আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ভাষা সৈনিক কমরেড আব্দুল মতিন

আমার সম্পর্কে বলার মতো কিছু নেই।

ভাষা সৈনিক কমরেড আব্দুল মতিনঃ ভাষা সৈনিক কমরেড আব্দুল মতিন বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির পলিটব্যুরোর সদস্য। 'রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই' এই দাবিতে জীবনবাজী লড়াই-সংগ্রামে নেতৃত্ব করেছেন। মাতৃভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার দাবিতে পৃথিবীতে যে সকল আন্দোলন এ যাবতকালে সংগঠিত হয়েছে, তার মধ্যে বাঙ্গালীর ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন শ্রেষ্টতম। যে কারণে ২১ ফেব্রুয়ারীকে আন্তর্জাতিক মর্যাদায় ভাষা দিবস হিসেবে পালিত হয়।

মার্কসবাদী কমিউনিস্ট নেতা ভাষা সৈনিক কমরেড আব্দুল মতিনের জন্ম ১৯২৬ সালের ৩ ডিসেম্বর। সিরাজগঞ্জের চৌহালী উপজেলার একটি ছোট্ট গ্রাম ধুবালীয়ায়। তার বাবার নাম আব্দুল জলিল। তিনি একজন কৃষক ছিলেন। মায়ের নাম আমেনা খাতুন।

তিনি ছিলেন পরিবারের প্রথম সন্তান। জন্মের পর তা‌কে পরিবারের সবাই আদর করে গেদু নামে ডাকতো। ১৯৩০ সালে তাদের গ্রামের বাড়ী নদী ভাঙনে(যমুনা) বিলীন হয়ে যায়। এসময় তাদের পরিবার খুব অসহায় হয়ে পড়ে। তার বাবা আবদুল জলিল জীবিকার সন্ধানে ভারতের দার্জিলিং যান।

সেখানে জালাপাহারের ক্যান্টনমেন্টে সুপারভাইস স্টাফ হিসেবে একটি চাকরি পান। বর্ণমালার হাতেখড়ি মা-বাবার কাছে। ১৯৩২ সালে আব্দুল মতিন শিশু শ্রেণীতে দার্জিলিং-এর বাংলা মিডিয়াম স্কুল মহারানী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। এখানেই তাঁর প্রাথমিক শিক্ষা জীবনের শুরু। ১৯৩৩ সালে যখন তার বয়স ৮ বছর তখন তার মা মারা যায়।

মহারানী স্কুলে থেকে তিনি প্রাইমারী পড়াশোনার শেষ করেন। ১৯৩৬ সালে তিনি দার্জিলিং গর্ভঃমেন্ট হাই স্কুলে পঞ্চম শ্রেণীতে ভর্তি হন। ১৯৪৩ সালে এনট্রেন্স পাস করেন। ওই বছর তিনি রাজশাহী গভঃমেন্ট কলেজে আই এ ভর্তি হন। ২ বছর পর ১৯৪৫ সালে তিনি এইচ এস সি পরীক্ষা উত্তীর্ণ হন।

কিছুদিন পর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষের দিকে তিনি বৃটিশ আর্মির কমিশন র‌্যাঙ্কে ভর্তি পরীক্ষা দেন। দৈহিক আকৃতি, উচ্চতা আত্মবিশ্বাস আর সাহসিকতার বলে তিনি ফোর্ট উইলিয়াম থেকে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে কমিশন পান। এরপর তিনি কলকাতা থেকে ব্যাঙ্গালোর গিয়ে পৌছান। কিন্তু ততদিনে যুদ্ধের পরিসমাপ্তি ঘটে। ফলে তিনি একটি সার্টিফিকেট নিয়ে আবার দেশে ফিরে আসেন।

দেশে আসার পর তিনি ১৯৪৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যাচেলর অব আর্টস (পাশ কোর্স) এ ভর্তি হন। ১৯৪৭ সালে গ্র্যাজুয়েশন কোর্স শেষ করেন এবং পরে মাস্টার্স করেন ইন্টারন্যাশনাল রিলেশন বিভাগ থেকে। ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারী রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ঢাকা ছিল উত্তাল। এ আন্দোলন ছড়িয়ে গিয়েছিল সারাদেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে, অফিস আদালতে এবং রাজপথের সবখানে। '৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারী ছিল রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে সারা দেশে আন্দোলনের প্রস্তুতি দিবস।

ওই দিন সকাল ৯ টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে জিমনেসিয়াম মাঠের পাশে ঢাকা মেডিকেল কলেজের (তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্গত) গেটের পাশে ছাত্র-ছাত্রীদের জমায়েত শুরু হতে থাকে। সকাল ১১ টায় কাজী গোলাম মাহবুব, অলি আহাদ, আব্দুল মতিন, গাজীউল হক প্রমুখের উপস্থিতিতে ছাত্র-ছাত্রীদের সমাবেশ শুরু হয়। ২০ ফেব্রুয়ারী পাকিস্থান সরকার ভাষা আন্দোলনের প্রস্তুতিকে তছনছ করে দেয়ার জন্য ঢাকাতে সমাবেশ, মিছিল-মিটিংযের উপর ১৪৪ ধারা জারি করে। সকালের দিকে ১৪৪ ধারা ভংগের ব্যাপারে ছাত্র-রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের মধ্যে মতানৈক্য দেখা দেয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর ড. এস এম হোসেইন এর নেতৃত্বে কয়েকজন শিক্ষক সমাবেশ স্থলে যান এবং ১৪৪ ধারা ভংগ না করার জন্য ছাত্রদের অনুরোধ করেন।

বেলা ১২টা থেকে বিকেল ৩টা পর্যন্ত সময় ধরে উপস্থিত ছাত্রনেতাদের মধ্যে আব্দুল মতিন এবং গাজীউল হকের নেতৃত্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্র ভাষা সংগ্রাম কমিটি ১৪৪ ধারা ভংগের পক্ষে মত দিলেও সর্বদলীয় সমাবেশ থেকে নেতৃবৃন্দ এ ব্যাপারে কোন সুনির্দিষ্ট ঘোষণা দিতে ব্যর্থ হন। এ অবস্থায় কমরেড আব্দুল মতিনের নেতৃত্বে বাংলার দামাল ছেলেরা দমনমূলক সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে রুখে দাড়ায়। বিশ্ববিদ্যালয় সংগ্রাম পরিষদ ১১৪ ধারা ভঙ্গ করতে বদ্ধপরিকর ছিল। বিশ্ববিদ্যালয় সংগ্রাম পরিষদের আহবায়ক ছিলেন কমরেড আব্দুল মতিন। উপস্থিত সাধারণ ছাত্ররা স্বত:স্ফূর্তভাবে ১৪৪ ধারা ভংগের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে এবং মিছিল নিয়ে পূর্ব বাংলা আইন পরিষদের (বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলের অন্তর্গত) দিকে যাবার উদ্যোগ নেয়।

অধিকার আদায়ের দাবিতে শত শত বিদ্রোহী কন্ঠে 'রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই' এই দাবীতে আন্দোলোন তীব্র হয়ে উঠে। পুলিশের সঙ্গে ছাত্র জনতার সংঘর্ষ হয়। শ্লোগানে শ্লোগানে কেঁপে উঠে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যামপাস। বুলেট আর লড়াই শুরু হয়। পুলিশ লাঠিচার্জ এবং গুলি বর্ষণ শুরু করে।

গুলিতে ঘটনাস্থলেই আবুল বরকত (ঢাবি এর রাষ্ট্রবিজ্ঞান এর মাষ্টার্সের ছাত্র), রফিক উদ্দীন, এবং আব্দুল জব্বার নামের তিন তরুণ মারা যায়। রফিক, জাব্বার, বরকত সহ নাম না জানা আরও অনেকের সাথে সালামও সেদিন গুলিবিদ্ধ হন। বিশ্ববিদ্যালয় সংগ্রাম পরিষদের আহবায়ক ভাষাসংগ্রামী আবদুল মতিন কে পঞ্চাশের দশক থেকে 'ভাষা মতিন' বলে ডাকা শুরু হয়। ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস লেখক বদর উদ্দিন উমর, বশির আল হেলাল সহ আবুল কাশেম ফজলুল হক, হাবিবুর রহমান শেলী, মুস্তফা নুরুল ইসলাম, এম আর আখতার মুকুল , কে জি মুস্তফা তাদের লেখায় 'ভাষা মতিন' ব্যবহার করেন। ভাষাসংগ্রামী কাজী গোলাম মাহবুব, মহবুব আনাম , আবদুল গফুর , হাসান ইকবাল ,এম আর আখতার মুকুল , কে জি মুস্তফা , আলাউদ্দিন আল আজাদ প্রমুখ তারাও 'ভাষা মতিন' হিসেবে সম্বোধন করেন।

যার কারণে এখন সকলের কাছে তিনি ভাষা মতিন হিসেবে পরিচিতি অর্জন করেছেন। সাধীনতা যুদ্ধে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। মুক্তিযুদ্ধের পর স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশে তিনি সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী অবস্হান গ্রহণ করেন। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়নের জন্য সর্বাত্মক সংগ্রাম করেন। লড়াই-সংগ্রামের পাশাপাশি তিনি কিছু বইও লিখেছেন।

এই বইগুলো তাঁর চিন্তা, চেতনা, রাজনীতি, দর্শন ও সত্ত্বাকে ধারণ করে চলেছে। তাঁর রচিত গ্রন্থাবলী-জীবন পথের বাঁকে বাঁকে, গণ চীনের উৎ‍পাদন ব্যবস্থা ও দায়িত্ব প্রথা, প্রকাশকাল : ১৯৮৫, ভাষা আন্দোলন ইতিহাস ও তাত্‍পর্য, প্রকাশকাল : ১৯৯১, আব্দুল মতিন ও আহমদ রফিক, বাঙালী জাতির উৎ‍স সন্ধান ও ভাষা আন্দোলন, প্রথম প্রকাশ : ১৯৯৫।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.