আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

শোকের মিনারে গৌরবের গান



হাতে ফুল, কণ্ঠে অমর একুশের গানে হূদয় নিংড়ানো ভালোবাসা। নগ্নপদ মিছিল। এই পথ চলায় কোনো ক্লান্তি নেই। দীর্ঘ অপেক্ষায়ও নেই কোনো শ্রান্তি। সারিবদ্ধ মিছিল।

হাজারো মানুষের চোখে-মুখে দৃপ্ত শপথ। হারানোর শোক ছাপিয়ে ওঠা গভীর শ্রদ্ধা। সবার পথেরই শেষ ছিল শহীদ মিনার। অমর একুশে ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে গতকাল রোববার সারা দেশ ছিল উদ্বেলিত। সমগ্র জাতি অপার শ্রদ্ধা আর ভালোবাসায় স্মরণ করেছে মৃত্যুঞ্জয়ী ভাষাশহীদদের এবং গৌরবোজ্জ্বল সেই দিনটিকে।

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ঘোষণার পর একুশে ফেব্রুয়ারি পালনে এ দিনটিতে এসেছে নতুন ব্যঞ্জনা। গতকাল তাই কর্মসূচিজুড়ে শোক ও শ্রদ্ধা প্রকাশের পাশাপাশি ছিল উত্সবের আমেজ। একুশের চেতনা রক্ষার দৃঢ় অঙ্গীকারও দেখা গেছে সাধারণ মানুষের মধ্যে। বিভিন্ন কর্মসূচিতে তাই বিকৃত বাংলা উচ্চারণ বন্ধ, সর্বস্তরে বাংলা ভাষার ব্যবহার এবং বাংলাকে জাতিসংঘের ভাষা হিসেবে দেখার আকুতিও ছিল তাদের মধ্যে। একুশের প্রথম প্রহর থেকেই শুরু হয় জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান ভাষাশহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন।

রোববার মধ্যরাতে একুশের প্রথম প্রহরে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, ডেপুটি স্পিকার ও বিরোধীদলীয় নেত্রী শহীদদের প্রতি সম্মান জানান। এরপর বেদিতে ফুল দিয়ে ভাষা আন্দোলনের শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়েছে সর্বস্তরের মানুষ। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার ঘিরে ছিল লোকে লোকারণ্য। তরুণ-যুবাদের সঙ্গে এই জনারণ্যে ছিলেন প্রৌঢ় ও শিশুরা। শহীদ মিনার ছাড়াও আজিমপুর কবরস্থানে ভাষাশহীদদের কবর জিয়ারতও করেছেন তাঁরা।

শনিবার রাত ১১টার পর থেকেই শাহবাগ, আজিমপুর, নীলক্ষেত, দোয়েল চত্বরসহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে যেতে প্রতিটি প্রবেশপথ-জুড়েই ছিল মিছিলের সারি। সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার—ভাষাশহীদদের রক্তে রঞ্জিত হয়ে যেন পুব আকাশে উঁকি দেয় ভোরের লাল সূর্য। আর সেই আলোর সঙ্গে সঙ্গে বাড়তে থাকে মানুষের সমাবেশ। ভোর ছয়টার পর থেকে বেলা সাড়ে ১১টা পর্যন্ত ভিড় ছিল সবচেয়ে বেশি। এ সময় একের পর এক আসতে থাকে মিছিল।

এই মিছিলের সারি আশপাশের প্রায় দুই বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। পোশাকে, রঙে, আঁকায়—সর্বত্রই ছিল একুশের চেতনা: ধানমন্ডি থেকে আবুল কালাম আজাদ তাঁর স্ত্রী ও দুই ছেলেমেয়েকে নিয়ে শহীদ মিনারে যাচ্ছিলেন। শাহবাগে পৌঁছানোর পর ছেলে তনয়ের বায়না, গালে ছবি আঁকবে। প্রথমে তার এক গালে আঁকিয়ে আঁকলেন জাতীয় পতাকা। সকাল থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের সামনে, সোহরাওয়ার্দী উদ্যোনে ও জাতীয় জাদুঘরের সামনে চলতে থাকে দুই গালে শহীদ মিনার, জাতীয় পতাকা বা অ-আ-ক-খ আঁকিয়ে নেওয়া।

হাতে তুলি আর রং নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন অসংখ্য তরুণ-তরুণী। মানুষের গালে আর কপালে তাঁরা এঁকেছেন বর্ণমালা, পতাকা, শহীদ মিনার আর আল্পনা। হূদয়ে ধারণ করা একুশের চেতনার অনুবাদ নানা ভাষায়, নানা রঙে প্রকাশ পেয়েছে গতকাল বাংলা একাডেমী, কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারসহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকাজুড়ে। একুশের প্রভাতফেরিতে অংশ নেওয়া মানুষের পোশাকে ছিল কালো-সাদার প্রাধান্য। বাংলা ভাষায় লেখা সাহিত্য, কবিতার পঙিক্ত, গানের কলি পোশাকে ভর করে হেঁটে বেড়িয়েছে।

কপাল আর গালে তুলি চালিয়েছেন আঁকিয়েরা। ফুটে উঠেছে শহীদ মিনার, বাংলাদেশের পতাকা আর বর্ণমালা। সাদা-কালো জমিনে উঠে এসেছে বর্ণমালা থেকে কবিতা, গান। একুশের চেতনা ফ্যাশনেও স্থান করে নিয়েছে। গতকাল কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার এবং আশপাশে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উদ্যাপনে আসা মানুষের পোশাকের রঙে, ভাষায় ছিল একুশের চেতনার প্রকাশ।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার ভেতর সাধারণভাবে যানবাহন চলাচল ছিল বন্ধ। একুশে উদ্যাপনে আসা মানুষের ঢলে তাই পুরো এলাকা পরিণত হয়েছিল মানুষের মিলনমেলায়। সে মেলা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস ছাড়িয়ে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান পর্যন্ত ছড়িয়ে ছিল। রাস্তার পাশে ছোট ছোট দোকানে এবং হাতে করে বিক্রেতারা বিক্রি করেছেন ছোট পতাকা, একুশের বাণীসমৃদ্ধ মাথার কাপড়, শহীদদের ছবিসহ পোস্টকার্ড। আবেগে আপ্লুত দেশি-বিদেশিরা: বয়সের ভারে ন্যুব্জ তাঁর শরীর।

হাতে ছড়ি, পরনে সাদা শাড়ি। ভিড়ের মধ্য থেকে বেরিয়ে দিলেন বিজয়ের হাসি। কাছে যেতেই জানালেন, কলকাতা থেকে এসেছেন তিনি। ৭৩ বছরের অঞ্জলি ঘটককে সাতচল্লিশে দেশ বিভাগের পর মাত্র ১০ বছর বয়সে পাড়ি জমাতে হয়েছিল ভারতে। তারপর ভাষা আন্দোলনের শুরু।

শত ইচ্ছা থাকলেও শ্রদ্ধা জানাতে আর আসা হয়নি। ‘এবার সুযোগ পেয়েই মাতৃভূমির ভাষাশহীদদের শ্রদ্ধা জানাতে চলে এসেছি’—বললেন তিনি। হাতে ফুল আর গায়ে রং-বেরঙের আল্পনা এঁকে সেই মিছিলে শামিল হয়েছিল সন্দ্বীপ ও সুদীপ। খালি গা আর ধুতি পরে সাত ও বারো বছর বয়সের দুুই ভাই এসেছে বাবার সঙ্গে। অবয়বে যেন বাঙালি সংস্কৃতিকে বহন করতে চেয়েছে পুরো পরিবারটি।

রাঙামাটি থেকে আসা আদিবাসী নিথু খিসা জীবনে প্রথমবারের মতো এখানে এসেছেন। জানালেন নিজ ভাষা রক্ষার আকুতি। শ্রদ্ধা জানাতে বিদেশিদের ভিড়ও ছিল চোখে পড়ার মতো। ঢাকায় নিযুক্ত বিভিন্ন দূতাবাসের কর্মকর্তারা ছাড়াও যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া, নেদারল্যান্ডসহ বিভিন্ন দেশের নাগরিকেরা এসেছিলেন শ্রদ্ধা জানাতে। যুক্তরাজ্যের নাগরিক এসথার লেক শ্রদ্ধা নিবেদনের পর বলেন, দিনটি বিশ্বময় ছড়িয়ে থাকা মানুষের মধ্যে এক ধরনের সাংস্কৃতিক ঐক্য গড়ে তোলে।

তাঁর মতে, ‘নিজ ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতি এত আবেগ আর কোথাও দেখিনি। ’ ইউনিভার্সিটি অব টরন্টোর অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক জোসেফ ওকোনেল জানান, এবারই প্রথম নয়। সুযোগ পেলেই তিনি এখানে আসেন। একুশে নিয়ে রাজনীতিবিদেরাও জানালের তাঁদের অভিব্যক্তি। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য খোন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, বিরোধী দলের ওপর বর্তমান সরকারের জুলুম-নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলাই হোক এবারের একুশের অঙ্গীকার।

আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম বলেন, ‘আমরা দেশ স্বাধীন করেছি। কিন্তু রাজাকারমুক্ত করতে পারিনি। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের মাধ্যমে জাতিকে কলুষমুক্ত করাই আজকের অঙ্গীকার। ’ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক সাংবাদিকদের বলেন, এখানে সবাই সুশৃঙ্খলভাবে শহীদ মিনারে ফুল দিয়েছে। এটাই একুশের চেতনা।

কিছু অসংগতি: কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা নিবেদন করতে গিয়ে কিছু সমস্যায়ও পড়েছিল বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনের নেতা-কর্মী ও সাধারণ মানুষ। প্রটোকল ভেঙে বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়ার আগেই শহীদ মিনারে ফুল দেয় স্বেচ্ছাসেবক লীগ। এ নিয়ে বিএনপি ক্ষোভও প্রকাশ করেছে। শহীদ মিনারের মূল বেদিতে জুতা পরেও উঠেছেন কেউ কেউ। বিশেষ করে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আর এ গনির জুতা পরে খালেদা জিয়ার সঙ্গে শ্রদ্ধা নিবেদনের ঘটনায় হতবাক হয়েছেন অনেকে।

শহীদ মিনারের দায়িত্বে নিয়োজিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিএনসিসির আচরণে ক্ষুদ্ধ হন অনেকেই। শ্রদ্ধা নিবেদনে আসা অনেকেই অভিযোগ করেন, বিএনসিসির সদস্যরা ন্যূনতম সম্মান দেখাননি। এ ছাড়া মিছিলের সামনে থাকা নিয়ে ঠেলাঠেলির কারণে কখনো কখনো বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হতে দেখা যায়।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।