পরিকল্পনায় মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার তাহেরকে বিচারের নামে ঠাণ্ডা মাথায় হত্যা করা হয়েছিলো।
আদালত রায়ে বলেছে, জিয়া জীবিত না থাকায় তার বিচার সম্ভবপর না হলেও সরকারের উচিত হবে এই হত্যার জন্য দায়ী কেউ জীবিত থাকলে তাকে খুঁজে বের করে হত্যার দায়ে অভিযুক্ত করা।
এই মামলায় অন্যতম প্রমাণ হিসেবে খ্যাতিমান সাংবাদিক লরেন্স লিফশুজের বক্তব্য এবং বিএনপি নেতা মওদুদ আহমদের লেখা বিবেচনায় আনা হয়েছে।
ব্যারিস্টার মওদুদের ‘ডেমোক্রেসি অ্যান্ড চ্যালেঞ্জ অব ডেভেলপমেন্ট : এ স্টাডি অব পলিটিক্যাল অ্যান্ড মিলিটারি ইন্টারভেনশন ইন বাংলাদেশ’ বইয়ের উল্লেখ করে রায়ে বলা হয়েছে, বইয়ে লেখক মওদুদ আহমদ অত্যন্ত প্রাঞ্জল ভাষায় ব্যক্ত করেছেন যে, এই বিচারের ট্রাইব্যুনাল গঠনের অনেক আগেই জেনারেল জিয়াউর রহমান পাকিস্তান ফেরত সামরিক অফিসারদের তুষ্ট করার জন্য কর্নেল তাহেরকে ফাঁসি দেয়ার মনস্থির করেছিলেন।
আমরা জানি, ইতিহাসের গতি কোনভাবেই মিথ্যা দিয়ে চাপিয়ে রাখা যায় না। সত্য প্রকাশিত হয়।
হতেই হয়। তা না হলে মনুষ্য জাতি নির্ভীক চিত্ত নিয়ে বেঁচে থাকতে পারে না। পরবর্তী প্রজন্ম সৎ সাহস নিয়ে দাঁড়াতে পারে না। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, যে জিয়াউর রহমানকে বন্দিদশা থেকে মুক্ত করেছিলেন কর্নেল তাহের, সে তাহেরকে তথাকথিত গোপন বিচার, সামরিক কোর্ট মার্শালের মাধ্যমে ফাঁসি দেওয়া হয় এবং রায় প্রদানের পর চরম বিশ্বাসঘাতকতার আশ্রয় নিয়ে মাত্র ৭২ ঘণ্টার মধ্যে রায় কার্যকর করা হয়।
পেছন ফিরে তাকালে দেখা যাবে, ১৫ আগস্টের নির্মমতম হত্যাকান্ডের পর সেনাবাহিনীর উপপ্রধান জিয়াউর রহমান বলেছিলেন, 'সো হোয়াট, ভাইস প্রেসিডেন্ট ইজ দেয়ার'।
সে সময়ে বাংলাদেশের ভাইস প্রেসিডেন্ট ছিলেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম। ঘাতকচক্র জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেই ক্ষান্ত হয়নি, তারা ক্ষমতার পালাবদলে ডানপন্থি মৌলবাদী শক্তিকে সার্বিক পুনর্বাসনে ছিল সর্বাত্মকভাবে তৎপর।
জিয়াউর রহমান প্রথমে যে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছিলেন, যদি তা পালিত হতো তবে সৈয়দ নজরুল ইসলামই ক্ষমতাসীন হতেন। বিদ্রোহী সেনাসদস্যদের তাৎক্ষণিক বন্দি করা সম্ভব হতো। ওদের বিচার হতো।
কিন্তু দেখা গেল খুব দ্রুতই তার মতামত থেকে সরে আসেন জিয়াউর রহমান। তিনি হাত মেলান খুনি ডালিম-রশীদ-হুদা চক্রের সঙ্গে। যদিও ডালিম-ফারুক চক্র পরে টিভি সাক্ষাৎকারে বলেছে, তারা জিয়াকে আগেই ১৫ আগস্টের ক্যুর কথা জানিয়ে রেখেছিল। ষড়যন্ত্রকারী মীরজাফর খন্দকার মোশতাকের শাসন সেজন্যই ছিল খুব ক্ষণস্থায়ী। প্রকৃত কুশীলবরা বেরিয়ে এসেছিল হ্যাঁ-না ভোটের মাধ্যমে।
খুনিদের বিদেশে পাঠানোর নিশ্চয়তা প্রদান করে রাষ্ট্রক্ষমতা পাকাপোক্ত করার সব ব্যবস্থাই করতে তৎপর ছিলেন জিয়াউর রহমান।
কর্নেল আবু তাহের মূলত ভয়ের কারণ ছিলেন সেই ক্ষমতালিপ্সুদের। তারা জানত তাহের বেঁচে থাকলে তাদের দীর্ঘমেয়াদি ক্ষমতায় থাকার পরিকল্পনা ভেস্তে যেতে পারে। তারা ক্ষমতায় টিকে নাও থাকতে পারে। সে কারণেই প্রহসনের বিচারের আয়োজন করে তাহেরসহ অন্যান্য দেশপ্রেমিক মুক্তিযোদ্ধা সৈনিকদের হত্যা করেছিল স্বৈরশাসক জিয়া সরকার।
তাহেরের সঙ্গে জিয়ার বৈরিতার প্রধান কারণ ছিল তাহের মৌলবাদী রাজাকার শক্তির সঙ্গে কোন আঁতাত মেনে নিতে চাননি। আর জিয়া সেই আঁতাতই করতে চেয়েছিলেন। যার কুফল আজও ভোগ করছে গোটা জাতি। গোটা বাংলাদেশের মানুষ।
কর্নেল তাহের হত্যাকাণ্ড কেন বেআইনি ঘোষণা হবে না- তা দাবি করাটা ঐতিহাসিক এবং নৈতিক দায়িত্বও ছিল বটে।
তাহের এ বাংলাদেশের গণমানুষের স্বপ্ন পূরণে ছিলেন অগ্রণী সৈনিক। যুদ্ধাহত হওয়ার পরও তার উদ্যম ও স্পৃহার কোন কমতি ছিল না।
বাংলাদেশে মৌলবাদী শক্তির দাপট বাড়াবার মূল কারণ হচ্ছে, ক্ষমতায় যাওয়া ও টিকে থাকা। আমরা মিডিয়ায় দেখছি, বিলাতে তারেক রহমান আবার সক্রিয় হয়ে
হেফাজতের পক্ষে কথা বলা শুরু করেছেন।
এটা গোটা দেশবাসীই জানেন, মতলব তাদের অন্যখানে।
তারা চায় ঘোলাজলে মাছ শিকার করে পুরো জাতির একাত্তরের বিজয় ইতিহাসটাকেই পাল্টে দিতে। একাত্তরে পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতে। আমরা দেখেছি, যেসব রাজাকার -আলবদর ঘাপটি মেরে বসেছিল, তারা প্রকাশ্যে বেরিয়ে আসে পঁচাত্তরের নির্মম হত্যাকান্ডের পর।
কালো চশমা পরা সেই জেনারেল কি তার জীবদ্দশায় কখনো বলেছিলেন,
তিনি স্বাধীনতার ঘোষক ?
না, বলেন নি। একজন মহানায়কের পক্ষে একজন সৈনিক সে ঘোষনা পাঠ করেছিলেন মাত্র।
তিনি ই তাই ঘোষক হয়ে গেলেন ?
অন্যের চিঠি কেউ পাঠ করে শোনালে , সে কি চিঠির লেখক হয়ে যায়?
না , হয় না।
জে. জিয়া সেই স্বৈরশাসক যিনি ক্ষমতায় যাবার জন্য চরম বিশ্বাসঘাতকতা
করে তারই একজন ত্রাণকর্তা কর্নেল তাহের কে ফাঁসিতে ঝুলান।
শত শত সেনা অফিসারকে হত্যা করেন , গোপনে- বিনা বিচারে।
সেসব কথা বাংলার মানুষ ভুলে যান নি। যাবেন ও না কোনোদিন।
এই সেই জিয়া , যিনি বলেছিলেন - প্রেসিডেন্ট ইজ ডেড , সো হোয়াট ?ভাইস প্রেসিডেন্ট ইজ দেয়ার !
তার আসল চরিত্র ক্রমশঃ প্রকাশ হতে থাকে।
৩ নভেম্বর ১৯৭৫ ঘটানো হয় নির্মমতম জেল হত্যাকান্ড।
এই হত্যাকান্ডের মূল উদ্দেশ্য ছিল , এরা যদি জেল থেকে বেরিয়ে রাজনৈতিক ভাবে আওয়ামী লীগ কে সংগঠিত করে তোলেন !
জে সফিউল্লাহ যা পারেন নি , সেই পাল্টা অভ্যুত্থানে এগিয়ে আসেন সেক্টর কমান্ডার খালেদ মোশাররফ।
তিনি বুঝতে পারেন , জিয়াই সেই নেপথ্যের নায়ক , যে ঘোলাজলে মাছ
শিকার করে সুবিধা নিতে চাইছে।
তিনি যে অভ্যুত্থান টি ঘটিয়েছিলেন , তা স্থায়ীত্ব পেলে দেশ আবার জাতির জনকের চেতনায়ই ফিরে যেতো।
মাত্র ছ'দিনের মাঝে ঘটে যায় অনেক ঘটনা।
খালেদ মোশাররফ ও অন্যান্য দেশপ্রেমিক মুক্তিযোদ্ধা সেনা অফিসাররা ১৫ আগস্টের হত্যাকান্ডের প্রতিবাদেই করেছিলেন এই পাল্টা অভ্যুত্থান।
এখানে যে বিষয়টি আরও প্রাসংগিক , তা হচ্ছে - এ সময়ে দেশের
সমাজতন্ত্রপন্থীরা মনে করেন দেশ টি তার মূলধারা গনতন্ত্র, সমাজতন্ত্র,
ধর্মনিরপেক্ষতা , জাতীয়তাবাদ - এ পরিচালিত হোক।
এই চেতনা নিয়ে এগিয়ে আসেন কর্নেল তাহের।
তিনি খালেদ মোশাররফ গ্রুপের হাতে বন্দী জিয়াউর রহমান ও তার
অনুসারীদেরকে মুক্ত করে আনেন।
এই ঘটনাটিই ঘটে ৭ নভেম্বর ।
প্রতিবিপ্লবী খুনী চক্রের নেতা জিয়া মুক্ত হয়েই পাল্টা অভ্যুত্থানের জোর তৎপরতা চালান।
শুরু হয় সকল দেশপ্রেমিক মুক্তিযোদ্ধা হত্যা। কতজন সৈনিক হত্যা করা
হয়েছিল সেদিন ? সে সময়ে ?
সেই খুনের ষড়যন্ত্র থেকে রেহাই পান নি স্বয়ং কর্নেল তাহের ও।
তাঁকেও ফাঁসি দেয়া হয় প্রহসনের বিচারের নামে ।
কি ছিল তার অপরাধ ? তিনি জিয়া কে মুক্ত করার নেতৃত্ব দিয়েছিলেন ?
জিয়া জানতেন , তাহের বেঁচে থাকলে তার সামরিকীকরণ প্রকল্প
ব্যাহত হতে পারে ।
৭ নভেম্বর যদি খালেদ মোশাররফ রা জয়ী হতেন , তা হলে আজ বাংলা
দেশের প্রেক্ষাপট অন্যরকম হতো।
ডানপন্থী মদদপুষ্ট জাতীয়তাবাদী আর রাজাকার চক্ররা ঐক্যবদ্ধ হয়ে
ঘাপটি মেরে বেড়ে উঠতে পারতো না।
এই দেশে এভাবে বৃদ্ধি পেতো না জংগীবাদ, মৌলবাদ, সাম্প্রদায়িক শক্তির বিস্তার।
রাজাকার শাহ আজিজ, মশিউর রহমান যাদু মিয়া, আব্দুল আলীম, খান এ সবুর এর মতো কুখ্যাত রাজাকারদেরকে কেবিনেটে টেনেছিলেন , ক্ষমতায়
টিকে থাকার জন্য।
আর তার জায়া খালেদা জিয়া নিজামী- মুজাহিদ নামের দুই কুখ্যাত রাজাকারকে মন্ত্রী বানিয়ে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদী সাধনায় সিদ্ধি লাভে ব্রত হন !
আজ হাইকোর্টে যে রায় হয়েছে সেই রায় ঐতিহাসিক। এই রায় সত্যের
পক্ষে গণমানুষের প্রত্যাশা।
যারা জাতির জনক শেখ মুজিবের নাম মুছে দেবার চেষ্টা করছে , তারা
নতুন নয়। এরা সেই পরাজিত শক্তি। এরা সেই দানব- যারা আজো
লাখো শহীদের রক্তকে , লাখো মা-বোনের সম্ভ্রম কে তুচ্ছ-তাচ্ছল্য করে।
জিয়া স্বাধীনতার ঘোষক - এর চাইতে নির্লজ্জ মিথ্যাচার বাংলাদেশের
ইতিহাসে আর কিছুই নেই। জিয়া এজজন সেক্টর কমান্ডার । এটাই তার শুরুর পরিচয়। এর চেয়ে বেশী কিছু নয় ।
আমি সবিনয়ে সেইসব সম্মানিত সম্পাদকদের অনুরোধ করি- আপনারা মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় শাণিত হোন।
' কাকে কাকের মাংস খায়না' এই জপমালা
গলে ঝুলিয়ে যাকে-তাকে সমর্থন দেবার আগে ভাবুন লোকটি কী করছে ! যা করছে- তা এই জাতির জন্য, এই ধর্মীয় চেতনাবোধ সম্পন্ন মানুষদের জন্য কল্যাণকর কী না। এদেশে কর্ণেল তাহের নতি স্বীকার করেন নি। তাঁর শংকাহীন চিত্ত
এদেশের কোটি প্রজন্মের প্রেরণা হয়ে আছে। তাই কেউ কলম হাতে নিয়ে মিথ্যা লিখলে,
কিংবা মিথ্যা গলাবাজি করে বিবৃতি দিলে তা এই প্রজন্ম মেনে নেবে না। #
-------------------------------------------------------------
দৈনিক ভোরের কাগজ/ ঢাকা / ২৫ মে ২০১৩ শনিবার প্রকাশিত
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।