শান্তিতে নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সামাজিক ব্যবসার আওতায় ২০০ কোটি টাকা (প্রায় ২০ মিলিয়ন ইউরো) বিনিয়োগ করতে চেয়েছিল জার্মানির খ্যাতনামা শিল্পগোষ্ঠী অটো। বস্ত্র খাতে বিনিয়োগের জন্য ২০১১ সালে গ্রামীণ অটো টেক্সটাইল নামের একটি কোম্পানি গঠনেরও উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। কথা ছিল, গ্রামীণ ট্রাস্টের সঙ্গে যৌথ বিনিয়োগের এই কোম্পানি রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাক কারখানা করবে। এ নিয়ে ২০১১ সালের নভেম্বরে দুই পক্ষের মধ্যে চুক্তিও হয়।
এর আগে প্রকল্পটি এগিয়ে নেওয়ার জন্য অটো গ্রুপের চেয়ারম্যান মাইকেল অটো বাংলাদেশে সফরে এসেছিলেন।
কিন্তু সরকারের অনুমতি না পাওয়ায় জার্মানির ২০০ কোটি টাকার এই বিনিয়োগ প্রস্তাবটি ফিরে গেছে।
বিদ্যুৎসাশ্রয়ী এলইডি বাতি কারখানা স্থাপনের জন্য গ্রামীণ শক্তির সঙ্গে যৌথ বিনিয়োগে আগ্রহী ছিল জার্মানিভিত্তিক আরেক খ্যাতনামা প্রতিষ্ঠান স্নেইডার ইলেকট্রনিকস। ২০১২ সালের জুন মাসে দুই পক্ষের মধ্যে একটি সমঝোতা সইও হয়। কিন্তু যৌথ মূলধনী কোম্পানি ও ফার্মসমূহের নিবন্ধকের কার্যালয় থেকে নিবন্ধন নিতে গেলেই বিপত্তি বাধে। আর নিবন্ধন মেলেনি।
একইভাবে গত বছর ফাইবার গ্লাস কারখানা নির্মাণের জন্য বাংলাদেশে বিনিয়োগ করতে চেয়েছিল বাহরাইনের প্রকৌশল খাতের প্রতিষ্ঠান আইইএস এলায়েন্স বাইরাইন। এ জন্য আইইএস-গ্রামীণ ফাইবার গ্লাস লিমিটেড নামে কোম্পানি খোলার উদ্যোগ নেওয়া হয়। কিন্তু যৌথ মূলধনী কোম্পানি ও ফার্মসমূহের নিবন্ধকের কার্যালয় থেকে প্রতিষ্ঠানের নামকরণের অনুমোদন পাওয়া যায়নি। ফলে সামাজিক ব্যবসার সেই উদ্যোগও অগ্রসর হয়নি।
এভাবেই ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সামাজিক ব্যবসার আওতায় ‘গ্রামীণ’ নাম নিয়ে কোনো বিদেশি বিনিয়োগের অনুমোদন দেওয়া হচ্ছে না।
ফলে বিদেশি খ্যাতনামা কোম্পানিগুলো বিনিয়োগ প্রস্তাব ফিরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।
দায়িত্বশীল সূত্রে জানা গেছে, গ্রামীণ নামধারী প্রতিষ্ঠানের নিবন্ধন দেওয়া বন্ধ রেখেছে যৌথ মূলধনী কোম্পানি ও ফার্মসমূহের নিবন্ধকের কার্যালয়। ডেস্ক কর্মকর্তারা এ ধরনের কোনো আবেদন রাখছেন না বলে অভিযোগ উঠেছে। এমনকি গ্রামীণ নাম দিয়ে অনলাইনে কোনো ‘নেইম ক্লিয়ারেন্স’ পাওয়া যাচ্ছে না। গত দেড় বছরে গ্রামীণ নামধারী কোনো প্রতিষ্ঠানকেই নিবন্ধন দেওয়া হয়নি।
যৌথ মূলধনী কোম্পানি ও ফার্মসমূহের নিবন্ধকের কার্যালয়ের নিবন্ধক বিজন কুমার বৈশ্য প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা যেকোনো গ্রামীণ নামধারী প্রতিষ্ঠানের নিবন্ধন দেওয়া বন্ধ রেখেছি। কেননা, গ্রামীণ ব্যাংক ও এর সহযোগী প্রতিষ্ঠানগুলো নিয়ে তদন্ত করতে একটি কমিশন কাজ করছে, যা অনুসন্ধান আইনের (দ্য কমিশন অব ইনকোয়ারি অ্যাক্ট, ১৯৫৬) আওতায় গঠিত। এই কমিশনের কাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত আমরা গ্রামীণের নতুন কোনো প্রতিষ্ঠানের নিবন্ধন দিতে পারি না। ’
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও গ্রামীণ ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান আকবর আলি খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘এভাবে বিদেশি বিনিয়োগ আসতে না দিলে সামাজিক ব্যবসা বাধাগ্রস্ত হবে। আর আমাদের মতো দেশে স্থানীয় বিনিয়োগে সামাজিক ব্যবসা খুব একটা হয় না।
’
বোর্ড সদস্যের শিক্ষাগত যোগ্যতা: গ্রামীণ ব্যাংক পরিচালনা পর্ষদের সদস্য হতে ন্যূনতম শিক্ষাগত যোগ্যতা বেঁধে দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এ জন্য আইএফআইসি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম শাহ আলম সারওয়ারের নেতৃত্বে অর্থ মন্ত্রণালয় একটি নতুন কমিটি গঠন করে দিয়েছে। এই কমিটি গ্রামীণ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের নির্বাচন-পদ্ধতি সংস্কার বিষয়েও প্রতিবেদন দেবে। এসব বিষয়ে গ্রামীণ ব্যাংক কমিশন কিছু সুপারিশ করেছিল। সেসব সুপারিশ পর্যালোচনা করে আগামী জুন মাসে প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য নতুন কমিটিকে বলা হয়েছে।
পরিচালনা পর্ষদের সদস্য হতে কমপক্ষে স্কুল ও মাদ্রাসার কোনো পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার বাধ্যবাধকতা থাকার সুপারিশ করেছিল কমিশন। বর্তমানে গ্রামীণ ব্যাংকে প্রতি তিন বছর অন্তর একযোগে নয়জন পরিচালক নির্বাচন করা হয়। নতুন সুপারিশ অনুযায়ী, প্রতিবছর তিনজন করে পরিচালক নির্বাচিত হবেন। আর নির্বাচন পরিচালিত হবে গ্রামীণ ব্যাংকের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নন এমন কারও নেতৃত্বে।
সহযোগী প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে তদন্ত: গ্রামীণ ব্যাংকের পর এবার সহযোগী অন্য সব প্রতিষ্ঠান নিয়ে তদন্তে নেমেছে গ্রামীণ ব্যাংক কমিশন।
গত ২৮ ফেব্রুয়ারি এসব প্রতিষ্ঠানকে কমিশনের কার্যতালিকায় আনা হয়েছে। গ্রামীণ ব্যাংকের দরিদ্র সদস্যদের কল্যাণে সহযোগী প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ করছে কি না, তাই তদন্ত করে দেখছে কমিশন।
কমিশন সূত্রে জানা গেছে, ইতিমধ্যে সব সহযোগী প্রতিষ্ঠানের তথ্য চেয়ে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের চিঠি দেওয়া হয়েছে। এমনকি গ্রামীণ ভিয়োলিয়া ওয়াটার লিমিটেড, গ্রামীণ ড্যানোন ফুডস লিমিটেডের মতো বিদেশি যৌথ বিনিয়োগের কোম্পানির কাছেও তথ্যও চাওয়া হয়েছে। চিঠিতে গ্রামীণ ব্যাংকের সহযোগী সব প্রতিষ্ঠানের কাছে প্রতিষ্ঠার পর থেকে পরিচালনা পর্ষদের সভাসমূহের কার্যবিবরণী ও বার্ষিক নিরীক্ষা প্রতিবেদন চাওয়া হয়েছে।
নির্ধারিত সময়ের মধ্যে তথ্য না দিলে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার কথাও বলা হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে আকবর আলি খান মত দেন, গ্রামীণ ব্যাংকের সহযোগী প্রতিষ্ঠানগুলো কোম্পানি আইনে গঠিত। এগুলো সরকারের অংশীদারে প্রতিষ্ঠিত কোম্পানি নয়। কোম্পানি আইনেই তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া যেত। কিন্তু এখন যে প্রক্রিয়ায় ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে, তা দুর্ভাগ্যজনক।
দুই বছরে এমডি নিয়োগ হয়নি: ২০১১ সালের জুলাই মাসের পর বিগত দুই বছরেও গ্রামীণ ব্যাংকে ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) নিয়োগ করা যায়নি। এমনকি এমডি নিয়োগের জন্য বাছাই কমিটি গঠন করা সম্ভব হয়নি। মূলত গ্রামীণ ব্যাংকের চেয়ারম্যান খন্দকার মোজ্জামেল হকের পছন্দমতো বাছাই কমিটি অনুমোদনে আপত্তি জানিয়ে আসছেন পরিচালনা পর্ষদের সদস্যরা।
এ অবস্থায় ২০১২ সালের আগস্টে গ্রামীণ ব্যাংক অধ্যাদেশ সংশোধন করা হয়। পরিচালনা পর্ষদের সদস্যদের সঙ্গে আলোচনা করে বাছাই কমিটি করার ক্ষমতা দেওয়া হয় চেয়ারম্যানকে।
গত সেপ্টেম্বর মাসে পরিচালনা পর্ষদের সভায় ঋণগ্রহীতা নারী সদস্যদের আপত্তি সত্ত্বেও একতরফাভাবে বাছাই কমিটি গঠন করা হয়। জাতিসংঘের সাবেক কর্মকর্তা শামসুল বারীকে বাছাই কমিটির প্রধান করা হয়।
গত ১১ নভেম্বর এমডি নিয়োগের জন্য গণমাধ্যমে বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়। এই বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের পর এর কার্যকারিতার বিরুদ্ধে গ্রামীণ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সদস্য মোছাম্মৎ তাহসিনা একটি রিট করেন। ২৬ নভেম্বর এমডি নিয়োগের ওপর দুই মাসের নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন উচ্চ আদালত।
গত ২৬ জানুয়ারি এই নিষেধাজ্ঞার মেয়াদ শেষ হয়েছে। এরপর আর কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।
এ প্রসঙ্গে মোছাম্মৎ তাহসিনা প্রথম আলোকে বলেন, গ্রামীণ ব্যাংক এত দিন ড. ইউনূসের নেতৃত্বে সফলভাবে পরিচালিত হয়েছে। তাই তাঁর ওপরেই দায়িত্ব থাকা উচিত উত্তরসূরি নির্বাচনের।
নিয়মিত কার্যক্রমেই সীমাবদ্ধ গ্রামীণ ব্যাংক: ড. মুহাম্মদ ইউনূস চলে যাওয়ার পর নিয়মিত কার্যক্রমেই সীমাবদ্ধ হয়ে গেছে গ্রামীণ ব্যাংক।
প্রতি তিন মাসে একটি সভা হওয়ার কথা থাকলেও ২০১২ সালের জানুয়ারি মাস থেকে এ পর্যন্ত পরিচালনা পর্ষদের মাত্র চারটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। সর্বশেষ সভাটি অনুষ্ঠিত হয়েছে ১৪ ফেব্রুয়ারি। এসব বৈঠকে নীতিনির্ধারণী আলোচনা খুব একটা হয়নি। প্রতিটি সভায় ব্যবস্থাপনা পরিচালক নিয়োগে বাছাই কমিটি গঠনে আলোচনা হলেও পর্ষদ সদস্যদের আপত্তির মুখে তা ভেস্তে যায়। এ ছাড়া বেতন-ভাতা, পদোন্নতি নিয়ে কিছু সিদ্ধান্ত হয়েছে এসব সভায়।
সর্বশেষ হিসাবে, ২০১১ সালে গ্রামীণ ব্যাংকের মুনাফাও কমে গেছে। জানা গেছে, ২০১০ সালে ৭৫ কোটি ৭২ লাখ টাকা মুনাফা করেছিল গ্রামীণ ব্যাংক। পরের বছর সাত কোটি টাকা কমে মুনাফা দাঁড়ায় ৬৮ কোটি ৩৫ লাখ টাকায়। গ্রামীণ ব্যাংকের আর্থিক হিসাব করা হয় জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর মাস ধরে।
এসব বিষয়ে কথা বলার জন্য চেষ্টা করা হলেও প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান খন্দকার মোজাম্মেল হকের সঙ্গে কথা বলা যায়নি।
তাঁর ফোন ক্রমাগত বন্ধ পাওয়া যায়। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।