আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

গমের শীষ বা রজনীগন্ধা

১০১৩ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ২০১৩ পর্যন্ত হাজার বছরে বাঙালি কমসে কম পাঁচ হাজার বার চালাকির আশ্রয় নিয়েছে। তার মধ্যে কাঁচা চালাকির সংখ্যা ৫০০-র কম নয়। তার থেকে যদি ৩০টির মতো বড় ধরনের কাঁচা চালাকি নির্বাচন করি, তা হলে দেখা যাবে, তার তিনটিই ঘটেছে গত ১০ বছরে।
শতাব্দীর প্রথম চাতুরীটি ছিল রাজনীতিতে ট্রাম্পকার্ড। ট্রাম্পকার্ডের পরিকল্পনাকারীরা পর্দার আড়ালেই রইলেন, বেইজ্জত হলেন শুধু একা আব্দুল জলিল।

এবং সেই তুরুপের তাসের ফাঁদে পড়ে ফেঁসে গেলেন আর একজন। ভাগ্যবিপর্যয় ঘটে রাজনীতিকদের মধ্যে সৎ ও সজ্জন বদরুদ্দোজা চৌধুরীর।
বাঙালির দ্বিতীয় রাজনৈতিক চাতুর্যটি ঘটে উদ্দীনীয় শাসনামলে। ওই কাঁচা চালাকিটির বিষয়বস্তু ছিল: আওয়ামী লীগ ও বিএনপিকে আপেল বা তরমুজের মতো ফালা ফালা করে টুকরো করা হবে। দুই জনপ্রিয় নেত্রীকে রাজনীতি থেকে করা হবে বিয়োগ।

উদ্দীনীয় চাতুরী বাস্তবায়িত হলে দেশে আজ দেখতাম আর কয়েকটি নতুন রাজনৈতিক দল। সেই সব দল থেকে যিনি সংসদ নেতা হিসেবে প্রধানমন্ত্রী হতেন, তাঁর মেয়াদ শেষ হতো ২০১৪ বা ’১৫-তে। হয়তো অর্থ বা শিক্ষামন্ত্রী হতেন প্রশিকার কর্ণধার, যিনি নির্বাচনে দুটি আসন থেকে দাঁড়িয়ে প্রতিটিতে পেয়েছিলেন শ চারেক ভোট। এনজিও-ড্রিভেন গভর্নমেন্টে তাঁরাই হতেন দেশের ভাগ্যবিধাতা। উদ্দীনীয় চাতুর্য জনগণ নস্যাৎ করে না দিলে আজ এক নেত্রী থাকতেন আমেরিকা বা কানাডায় অথবা মাঝে মাঝে লন্ডনে, আর এক নেত্রী থাকতেন জাজিরাতুল আরবে।


বাঙালি জাতীয়তাবাদীদের উর্বর মস্তিষ্কপ্রসূত সর্বশেষ চালাকির ফসল বিএনএফ (বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট ফ্রন্ট)। জনগণ ধারণা করছে, বিএনএফ আগামী নির্বাচনে অংশ নেবে এবং তাদের নির্বাচনী প্রতীক হতে পারে ‘গমের শীষ’ অথবা ‘ধানের শীষ’ কিংবা ‘ধানগাছ’। কোনো কারণে এগুলো যদি না পাওয়া যায়, তাহলে এগুলোর মতোই দেখতে রজনীগন্ধার ডাঁটি হলেও চলবে। রজনীগন্ধার ডাঁটিতেও যদি না কুলায় তাহলে বাংলার মাঠঘাট-বনবাদাড় ঘুরে দেখতে হবে অবিকল ধানের শীষের মতো দেখতে আর কী কী বস্তু আছে।
আগামী বছর যখন বর্তমান নির্বাচন কমিশন অতি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন করবে, তখন বস্তির চোখে ছানি পড়া কোনো বুড়ি বুঝে উঠতে পারবে না—কোনটা ধানের শীষ আর কোনটা ‘গমের শীষ’, ‘ধান গাছ’ বা ‘রজনীগন্ধা’।

ছয় লাখ পোলিং এজেন্টকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। সেসব পরোপকারী পোলিং এজেন্টের কেউ বস্তির বুড়িকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বলবেন, নানি, ধানের শীষে দিবেন তো? মারেন এই জায়গায় সিল।
নির্বাচন কমিশন যখন ফলাফল ঘোষণা করবে নিশুতি রাতে বা শেষরাতের দিকে, তখন দেখা যাবে মহাজোট পেয়েছে ২১২ আসন, বিএনএফ ৪২ আসন, জাতীয় পার্টি ২২, বিএনপি ১৭, ইসলামী ঐক্যজোট (স্বাধীনতার সপক্ষ) ৭ এবং বাকি আসন অন্যরা। সংসদে বিরোধী দলের নেতা হবেন কোনো বিজ্ঞ ব্যারিস্টার। সংসদের প্রথম অধিবেশনেই তিনি শ্রদ্ধা জানাবেন তাঁর প্রয়াত নেতা জিয়াউর রহমানকে এবং সেই সঙ্গে যোগ করবেন, ‘বঙ্গবন্ধু আমাকে ভীষণ আদর করতেন।

সেই জন্য আমি যখন তথ্যমন্ত্রী ছিলাম বিটিভিতে তাঁর ছবি দেখে সইতে পারব না বলে তাঁর ওপরে কোনো অনুষ্ঠানই করতে দিইনি। ’
বিএনএফের প্রতি বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশনের গভীর সহানুভূতির পরিচয় ইতিমধ্যে মানুষ জেনে গেছে। বিএনএফের প্রধান সমন্বয়ক প্রথম আলোকে বলেছেন, ‘আগামী নির্বাচন সামনে রেখে দেশে যাতে কোনো ধরনের সাংবিধানিক সংকট সৃষ্টি না হয়, সে জন্য বিএনএফ অবদান রাখার চেষ্টা করবে। ’ সংবাদপত্রের প্রতিবেদন থেকে জানা যাচ্ছে, ‘নিবন্ধনের জন্য নির্বাচন কমিশনের শর্ত পূরণ করতে সরকারের ছত্রচ্ছায়ায় বিভিন্ন জেলা ও উপজেলায় বিএনএফের নামে কার্যালয় স্থাপন এবং কাগজপত্রের কমিটি গঠনের কাজ চলছে। ’
বিএনএফ ও বিইসি মালকোঁচা মেরে নেমেছে বিএনপি নামক এক ছোট্ট দলকে বেকায়দায় ফেলতে।

এই তৎপরতায় বিএএলের নীতিনির্ধারকেরা বগল বাজাচ্ছেন। মনে করছেন, নির্বাচনের দিন শেষ রাতে দরজা বন্ধ করে গুনে দেখা যাবে ধানগাছ বা রজনীগন্ধা পেয়েছে দুই লাখ ২৭ হাজার ভোট, তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ধানের শীষ পেয়েছে ৩৭ হাজার ভোট। ভোটাররা ধানের শীষ ভেবে কষে ছাপ্পর মেরেছে ধানগাছ, গমের শীষ বা রজনীগন্ধায়। বিএএলের নেতারা বোঝার চেষ্টা করছেন না যে বাংলার জনগণ নেতাদের মতো অতি বুদ্ধিমান নয় বটে, কিন্তু তারা ছাগলও নয়।
বড় বড় দল ভাঙে দুই কারণে।

নীতি ও আদর্শগত কারণে কোনো কোনো নেতা বেরিয়ে গিয়ে নতুন দল গড়েন। তাকে চক্রান্ত বলে না। একদিন কংগ্রেসেই ছিলেন মোরারজি দেশাই, চরণ সিং, ভিপি সিং, চন্দ্রশেখর, এমনকি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পর্যন্ত। তাঁরা নতুন দল গঠন করে নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় গেছেন। আরেকভাবে দল ভাঙে বিশ্বাসঘাতকদের ষড়যন্ত্রে।

ওই ধরনের ষড়যন্ত্র যারা করে, তারা ইতিহাসের নর্দমা দিয়ে ভেসে যায়।
গণতন্ত্রে নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা খুব বড়। তারা কোনো দল বা গোষ্ঠীর দাসের কাজ করে না। ভারতের সুন্দরম, স্বামীনাথন, সেশন বা গিলের মতো নির্বাচন কমিশনার আমরা পাব না। সব মানুষ সৎ ও ব্যক্তিত্বসম্পন্ন হন না।

তা দোষের নয়। কিন্তু এমন কমিশনও কাম্য নয়, যাঁদের কারণে দুনিয়ার কাছে ১৬ কোটি মানুষের মাথা হেঁট হয়ে যায়।
সৈয়দ আবুল মকসুুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক। ।

সোর্স: http://www.prothom-alo.com

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।