আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ভাষা ব্যবহারের ওপর আইনী খবরদারী অথবা ফ্যাসিবাদের নতুন ধরণ



ফরহাদ মজহার আমি ভয় পেয়েছি। বাংলা একাডেমী নাকি আইন করবে। সেই আইন মোতাবেক উকিল মোক্তার আইন আদালত আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর কথা মাথায় রেখে আমাদের এখন লেখালিখি করতে হবে। কাগজে পত্রে খবরে গুজবে কানে এসেছে যে বাংলা একাডেমী যাদের শায়েস্তা করতে চায় তারা হচ্ছে তরুণ লেখক। তাদের ক্রিয়াপদ ব্যবহার এখন যাঁরা বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের সরকারি পণ্ডিত তাদের ভালো লাগে না।

কী রকম? বঙ্কিমবাবু লিখতেন, ‘করিয়াছিলাম’, রবি ঠাকুর শিখিয়েছিলেন ‘করেছিলাম’। এখন পোলাপান কখনো ‘করছিলাম’, কখনো ‘করসিলাম’ এমনকি স্থানভেদে নাকি ‘করশিলাম’ লিখছে। তারা ‘পাবো’-কে লেখে ‘পামু’, ‘ভেঙেচুরে’-কে লেখে ‘ভাইঙ্গাচুইরা’, ‘করে’-কে লেখে ‘কইর‌্যা’ ইত্যাদি। খুবই খারাপ কাজ। জঘন্য।

বাংলা ভাষার ইজ্জত গেল। তরুণ কবি সাহিত্যিকদের মধ্যে যাঁরা বাংলা ক্রিয়াপদ নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা করেন তাঁদের প্রায় সকলকেই আমি চিনি এবং আগ্রহের সঙ্গেই তাঁদের পরীক্ষানিরীক্ষার আমি খবর রাখি। তাঁদের সব ফলাফল আমাকে সমর্থন করতে হবে এমন কোনো কথা নাই। কিন্তু তাদের চেষ্টার সাহিত্যিক, নান্দনিক এবং রাজনৈতিক গুরুত্বকে খাটো করে দেখার কোনো উপায় নাই। কিন্তু এখন তাঁদের ঠ্যাঙানোর কথা শুনছি।

অতএব তাদের শায়েস্তা করার জন্য এখন পুলিশ দারোগা র‌্যাপিড এ্যাকশন ব্যাটেলিয়ন আইন আদালত দরকার। আইন করতে হবে। আলবৎ। এইসকল পোংক্টাদের শায়েস্তা না করলে ‘প্রমিত’ বাংলার পবিত্রতা বিনষ্ট হবে। আইন করে ক্রিয়াপদ ব্যবহারের শাসন কায়েম করবার খবরটি পত্রিকাতে দেখেছি বলে মনে হয়।

কিন্তু হাতের কাছে রেফারেন্স নাই। তবে ‘দেশ’ টেলিভিশন ফেব্রুয়ারির ২৩ তারিখে তাদের ২, ৫, ৭, ৯, ১১ ও ১টার প্রচারনায় বিষয়টি নিয়ে এসেছে। তারা জানিয়েছে, ক্রিয়াপদের ক্ষেত্রে কথ্যরূপ ব্যবহারের প্রবণতা তরুণ কিছু সাহিত্যিকের লেখায় প্রবলভাবে দেখা যায়। এ নিয়ে বেশ কিছুদিন ধরেই চলছে সরব বিতর্ক। বাংলা একাডেমী ভাষার এ ধরণের ব্যবহারকে নীতিবিরুদ্ধ হিসেবে উল্লেখ করে আইন করার চিন্তাভাবনা করছে।

যেটা বুঝতে পেরেছি সেটা হোল তরুণ সাহিত্যিকরা ভাষার ক্রিয়াপদ নিয়ে যে পরীক্ষানিরীক্ষা করছেন সেখানেই আপত্তি। সুনির্দিষ্ট ভাবে তরুণদের ক্রিয়াপদ ব্যবহারের বিরুদ্ধেই সরকারি পণ্ডিতদের নালিশ। বাংলা একাডেমী এখন একটা নতুন কাজ পেতে যাচ্ছে। ভাষার ওপর নজরদারি রাখা। শামসুজ্জামান খান বলেছেন, “ভাষা পরিস্থিতিতে একটা নৈরাজ্য সৃষ্টি হয়েছে বাংলাদেশে।

বাংলা একাডেমীর একটা খসড়া আইন আমরা তৈরি করেছি। সে আইনে এই সব বিষয়ে সুস্পষ্ট বিধান রাখা হয়েছে। সেই আইনটি সরকারের মাধ্যমে পার্লামেন্টে পেশ করার পর যদি অনুমোদিত হয়ে আসে তাহলে এই ক্ষেত্রে আমরা যথাযথ ভূমিকা পালন করতে পারব। ” আমরা কে কীভাবে কথা বলব, লিখব… কবিতা, গদ্য, প্রবন্ধ, উপন্যাস ইত্যাদি লিখব তার জন্য আইনের খসড়া করছে বাংলা একাডেমী। সেটা পাশ করবে জাতীয় সংসদ আর সেটা প্রয়োগ করবে বিচার ও নির্বাহী বিভাগ।

দারুণ খবর! আমি অন্যত্র আমার লেখালিখিতে ‘ডিজ্যুস সংস্কৃতি’ নামে গোলকায়নের যাঁতাকলে পিষ্ট বাংলাদেশে এক ধরণের বিজ্ঞাপনী ভাষার বিরুদ্ধে আপত্তি তুলেছিলাম। আমার সেই আপত্তি এখনো পুরা মাত্রায় বহাল আছে। সেই আপত্তির মর্মটা ভাষার পরীক্ষানিরীক্ষা নিয়ে নয়, বরং বাংলাদেশের এক গুচ্ছ প্রতিভাধর তরুণের রাজনৈতিক অসচেতনতা। আপত্তি কথাটাও ঠিক নয়। এটা বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক লড়াই সংগ্রাম বা প্রথাগত অর্থে শ্রেণিসংগ্রামের গতি-প্রকৃতি অনুধাবনের সঙ্গে যুক্ত।

সমাজের সংবেদনশীল এবং সৃষ্টিশীল তরুণদের বহুজাতিক কম্পানির বিজ্ঞাপন বানানোর কাজে মনেপ্রাণে নিবেদিত হয়ে যাওয়া দেখে ভয় পেয়ে নালিশটুকু জানিয়েছিলাম। তাদের খুবই কম দরে বিক্রি হয়ে যাওয়াটা আমার কাছে একটি তাৎপর্যপূর্ণ সমাজতাত্ত্বিক উপাদান হিসাবে হাজির হয়েছিল। আমি উন্নাসিক নই, একটু আধটু কাব্য কি শিল্পকলা নিয়ে নাড়াচাড়া করি বলে তরুণদের সৃষ্টিশীল প্রতিভা সম্পর্কে সন্দেহ নাই আমার। কিন্তু খুবই কম দামে ইউনিলিভার, বাংলা লিংক, গ্রামীণ ফোন ইত্যাদি মোবাইল কম্পানিসহ বিভিন্ন বহুজাতিক কম্পানির কাছে তরুণদের একটা জেনারেশনের প্রায় সকলেরই বিক্রি হয়ে যাওয়াকে আমি নিছকই পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সবকিছুই পণ্য হয়ে যাওয়া বলে মেনে নিতে পারছিলাম না। সৃষ্টিশীলতার আবেগ, সংবেদনা ও আগাম দৃষ্টিপাতের ক্ষমতা এমন কিছু ব্যাপারে যাকে পুঁজি হয়তো কাঁচামাল হিসাবে ব্যবহার করতে পারে, কিন্তু কখনোই হজম করতে পারে না।

পুঁজির এই অপারগতার কারণেই প্রতিটি সমাজেই বৈপ্লবিক রূপান্তর সবসময়ই একটা সম্ভাবনা হয়ে থেকে যায়। কবিতা, সাহিত্য, চিত্রকলা, সিনেমা, গান—সৃষ্টির এইসকল ক্ষেত্রগুলো পুঁজির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য এমন সব গলি ঘুপচির ফাঁদ পাতে কিম্বা গেরিলা হামলার ক্ষেত্র বানিয়ে রাখে যে কখন কোন বোমা কীভাবে ফাটবে সেটা আগাম আন্দাজ করা যায় না। যদি সৃষ্টিশীল তরুণরা জীবিকা হিসাবে কম্পানির বিজ্ঞাপন তৈরির কাজকেই বেছে নেয় তখন সেই সমাজ সম্পর্কে চিন্তিত হবার যথেষ্ট কারণ থাকে বৈকি। নিজের মর্যাদাকে সংবেদনশীল তরুণ যখন ছোট করতে কুণ্ঠা বোধ করে না তখন তার সমাজতাত্ত্বিক দিকটা বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। যখন ডিজ্যুস সংস্কৃতি সম্পর্কে সচেতন হয়ে উঠছিলাম তখনো মইনুদ্দিন-ফখরুদ্দিনের সরকার আসেনি, কিন্তু এই সকল বিজ্ঞাপন যে সকল গণমাধ্যমগুলো ছাপছিলো তারা বাংলাদেশকে ব্যর্থ রাষ্ট্র এবং ইসলামি সন্ত্রাসীদের আখড়া হিসাবে তুমুল প্রচার চালিয়ে দেশকে অস্থিতিশীল করে তুলছিল।

পরদেশী হস্তক্ষেপের পাঁয়তারা চলছিল। তথাকথিত ‘সুশীল সমাজ’ গুটিকয়েক বিদেশী কম্পানি ও কয়েকজন সামরিক অফিসার মিলে ঔপনিবেশিক ইংরেজ রাজত্বে যেমন একজন গভর্নর দিয়ে একটি দেশ শাসিত হোত, তেমনি বিশ্বব্যাংকের একজন কর্মচারীকে ধরে নিয়ে এসে ক্ষমতায় বসিয়ে দিল। দুই বছর বাংলাদেশ তারা শাসনও করে গেল। এনজিওগুলো বাংলাদেশে গণতন্ত্র নয়, ‘সুশাসন’ চায়। সমাজে সংবেদনশীল সৃষ্টিশীল তরুণদের বিকিয়ে যাওয়া দেখে বোঝা যায় একটি দেশের রাজনৈতিক পরাধীনতার মাত্রা কতদূর হতে পারে।

ডিজ্যুস সংস্কৃতি তার আগাম লক্ষণ বলেই আমি শনাক্ত করেছিলাম। ডিজ্যুস সংস্কৃতির ভাষা বিজ্ঞাপন কর্মকাণ্ড ইত্যাদির মধ্যে বুশ-ব্লেয়ারের সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধের ভাষা ও বয়ান নিহিত রয়েছে। সে কারণেও আমি তার বিরোধিতা করেছি। এখনও করি। যেমন, ‘হারিয়ে যাও।

’ তরুণদের তো এখন হারিয়ে যাবার কথা নয়, বরং প্যালেস্টাইন, ইরাক, আফগানিস্তানের ঘটনায় রুখে দাঁড়াবার কথা। কিম্বা ‘বদলে যাও, বদলে দাও। ’ ভাবলাম বেশ তো দারুণ বিপ্লবী বিজ্ঞাপন। কিন্তু কী রকম বদলাবে মানুষ! বাসে উঠলে মহিলাদের জন্য সিট ছেড়ে দিতে হবে। ব্যবহার বদলালেই বাংলাদেশের পরিবর্তন হয়ে যাবে।

বহুজাতিক কম্পানি আমাদের তেল গ্যাস কয়লা লুট করে নিয়ে যাচ্ছে, ‘অবাধ বাজার’ ব্যবস্থার নামে অর্থনৈতিক লুণ্ঠন চলছে—এই সবের বিরুদ্ধে লড়াই করবার দরকার নাই। গার্মেন্টের মেয়েরা আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে মরছে, ছাদ ধসে গিয়ে মাটিচাপা পড়ে কুকুর-বেড়ালের মতো মরে যাচ্ছে কিশোর বয়েসী ছেলেমেয়েগুলো, জীবনের কোনো স্বাদই তারা নিতে পারেনি। কিন্তু এদের জন্য কিছুই করবার দরকার নাই। ‘বদলে যাও বদলে দাও। ’ কে কাকে বদলাবে? একজন মহিলার জন্য সিট ছেড়ে দিলেই কি ‘বদলে যাও বদলে দাও’ হয়ে যাবে? বাংলা একাডেমী এখন আইন করে কী ভাষায় আমার লিখব কী ভাষায় কথা বলব ঠিক করে দেবে।

ঘটনা বহুদূর গড়িয়ে গেছে। একে এখন আর ডিজ্যুস বলা যাচ্ছে না। তরুণরাও কম যায় না। তারা এটাকে ‘ফ্যাসিবাদ’ বলছে। ফেইসবুকে তাদের একটি ব্লগ দেখলাম ‘ভাষা-ফ্যাসিবাদীদের ঠেকাও’।

এক তরুণ কবি আমাকে তাঁর ভাষায় বললেন, ‘হালারা কেডা? আমি কেমনে কথা কমু না কমু কেমনে লিখুম না লিখুম হেইডা ঠিক কইরবার হুকুমদার তাদের বানাইলো কেডা?’ বাংলা একাডেমী ইতোমধ্যেই আইনের খসড়া তৈরি করেছে, আগেই বলেছি। সেটা তারা সংসদে নিয়ে যাবে। সংসদে যেহেতু আওয়ামী লীগই সর্বেসর্বা অতএব বাংলাভাষা রক্ষা করবার বাঙালি জাতীয়তাবাদী জিহাদ অনায়াসেই সফল হবে এটা আন্দাজ করা যায়। ‘হালারা কেডা? আমি কেমনে কথা কমু না কমু কেমনে লিখুম না লিখুম হেইডা ঠিক কইরবার হুকুমদার তাদের বানাইলো কেডা?’ কথাটা ঠিক। ভাষার একটা নিজস্বতা আছে।

যে জায়গার ওপর ভাষা দাঁড়ায় তার একদিকে আছে তার সামাজিক বা সামষ্টিক দিক, অন্যদিকে যিনি সেই সামাজিক ভাষাটা ব্যবহার করেন সেটা তিনি তাঁর মতো করেই ব্যবহার করেন। অবস্থা বুঝে, উদ্দেশ্য অনুযায়ী। ভাষা সেই দিক থেকে একান্তই তাঁর নিজের জিনিস। এই দিক থেকে তার একটা ‘ব্যক্তিগত’ বা ‘সৃষ্টিশীল’ দিক আছে। অর্থাৎ সামাজিক ব্যক্তি সমাজে থেকে সমাজে বাস করতে গিয়ে সামাজিক ভাষাটা তাঁর নিজের মতো করেই ব্যবহার করেন।

সমাজ ও ব্যক্তির দাগচিহ্নে‎র পর দাঁড়িয়ে ভাষার এই ব্যবহার ভাষাকে সবসময়ই সপ্রাণ রাখে। ভাষা এই সামাজিকতা ও ব্যক্তিকতার টানাপড়েনের মধ্য দিয়ে নিজের গতিতে বদলায়। সেখানে কোনো আইন নাই; পুলিশ, দারোগা, র‌্যাপিড একশান ব্যাটালিয়ন বা বাংলা একাডেমী নাই। সেখানে যদি কারো সর্দারি আদৌ মানতেই হয় তবে তাঁরা সৃষ্টিশীল কবি ও সাহিত্যিক। বিশেষত যাঁরা সজ্ঞানে ও সচেতন ভাবে ভাষা নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেন।

দুমড়েমুচড়ে উল্টেপাল্টে ভাষার সম্ভাবনা ও সীমার নিরন্তর পরীক্ষা-নিরীক্ষাই সাহিত্যের কাজ। পরীক্ষা-নিরীক্ষার অতি অল্প অংশই হয়তো টেঁকে, বাকিটা ভাষার ইতিহাস হয়ে থেকে যায়। কিন্তু সমাজের এই সৃষ্টিশীল উদযাপন ও কর্মযোগকে সমূলে খুন করবার আওয়াজ যখন ওঠে তখন আতংকিত না হয়ে পারা যায় না। ভাষার ক্ষেত্রে যাকে আমরা সামাজিক বা সামষ্টিক নির্মাণ বলছি তার একটা ইতিহাস থাকে। আছে।

অবশ্যই। ঠিক যেমন যিনি বিশেষ স্থানে ও সময়ে তাঁর নিজের মতো করে ভাষা ব্যবহার করছেন তাঁরও একটা ইতিহাস আছে। সমাজ যেমন হঠাৎ হাজির হয়নি, ঠিক তেমনি ব্যক্তি—এই ক্ষেত্রে বাংলাদেশের তরুণ কথাওয়ালারা—তাঁরাও হঠাৎ করে উদয় হননি। তাঁরাও ইতিহাসেরই তৈরি জিনিস। উভয়ের ইতিহাস পণ্ডিতদের গবেষণার বিষয় হতে পারে।

তাঁদের পরীক্ষা-নিরীক্ষা যদি স্বেচ্ছাচার মনে হয় তাহলে আমরা নিজ নিজ রুচি ও অভ্যাসের জায়গায় দাঁড়িয়ে আপত্তি জানাতে পারি। তাঁদের লেখালিখি পরিহার করতে, এমনকি লিখে বিরোধিতাও করতে পারি। কিন্তু কে কীভাবে ভাষা ব্যবহার করবে তার আইন করার এই চিন্তাটা এতই উদ্ভট, বিকৃত ও ভয়ানক যে তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোই সজ্ঞান নাগরিকদের কর্তব্য। ‘ভাষা-ফ্যাসিবাদীদের ঠেকাও’ ব্লগে দেখলাম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ-র মস্তো ছবি। তাঁর ছবি ফেইসবুকে জুড়ে দিয়ে তরুণরা বোঝাতে চাইছেন কায়েদে আজম যেমন রাষ্ট্রভাষা হিসাবে উর্দুকে আমাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন, এখনকার বাংলাদেশে সেই কায়েদে আজম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর ভূত ফিরতিবার সদর্পে হাজির হয়েছে।

তবে ইতিহাস যেহেতু দ্বিতীয়বার পুনরাবৃত্তির সময় ‘প্রহসন’ বা মশকরা হয়ে হাজির হয়, এই ক্ষেত্রেও তামাশার মিশাল আছে। জিন্নাহ একমাত্র উর্দুকেই রাষ্ট্রভাষা করতে চেয়েছিলেন। বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন শাসক শ্রেণী এবং তাদের তাঁবেদাররা তকাকথিত ‘প্রমিত ভাষা’-কেই লেখালিখি সাহিত্য চর্চা রেডিও টেলিভিশনে কথা বলবার একমাত্র ভাষা হিসাবে আইন করে চাপিয়ে দিতে চাইছে। বাংলা সাহিত্যের এখনকার ভাষা বা ‘আধুনিক’ কলকাতাকেন্দ্রিক বাংলা ভাষা ছাড়া কেউ নাকি কথা বলতে পারবে না। রেডিও টেলিভিশনে, পত্রপত্রিকাতেও এই ‘প্রমিত’ ভাষাই চলবে।

আমি তরুণদের পক্ষে ভাষা-ফ্যাসিবাদীদের বিরুদ্ধে দাঁড়াবার জন্য রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকেই আপাতত সাক্ষী মানব। রবীন্দ্রনাথ পরিষ্কারই বলেছেন যাকে আমরা সাহিত্যের ভাষা বলি আর সরকারি পণ্ডিতরা যাকে ‘প্রমিত ভাষা’ বলছেন তার ‘সূত্রপাত’ হয়েছে বিদেশের ফরমাশে এবং তার সূত্রধর হচ্ছে সংস্কৃত পণ্ডিত। রবীন্দ্রনাথ বলছেন, বাংলাভাষার সঙ্গে এঁদের সম্পর্ক হচ্ছে ‘ভাসুর-ভাদ্র বউয়ের’ মতো। বাংলা ভাষা একটি সজীব প্রাণবন্ত ভাষা। কিন্তু “এই সজীব ভাষা তাঁদের কাছে ঘোমটার ভিতরে আড়ষ্ট হইয়া ছিল, সেই জন্য ইহাকে তাঁরা আমল দিলেন না।

তাঁরা সংস্কৃত ব্যাকরণের হাতুড়ি পিটিয়া নিজের হাতে এমন একটা পদার্থ খাড়া করিলেন যাহার কেবল বিধিই আছে গতি নাই। ” বাংলা ভাষার এই পশ্চাত ইতিহাস নিয়ে আমার রক্তের দাগ মুছে রবীন্দ্র পাঠ বইতে কিছুটা আলোচনা করেছি। এখানে পুনরাবৃত্তি করব না। শুধু মনে করিয়ে দেব বাংলা ভাষার বিকাশ ঘটানোর যে পথটা রবীন্দ্রনাথ দেখিয়েছেন সেটা হচ্ছে সাহেবদের ঔরসে এবং ব্রা‎হ্মণ পণ্ডিতদের গর্ভে যে বাংলা তৈরি হয়েছে তার বিপরীতে যাত্রা করা। মুখের ভাষার যে সজীব ও প্রাণবন্ত বাংলা সেই দিকেই ভাষাচর্চার অভিমুখ স্থাপন করা।

রবীন্দ্রনাথ নিজেও তাই করেছেন। দুই একজন অনুকরণপ্রিয় দুর্বল লেখকের কথা বাদ দিয়ে এখনকার তরুণরা ক্রিয়াপদ ব্যবহারের ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথের শিক্ষার বাইরে কিছু করেছেন বলে আমার মনে হয় নি। অনেকের চোখে সেটা খানিক স্বেচ্ছাচারিতা মনে হতে পারে কিন্তু ক্রিয়েটিভ লেখার ক্ষেত্রে সেটা অপরাধ নয়। এটাও মনে রাখা দরকার রবীন্দ্রনাথ এবং রবীন্দ্রোত্তর বাংলা কলকাতা হয়ে যে রূপ নিয়ে আমাদের হাতে এসেছে, তাকেই সরকারি পণ্ডিতরা এখন ‘প্রমিত বাংলা’ বলে শিরোপা দিচ্ছেন, অথচ সেটা আমাদের অনেকেরই মাতৃভাষা নয়। যেমন আমি নোয়াখালির ছেলে, নোয়াখালির ভাষাই আমার মাতৃভাষা।

নোয়াখালির ভাষায় বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চলের মতো অবশ্যই গান, কবিতা, কাহিনী রচিত হয়। সেইগুলোও সাহিত্য। নেয়াখালির ক্রিয়াপদ ‘প্রমিত বাংলা’-র ক্রিয়াপদের নিয়মে চলে না। বাংলাভাষা যত বেশি সাধারণ মানুষের ভাষা হয়ে উঠবে ততই সাধারণ মানুষের দৈনন্দিনের ভাষা থেকে নিজের সমৃদ্ধি নিশ্চিত করবে। ক্রিয়াপদের ব্যবহারও বাদ যাবে না।

কতটুকু সেই চেষ্টা সফল হবে সেটা নির্ভর করবে বাংলা ভাষার কবি-সাহিত্যিকদের শক্তির ওপর। সেই শক্তির চর্চা তো তরুণদের সাহসী প্রয়াসের মধ্যেই আগে ধরা পড়বে। বিদ্যমান ভাষার যে সামাজিক বা সামষ্টিক দিক তার সীমানা প্রসারিত করলে কতদূর সেটা লংঘন বলে পরিগণিত হবে সেটা আইন করে ঠিক করে দেবার বিষয় নয়। তরুণদের ভাষায় ক্রিয়াপদ ব্যবহারে স্বেচ্ছাচারিতা থাকলেই তা সাহিত্যে গৃহীত হয়ে যাবে তারও কোনো কথা নাই। কিন্তু পরীক্ষা-নিরীক্ষার এই অধিকার মানতে হবে—এমনকি সৃষ্টিশীল স্বেচ্ছাচারিতার মূল্যও সাহিত্যের দিক থেকে অপরিসীম।

যাঁরা সাহিত্যের ইতিহাস জানেন তাঁদের কাছে এইসব নতুন কোনো কথা নয়। বাংলা একাডেমীকে এই সব উদ্ভট চিন্তা বাদ দিতে হবে। বাংলা ভাষা কী রূপ নিয়ে দাঁড়াবে সেটা কাউকে আইন করে ঠিক করে দিতে হবে না। কেউ যেন স্বেচ্ছাচারিতাকেই সাহিত্যের স্বাধীনতা বলে ভুল না করে তার জন্য পরামর্শ দিতে পারে বাংলা একাডেমী। আইন করে ভাষা ব্যবহার শাসন করবার এই উদ্ভট চিন্তা ফ্যাসিবাদী কিনা সেই তর্কটা করা দরকার।

কিন্তু গালি দেবার জন্য শব্দ ব্যবহার করলে আমরা ভুল করব। নিঃসন্দেহে ফ্যাসিবাদের ভিত্তি ভাষা ও সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদ ও আত্ম পরিচয়ের রাজনীতি নিয়ে অন্ধ আবেগ। ফ্যাসিবাদ শুধু একনায়কতন্ত্র নয়, বরং এমন এক একনায়কী ক্ষমতা যার পেছনে গণসমর্থন থাকে। বাংলাদেশ সেই ধরণের বিপজ্জনক খাদে পড়েছে। ফ্যাসিবাদকে চিনবার আরো একটি সহজ পথ হচ্ছে একধরণের বিশুদ্ধতার ধারণা।

নাৎসি জার্মানি তাদের রক্তের বিশুদ্ধতা নিয়ে দর্প করে ফ্যাসিবাদের একটা ঐতিহাসিক রূপ আমাদের দেখিয়েছে। ভাষার বিশুদ্ধতার ধারণাকে সেই দিক থেকে ফ্যাসিবাদ থেকে আলাদা করতে পারি না। বাংলা ভাষার তথাকথিত ‘প্রমিত রূপ’ বা বিশুদ্ধ ধারণার মধ্যে ভাষা ব্যবহারের অন্য সকল সম্ভাবনা নাকচ করে দেওয়াকে তরুণদের এই অর্থেই ফ্যাসিবাদ মনে হয়েছে। আসলেই, একে রুখে দেওয়াই এখনকার কাজ। ২৩ ফাল্গুন ১৪১৬।

৭ মার্চ ২০১০। শ্যামলী। *লেখাটি বিডিনিউজ২৪-এ প্রকাশিত হয়েছে

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.