আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বাবা আমার নতুন বাড়ীতে উঠলেন না



আমি মার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে, বাসার গেট থেকে একটু দুরে গেলে মা আবার ডাক দেয়। বাবা একটু শুনে যাওতো। মা যেটা বলবে সেটার জন্য আমি মোটেও প্রস্তুত ছিলামনা। কিন্তু মা আমার কিভাবে, কিবুঝে তা বলেছিল। সেটা নিয়ে আমি অনেক গভীরভাবে ভেবেছি।

হয়তো গভীর ভালবাসার টানে এবং খুব কাছে থেকে বাবাকে মা হয়তো দেখেছে। হাঁ আমি একবার দেখেছিলাম, মা কি ভাবে বাবা কে সেবা-যত্ন করেছিল। সেটাছিল তার আগের বছরের কথা। একরাতে মা নিজে নিজে দুঃখ করে একটু জোরে জোরে কথা বলাতে হঠাৎ আমার ঘুম ভেঙ্গে যায়। তখন যা আমার কানে আসে।

মা বলছে... কতবার বললাম উঠেন প্রসাব-পায়খানা করে আসেন, না করা লাগবে না বলে শুয়েই থাকলো। আর এখন আমাকে কষ্ট দিচ্ছে। ওফ্ আসলে মা এমন কতদিনই না কষ্ট করেছে, আমি তো শুধু একদিনই না দেখেছি। রাতটাতে ছিল কনকনে শীত। সেদিন আমি বাবা-মার সাথেই শুয়েছিলাম।

মাকে দেখি বাবার হাত ধরে টেনে নিয়ে যাচ্ছে, সেকি বেদনা দায়ক দৃশ্য দুজনেই বুড়া, চলতে দুজনেরই কষ্ট। আমি একটু হাত ধরতেই বাবা চিল্লাইয়ে উঠে বলে ওরে বাবারে আমার হাত ভেঙ্গে ফেললো, মা বলে তুমি পারবেনা, তাকে ধরার কায়দা আছে। (বাবার ছোটকালে ফুটবল খেলতে গিয়ে নাকি হাত ভেঙ্গেছিল তার আছর এই বুড়া বয়সে হয়েছিল) তারপরও মা বাবাকে ঘরের বাহিরে আমাদের ছিল পায়খানা সেখানে নিয়ে গিয়ে তার বাকি কাজ সারায়ে আবার গোসল খানায় এনে তার সব কিছু পরিস্কার দেয়। এরপর তাকে গরম কাপড় পড়ায়ে প্রথমে চেয়ারে বসায়ে রেখে, মা খাট পরিস্কার করতে থাকে তখন আমিও ঘরে ভিতরে আসি, দেখি বাবা পায়খানা তো করেছে তারপর আবার বিছানার চাদরের এককনা জোড়ায়ে সাথে তার গায়ের চাদর নিয়ে পোটলা বেঁধে রেখেছে। বাবা নাকি এমন কাজটি মাঝে মধ্যেই করে।

মা বকতে পারে বলে তার ভয়ে এটা সে করেছে। আর সেকি গন্ধ, মা বলে তুমি বাহিরে যাও। এরপর মা ঘর থেকে যেদিক দিয়ে বাবাকে পায়খানাই নিয়ে গিয়েছিল সেই সারা পথ এবং ঘরের মধ্যে যেখানে তা পড়েছিল, মা সব কিছু ধুয়ে-মুছে পরিস্কার করে। তারপর মা গোসল করে ঘরে আসে। তখন আমি ভেবেছিলাম, বাবার প্রতি মার কত গভীর ভালবাসা হয়তো সেই খাতিরে মা এটা করেছে, নাকি স্ত্রী হয়ে স্বামীর প্রতি দ্য়ীত্ব-কর্তব্যের সেই দৃষ্টিভঙ্গি থেকে করেছে।

আসলে স্বামী-স্ত্রী সম্পর্কের মত মধুর সম্পর্ক আর এত আপনজন দুনিয়ার অন্য কিছুতেই নাই। যদি থাকে উভয়ের মধ্য আন্তরিকতা, ভালবাসা এবং সমঝোতা। আমি তো নিজ চোখে এই কনকনে শীতের এক রাতের মার কষ্টটা দেখলাম, এরকম কত কষ্ট প্রতি দিনই মা এই বৃদ্ধ বয়সে বাবার সেবা-যত্ন করেছে। আর সেই সাথে দেখলাম নিজ চোখে বাবার কষ্টটা । তাই ভাবলাম আমি থাকি প্রবাসে যদিও নিজ হাতে তাদের সেবা-যত্ন এবং খেদমত করার তেমন সুযোগ হয় নাই, তবুও যেভাবে পারি তার কোন ত্রুটি করি না।

তখন আমি মনে মনে ভাবি এবারে তো হলো না পরের বারে এসে আমার নিজ বাড়ীর তৈরীর কাজ করবো। আবার এগার মাস পর দেশে গেলাম। আমাদের বাৎছরিক ছুটি এগার মাস পর মাত্র ৩০ দিন। বৃহস্পতি এবং শুক্রবার সাপ্তাহিক ছুটি। তাই আমাদের একটা নিয়ম আছে এই বৃহস্পতি বা শুক্রবারে এক বছরের মধ্যে ৮৫ ঘন্টা ডিউটি করে কোম্পানীকে দিলে আরোও ১৫ দিন ছুটি Compensatory leave হিসাবে বাৎছরিক ছুটির যোগ হয়।

তারপর আরো ১৫ দিন without pay নিয়ে মোট ৬০ দিনের ছুটিতে যাই এবং মনে মনে ঠিক করি আসার সময় আরো ৫দিন লেট করে দেশ থেকে ফিরবো। তাহলে মোট ৬৫ দিন ছুটি হবে। এরপর দেশে গিয়েই দুইদিন পরেই বাড়ি করার কাজ শুরু করে দিই। আমি একা মানুষ আর শীতের দিন তারপর কত রকমের ঝামেলা আর কষ্ট সহ্য যে আমাকে করতে হয়েছে, তা আমি ভাষায় প্রকাশ করতে পারবোনা। তারপরও আমার খুব ভাল লাগছিল যে অল্প সময়ের মধ্যে আমি ছাদ ঢালাই পর্যন্ত কাজ সম্পূর্ণ করে ফেলি।

শুধু তাই নয় নিজের বুদ্ধির বলে স্যাটারিংটা আমি এমন ভাবে করেছিলাম যাতে একটা ঘরের কাজ অ্যাট্যাচ টয়লেট সহ তার মধ্যেই করতে পারি এবং স্যাটারিং খোলার আগেই তা করে ফেলি। কারন আমি বাবা-মার কষ্ট নিজ চোখে দেখেছিলাম বলেই, সেই সময় আমি ঠিক করেছিলাম। যেহেতু বাবা তার কর্ম জীবন শেষ করেও একটা ভালো বাড়ী করতে পারে নাই, তাই আমি তাদের একটু সুখের আশায় এবং মার কিছুটা হলেও কষ্ট কম হবে আর শুধু বাবার কথা খেয়াল করে বাড়ীটির কাজ মোটামুটি শেষ করে করি। আমি যেখানে বাড়ী করি, সেটা ছিল বাবার বাড়ী থেকে একটু দুরে ১০/১৫ মিনিটের রাস্তা। তাই প্রতি দিন এবং সব সময় কাজ তদারক করার জন্য কষ্টকর হবে বলে আমার বাড়ীর পার্শে একটা বাড়ীর নীচ তালার শুধু একটা রুম ২/৩ মাসের কথা বলে ভাড়া নিই, তা অনেক কষ্ট করে খুজে পাই।

মা-বাবা কে সাথে নিয়ে এখানে থেকে বাড়ীটির কাজ শেষ করি। এদিকে আমার ছুটি শেষ। আর দুইদিন পরই ছাদের স্যাটারিং খুলবে, সেই সাথে তাদের অ্যাট্যাচ টয়লেট ঘরটাও রেডী পরের দিন গিয়ে তারা সেখানে বসবাস করতে পারবে। আমি মনে মনে মহা খুশী হই, যাক মা-বাবার জন্য মানে একটু শান্তির জন্য কিছু একটা তো করতে পেরেছি। মাকে বলি মা তুমি তো খুশী, মা কোন জবাব দেয় না আমার জন্য কেঁদে কেঁদে দোয়া করে।

বলে বাবা আমাদের জন্য আর কিছু করা লাগবেনা, তোমার জীবনে কবে সুখ আসবে এইটাই আমার বড় চিন্তা। এরপর আমি সব কিছু গোছায়ে রেডি হতে থাকি বিকেলও হয়েগেছে। সন্ধ্যায় আমার বাস। তারও টাইম হয়ে যাচ্ছে। আর ভোর বেলাতে আমার ফ্লাইট।

যাক সব কিছু দেখে- শোনে সবাইকে বলে-কহে আমিও মার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে, বাসার গেট থেকে একটু দুরে গেলে মা আবার ডাক দেয়। বাবা একটু শুনে যাওতো। মা যেটা বলবে সেটার জন্য আমি মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না। কিন্তু মা আমার কিভাবে, কিবুঝে তা বলেছিল। সেটা নিয়ে আমি অনেক গভীরভাবে ভেবেছি।

মা কান্নার সুরে বলছে, বাবা পরের বারে এসে তুমি আর তোমার বাবাকে দেখতে পারবে না। আমি বললাম কেন ? কি ভাবে বুঝলে তা, সে বলে আমি তার সাথে থাকি তার সব কিছু আমি বুঝতে পারি। মাকে আমি আর আর কি বলবো কারন এই দুনিয়াতে সেতো আমার আগে এসেছে। শান্তনা দেবার ভাষা খুজে পেলাম না। বললাম মা, এই বাবার জন্যই তো এত তারাহুরু করে এই বাড়ীটি করলাম।

সেই সাথে তোমার কষ্ট ও অনেক কমে যাবে। পরশু আমার নতুন বাড়ীতে গিয়ে তার সাথে একটু আনন্দ করে কিছুটা দিন তো কাটাও তা হলে আমি ও অনেক সুখ পাবো। এরপর আবার মার কাছ থেকে বিদায় নিলাম। আমার প্রবাসে এসে দুইদিন হয়েগেছে। B shift থাকায় সকালে বাসায় ছিলাম।

পাশের রুমে গিয়ে গল্প করছিলাম। তখন এক বন্ধু আমাকে খুজতে খুজতে এখানে এসে বলে আমি একটু কাজে অফিসে গিয়েছিলাম, জানতে পারি আপানার একটা fax এসেছে আপনার রুমে ফোন করে ,না পেয়ে আমি তা সঙ্গে করে নিয়ে এলাম। আপনার জন্য একটা দুঃখ জনক সংবাদ আছে। আমি খুলে পড়ি আর ভাবি শেষ পর্যন্ত মার কথাই ঠিক হলো বাবা আমার নতুন বাড়িতে উঠলো না। তার আসল বাড়ীতে চিরদিনের জন্য চলে গেল।

বাবাকে আজ খুব মনে পড়ছে। তার আত্মার মাগফেরাত কামনা করছি।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.