আমরা যদি না জাগি মা, কেমনে সকাল হবে...
এক পাহাড়ি গেরিলার স্মৃতিচারণ
"...আমাদের দলে গেরিলার সংখ্যা ৯০ জন। আমাদের যে স্বয়ংক্রিয় আধুনিক অস্ত্র ছিল, সবই সঙ্গে নিলাম। যেমন একে-৪৭ রাইফেল, চাইনিজ রাইফেল, এলএমজি, এসএমজি, কারবাইন প্রভৃতি। আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম আর্মির গ্রুপে যতজনই থাক না কেন, প্রথম আক্রমণেই আমরা তাদের সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দেব। আমরা একটা 'সুইটেবল' পজিশন নিলাম।
অর্থাৎ মূল আক্রমণটা যেখান থেকে হবে সেটার পজিশন ঠিক করলাম। তারপর সামনে একটা গ্রুপ রাখলাম, যেটাকে বলা হয় 'ফ্রন্ট কাট অব পার্ট', একইভাবে পেছনে আর একটি 'রিয়ার কাট অব পার্ট' রাখলাম। এই দুটি শক্তিশালী গ্রুপকে রাখা হল আমাদের কাভারিং দেয়ার জন্য। সব আয়োজন সম্পন্ন হলো। এবার অপেক্ষার পালা।
কখন আসবে মেজর মহসিন রেজার সেনাবাহিনী? একদিন, দুই দিন, তিন দিন...
এভাবে সাতদিন কেটে গেল। একই স্থানে থাকা খাওয়া ঘুমানো। আবার ভেতরে ভয় কখন চলে আসে সেনাবাহিনী। কোনো কিছুই ঠিক মতো করা যায় না। আর কতদিন এভাবে থাকতে হবে সেটাও বুঝতে পারছি না।
এই যখন আমাদের অবস্থা ঠিক এরকম সময়েই চলে এলো সেনাবাহিনী। সেই সময় আমরা কিছুটা অপ্রস্তুতই বলা যায়। সাতদিনের দিন সকাল সাতটার দিকে হঠাৎ করেই দেখলাম মেজর মহসিন রেজার নেতৃত্বে ৪০ জনের মতো সেনাবাহিনী আমাদের অ্যামবুশ স্থানে চলে এসেছে। আমাদের মধ্যে কর্পোরাল শুক্র নামে একজন প্রচণ্ড সাহসী গেরিলা ছিল। সে ছিল এলএমজিম্যান।
খুব ভালো ফাইটার। সে কারণে প্রথম ফায়ারের দায়িত্ব ছিল তার ওপর। পাহাড়ি পথ বেয়ে লাইন দিয়ে এগিয়ে আসছে সেনাবাহিনী। শুক্রর দিকে খেয়াল করলাম সে ফায়ারের জন্য সম্পূর্ণ প্রস্তুত। একেবারে আমাদের রেঞ্জের মধ্যে চলে এল সেনাবাহিনী।
কমান্ডারের নির্দেশে গর্জে উঠল শুক্রর এলএমজি। শুক্রর এলএমজির গুলিতে চার-পাঁচজন আর্মি লুটিয়ে পড়লো মাটিতে। তখন আমরা সবাই গুলি শুরু করেছি। পাল্টা গুলিবর্ষণ শুরু করেছে সেনাবাহিনীও। তুমুল গুলি বিনিময় হচ্ছে।
সত্যিকার অর্থেই বৃষ্টির মতো গুলিবর্ষণ। এক পর্যায়ে দেখলাম মেজর মহসিন রেজা সাত-আটজন সৈনিক নিয়ে মোটা গাছের আড়ালে পজিশন নিয়ে গুলিবর্ষণ শুরু করলো। আমরা বেশ সমস্যায় পড়ে গেলাম। এভাবে বেশ কিছুক্ষণ গুলি বিনিময় হলো। তারপর আমাদের মধ্যে থেকে একজন গেরিলা 'অ্যামবুশ' অবস্থান থেকে সামনে এগিয়ে গেলেন।
একেবারে ফিক্সড লাইন অর্থাৎ কোনো আড়াল ছাড়া সামনে গিয়ে অবস্থান নিলেন। তার হাতে ছিল কারবাইন। ব্রাশফায়ার করলেন। পঁচিশ রাউন্ড গুলি বেরিয়ে কারবাইনের ম্যাগাজিন খালি হয়ে গেল। মেজর মহসিন রেজাসহ সাত-আটজন সৈনিকের রক্তাক্ত দেহ পড়ে রইল মাটিতে।
নিহত হলেন তারা সবাই। আধঘন্টার মতো যুদ্ধ চলল। সেনাবাহিনীর পুরো এক প্লাটুনের ৪০ জনের মতো সৈনিক নিহত হলেন। দুটি রকেট লাঞ্চার, মর্টার, এসএমজি, এলএমজি, একে-৪৭ রাইফেল, চাইনিজ রাইফেল প্রভৃতি প্রায় ৪০টি মতো আর্মির অস্ত্র দখল করলাম আমরা। এই প্রচুরসংখ্যক অস্ত্র নিয়ে আমরা বিজয়ীর বেশে ফিরে এলাম..."
(সূত্র : শান্তিবাহিনী ও গেরিলা জীবন/ গোলাম মোর্তোজা, সময় প্রকাশনী, ২০০২)
শান্তিবাহিনীর আরেক গেরিলা ও দীঘিনালা কলেজের সাবেক শিক্ষক বোজেন্দ্র প্রসাদ চাকমা ওরফে বিভাশের স্মৃতিচারণ- "আমি যখন চট্টগ্রাম কলেজে লেখাপড়া করছি সেই সময়ের একটি ঘটনা এখনো মনে আছে।
শান্তিবাহিনীর একটি অ্যামবুশে সেনাবাহিনীর মেজর মহসিন রেজা নিহত হলেন। মহসিন রেজার স্ত্রীও তখন চট্টগ্রাম কলেজে পড়তেন। তার মৃত্যুর খবর এলো। হাউমাউ করে কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন মহসিন রেজার স্ত্রী। সেই দৃশ্য এখনো আমার চোখে ভাসে।
"
(সূত্র : প্রাগুক্ত)
(ডিসক্লেইমার : নিচের ঘটনাক্রম পুরোপুরি বানোয়াট ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। প্রিয় ব্লগার, সুতরাং নিচের দিকের কিছুই পড়ার দরকার নেই আপনার, কারণ সেটা 'মানুষের' গল্প নয়, হতভাগা বাঙালির নিয়তি!)
ঘটনাক্রম (১৯৭৭-) : পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙালি ও সেনা হত্যা
৬ মে ১৯৭৭ : সাঙ্গু নদীতে কর্তব্যরত অবস্থায় আবদুল কাদিরসহ পাঁচ সেনাসদস্যকে হত্যা।
২৫ অক্টোবর ১৯৭৭ : বান্দরবানে নিহত হন নায়েক আবদুল গণি মিয়া, নায়েক আবদুস সাত্তার, নায়েক আরিফ, সিপাহী লুৎফর রহমান, সিপাহী আলী হোসেন এবং সিপাহী আবদুল খালেক মুন্সি।
২ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৯ : সাঙ্গু নদীতে অ্যামবুশ, এক সেনাসদস্যকে হত্যা এবং প্রচুর গোলাবারুদ লুট।
৫ জুলাই ১৯৭৯ : কাপ্তাই নতুন বাজার থেকে ২ জন আনসার সদস্যকে অপহরণ করে হত্যা।
১৮ সেপ্টেম্বর ১৯৭৯ : দীঘিনালায় নায়েক এসএম রুহুল আমিনকে হত্যা।
১৪ অক্টোবর ১৯৭৯ : খাগড়াছড়িতে পাঁচ সেনাসদস্যকে হত্যা।
১৯ ডিসেম্বর ১৯৭৯, লংগদু : একই রাতে একযোগে কয়েকটি গ্রামে হামলা, ২০ অ-উপজাতীয়কে হত্যা, আহত ৪০, ১০৪টি বাড়ি অগ্নিদগ্ধ।
২৩ জানুয়ারি ১৯৮০ : খাগড়াছড়িতে তিন সেনাসদস্য খুন, আহত ৫।
২১ এপ্রিল ১৯৮০ : ফালাউংপাড়া নামের একটি স্থানে অ্যামবুশ করে ১১ রাইফেল ব্যাটালিয়নের ২০ জন জওয়ানকে হত্যা, প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র লুট।
১ মার্চ ১৯৮০ : ঘন্টিছড়া নামের একটি স্থানে অ্যামবুশ করে হত্যা করা হয় মেজর মহসিন আলমসহ ২২ জন সেনাসদস্যকে।
২৫ মার্চ ১৯৮০, কাউখালী : বাঙালি বসতিতে হামলা, দুই পক্ষে নিহত ২৯, আহত ১১ জন।
১৫ সেপ্টেম্বর ১৯৮০, কাউখালী, বেতছড়ি ও কচুখালী : আকস্মিক আক্রমণে ৬ বাঙালি খুন, আহত ২৫ জন।
২৯ এপ্রিল ১৯৮৪ : খাগড়াছড়ি মাটিরাঙ্গায় বাঙালি বসতিতে গণহত্যা। হতাহতের প্রকৃত চিত্র পাওয়া যায়নি।
৩০ ও ৩১ মে ১৯৮৪, ভূষণছড়া ও বরকল : দিবাগত রাতে বাঙালি বসতিতে হামলা, ৮৮ জনকে গুলি করে হত্যা, আহত ৩৩ এবং ১৮ জন অপহৃত। আগুনে পুড়ে ছাই ২৬৪টি বাড়ি।
১৯ জুলাই ১৯৮৬ : খাগড়াছড়িতে এক সেনাসদস্য নিহত, আহত ৭।
২২ জুলাই ১৯৮৬, দীঘিনালা : সশস্ত্র হামলায় ২৪ বাঙালি খুন, ৩২ জনকে অপহরণ।
৭ আগস্ট ১৯৮৬ : ২ জন আনসার সদস্যকে অপহরণ করে হত্যা।
২১ জুন ১৯৮৭ : নাড়াইছড়ির অদূরে অ্যামবুশ, সেনাসদস্য আবদুর রাজ্জাক, ইসমাঈল হোসেন ও মোহনলালকে হত্যা।
২৪ নভেম্বর ১৯৮৭ : শিলছড়িতে দুই সেনাসদস্যকে গুলি করে হত্যা।
১৮ এপ্রিল ১৯৮৯, বাশখালী : পাহাড়ি-বাঙালি সংঘর্ষে ১৫ জনের মৃত্যু।
২৭ জানুয়ারি ১৯৮৯ : বন কর্মকর্তা আবুল হোসেন, বজল আহমদ ও মাহবুবুল আলমকে অপহরণ করে হত্যা।
৪ মে ১৯৮৯, লংগদু : আকস্মিক আক্রমণে ১৫ বাঙালির মৃত্যু।
১৬ এপ্রিল ১৯৯০, নাইক্ষ্যংছড়ি ও বলিপাড়া : ১৯ বাঙালিকে গুলি করে হত্যা। এ বছরই থানচিতে ১১ জন সেনা জওয়ানকে অপহরণ করে হত্যা করা হয়।
১০ জানুয়ারি ১৯৯২, খিরাম : খিরাম বন কার্যালয়ে আক্রমণ, ৬ কর্মচারীকে হত্যা।
২ ফেব্রুয়ারি ১৯৯২, লংগদু : চলন্ত লঞ্চে বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে ১৭ বাঙালিকে হত্যা।
২৯ জুন ১৯৯২ : মহালছড়ি-রাঙ্গামাটি সড়কে পাহারা চৌকির ওপর হামলা, দুজন সেনা সদস্য নিহত।
১৪ জুন ১৯৯৫ : শান্তিবাহিনীর ২০ সদস্যের একটি গ্রুপের হাতে ব্যাংক লুট। গার্ডকে হত্যা এবং দুই ব্যাংক কর্মচারীকে অপহরণ।
৯ সেপ্টেম্বর ১৯৯৬, পাকুয়াখালী (রাঙামাটি) : নৃশংস হামলা চালিয়ে ৩৫ জন নিরস্ত্র বাঙালি কাঠুরিয়াকে হত্যা।
ভালো থেকো কল্পনা চাকমা, ভালো থেকো মেজর মহসিন রেজা, ভালো থেকো ধান, ভাটিয়ালী গান, ভালো থেকো...
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।