Miles to go before I sleep.....
১.
রাতে ঘুম হয়নি একদম। দুপুরে ঘুমিয়ে ছিলাম ঘন্টাখানেক, তাই রাতে ঘুম আসবেনা সেটা জানতাম। সামু'র ব্লগার সিহাবের সাথে চ্যাটে বিভিন্ন কথাবার্তা বলতে বলতে রাত ৪টা বেজে গেছিল, সকালে ৭টার আগে উঠতে হবে ফজরের নামাজ ধরার জন্য। আবার ৯টায় ক্লাশ, তাই ফজরের নামাজের পর ঘুমানো যাবেনা। ক্লাশে সারাক্ষণ ঝিমুলাম, দুপুরে বাসায় এসে ঘুমাতে চেষ্টা করলাম অনেকক্ষন কিন্তু ঘুম আসেনি।
সন্ধা ৭টার দিকে স্কয়ার স্টুডেন্ট সেন্টারে গ্রুপ-মিটিংয়ে গেলাম। ঘুম ঘুম ভাব তাড়ানোর জন্য কফি নেওয়ার জন্য গেলাম কফিশপে। অর্ডার দিচ্ছি সেসময় পিছন থেকে মেয়ে একটা "নো" বলে আমার হাতটা টান দিল।
পিছনে ফিরে তাকালাম, এমেরিকান মেয়ে। প্রশ্নচোখে তাকালাম।
বলল "আমি তোমার বিল পে করব। "
আমি মেয়েটাকে চিনিনা, কোনদিন দেখা হয়নি, সেও আমাকে চিনেনা।
"তুমি পে করবে?" জিজ্ঞেস করলাম।
সারামুখে হাসি ছড়িয়ে বলল "হ্যাঁ, আমি পে করব। "
জিজ্ঞেস করলাম "কেন?"
"এম্নিতে" বলল সে।
"কোন বিশেষ অকেশান নাকি? তোমার বার্থডে?"
"না না, সেরকম কিছুনা। আই'ম জাস্ট ফিলিং জেনারাস টুডে। "
আমি চোখ ঘুরিয়ে বললাম "আমার মনে হয় তুমি কিছু লুকাচ্ছ। তুমি কি আজকে প্রেমে পড়েছ বা তুমি যাকে পছন্দ করতে সে তোমাকে প্রেম নিবেদন করেছে?"
"হাহহাহাহহা....." হাসল সে সারারুম কাঁপিয়ে "না, আসলে কোন অকেশান না, বিশ্বাস কর। এম্নিতে আমি প্রতি সপ্তাহে কোন একদিন কফিশপে এসে কয়েকজন র্যান্ডম লোককে খাওয়াই।
আজকে র্যান্ডম সিলেকশানে তুমি পড়ে গেছ"
"অ, তাই বল। "
আমি কথা বলতে বলতে কফির দাম পরিশোধ করে দিছি, খেয়াল না করেই।
"একি, তুমি তো তোমার কফির বিল পরিশোধ করে দিলা?" সে একটু মন খারাপ করেই যেন বলল।
"অ, তাই তো। খেয়াল ছিলনা।
একটা কাজ কর তুমি আমাকে একটা স্মুদি কিনে দাও। স্ট্রবেরি। "
"ঠিকাছে। সেটাই ভাল। কিন্তু শুধুই স্মুদি? নাকি আরো কিছু নেবে?"
"না না, আমার আসলে ক্ষিধে নেই এখন।
শুধুই স্মুদি চলবে। "
"দেখ, পরে আবার পস্তাবা। আর কিছু খাবা কিনা দেখ। "
"হাহাহাহ, পস্তালে তো তুমি আছই। শুধু স্মুদিই চলবে।
"
"ঠিকাছে, আমি এখানে আছি আজ রাত ১০টা পর্যন্ত। তোমার আর কিছু খেতে ইচ্ছে হলে চলে এস। "
"ঠিকাছে। "
স্মুদির জন্য দাড়ালাম। সে অন্য একজনকে কি খাবে জিজ্ঞেস করতেছে।
তবে অন্য একজন আমার মত অবাক হয়নি। ছেলেটা মনে হয় মেয়েটার এই পাগলামো আগেই জানত হয়ত। সে হেসে হেসে কি খাবে বলতেছে। মেয়েটার চোখেমুখে স্বর্গীয় আভা ভাসতেছে।
২. এখানে আসার আগে অন্য জায়গায় (অন্য স্টেটে) ছিলাম।
ভিনিস ছিল আমার রুমমেইট। আমার শেষ সেমিস্টারেই সে এসেছিল। আমাকে নামাজ পড়তে দেখে সে জিজ্ঞেস করেছিল কি করতেছিলাম। তাকে বুঝিয়ে বললাম। সে বলল তার মা ও নাকি মুসলিম।
তবে তার মা'র সাথে তার বাবার কোনদিন বিয়ে হয়নি, সে জন্ম হওয়ার অনেক পরে তার মা মুসলিম হয়ে যায়। সে তার নানীর হাতে মানুষ। ভিনিস আফ্রিকান আমেরিকান। অসম্ভব মোটা। প্রায়ই মনে করে জিমে যাবে, রেড মিট খাওয়া বাদ দিবে।
কিন্তু করতে পারেনা। আমার সাথে খুবই ভাল সম্পর্ক হয়ে গেল কিছুদিনের মধ্যেই। পিৎজা আনলে সে আমার জন্য রেখে দিত। যখন জানল আমি হালাল ছাড়া খাইনা, তখন থেকে শুধু পাপা-জনসের ভেজি পিৎজাই আনত।
গ্রেজুয়েশানের জন্য গেস্ট হিসেবে তাকে একটা টিকিট দিলাম।
সে টিকিটটা পেয়ে যারপরনাই আশ্চর্য্যান্বিত। আমার গায়ে ঝাঁপ দিয়ে পড়ল, জড়িয়ে ধরল। এমেরিকানদের বিখ্যাত হাগিং। আমার নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসার উপক্রম, আমার দ্বিগুন কোন মানুষ ঝাঁপ দিয়ে গায়ে পড়লে নিশ্বাস বন্ধ না হয়ে উপায় নেই। জড়িয়ে ধরেই কান্নাকাটি করতেছে, বলতেছে সে মোটা, দেখতে বিশ্রী, তবুও আমি তাকে আমার গ্র্যাজুয়েশানের জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছি গেস্ট হিসেবে, সে কোনমতেই বিশ্বাস করতে পারতেছেনা।
অনেকক্ষণ পর ছাড়ল, দেখলাম চোখে পানি। ঈশ্বর তোমার মংগল করুন, বারবার সে বিরবির করতে লাগল।
গ্র্যাজুয়েশানের দিন সকালবেলা তার রুমে নক করলাম, সে নাই। একটা কাগজে আমি কোন বিল্ডিংয়ে থাকব সেটা লিখে তার দরজায় লটকে দিলাম। গ্র্যাজুয়েশানের পর বন্ধু-বান্ধব সবাই মিলে ছবি তুললাম।
হাসাহাসি, প্রফেসর ক্লার্কের সাথে টিপিকাল মশকরা সবই চলল। অনেককে আর সারাজীবনে একবারও দেখবনা। আমি তেমন সেন্টিমেন্টাল না, জীবনকে নিস্পৃহভাবে দেখতে চেষ্টা করি। কিন্তু অনেকেই দেখি খুব সেন্টিমেন্টাল আচরন করতেছিল। ইথিওপিয়ার আমারা তো কান্নাকাটিই শুরু করল।
এত কিছুর মধ্যে ভিনিসের কথা মনেই ছিলনা। সন্ধ্যার সময় এসে ভিনিসকে দেখে মনে পড়ল।
জিজ্ঞেস করলাম "কি, তুমি যাওনি কেন?"
বলল, "গিয়েছিলাম, তোমাকে তোমার বন্ধুদের সাথে ছবি তুলতে দেখেছি। খুব ভাল লাগতেছিল তোমাদের আনন্দ দেখে। "
"কিন্তু কাছে যাওনি কেন? আমি তো তোমাকে দেখিনি।
তুমি কাছে গেলে ছবি তুলতে পারতাম। "
"না, আসলে মনে হয়েছে সেখানে তুমি বন্ধুদের নিয়ে আনন্দে ছিলে। আমি বিশ্রী মহিলা গেলে তুমি হয়ত বিব্রত বোধ করবে। "
আমি খুবই আশ্চর্য্য হয়ে গেলাম। কি বলব ভেবে পেলাম না।
শুধু বললাম "তুমি বিশ্রী সেটা যদি আবার আমার সামনে বল তাহলে আমি তোমাকে খুন করে ফেলব। তুমি খুবই সুন্দর একজন মানুষ, বাইরের সৌন্দর্য্য তো কয়দিনের। ১০ বছর আগে যেসব মেয়ে সুন্দরি ছিল তাদেরকে এখন দেখ কিরকম হয়েছে। কেট উইন্সলেটকে দেখ টাইটানিকে ১০ বছর আগে আর দ্যা রিডারে ১০ বছর পরে। তুমি কিন্তু সারাজীবন সুন্দর থেকে যাবে, কারন তোমার মন সুন্দর।
"
চোখ ছলছল করে তাকাল আমার দিকে। মনে হল আবার গায়ে ঝাঁপিয়ে পড়বে। একটু ভয়ে ভয়ে ছিলাম। মাহফুজ, তুমি খুব সুন্দর করে কথা বল, বলেই ঝাঁপিয়ে পড়ল। নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে আমার আবার!
কয়েকদিন পরেই চলে আসলাম ভাইয়ার কাছে।
আসার সময় ভিনিসের সাথে দেখা হয়নি। কয়েকদিন পরে ফোন করে বলল যখনই সেখানে যাই, তার বাসায় যেন উঠি। আবার ফোনে কান্নাকাটি করল। বলল "মাহফুজ, তোমার দেশের সব মানুষ কি ভাল?"
"হ্যাঁ" আমি বললাম "আমার দেশের সব মানুষই ভাল"।
"তোমার চেয়েও ভাল?"
"হ্যাঁ, আমার দেশের সব মানুষ আমার চেয়ে ভাল।
"
"আমি তোমাদের দেশ অবশ্যই দেখতে যাব। "
"তোমাকে আমন্ত্রণ জানিয়ে রাখলাম। "
তেমন যোগাযোগ নাই এখন ভিনিসের সাথে। বন্ধুত্ব রক্ষা করার ক্ষেত্রে আমি খুবই বাজে, খোঁজ-খবর নেওয়া হয়ে উঠেনা একদমই। সে মাঝে মাঝে ইমেইল করে, আমি জবাব দেব দেব করে আর দেওয়া হয়না।
৩.
আগের বিশ্ববিদ্যলয়ে থাকাকালীন রান্নাবান্না খুবই কম করতাম। আমার রুমমেইটও ছিল চরম অলস। দুজনে একই রকম হওয়াতে বাইরেই খাওয়া হত বেশি। দুপুরে স্টুডেন্ট এক্টিভিটি সেন্টারে (স্যাক) খেতাম। ব্যাম্বু নামে চাইনিজ লান্ঞের একটা খাবারের দোকান ছিল।
আমি সেখানেই খেতাম। সাধারণতা শ্রিম্প, এগ রোল আর লো মেইন নামে স্প্যাগেটির মত একটা আইটেম। এখানে আসার পর জানতে পারলাম লো-মেইনে ওয়াইন দেওয়া হয়, হালাল না। যাই হোক, অন্য কিছুও হালাল ছিলনা। লো-মেইন হালাল ছিলনা সেটা জানতাম না সেসময়।
তাই আমি প্রতিদিনই এই একটা আইটেমই খেতাম। যথেস্ঠ সুস্বাদু ছিল। আইটেমটা বানাত এক চাইনিজ মহিলা। এক লাইন ইংরেজীও বলতে পারেনা। কিছুদিন পর লক্ষ করলাম মহিলা আমাকে দেখলেই জিজ্ঞেস না করেই বানানো শুরু করে আমি যা খাব তাই।
তিনি লক্ষ করেছেন আমি যখনই আসি তখনই এটাই খাই। আরো কিছুদিন পরে লক্ষ করলাম মহিলা আমার প্লেটে অনেক বেশি এমাউন্টের লো-মেইন দিচ্ছে। অন্যদের তুলনায় প্রায় ডাবল। দুপুরে খেলে আর রাতে খেতেও হবেনা, এত এমাউন্টের খাবার দেয়। তার সাথে কথা বলতে পারিনা, মহিলার বয়স মনে হয় ৫০ হবে, কিন্তু কেমন জানি একটা ভাল সম্পর্ক হয়ে গেল।
দুজন দুজনকে দেখলেই হাসি দিই শুধু। হাসি ইউনিভার্সাল ভাষা।
যেদিন শেষ সেমিস্টারের শেষ দিন, মহিলাকে বললাম ইংরেজীতেই যে আজ আমার এখানে শেষ দিন। আপনার সাথে আমার আর দেখা হবেনা। এতদিন আমাকে সার্ভ করার জন্য আমি আপনার কাছে খুবই কৃতজ্ঞ।
মহিলা বুঝলেন কি বলতে চাচ্ছি। দেখলাম হাতের গ্লাভস খুললেন। আমাকে ইশারাই ওয়েট করতে বললেন। পাশের স্মুদি থেকে মিল্ক শেইক নিয়ে আসলেন। উনি খেয়াল করেছেন যে আমি প্রায়ই মিল্ক শেইক খাই।
সেদিন আরো বেশি পরিমানে লো-মেইন বানালেন আমার জন্য। ৪ টা এগ-রোল দিলেন। ইশারায় বুঝিয়ে দিলেন যে পে করতে হবেনা।
সেদিন বিকালে যখন চাইনিজ খাবারের দোকানটা বন্ধ হয়ে যায় তখন গেলাম। বন্ধ হওয়ার একটু আগেই পোঁছলাম।
মহিলাকে ইশারায় আর ইংরেজীতে বললাম আমি আপনাকে একটা কফি খাওয়াতে চাই। হাসলেন। আমার সাথে আসলেন উপরের তলায় কফিশপে। কাপাচিনু নিলাম দুজনের জন্যই। দুজনেই পাশাপাশি চেয়ারে বসলাম।
আমি ইংরেজীতে বললাম যে "আমি উনাকে মিস করব। " বুঝলেন কিনা জানিনা। শেষে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন অনেকক্ষণ ধরে। আশ্চর্য্য!! আমার মাও একই রকমভাবে হাত বুলিয়ে দেন। আমার বন্ধু ক্যালের মা-বাবা যখন তাকে দেখতে পিটসবুর্গ থেকে এসেছিল, আমি তখন যুক্তরাষ্ঠ্র প্রথম গিয়েছি।
মায়ের জন্য খারাপ লাগত। তার মা আসাতে দেখতে গেছিলাম। তিনিও চলে যাওয়ার সময় আমার কপালে চুমু দিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়েছিলেন। সেসময়ও আমার মনে হয়েছে আমার মায়ের হাত বুলালেও সেই একই রকম স্বর্গীয় একটা অনুভুতি হয়, ক্যালের মা হাত বুলালেও একই অনুভূতি হচ্ছে! তার বাবার গায়ের গন্ধটা ঠিক আমার বাবার গায়রে গন্ধের মত। যাওয়ার সময় যখন আমাকে হাগ করলেন মনে হল আসলে পৃথিবীর সকল বাবা-মা একই রকম।
চাইনিজ বাবা-মা, এমেরিকান বাবা-মা, সাদা বাবা-মা, কাল বাবা-মা, বাংলাদেশী বাবা-মা, পাকিস্তানি বাবা-মা, ভারতীয় বাবা-মা, পার্বত্য চট্টগ্রামে আমরা যাদেরকে মেরে ফেলতেছি বা আগুন দিয়ে ঘর-বাড়ি জ্বালিয়ে দিচ্ছি তাদের বাবা-মাও একই রকম।
জগতের মানুষগুলো খুবই আশ্চর্য্য প্রাণী। আমি এদের কাজকর্ম দেখে প্রায়ই অবাক হই। বিভিন্ন সময়ে মানুষের উপর বিশ্বাস হারাই না, তা না। এই যেমন পাহাড়ীদেরকে আমাদের রাষ্ঠ্রযন্ত্র এই ২১শে ফেব্রুয়ারীর সময়ই যা করল তাতে চরম মন খারাপ হয়েছিল।
আবার এই র্যান্ডম লোককে ফ্রিতে খাওয়াচ্ছে মেয়েটার মত মানুষ দেখে আশাবাদী হই, ভিনিসকে দেখে মনে হয় সব শেষ না এখনও, চাইনিজ মহিলার কথা মনে পড়লে ভাবি, না, সারা বিশ্বে সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই। রবীন্দ্রনাথের কথা মনে পড়ে। "মানুষের উপর বিশ্বাস হারানো পাপ। " আসলেই।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।