হিন্দু না ওরা মুসলিম ঐ জিজ্ঞাসে কোনজন, কান্ডারি বলো ডুবিছে মানুষ সন্তান মোর মা'র
[ এই ভাষা আন্দোলনের মাসেই এদেশের ক্ষুদ্র জাতিসত্তাদের সাথে সংঘাতে জড়িয়ে পরেছে এদেশেরই কিছু বাঙালি, আবার এই ব্লগেই দেখতে পাচ্ছি এদেশিয় ক্ষুদ্রজাতিসত্তাদের বিরুদ্ধে ভাষাগত সহিংসতা। "পাহাড়ি সন্ত্রাসী" নাম চাপিয়ে দিয়ে আমরা যা করছি সেই একই কাজ ব্রিটিশরা/পাকিস্তানীরা একসময় আমাদের সাথে করেছে এবং বর্তমানের মার্কিন উপনিবেশী শক্তিও ঠিক সেই একই কাজ করে তার শত্রুদের বিরুদ্ধে। ভাষা আন্দোলন আর মুক্তিযুদ্ধের জাতি হিসাবে এই ব্লগের অনেকের সহিংস লেখা দেখে আমি ভাষা হাঁড়িয়ে ফেলেছি। যে জাতির জন্ম উপনিবেশের বিরুদ্ধে লড়াই করে, সেই জাতির জন্য এ চরম অবমাননাকর। ক্ষুদ্র জাতিসত্বা বা আদিবাসী যারা তারা নিরাপত্বার অভাবে না পরলে কখনো বিচ্ছিন্নতা চায়না, কারন তারা ক্ষুদ্র জাতিসত্বা।
ইতিহাস সাক্ষি এদেশীয় ক্ষুদ্র জাতিসত্বার ওপর আগ্রাসন চালিয়েছে আমাদের দেশেরই উপনিবেশী কাঠামোর পশ্চিমা দালাল সরকার গুলো। এই ভাষা আন্দোলনের মাসে অন্তত সেই কাঠামোর বিরুদ্ধে দাঁড়াই। ফয়েজ আলমের লেখাটা এখানে দিলাম এই কারনেই। বড় লেখা। কিন্তু কষ্ট করে পড়লে আমাদের নিজেদের চেতনার উপকারই হবে।
অন্ধত্ব মুক্তি দেয়না। ]
ভাষা আর সংস্কৃতির ক্ষমতা: ক্ষুদ্র জাতিসত্তা প্রসঙ্গে
ফয়েজ আলম
ঢাকাত্ত আইলান যাদু ফাসকি মারানি।
'আব' 'আব' কইরা গেল যাদুর পরাণি॥
আগে যুদি জানতাম যাদু ‘আবেরে কয় পানি।
তে কি আর যাইত আমার যাদুর পরাণি॥
এই ছড়াটা আমি শুনেছি মায়ের কাছে। তিনি পেয়েছেন তার নানীর কাছ থেকে।
ছোটোবেলা ছড়াটা শুনলেই হাসি আসতো। কোনো এক মায়ের ছেলে ঢাকায় থাকতো। বাড়ি গিয়ে সে ফাস্কি (ফারসি) ভাষায় কথা বলা শুরু করে। একদিন ভাত খাওয়ার সময় গলায় ভাতের নলা আটকে গেলে সে ‘আব’ ‘আব’ করতে থাকে। ‘আব’ অর্থ পানি।
ফারসি না-জানা মা ছেলের কথা বুঝতেও পারে না, পানিও দেয় না। ফারসিঅলা ছেলেটি দমবন্ধ হয়ে মারা যায়। ‘আব- এর অর্থ জানার পর পুত্রহারা মায়ের বুকফাটা আর্তি বেরিয়ে আসে এই চারটা চরণে। ফারসি ‘আব’ শব্দটা হয়তো সেই মায়ের বুকে দারুণ সেলের মত গেঁথে ছিলো সারা জীবন। --- এই করুণ কথাটার মধ্যে হাসির খোরাক কই!
মন এর একটা ব্যাখ্যা অবশ্য বানিয়ে নিয়েছে: ফাসকি বুলিতে নিজের দেমাগ জাহির করতে চেয়েছিলো সেই মানুষটা, তার নিজ সমাজের হয়েও নিজেকে সমাজের সকলের থেকে আলাদা খাড়া করতে চেয়েছিলো।
ফলে আমার অপরিণত মনে সে পরিণত হয়েছিলো আনমানুষে (আদার)। তাই তার করুণ দশা আমার হাসির কারণ হয়ে থাকবে। যার অর্থ হচ্ছে, এই পদের আসল কথাটা ছোটবেলা কোনদিনই ধরতে পারি নাই আমি।
সেইটা হলো, মানুষের ভাষা তার সমাজ ও পরিপার্শ্বের সাথে এমন নিবিড় সম্পর্কে জড়ানো যে সেই ভাষার সাথে বিচ্ছেদ হলে চারপাশের মানুষ ও পরিপার্শ্বের সাথেও একরকম বিচ্ছেদ ঘটে যায়। জন্মের পর যে-ভাষায় মায়ের সাথে (বা ধাই-মার সাথে) মনের ভাব আর কাজের কথা লেনদেন করতে করতে আমরা বেড়ে উঠি সেই ভাষা দূরে ঠেলে দিলে মা-সন্তানের সমন্ধেও ফারাক দেখা দেয়।
কারণ ভাষা ব্যক্তিগত ব্যাপার নয়, একটা সামাজিক অর্জন। ভাষার মধ্যে আছে বহু শত বছরের হাজার-হাজার লক্ষ-লক্ষ মানুষের ইচ্ছা, সম্মতি, ঐক্যমত, স্মৃতি আর অভিজ্ঞতার ফোঁড়। ভাষা বেঁচে থাকে সমাজের সকলের ওপর ভর দিয়ে। সেই দিক থেকে বলতে পারি সমাজের সকলে ভাষার জালের মধ্যে একজন আরেকজনের সাথে সম্পর্কিত। ভাষা ত্যাগ করার অর্থ হলো সেই জাল থেকে বেরিয়ে যাওয়া, ভাষার দিক থেকে সকলের সাথে যে-সমন্ধ তার থেকে খারিজ হয়ে যাওয়া।
সামাজিক মানুষ কেবল মাটির আশ্রয়ে বাঁচে না, ভাষার মধ্যেও বাঁচে, ভাষার মধ্যে সে মানুষ হয়ে ওঠে। সংস্কৃতি বলতে যা বোঝায় তার মূর্তিটার অনেকখানিই ভাষা দিয়ে বানানো। মানুষের আত্ম-চেতনা বা আমিত্বের বোধের বেশিরভাগটা ভাষার আশ্রয়ে তৈরি। যে-প্রাকৃতিক ও সামাজিক পরিবেশের মধ্যে মানুষের বড়-হওয়া সেই পরিবেশকে সে চৈতন্যে ধারণ করে ভাষার সাহায্যে চিনে নিয়ে।
অন্যদিকে, ভাষা বিকশিত হয়েছে সমাজের অতীত ও বর্তমানের সকল মানুষ আর পরিপার্শ্বের মধ্যেই।
কোনো একটা জনগোষ্ঠীর লোকদের কাছে ভিন্ভাষা কেবল ভিন্ন একটা ভাষাই নয়, বরং সেই ভিন্ভাষার জনসমাজ ও পরিবেশের অতীত ও বর্তমানের ইতিহাসের ভিন্নতারও চিহ্ন। মান্দি জনগোষ্ঠীর একটা মানুষ হয়তো ছোটোবেলা থেকে ‘দো’ শব্দটি দিয়ে পাখি বুঝে এসেছে, হরেক রকম পাখি। সেইসব পাখির পাখনার রঙ কেমন, কোন গাছে কোন পাখি বসতো, কিভাবে ডাকতো--এসবই ভেসে উঠবে ‘দো’ শব্দটি উচ্চারণের সাথে সাথে। কারণ মাসের পর মাস বছরের পর বছর তার চৈতন্যে ‘দো’ শব্দের বিচিত্র ব্যবহারের সাথে সাথে এইগুলাও দাগ কেটেছে, স্মৃতিতে জমা হয়েছে। এখন সে যদি নতুন করে ‘পাখি’ বা ‘বার্ড’ শব্দ দিয়ে পাখিকে বুঝতে চায় তাহলে তার স্মৃতি শক্তি কাজে লাগিয়ে প্রতীক হিসাবে এর অর্থ বুঝতে পারবে, কিন্তু তার চৈতন্য থেকে হারিয়ে যাবে ‘দো’ শব্দটির সাথে জড়িয়ে থাকা বাহারি রঙের অনুভূতি, বিচিত্র কলকাকলির রেশ।
‘পাখি’ বা ‘বার্ড’ তার কাছে কেবলই একটা প্রতীক---শুকনো খড়খড়ে প্রতীক হয়ে থাকবে দীর্ঘদিন।
ভাষা, ভাষা-জগত
সমাজিক মানুষের একটা গুরুত্বপূর্ণ অর্জন হচ্ছে ভাষা। সাধারণভাবে ভাষা বলতে বোঝায় এক বা একাধিক ধ্বনির বিশেষ বিন্যাসময় উচ্চারণের (বা লেখনের) মধ্য দিয়ে মনের ভাব প্রকাশের ব্যাপার: এখানে ধ্বনি বা অক্ষর, এদের নিয়মমাফিক সম্মিলন, এবং বিন্যাসের ধরণকেও ভাষার অঙ্গ ধরতে হবে; অথাৎ সবটা মিলিয়েই ভাষা।
আধুনিক ভাষাবিজ্ঞানের ভিত্তি ধরা হয় সোস্যুরের ভাষাচিন্তাকে। সোসুর বলেন ‘ভাষা হলো অর্থের বিভেদনামূলক নেটওয়ার্ক’।
ভাষা কাজ করে দুইটা জিনিষের সাহায্যে: এক ধ্বনিপ্রতিমা, দুই ধ্বনিপ্রতিমা বা আওয়াজের দ্বারা মনে জেগে উঠা ধারণা। যেমন ‘মাছ’ একটি ধ্বনিগুচ্ছ, যেটাকে শব্দ বলা হয়। এই ধ্বনিগুচ্ছটি উচ্চারণ করলে আমরা নির্দিষ্ট ধরণের একটি জীবের কথা ঝুঝি, সেই শ্রেণীর জীবের কিছু বৈশিষ্টও আমাদের মনে চলে আসে। বাস্তবে ‘মাছ’ ধ্বনিগুচ্ছের সাথে প্রকৃত জীবটির (অর্থাৎ মাছ বলতে যে জীবটিকে বুঝি সেই জীবটির) কোনো সমন্ধ নাই। এই যে ‘মাছ’ শব্দটি দিয়ে একটা জীবকে বোঝানো হচ্ছে বোঝানোর সেই কাজটায় মাছ শব্দটা হলো দ্যোতক, আর প্রকৃত (মাছ নামের) জীবটা হলো দ্যোতিত।
মাছ বলতেই যে আমরা নির্দিষ্ট ধরণের একটা জীবকে বুঝে নিই তার কারণ হলো মাছ শব্দটা এ ধরণের অন্য শব্দ যেমন ‘গাছ’, ‘পাছ’ ইত্যাদি থেকে আলাদাভাবে কানে বাজে। সোস্যুরের কথা হচ্ছে অর্থ সৃষ্টি হয় ধ্বনিগুচ্ছের (সাধারণভাবে যাকে শব্দ বলি সেগুলোর ) পার্থক্য উপলব্ধির মধ্য দিয়ে। মাছ যে ‘গাছ’ বা ‘পাছ’ কিংবা ‘কাছ’ না সেইটা বোঝার মধ্য দিয়ে আমরা মাছ নামের জীবটার কথা ধারণা করতে পারি। অর্থাৎ ধ্বনিগুচ্ছের বিভেদ চিনে চিনে শব্দের অর্থ উপলব্ধি হয়। এজন্যই ভাষাকে অর্থের বিভেদনামূলক নেটওয়ার্ক বলা হচ্ছে।
ধ্বনিগুচ্ছ যেনতেন ভাবে উচ্চারণ করলেই অর্থ হয় না, সেগুলো উচ্চারণ করতে হয় বিশেষ কিছু নিয়ম মেনে। সেই নিয়মগুলোকে সোস্যুর লঁগ বলেন।
এখন কথা হচ্ছে নির্দিষ্ট কোনো ধ্বনিগুচ্ছ উচ্চারণ করলে কেন আমরা একটা বিশেষ ধরণের জীব (মাছ) বুঝতে পারি? এখানে আসে ভাষার উৎপত্তির প্রশ্নটি। ভাষা একদিনে সৃষ্টি হয় নাই। দল বেঁধে বাস আরম্ভ করার পর থেকে মানুষ বহু শত সহস্র বছর ধরে তিল তিল করে ভাষার ব্যাপারটা তৈরি করেছে।
মানুষ যখন একা বাস করতো তখন ভাষার দরকার পড়ে নাই। দলবদ্ধ বসবাস করতে গিয়েই একজন আরেকজনের কাছে মনের ভাব প্রকাশ করার প্রয়োজন বোধ করে। আকারে ঈঙ্গিতে, হাতের টানে চেহারাসুরত-আকার বুঝিয়ে অথবা আওয়াজ অনুকরণ করে মনের ভাব অন্যকে বোঝানোর সূচনা করে মানুষ। এর মধ্যে আওয়াজ অনুকরণের কায়দাটাই আধুনিক ভাষা হিসাবে বিকশিত হয়।
প্রথম দিকে মানুষ তার চারপাশের প্রকৃতির বিভিন্ন শব্দ অনুকরণ করতে করতে অর্থবোধক শব্দের জন্ম দেয়।
সে পর্যায়ে হয়তো এক একটি শব্দ কোনো একটি বস্তু বা কাজকে নির্দেশ করার জন্য ব্যবহার করা হতো। একদল মানুষের কোনো একজন হয়তো অন্য আরেকজনের নিকট বাঘ বা কুকুরের কথা বলতে চাইলে বাঘ বা কুকুরের আওয়াজ অনুকরণ করে ভাবটা ব্যক্ত করে। যার উদ্দেশ্যে আওয়াজ করা সে যখন বুঝতে পারে যে এই আওয়াজের অর্থ হচ্ছে লোকটা বাঘ কিংবা কুকুরের কথা বলছে তখন ভাষার একটা শব্দ সৃষ্টি হলো। একই পদ্ধতিতে দলের প্রত্যেকটি লোকই হয়তো এই আওয়াজের মধ্য দিয়ে সংশ্লিষ্ট প্রাণীটি (বাঘ বা কুকুরকে) বুঝতে আরম্ভ করে। ফলে এই দলটার ভাষার একটা শব্দ হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেল সেই আওয়াজ।
কোনো একটা দল বা জনগোষ্ঠীর সকলের ব্যবহার ও মান্যতার মধ্য দিয়ে ভাষার সূচনা। শুধু একজন কথক হাজার বছর বেঁচে থেকে প্রতিদিন একই শব্দ দিয়ে বাঘ বা অন্য কোনো প্রাণী বোঝানোর চেষ্টা করলেও যদি কেউ তা বুঝতে না পারে তা হলে সেই শব্দটি কখনো অর্থবাচক শব্দ বা মুনিষ্যি ভাষার শব্দ হয়ে উঠবে না। অর্থাৎ ভাষা এবং শব্দ, ধ্বনি, অক্ষর ইত্যাদি ভাষিক উপাদান কারো ব্যক্তিগত অর্জন নয়, এগুলো সামাজিক সম্পদ, সমাজের অধিকাংশ লোকের একমতের ভিত্তিতে তৈয়ার করা।
সূচনা পর্যায়ে আওয়াজ অনুকরণ করে সংশ্লিষ্ট প্রাণী/বস্তু/কাজ বোঝানোর পদ্ধতি সৃষ্টি হয়। কাকের ডাক অনুকরণ করে ‘কাক’-এর নাম দেয়া হলো ‘কাউয়া’।
কোকিল শব্দটি প্রলম্বিত করে উচ্চারণ করলে বোঝা যায় এই পাখিটির ডাকের সাথে তার নামের ধ্বনিগত সাদৃশ্য আছে। মানুষ তার চারপাশকে আরো ভালোভাবে খুঁটিয়ে পর্যবেক্ষণ করার সূত্রে বস্তু ও ক্রিয়ার নামকরণে সংশ্লিষ্ট বস্তুর অন্যান্য গুণও যুক্ত হয়। যে-সব প্রাণী/বস্তু/কাজের সাথে কোনো শব্দই উৎপন্ন হয় না হয়তো সেগুলো বোঝানোর জন্যই সৃষ্টি হয় সামগ্রিকভাবে দ্যোতিত-নিরপেক্ষ শব্দ। বর্ণনামুলক সরল বাক্য গঠন শুরু হয়ে থাকবে এর পরের পর্যায়ে। ভাষা সৃষ্টির অনেক পড়ে লিপির সৃষ্টি হয়েছে বলে মনে হয়।
প্রথমদিকের লিপি ছিলো চিত্রলিপি। সেই লিপিতে কোনো একটা চিত্র দিয়ে নির্দিষ্ট একটা ভাব বোঝানো হতো।
আমরা এখন যে লিপি ব্যবহার করি তা প্রতিকী লিপি, একেকটা ধ্বনির জন্য একেকটা চিহ্ন প্রতীক বা বদলী হিসাবে ব্যবহৃত হয়। যেমন /শ্/ ধ্বনিটির জন্য লেখা হয় ‘শ’।
ভাষার সূচনা পর্যায় থেকে ধ্বনি ছিলো মূল ব্যাপার।
লিপি সৃষ্টি হওয়ার পর লিপি হলো ধ্বনির প্রতীক, মূল ভাব/বস্তুর প্রতীক নয়। এটা অবশ্য ভাষা তার পুরো ক্ষমতা নিয়ে বিকশিত হওয়ার পরের ব্যাপার। প্রথম দিকে কোনো মানুষের সামনে একটা নির্দিষ্ট আওয়াজ করলে সে স্মৃতি থেকে হাতড়ে আওয়াজের নির্দেশনাটা বুঝতো। ভাষা আরো বিকশিত হওয়ার পর তা সমাজের অন্যান্য নিয়মকানুনের মতই মানবিক নিয়তিতে পরিণত হয়। সমাজে যে জন্মাবে তাকে বাধ্য হয়েই সেই ভাষা রপ্ত করতে হবে।
কারণ যে সমাজে সে জন্ম নেয় সেই সমাজকে ভাষিক সমাজ বললেও বেশি বলা হয় না। সমাজে জন্ম নেয়ার অর্থ একটা ভাষা-জগতে প্রবেশ করা। সেই সমাজের আচার-কানুন, চালচলন, অভ্যাস, কল্পনা, সুখ-দুঃখ সবই প্রকাশিত হচ্ছে ভাষার মাধ্যমে, পরস্পরের মধ্যে বিনিময়ও হচ্ছে ভাষায়। সমাজে জন্মের পর কোনো মানুষ যখন তার পরিপার্শ্বকে বুঝতে চায় তখন তাকে তা বুঝতে হয় ভাষার সহায়তায়। কারণ তার আগেই সেই সমাজের সকল মানুষ ভাষার মাধ্যমে জীবন ও জগতকে নিজ নিজ কায়দায় চিনে নিয়েছে।
তাই আগত শিশুটিকে প্রচলিত কায়দাতেই চিনে নিতে হয় প্রকৃতিকে। যেমন ডাল-পাতাঅলা উদ্ভিদটিকে ‘গাছ’ নামে চিনতে হবে। ভিন্ন কোনো নামে চিনতে চাইলে তা অন্যের বোধগম হবে না। অর্থাৎ ভাষা ছাড়া সামাজিক ও চিন্তাশীল ব্যক্তি হিসাবে বিকশিত হওয়ার সুযোগ নাই। তাই জন্মের পর শিশুর গুরুত্বপূর্ণ কাজের একটা হচ্ছে ভাষায় আত্তীকরণ।
ভাষায় আত্তীকরণ হয় ধীরে ধীরে, অনেক বছর ধরে। এক অর্থে ভাষার মধ্য দিয়ে মানুষের অর্জন অব্যাহত থাকে সারাজীবন। এই কাজে ধ্বনিপ্রতিমার ভূমিকা জরুরী। অর্থ বোঝার পয়লা অবলম্বন ধ্বনিপ্রতিমা। ধ্বনি শোনার পর যে-প্রক্রিয়ায় অর্থ বোধগম্য হয় তা কেবল বুদ্ধির ব্যাপার নয়, প্রতিবর্তী ক্রিয়ার মতই একরকম ক্রিয়া।
অর্থাৎ নির্দিষ্ট একটা ধ্বনিগুচ্ছ কানে যাওয়ার সাথে সাথে স্বংক্রিয়ভাবে সংশ্লিষ্ট বস্তু বা ক্রিয়াটি সম্পর্কে ধারণা আসে শ্রোতার মনে। শ্রোতা চাইলেও এ প্রক্রিয়া থামিয়ে রাখতে পারবে না। এ অবস্থা অর্জিত হয় বহুদিনে। একেবারে নিকটজন থেকে আরম্ভ করে চারপাশের মানুষ, সামজিক ও প্রাকৃতিক পরিবেশ সবকিছুর প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে একই শব্দ অসংখ্যবার শুনতে শুনতে ধ্বনিপ্রতিমাটির সাথে স্মৃতির স্বয়ংক্রিয় সমন্ধ ঘটে। চৈতন্যে এই ধ্বনির সাথে ওতোপ্রোতভাবে মিশখেয়ে থাকে সংশ্লিষ্ট বস্তু বা ক্রিয়ার ধারণাটা ।
জন্মের পর মানুষ যখন ভাষা শিখতে থাকে তখন তার স্মৃতিতে জমা হতে থাকে এইরকম বহুসংখ্যক ধ্বনিগুচ্ছের ছাপ এবং সংশ্লিষ্ট দ্যোতিত বস্তু বা ক্রিয়া সম্পর্কিত ধারণা। মানুষ লিখিত ভাষা পড়ার সময়ও মনে মনে ধ্বনিটি উচ্চারণ করে। এর ফলেই মাথায় আসে সংশ্লিষ্ট ধারণা। এভাবে যে-কোনো ভাষার শব্দরাশির (এখানে শব্দ বলতে অর্থবোধক ধ্বনিগুচ্ছ বুঝতে হবে) সাথে সেই ভাষাব্যবহারকারীর স্মৃতি এমনকি চেতন-অবচেতনের একটা সমন্ধ স্থাপিত হয়ে যায়। সচরাচর যে-প্রাকৃতিক পরিবেশে ভাষার উৎপত্তি সেই সামগ্রিক পরিবেশেই শিশুমানবের সাথে সেই ভাষার আত্তীকরণ হয়।
একটি ভাষার মধ্য দিয়ে ব্যক্তির মনোজগত গড়ে ওঠার পর সে যখন ভিন্ন ভাষা শিখতে যায় তখন মূলত তার নিজ ভাষার অসংখ্য শব্দরাশির ধারণার আলোকে অনুবাদ করে বুঝে নেয় নতুন ভাষার শব্দগুলোকে। কারণ নয়া ভাষাটি তার নিজস্ব পরিবেশ থেকে ভিন্ন পরিবেশে কথিত হচ্ছে। এ ছাড়া, শ্রোতার চেতন-অবচেতনে এইসব ধ্বনিগুচ্ছের ছাপও নেই। এ অবস্থায় নতুন ভাষিক ধারণাগুলো অবশ্যই পুরানো ভাষিক ধারণার ওপর নির্ভরশীল থেকে যাবে।
এতো গেল মূল শব্দের ব্যাপার।
এরপর আসে প্রতিটি শব্দের ব্যবহারগত বৈচিত্রের সাথে সম্পর্কিত নানা ভাবমূর্তি, চিত্রকল্প, রঙ, অনুভূতি ইত্যাদির কথা। যেমন: ‘হাটত্ত আইলাম (হাট থেকে এলাম)’ এ বাক্যটিতে হাট শব্দটি (অর্থাৎ ধ্বনিগুচ্ছ) গাঁয়ের বাজারের কথা বোঝাচ্ছে। কিন্তু যিনি শুনছেন তার মনে হাট সম্পর্কিত অন্যান্য ধারণা ও চিত্রকল্পগুলাও হাজির হবে। হাট কথাটা শোনার পর প্রথমেই তার মনে উদয় হবে নিজের দেখা হাটের ছবি। হয়তো কোনো কালে পিতার হাত ধরে হাটে ঘোরার মধুর স্মৃতিও উঁকি দিয়ে যাবে।
আসতে পারে এমন কোনো চিত্রকল্পও যা কেবল তিক্ততার স্মারক। এইখানে ‘হাট’ শব্দটার ধ্বনিগুলা গুরুত্বপূর্ণ। পরিচিত এই ধ্বনিগুচ্ছের কারণেই শ্রোতার মনে স্বংয়ক্রিয়ভাবে প্রাসঙ্গিক চিত্রকল্পগুলা মুহূর্তের মধ্যে উঁকি দিয়ে আলোড়ন তুলে আবার সরে যাচ্ছে।
ভাষা আর সংস্কৃতির আধিপত্য
যেই দেশে যেই বাক্য করে নরগণ।
সেই বাক্য বুঝে প্রভু আপে নিরঞ্জন॥
--‘নুরনামা’য় কবি আবদুল হাকিম।
অতএব একেকটা শব্দেরও ছোটোখাটো স্বতন্ত্র পৃথিবী আছে। মানুষ জন্মের পর থেকে বড় হতে হতে একেকটা শব্দ বহুভাবে, বহুব্যবহারের মধ্য দিয়ে শুনে, তার স্মৃতি-চৈতন্যে এর ছাপ এঁকে নেয়, আর এভাবে ধীরে ধীরে গড়ে তুলে সেই শব্দের নিজস্ব জগতটিকে। তাই ভাষার ক্ষেত্রে ধ্বনির ভার ও ধার কোনোটাই অস্বীকার করার না।
‘ঘরর খতা মনত্ পড়ে’ (চাকমা ভাষার) এই বাক্যটি যখন একজন চাকমা উচ্চারণ করবেন তখন তার মনে নির্দিষ্ট একটা বাড়ির ছবি ভেসে উঠবে। বাক্যটি শোনার পর কাছাকাছি উপলব্ধি হবে একজন চাকমা শ্রোতার।
কারণ এই কয়টি শব্দের ধ্বনিগুচ্ছের সাথে তার আর কথকের স্মৃতি ও অভিজ্ঞতার সাদৃশ্য অনেক। কিন্তু নেত্রকোনার একজন বাঙালি যখন চাকমা ভাষা থেকে বাংলায় অনুবাদ করে এর অর্থ উপলব্ধি করবে তখন তার মনে ভেসে উঠা চিত্রকল্পগুলো হবে প্রায় আরেক রকম। কারণ এই ধ্বনিগুচ্ছের সাথে সম্পর্কিত কোনো চিত্রকল্প বা অনুভূতি তার চেতনায় সুপ্ত নেই যে, ধ্বনিগুচ্ছগুলো শোনা মাত্র তা মনের মধ্যে ভেসে উঠবে।
এক্ষেত্রে সে বরং বুদ্ধি দিয়ে শব্দগুলোর অর্থ উদ্ধার করবে, এবং কেবল তখনই তার স্মৃতিতে সঞ্চিত সংশ্লিষ্ট ছবিগুলা সামনে আসবে। কারণ বাড়ি বিষয়ে তার অভিজ্ঞতা ভিন্ন।
কোনো ভাষার শব্দরাশির (ধ্বনিগুচ্ছের) সাথে জড়িয়ে আছে সেই ভাষা ব্যবহারকারী জনগোষ্ঠীর প্রাকৃতিক ও কৃত্রিম সকল পরিবেশ থেকেই একটু একটু করে মিশে-যাওয়া রূপ-রঙ-রস-এর স্মৃতি ও অনুরণন। সেগুলো কেবল শব্দ নয়, একেকটা ছোটোখাটো জগত। অথচ অন্যভাষাভাষীর কাছে তা কেবল নির্দিষ্ট একটা অর্থের স্মারক। কাজেই একজন চাকমা যখন বলবেন ‘বাড়ির কথা মনে পড়ছে’ তখন এই বাংলা বাক্যটির ধ্বনিগত অনুরণন মুল চাকমা বাক্যটির ধ্বনিগত অনুরণন এক হবে না; এমনকি (চাকমা) ব্যবহারকারীরও মনে হবে তার আকুতি ঠিক প্রকাশ পাচ্ছে না, চাকমা শ্রোতাও একইরকম বোধ করবে। কারণ এই বাক্যটির ধ্বনিগুচ্ছের সাথে তার স্মৃতির স্বয়ংক্রিয় সংযোগ নাই।
এইধ্বনিগুচ্ছের সাথে তার মনোজগতের আত্তীকরণ হয় নাই। সেজন্য (বাড়ি) কথাটা উচ্চারণের সাথে সাথে যে ছবি তার মনে ভেসে ওঠার কথা তা ঠিক স্বতস্ফূর্তভাবে আসবে না, অনুবাদ করে দাঁড় করাতে হবে।
যে-ভাষার মধ্যে মানুষ বেড়ে ওঠে সেই ভাষাই তার স্মৃতি, কল্পনা, অভিজ্ঞতা, জ্ঞানের আশ্রয়। দিনের পর দিন বছরের পর বছর সেই ভাষায় সে স্বপ্ন দেখেছে, সু:খদুঃ:খ কল্পনা করেছে, স্মৃতিচারণ করেছে। এই ভাষার সাহায্যেই জীবন ও জগতকে চিনে চিনে তার নিজের ভেতরে গড়ে তুলেছে আরেকটা জগত।
সেই মানুষটি যখন নিজ ভাষা ছেড়ে ভিন্ ভাষায় প্রবেশ করবে তখন তার নিজ ভাষার সাথে সম্পর্কিত অনেক স্মৃতি ও অভিজ্ঞতাই অস্পষ্ট হয়ে আসতে থাকবে, অনেক ছবি হারিয়ে যাবে, অনেক অনভূতি মুছে যাবে চিরতরে। কারণ সেগুলো আর ব্যবহৃত হবে না। এটা ঘটবে নতুন ভাষার সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলোকে জায়গা করে দেয়ার জন্যই। এ কথা কেবল ব্যক্তির ক্ষেত্রেই নয়, গোটা একটা জনগোষ্ঠী সম্পর্কেও সত্য। ভাষা বদলের কারণে সেই জনগোষ্ঠীর মূল ভাষা ও পরিবেশের সাথে সংশ্লিষ্ট অনেক অনুভূতি, অনেক চিত্র ও চিত্রকল্প, স্মৃতি, ঐতিহ্য দিনে দিনে ক্ষয় হয়ে হারিয়ে যাবে কালের অতলে।
ভাষার ব্যবহার বিচিত্র। প্রবাদ, রূপক,অলংকার ইত্যাদি রূপে ভাষার মধ্যে জমা হয়ে থাকে সংশ্লিষ্ট জাতির অহমিকার প্রসঙ্গ, এমনকি মিথ্যা অহমিকার কথাও থাকতে পারে। তেমনি থাকতে পারে অন্য জাতির প্রতি ঘৃণার প্রকাশও। যেমন আর্য ভাষাগুলায় এই প্রবণতা অনেক বেশি। বাংলায় ‘ঘাড়মোটা’ কথাটার অর্থ যুক্তিহীন একগুঁয়ে।
এটি আর্যভাষা ব্যবহারকারী মানুষদের (সাধারণভাবে যাদেরকে আর্য বলা হয় তাদের) সৃষ্ট কথা, বাংলায় চালু হয়ে গেছে। এদেশের আদিবাসিন্দা অর্থাৎ ভেড্ডিড বা আদি-অষ্ট্রেলীয়দের ঘাড় মোটা ও খাটো। দখলদার আর্যরা এখানে ঢুকতে গিয়ে স্থানীয় মানুষদের প্রবল বাধার সম্মুখিন হয়েছিলো নিশ্চয়ই। সেজন্যই স্থানীয়দেরকে হেয় করার জন্য ঘাড়মোটা কথাটা চালু করে থাকবে। এখন যে কোনো বাঙালিই হয়তো কথাটা ব্যবহার করবেন নিজের অজান্তেই।
এমনকি যার শরীরে ভেড্ডিড প্রভাবের আধিক্যের কারণে ঘাড়টা খানিকটা মোটা আর খাটো রয়ে গেছে তিনিও কথাটা উচ্চারণ করবেন। এভাবে ভাষার গুপ্ত আগ্রাসনের কারণে তিনি নিজেই নিজেকে নিয়ে মস্করা করে বসবেন, নিজের বিরুদ্ধে দাড়াবেন, প্রায় কিছু না জেনেই। ক্ষুদ্র জাতিগুলার কোনো বৈশিষ্ট নিয়ে বাংলায় এমন আন্দাজ/প্রবাদ/কথাও চালু আছে হয়তো।
ভাষাকে দিয়ে সবচেয়ে ভয়াবহ আগ্রাসানটা আসে কিতাবে সহওয়ার হয়ে, জ্ঞানর্চচার নাম ভাঙ্গিয়ে। যেমনটা ঘটেছিলো বৃটিশ উপনিবেশী শাসনামলে।
বৃটিশরা এ উপমহাদেশে ইংরেজী ভাষা শিক্ষা দেয়া আরম্ভ করার পর ইংরেজী বইপত্রের প্রতি বেশ আগ্রহী হয়ে উঠে নানা শ্রেণীর পাঠক। এই চাহিদা মেটানোর জন্য আসে বৃটিশদের লেখা ইংরেজ জাতির ইতিহাস, সাহিত্য, শিল্পকলা, দর্শন, গণিত প্রভৃতি নানা বিষয়ক বইপত্র। সেই সকল বইয়ের গুরুত্বপূর্ণ একটা কথা ছিলো এই যে, ইংরেজ যা ভাবে তা সবচেয়ে ভালো, যা করে তা সর্বশ্রেষ্ঠ, ভারতীয়রা কুসংস্করাচ্ছন্ন, পশ্চাদপদ, অলস, অদক্ষ; ইংরেজদের জ্ঞান উন্নত, ভারতীয়দের জ্ঞান নিম্নমানের, কুসংস্কারে ভরা। ভারতীয়দেরকে উন্নত হতে হলে ইংরেজদের নিকট থেকে শিখতে হবে।
তো, উন্নত হওয়ার আশায় ভারতীয়রা অবশেষে ইংরেজের জ্ঞান ও সংস্কৃতিকে আরাধ্য ধরে নেয়।
নিজেদেরকে হীন বলে বিশ্বাস করতে থাকে। অর্থাৎ ইংরেজ ও ভারতীয়দের মধ্যে তৈরি হয় শক্তিশালী হেজেমনিক সম্পর্ক। এর ফলে প্রায় দুইশ বছর ধরে ভারত শাসন করতে সক্ষম হয় ইংরেজ জাতি। মনোজগতে এই আধিপত্যের পয়লা সূইটা ঢুকে ইংরেজী ভাষা প্রবেশের মধ্য দিয়ে। এই নিয়ে অনেক লেখালেখি হয়েছে, এখানে বিস্তারিত আলোচনার দরকার নাই।
মোট কথা হচ্ছে ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাস থেকে বোঝা যায় ভাষিক-জ্ঞানতাত্ত্বিক আগ্রাসন কিভাবে মনোজগতে প্রস্তুত করে দিতে পারে সামগ্রিক আগ্রাসণের চমৎকার উন্মুখ পরিবেশ।
বাংলা এবং ক্ষুদ্র জাতিগুলার ভাষা
বাংলাদেশের ক্ষুদ্র জাতিসত্তাগুলোর ভাষার প্রশ্নটা এই দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা উচিত। এদেশে অনেকগুলো জাতি ক্ষুদ্র বলে চিহ্নিত। চট্টগ্রামে আছে ১১টি। নেত্রকোনা-ময়মনসিংহ ও অন্যান্য অঞ্চলে আছে বৃহত্তর বোড়ো গোষ্ঠীর কোচ, মান্দি, হাজং, সিলেটে খাসিয়া, উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে সাঁওতাল, ওঁরাও প্রভৃতি জাতি।
প্রায় আড়াইশো বছর ধরে এরা বিরামহীন আগ্রাসনের মধ্য দিয়ে এগিয়েছে। নানামুখি চাপে পড়ে এরই মধ্যে প্রতিটি জাতির ভাষা ও সংস্কৃতিতে ঘটে গেছে কমবেশি পরিবর্তন।
বৃটিশ দখলদারিত্বের আগ পর্যন্ত এদেশের কম-মানুষের জাতিগুলা মোটামুটিভাবে ভাষিক ও সাংস্কৃতিক স্বাধীনতা ঠিক রেখেই চলছিলো। বৃটিশ-দখলদারিত্বের আগের ও পরের কালের মধ্যে কয়েকটা মৌলিক ব্যবধানের একটা হচ্ছে ছাপাখানা ও সংবাদপত্রের ব্যবহার। ছাপা বই ও সংবাদপত্র অল্পসময়ে বহুসংখ্যক মানুষের মগজে হানা দিতে পারে।
ফলে ছাপা জিনিষের মাধ্যমে বিভিন্ন তথ্য ও মত ছড়ায়া দেয়া সহজ ছিলো। ভাষা ও সংস্কৃতির যে-আগ্রাসনকে আমরা আর্থ-রাজনৈতিক আধিপত্য ও শোষণ মজবুত করার পয়লা ধাপরূপে গণ্য করছি তা সম্ভব হয়ে উঠার একটা শক্ত কারণ ছাপাখানা ও ইলেক্ট্রনিক প্রচারমাধ্যমের আবিষ্কার। এর আগে গণপর্যায়ে ভাষিক বা জ্ঞানতাত্ত্বিক প্রভাব বিস্তার অত সহজ ছিলো না।
বৃটিশরা এ অঞ্চলে জবরদস্তি শাসন আরম্ভ করার পর আসে খ্রিস্টান মিশনারীরা। খিস্টীয় ধর্ম প্রচারের জন্য দেশের প্রত্যেকটা এলাকায় চলে তাদের কর্মকাণ্ড।
প্রথমদিকে মুলত ক্ষুদ্র জাতিগুলাই খিস্টান আগ্রাসনের শিকার হয়। এক অর্থে বলা যায় ক্ষুদ্র জাতিগুলোর ভাষা ও সংস্কৃতিকে প্রথমবারের মত ভেতর থেকে আক্রমণ করে খ্রিস্টান মিশনারীগুলা। তাদের বহুশত বছরের বিশ্বাসের জায়গাটা ভেঙ্গে দেয়া হয় ধর্মান্তরিত করার মধ্য দিয়ে। কিন্তু ধর্ম চর্চা কেবল ধর্মীয় বিষয়ে সীমাবদ্ধ থাকে না। ধর্মের সঙ্গে প্রভাব বিস্তার করে খ্রিস্টীয় নৈতিকতা, আচার-প্রথা, রীতিনীতি, ভাষা ও সাহিত্যও ।
ছোটো ছোটো মক্তব খুলে তাতে ইংরেজী শিক্ষা প্রদান আরম্ভ হয়। এমনকি এদের নামগুলাও বদলে যেতে থাকে খ্রিস্টীয় ধর্মের কারণে। পৌনে দুইশ বছরের বৃটিশ শাসনের মধ্য দিয়ে পশ্চিমের অনেক কিছূই জায়গা করে নেয় পাহাড়ের পরিসরে। পুঁজিবাদের সবচেয়ে বদবৈশিষ্টগুলোও এখানে ঢুকে পড়ে----পাহাড়ের প্রকৃতি-নির্ভর জীবনের পরিবর্তে বাজারী পণ্যমুখি উন্মাদ প্রতিযোগিতার মনোবৃত্তির বিষাক্ত বীজ রুওয়া হয়ে যায়। এ কালের ক্ষুদ্র জাতিসত্তার এ প্রজন্মের শিক্ষিত ছেলেমেয়েরাও বাঙালি ছেলেমেয়েদের মতই পশ্চিমের কেবল-ভোগবাদী বাজারী সভ্যতার মোহে পা-মাথা আকৃষ্ট।
১৯৪৭ সালে স্বাধীনতা অর্জনের মধ্য দিয়ে বৃটিশ দখলদারিত্ব শেষ হয়, কিন্তু বন্ধ হয় না ক্ষুদ্রজাতিগুলার ওপর বড় জাতির মানুষদের আগ্রাসী তৎপরতা। বরং তা বিস্তৃত হয় নানা বিষয়ে। জঙ্গল ও জমি থেকে উচ্ছেদ, জমি-বেদখল, নানা রকম নির্যাতন, প্রতারণা এসবই দীর্ঘদিন থেকে ক্ষুদ্র জাতিগুলাকে কোণঠাসা করে ফেলছে---প্রতিদিন---একটু একটু করে। অন্যদিকে, ব্যক্তি ও জাতির যুথবদ্ধ শক্তির মূল জায়গা হচ্ছে ভাষা ও সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্রের ভিত্তিতে বিকশিত আত্মপরিচয়। ওখানেও চলছে ভিন্ ভাষা ও সংস্কৃতির ধীরগতির নিশ্চিত প্রভাব বিস্তার।
ভিন্ ভাষা বলতে কেবল বাংলা নয়, ইংরেজীর কথাও আসে।
আর্থ-রাজনৈতিক ও ভূমির আগ্রাসন খুবই প্রত্যক্ষ এবং প্রভাবশালী। ভাষা ও সংস্কৃতির আগ্রাসন ঘটে চুপেচাপে, কিন্তু তার ফলাফল বহুশত বছর ধরে চালু থাকে, মুনিষ্যি সত্তার একবারে গভীরে ঢুকে তার শক্তিমত্তার উৎসগুলাকে তছনছ করে দেয়। এ কারণে ভাষা ও সংস্কৃতির আগ্রাসন সফলকাম হলে রাজনৈতিক ও আর্থ আগ্রাসন অনেক সহজ ও দ্রুত হয়। ময়মনসিংহ-নেত্রকোনা অঞ্চলের হাজংদের পরিস্থিতি বিচার করলে ব্যাপারটার ভয়াবহতা ধারণা করা যাবে।
কেউ কেউ মনে করেন প্রাচীন যুগে বা মধ্যযুগের প্রথম দিকে মান্দি (গারো) জাতির একটা অংশ সমতলে নেমে এসে বসবাস আরম্ভ করে। সমতলের বাঙালি হিন্দুদের প্রভাবে বদলে যায় এদের জীবনযাপনের ধরণ, ধর্মবিশ্বাস, ভাষা ইত্যাদি। এরাই এখন হাজং নামে পরিচিত।
মধ্যযুগের গণসাহিত্যে (তথাকথিত লোকসাহিত্যে) বাঙালি ভিন্ন আরো কয়টা জাতি সম্পর্কে নানা ধরনের কাহিনী আছে। ময়মনসিংহ গীতিকা’র কয়েকটি পালায় সমতলভূমিতে মান্দিদের (গারোদের) বসবাসের কথা আছে, আছে বাঙালি ও কোচ/গারো/মুন্ডাদের রক্তাক্ত যুদ্ধের বয়ান।
ভারইয়া রাজার কাহিনী’তে দেখা যায় নেত্রকোনা জেলার আটপাড়া থানার আমগোসাইলে ভারই হাজড়া নামে এক কোচ ভূস্বামীর বাস ছিলো। এছাড়া ময়মনসিংহ, জামালপুর, নেত্রকোনার বিভিন্ন কিংবদন্তীতে সমতলে কোচরাজাদের প্রচন্ড প্রতাপের কথা আছে। নেত্রকোনা সদর উপজেলার মদনপুরের জনৈক কোচরাজার রাজত্বে এসে প্রথম বসত গেড়েছিলেন পীর শাহ সুলতান কমরউদ্দীন রুমী। ময়মনসিংহ গীতিকার ধোপার পাট পালায় গারো রাজত্বের বর্ণনা আছে। ভারইয়া রাজার কাহিনী আসলে বাঙালি হিন্দু রাজার অনৈতিক যুদ্ধকৌশলের কাছে কোচ রাজা ভারই হাজড়ার পরাজয়ের কাহিনী ।
নেত্রকোনা-ময়মনসিংহ অঞ্চলের উত্তরাংশের সমভূমিতে বোড়ো জনগোষ্ঠীর আধিপত্যের উল্লেখ আছে ইতিহাসেও। তের শতকে কোচেরা বর্তমান কুচবিহারে কামতা রাজ্য এবং ব্রহ্মপুত্রের দক্ষিণ তীরে অহোমরা আসাম রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে। ষোড়শ শতকের মাঝামাঝি সময়ে কোচরাজ মল্লদেব নরনারায়নের সময় তার রাজ্য পুব দিকে অনেকটা বিস্তার লাভ করে। এ সময় কোচ জনগোষ্ঠী ময়মনসংহ-নেত্রকোনা-কিশোরগঞ্জ এলাকায় শক্ত অবস্থান নিয়েছিলো। ঈসা খাঁর সমকালে দুই কোচ রাজার আস্তানা ছিলো ময়মনসিংহের বোকাইনগর ও কিশোরগঞ্জের জঙ্গলবাড়িয়ায়।
এদেরকে হটিয়ে জায়গা করে নেন ঈসা খাঁ।
ময়মনসিংহ-নেত্রকোনা অঞ্চলের ভাষা ও খাওয়নদাওনে গারো প্রভাবের পরিষ্কার চিহ্নও রয়েছে এখনো। এসব তথ্য থেকে ধরে নেয়া যায়, ময়মনসিংহ-নেত্রকোনার উত্তরাংশে মান্দি ও কোচ জনগোষ্ঠীর বসবাস ছিলো। হয়তোবা মধ্যযুগের শুরুতে এরা পাহাড়ী এলাকা থেকে নেমে এসে সমতলে ছড়িয়ে পড়েছিলো। সম্ভবত, এদের দাপট বজায় ছিলো ঈসা খাঁর আগ পর্যন্ত।
সমতলের বাঙালিদের সাথে অবিরাম সংঘাতে দুর্বল হতে হতে এদের একটা অংশ আবার ফিরে যায় সীমান্তের পাহাড়ে। অন্যরা স্থানীয় বাঙালি হিন্দু ভূস্বামীদের বশ্যতা মেনে সমতলেই থেকে যায়। বাঙালি হিন্দুদের প্রভাবে ধীরে ধীরে বদল আসে এদের জীবনযাপন, ধর্মবিশ্বাস, আচার-প্রথা, ভাষা সবদিকেই । এরাই হাজং নামে পরিচিত হয়। হাজংদের ভাষা বাংলা ও আসামীর খুব কাছাকাছি।
সে কালে এই দুই ভাষার পার্থক্যও ছিলো সামান্য।
শারীরিক গঠনের কথা বাদ দিলে সমতল ভূমির মান্দি গোষ্ঠীর এইসব মানুষদের মধ্যে মান্দি সম্প্রদায়ের সামান্য বৈশিষ্টই আজ অবশিষ্ট আছে। হাজংদের নির্দিষ্ট কোনো ভৌগোলিক এলাকার ওপর দাবী নাই। সে দাবী ছেড়েই হয়তো ওরা সমতলে বাঙালিদের সাথে হাত মিলিয়েছিলো। এদের ভাষা বিকশিত হয়েছে বাংলা ও আসামী থেকে অনেক কিছু ধার করে।
ধর্মবিশ্বাস, রীতিনীত, প্রথা-আচারে প্রধানত হয় হিন্দু, নয়তো খ্রিষ্ট্রীয় প্রভাবের পরিষ্কার চিহ্ন। বড় কোনো জাতির ভাষা, ধর্মবিশ্বাস, আচার-প্রথা, রীতিনীতির অবিরাম প্রভাবের মধ্যে বাস করতে গিয়ে একটা ক্ষুদ্র জাতি কিভাবে তার বহুকিছু হারিয়ে ভিন্ন আরেক জাতি রূপে প্রতিভাত হতে পারে তার নমুনা এই হাজং জনগোষ্ঠী।
কেবল এরাই নয়, এরকম আগ্রাসী পরিবেশে যে-কোনো ক্ষুদ্র জাতিসত্তার পরিণতি এমন হওয়ার সম্ভাবনা বেশি, যদি না তারা ভাষা ও সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্যের ওপর দাড়িয়ে আত্মপরিচয়ের জায়গাটা জখমহীন রাখতে না পারে। মধুপুর অঞ্চলের মান্দি জাতির ওপর সামগ্রিক আগ্রাসনের কি প্রভাব পড়েছে তাদের মান্দিকুসুকে (ভাষায়) তার একটা বিশ্লেষণ দিয়েছেন পাভেল পার্থ। লেখাটি পড়লে উপলব্ধি করা যায় কোনো জাতির জীবনযাপনে অন্য জাতির আধিপত্য কিভাবে তাদের মাতৃভাষাকে ছিঁড়েখুড়ে খেতে থাকে।
আসলে ভাষা ও সংস্কৃতি হচ্ছে মানুষের আত্মপরিচয়বোধের মূল জায়গা। একই জাতির বিভিন্ন লোকের মধ্যে যে আবেগঘণ ঐক্য, তার পেছনে একই ভাষা ও সংস্কৃতির টান আছে। এই দুইটা ব্যাপার আবার পরিপার্শ্বের সাথে জড়িত। কাজেই ভাষা ও সংস্কৃতি হলো মানুষের আত্মবোধনের স্থান, আবার বৃহত্তর সামাজিক ঐক্যেরও প্রেক্ষিত। বাইরের আধিপত্য প্রতিরোধের জন্য যে-আত্মিক শক্তি দরকার, অটুট ঐক্য প্রয়োজন তার ভিত্তি হতে হবে ভাষিক ও সাংস্কৃতিক আত্মীয়তার সমন্ধ।
একটা জাতির সংস্কৃতি যখন ক্ষয় হতে হতে ক্ষীন হয়ে যায়, ভিন্ ভাষার আগ্রাসনে ভাষা বদলে যেতে যেতে হয়ে উঠে ভিন্ভাষার উপভাষার মত তখন সেই জাতির প্রতিরোধ শক্তি বলে আর কিছুই থাকেনা। একটু আগে আমরা একটা নজীর বিশ্লেষণ করে এই কথাটাই বলতে চেয়েছি। নিজ ভাষা ও সংস্কৃতি থেকে একটু একটু করে ফেলে দিয়ে ভিন্ ভাষা ও সংস্কৃতি মেনে নেয়ার অর্থ হলো নিজের নিজত্ব বিসর্জন দিয়ে আগ্রাসী জাতির আধিপত্যের কাছে মাথা ঠেকানো।
কিছুদিন আগে নেত্রকোনায় এক হাজং নেতার সাথে কথা হচ্ছিলো নানা বিষয়ে। এই ভদ্রলোক বাংলা লিপি নিয়ে হাজং ভাষা লেখার লিপি তৈরির চেষ্টা করছেন যাতে হাজং ভাষায় প্রাথমিক পর্যায়ের কিছু বইপত্র লিখে ছেলেমেয়েদের পাঠ্য করা যায়।
কোনো একটি এনজিও আর্থিক সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। কিন্তু এখানেও সেই বিশ্বব্যাংক কাহিনী: এনজিওটি সাহায্যের প্রতিশ্রুতির সাথে জুড়ে দিয়েছে জনৈক শিক্ষকের বিশেষজ্ঞতা গ্রহণের পরামর্শ। শিক্ষকটির নাম শুনে আমি খুবই আশ্চর্য হলাম। তিনি ভাষাবিজ্ঞানী নন, গুরুত্বপূর্ণ কোনো লেখকও নন, তার বিশেষ কোনো গবেষণা কর্মের কথাও আমাদের জানা নেই। হাজং ভাষা ও লিপি সংগঠিত করার জন্য দরকার মূলের (মান্দিকুসুক/আচিককুসুক) বিষয়ে জানলেঅলা ভাষা-পণ্ডিত, যাতে হাজং ভাষা বিকাশের ধারাবাহিকতা চিহ্নিত করে প্রয়োজনে মূলের মানদণ্ড ও উপাদান ব্যবহার করা যায়।
যার নাম বলা হলো তিনি হাজং ভাষা ও লিপি সংগঠনে কি পরামর্শ দিতে পারেন তা আমার বোধগম্য হলো না?
লেখাটি ছাপা হয়েছিলো মাওরুম পত্রিকার অপরাজেয় ভাষা সংকলন, মার্চ ২০০৬ সংখ্যায়।
কেবল ভাষাই নয়, জ্ঞানকান্ডের বাহন, ব্যক্তিতা বিকশিত হওয়ার মাধ্যম। অন্যদিকে সংস্কৃতি জড়িয়ে থাকে একটা জনগোষ্ঠীর সমাজবিন্যাস, রাজনীতি ও আর্থিক কর্মকান্ডের সাথেও। এ উপমহাদেশে ইংরেজ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।