সমাজ থেকে কল্পিত দ্বন্দগুলো দূর হোক।
এক বনে প্রচুর পরিমাণে বিভিন্ন প্রাণীদের বসবাস। প্রাণীদের বৈচিত্র এত বেশি যে সেখানে সুষ্ঠু ও শক্তিশালী প্রশাসনিক কাঠামো ছাড়া বনের প্রাণীদের মধ্যে শৃঙ্খলা বজায় রাখা সম্ভব নয়। তাই সবাই মিলে বন রাজ্যে একটা শক্তিশালী প্রশাসনিক কাঠামো গড়ে তুলার উদ্যোগ নিল। যথা উদ্যোগ তথা বাস্তবায়ন।
একটি প্রাশাসনিক কাঠামো গড়ে তুলা হলো। এই কাঠামোকে সামনের দিকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য কাকে দায়িত্বভার দেওয়া যায় সকলে মিলে সে বিষয়ে চিন্তা করতে লাগল। বিশৃঙ্খল ভাবে কোন সিন্ধান্ত গ্রহণ করতে না পারায় ও বিষয়টা খুব জটিল হওয়ায় বনের সকল প্রাণী মিলে একটা সার্বজনীন সভার আয়োজন করল। সেই সভায় সংখ্যাগরিষ্ট প্রাণীদের নিকট থেকে প্রস্তাব আসল; যিনি বনরাজ্যের দায়িত্বভার গ্রহণ করবেন তার থাকতে হবে শক্তি ও সাহস এবং এই শক্তি ও সাহস দ্বারা যাতে তিনি যে কোন সময় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারেন। আরও সিদ্ধান্ত হল যে- যিনি দায়িত্ব পালন করবেন একটানা দুই বছর ধরে দায়িত্ব পালন করবেন এবং পরবর্তী দুই বছরের জন্য আর একটা শক্তি ও সাহসি প্রাণীকে সেই দায়িত্বভার প্রদান করা হবে।
সভায় এই সিদ্ধান্তও নেওয়া হলো যে-যেহেতু রাজ্য চালানোর জন্য রাজাকে প্রচুর পরিমাণে মেধা ও শ্রম প্রয়োগ করতে হবে সেহেতু বন রাজ্যের সকল প্রাণীর তাদের উপার্জিত সম্পদের একটা অংশ রাজাকে প্রদান করতে হবে। এই প্রস্তাবের আলোকে সার্বিক দিক বিবেচনা করে বাঘ ও সিংহ কে বনরাজ্য চালানোর দায়িত্বভার ধারাবাহিক ভাবে প্রদান করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হলো। প্র্রথম মেয়াদে এই দায়িত্ব বাঘকে প্রদান করা হলো।
এই বনের সবচেয়ে বেশী সংখ্যাক প্রাণী হলো হরিণ, স্বভাবে বেশ শান্ত এবং দেখতে সুন্দর। এই হরিণ বনের সৌন্দর্য্য বছরের পর বছর বৃদ্ধি করে চলেছে।
বনে শেয়ালের সংখ্যা যথেষ্ঠ। এরা একটু চতুর প্রকৃতির এবং চিন্তা চেতনায় সুবিধাভোগী। বনটিতে গাধার সংখ্যাও নেহায়েত কম নয়। গাধাদের মূল কাজ হল খাওয়া ও ঘুমানো, কে কি করল এসব নিয়ে তাদের ভাবনার কোন সুযোগ নেই। এ ছাড়াও এখানে সুন্দর পাখি ও অন্যান্য প্র্রাণীও যথেষ্ঠ পরিমাণে বাস করে।
বনটি সুন্দর সুন্দর বৃক্ষ-তৃণে সমৃদ্ধ।
হরিণগুলো তৃণ ভোজন করে বেঁচে থাকে, কখনও সখনও হয়তো ভাবে কি করে আরও ভাল খাবার সংগ্রহ করা যায় তবে সেটা অধিকাংশ ক্ষেত্রে ফলপ্রসু হয় না। গাধাগুলো সারাদিন খেটে খুটে সামান্য খাদ্য সংগ্রহ করে সন্ধ্যা বেলা তা খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। কখনও সে ভাবে না, কি করে পুষ্টিকর খাবার সংগ্রহ করা যায়, কি করে এই বনে তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করা যায়। শেয়ালগুলোর মূল কাজ ধুর্তমী করা।
সে সারাক্ষণ কি করে গাধা এবং হরিণগুলোর সংগ্রহ করা খাবার খাওয়া যায় সেই চিন্তাতেই মত্ত থাকে এবং তাদের সংগৃহীত খাবার কু-কৌশলে কুক্ষিগত করে ভোগ করে।
যেহেতু এই বনরাজ্যের রাজা হিসাবে বাঘ চলমান মেয়াদের দায়িত্ব পালন করছে। প্রত্যেক প্রাণীই রাজস্ব হিসাবে তাদের সংগৃহীত খাবারের একটি অংশ বাঘকে দিয়ে থাকে। যেহেতু বনের কোটি কোটি হরিণ, গাধা ও শেয়াল তাদের খাবারের একটি অংশ বনের বাঘকে রাজস্ব হিসাবে দেয় সেহেতু বাঘ বসে বসে তার প্রয়োজনীয় সমস্ত খাবার পেয়ে যায় এবং কিছুটা অবশিষ্ট্য থেকে যায়। দেশে যখন খাবারের সংকট দেখো দেয় তখন অবশিষ্ট্য এই খাবার হরিণ, গাধা ও শেয়ালদের মাঝে বিক্রি করে দেয়।
ফলে বাঘগুলো একদিকে যেমন স্বাস্থ্যবান হয়ে উঠছে অন্যদিকে সম্পদেও সমৃদ্ধ হয়ে উঠছে। বাঘের সুখ, স্বাচ্ছন্দ বাঘকে স্বৈরতান্ত্রিক আচরণে অভ্যস্ত করে তুলছে। আর এসব দেখে পরবর্তী মেয়াদের বন রাজার তা সহ্য হচ্ছে না।
তবে ঝামেলা শুরু হল তখন যখন বন রাজা বাঘ ও তার চেলারা হরিণ শাবকদের ধরে ধরে খাওয়া শুরু করল।
আজকে বনের সমস্ত হরিণ, গাধা ও শেয়াল একজায়গায় সমবেত হয়েছে।
সমবেত হওয়ার কারণ বন রাজা বাঘ ও বাঘের চেলারা হরিণের বাচ্চাদেরকে ধরে ধরে খাচ্ছে। রাজ্য ক্ষমতা দেওয়ার সময় শর্তছিল বনের সকল প্রাণী যে খাবার সংগ্রহ করবে সেখান থেকে একটা অংশ বনের রাজাকে দেবে। বিনিময়ে বনের রাজা বনে বসবাসরত সকল প্রাণীদের জান ও মালের নিরপত্তা বিধান করবে। বন রাজা বাঘ এখন অন্য প্র্রাণীদের তো নিরাপত্তা দিচ্ছেই না বরং রাজাদের পরিবারের অন্যান্য বাঘেরা হরিণদের বাচ্চাদের ধরে ধরে ধরে খাচ্ছে।
-আমরা রাজা বাঘের পরিবারের সদস্যদের এই সব অনিয়ম মেনে নেবনা।
একটি হরিণ বলল। আমরা সবাই মিলে এর প্রতিবাদ করব।
হরিণ সর্দারের এই কথা শুনে কিছু হরিণ তার সাথে একাত্মতা ঘোষনা করল।
-বল্ল-হ্যাঁ হ্যাঁ বাঘেদের এই অত্যাচার অনিয়ম মেনে নিতে পারিনা। এর একটা বিধি ব্যবস্থা করতেই হবে।
হরিণদের এই প্রতিবাদের ফলে সুবিধাভোগী কুচক্রী শেয়াল গোপনে গোপনে কিছু হরিণের সাথে যোগাযোগ করে তাদেরকে বিশ্বাসঘাতক হতে প্ররোচিত করল এবং সেই বিশ্বাঘতক হরিণদেরকে রাজা বাঘের সাথে যোগাযোগ করিয়ে দিল। শেয়াল বল্লল-
-তোমারা যদি রাজার বিরুদ্ধে আন্দোলন না কর তাহলে রাজা তোমাদের বা তোমাদের সন্তানদেরকে ধরে খাবেনা।
বিপন্ন জীবন বাঁচাতে কিছু হরিণ শেয়ালের এই কুচক্রের সাথে যোগ দিল এবং তারা আন্দোলনে যাওয়া থেকে নিজেদেরকে বিরত রাখল।
প্রোরোচিত হরিণদেরকে শেয়াল বল্ল-
-রাজা সাহেব বলেছে, যে সকল হরিণেরা প্রতিবাদ করছে তোমরা যদি তাদের নাম ও ঠিকানা আমাদেরকে জানিয়ে দাও তাহলে রাজা তোমাদের নিকট থেকে তোমাদের উৎপাদিত ফসলের যে অংশ নেন তা নেবেন না। তাছাড়া পুরষ্কার হিসাবে রাজা তোমাদেরকে রাজ পরিবারের খাবারও খেতে দিবে।
এই শুনে কিছু হরিণ প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে প্রতিবাদ করা বন্ধ করে দিল এবং কিছু হরিণ প্রতিবাদ বন্ধ করার পাশা-পাশি প্রতিবাদী অন্য হরিণের তালিকা শেয়ালের মাধ্যমে রাজাকে পৌঁছে দিল।
কিছুদিন পর বনে একটা মজার ব্যাপার লক্ষ্য করা গেলো। যে হরিণগুলো বন রাজার অন্যায়ের প্রতিবাদ করা বন্ধ করে দিল তারা গাধায় পরিণত হলো এবং যারা প্রতিবাদী হরিণদের তালিকা রাজার কাছে পৌঁছে দিল তারা শেয়ালে পরিণত হলো।
একদিকে বনরাজা ও বনরাজার পরিবারের সদস্যগণ হরিণ ধরে ধরে খেতে লাগল, আর একদিকে নিরব হরিণেরা গাধায় পরিণত হতে লাগল, অন্যদিকে বিশ্বাস ঘাতক হরিণেরা শেয়ালে পরিণত হতে লাগল। এতসব ঘটনার প্রেক্ষিতে বনে হরিণের সংখ্যা জ্যামিতিক হারে কমতে লাগল।
সংক্ষুব্ধ হরিণেরা বাধ্য হয়ে বাঁচার তাগিদে সিংহকে সাথে নিয়ে দূর্বার আন্দোলন করতে শুরু করল। সিংহও রাজ্যভার পাওয়ার লোভে সংক্ষুব্ধ হরিণদের আন্দোলনের নেতৃত্ব দিল। ধীরে ধীরে আন্দোলন জোরালো হতে লাগল। বনের সকল প্রাণী বুঝতে পারল বাঘের মেয়াদ শেষের পথে। ধূর্ত শেয়ালেরা ভাব বেগতিক দেখে তারাও সিংহ-হরিণের দলে যোগ দিল।
বনের সম্মিলিত সকল প্রাণীর দূর্বার আন্দোলনের ফলে সময়ের আগেই বাঘ ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হলো।
পরবর্তী মেয়াদের জন্য সিংহ বন রাজ্যের দায়িত্বভার গ্রহণ করল। কিছুদিন যাওয়ার পর যে সকল হরিণেরা শেয়াল এবং গাধায় রুপান্তর হয়ে গিয়েছিল তারা আবার হরিণ হয়ে গেল এবং নতুন নতুন হরিণ জন্মগ্রহণ করায় হরিণের সংখ্যা বনে যথেষ্ঠ পরিমাণে বেড়ে গেলো। আন্দোলনরত হরিণেরা আবার নিরিহ হতে শুরু করল। বনে শান্তি ফিরতে শুরু করল।
তবে ধূর্ত শেয়ালদের ধূর্তমী আবার নতুন করে শুরু হলো।
বনে হরিণের সংখ্যা বর্ধন দেখে এবং এই বর্ধিত হরিণের কচি মাংশ দেখে সিংহ এবং তার পরিবারের সদস্যরা লালায়িত হলো। একদিকে তাদের লালসা চরম পর্যায়ে, অন্যদিকে বনের হরিণসহ সকল প্রাণীর শান্ত অবস্থা দেখে তারা লোভ সামলাতে পারলনা। বাঘের শাসন আমলের শেয়ালের ভূমিকার কথা সিংহের জানা ছিল সেই অভিজ্ঞতা থেকে সিংহরা শেয়ালকে তাদের স্বার্থ হাছিলে কাজে লাগাতে শুরু করল। শেয়ালেরা তাদের পুরাতন ভূমিকায় ফিরে গেলো, প্রোরোচিত হরিণেরাও তাদের পূর্বের ভূমিকায় ফিরে গেলো।
কিছুদনি পর
বিশ্বাস ঘাতক হরিণেরা আবার শেয়ালে রুপান্তর হতে শুরু করল, প্রতিবাদ বিমুখ হরিণেরা গাধায় পরিণত হতে শুরু করল।
সুযোগ বুঝে বাঘ সিংহর উপর প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য হরিণ ও শেয়ালদের সংঘবদ্ধ করার প্রয়াসে হরিণ, বাঘ, গাধাসহ সকল প্রাণীকে একত্র করে বল্ল-
-সিংহ তোমাদের উপর যে অত্যাচার শুরু করেছে আমি এর প্রতিবাদ করতে চাই। (এই কথা বলার সময় বাঘ মনে মনে খুব লজ্জা পেলো। ভাবল আমি যে কাজ করেছি এরাওতো সেই একই কাজই করছে তা হলে আমি.....)। সিংহর এই অন্যায় মেনে নেওয়া যায়না।
নিরিহ হরিণদেরকে যে ভাবে ধরে ধরে খাচ্ছে এটা চরম অন্যায়। (এবার বাঘ আনমনে তার ভুড়িতে হাত বুলিয়ে মনে মনে বল্র আমার এই ভুড়ি তো এই হরিণদের মাংশেই গড়া। )আমার সবাই মিলে এর প্রতিবাদ করব। আর আমি এবার এই বনরাজ্যের দায়িত্ব পেলে আমি তোমাদের জীবনের নিরাপত্তা দেব, তোমাদের জন্য উন্নত মানের খাবারের ব্যবস্থা করব।
-বাঘ ভাই আপনি এবং আপনার চেলারা আমাদের যেভাবে অত্যাচার করেছিলেন তা আমরা আজও ভুলতে পরিনি।
সিংহ এখন যা করছে আপনি ক্ষমতায় থাকা কালীন সময়ে তাই করেছিলেন। আমরা সেটা ভুলে যায়নি। তবুও বাঁচার তাগিদে আপনার সাথে আন্দোলন করছি। একটি হরিণ বল্ল।
-বাঘ খর্বকায় এক হরিণের এই কথা শুনে খুক খুক করে কেশে উঠল।
বনের দায়িত্বে কখনও বাঘ আসে, কখনও সিংহ আসে কিন্তু যিনিই বন রাজ্য চালানোর দায়িত্ব পান না কেন তিনি সেই একই ভূমিকায় অবতীর্ণ হন।
কয়েক বছর পর-
বাঘ, শেয়াল এবং হরিণ অথবা সিংহ, শেয়াল এবং হরিণ এখন আর যুগপৎ আন্দোলন করতে যাইনা। বাঘ এবং সিংহ তারা দুই পক্ষই শলা পরার্শ করে এই সিদ্ধান্তে উপনিত হয় যে-তারা যেহেতু উভয় পক্ষই কচি হরিণের মাংশ খেতে পছন্দ করে সেহেতু তারা এখন আর গন্ডগোল করবে না। বরং মিলে মিশে পালাক্রমে হরিণ ধরে ধরে খাবে।
আরও কয়েক বছর-
বনে এখন আর কোন হরিণ নেই, বাঘে সিংহে প্রচুর পরিমাণে হরিণ তারা ধরে ধরে খেয়েছে।
বিশ্বাস ঘাতক হরিণগুলো শেয়ালে পরিণত হয়েছে, প্রতিবাদ বিমুখ হরিণগুলো গাধায় পরিণত হয়েছে। হরিণ এই বনের এখন এক বিলুপ্ত প্রাণী। তাই সিংহ বাঘের রসনা বিলাসের জন্য এখন আর কচি হরিণের সুস্বাদু মাংশ ভক্ষণ করতে পারেনা।
বাঘ সিংহ হরিণে সুস্বাদু মাংশ আস্বাদনের অভাবে কাঁদে, শেয়াল এখন ধূর্তমীর খেলা করার জন্য কাউকে পায়না, তাই সে কাঁদে। যে সকল নির্বোধ হরিণ গাঁধাদের সঙ্গী ছিল তাদের হারানোর বেদনায় কাঁদে।
বনের সকল প্রাণীদের সময় এখন শুধুমাত্র স্মৃতি চারণ ও দীর্ঘশ্বাস ফেলে কাটে।
পরিবর্তনের প্রত্যাশায় কিছু কিছু প্রাণী ভাবে হাতি অনেক বড়, শক্তিশালী ও শান্ত প্রকৃতির প্রাণী হাতি এসে নিশ্চয় তাদের সুদিন ফিরিয়ে দেবে। আবার তখনই আরেক ভাবনা এসে সুভাবনাকে প্রতিহত করে; ভাবে হাতির পেটতো সিংহ বা বাঘের চেয়ে আরও অনেক বড়।
আলমগীর কবির
দর্শনা
8/27/2013 8:13:06 PM
এক বনে প্রচুর পরিমাণে বিভিন্ন প্রাণীদের বসবাস। প্রাণীদের বৈচিত্র এত বেশি যে সেখানে সুষ্ঠু ও শক্তিশালী প্রশাসনিক কাঠামো ছাড়া বনের প্রাণীদের মধ্যে শৃঙ্খলা বজায় রাখা সম্ভব নয়।
তাই সবাই মিলে বন রাজ্যে একটা শক্তিশালী প্রশাসনিক কাঠামো গড়ে তুলার উদ্যোগ নিল। যথা উদ্যোগ তথা বাস্তবায়ন। একটি প্রাশাসনিক কাঠামো গড়ে তুলা হলো। এই কাঠামোকে সামনের দিকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য কাকে দায়িত্বভার দেওয়া যায় সকলে মিলে সে বিষয়ে চিন্তা করতে লাগল। বিশৃঙ্খল ভাবে কোন সিন্ধান্ত গ্রহণ করতে না পারায় ও বিষয়টা খুব জটিল হওয়ায় বনের সকল প্রাণী মিলে একটা সার্বজনীন সভার আয়োজন করল।
সেই সভায় সংখ্যাগরিষ্ট প্রাণীদের নিকট থেকে প্রস্তাব আসল; যিনি বনরাজ্যের দায়িত্বভার গ্রহণ করবেন তার থাকতে হবে শক্তি ও সাহস এবং এই শক্তি ও সাহস দ্বারা যাতে তিনি যে কোন সময় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারেন। আরও সিদ্ধান্ত হল যে- যিনি দায়িত্ব পালন করবেন একটানা দুই বছর ধরে দায়িত্ব পালন করবেন এবং পরবর্তী দুই বছরের জন্য আর একটা শক্তি ও সাহসি প্রাণীকে সেই দায়িত্বভার প্রদান করা হবে। সভায় এই সিদ্ধান্তও নেওয়া হলো যে-যেহেতু রাজ্য চালানোর জন্য রাজাকে প্রচুর পরিমাণে মেধা ও শ্রম প্রয়োগ করতে হবে সেহেতু বন রাজ্যের সকল প্রাণীর তাদের উপার্জিত সম্পদের একটা অংশ রাজাকে প্রদান করতে হবে। এই প্রস্তাবের আলোকে সার্বিক দিক বিবেচনা করে বাঘ ও সিংহ কে বনরাজ্য চালানোর দায়িত্বভার ধারাবাহিক ভাবে প্রদান করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হলো। প্র্রথম মেয়াদে এই দায়িত্ব বাঘকে প্রদান করা হলো।
এই বনের সবচেয়ে বেশী সংখ্যাক প্রাণী হলো হরিণ, স্বভাবে বেশ শান্ত এবং দেখতে সুন্দর। এই হরিণ বনের সৌন্দর্য্য বছরের পর বছর বৃদ্ধি করে চলেছে। বনে শেয়ালের সংখ্যা যথেষ্ঠ। এরা একটু চতুর প্রকৃতির এবং চিন্তা চেতনায় সুবিধাভোগী। বনটিতে গাধার সংখ্যাও নেহায়েত কম নয়।
গাধাদের মূল কাজ হল খাওয়া ও ঘুমানো, কে কি করল এসব নিয়ে তাদের ভাবনার কোন সুযোগ নেই। এ ছাড়াও এখানে সুন্দর পাখি ও অন্যান্য প্র্রাণীও যথেষ্ঠ পরিমাণে বাস করে। বনটি সুন্দর সুন্দর বৃক্ষ-তৃণে সমৃদ্ধ।
হরিণগুলো তৃণ ভোজন করে বেঁচে থাকে, কখনও সখনও হয়তো ভাবে কি করে আরও ভাল খাবার সংগ্রহ করা যায় তবে সেটা অধিকাংশ ক্ষেত্রে ফলপ্রসু হয় না। গাধাগুলো সারাদিন খেটে খুটে সামান্য খাদ্য সংগ্রহ করে সন্ধ্যা বেলা তা খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ে।
কখনও সে ভাবে না, কি করে পুষ্টিকর খাবার সংগ্রহ করা যায়, কি করে এই বনে তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করা যায়। শেয়ালগুলোর মূল কাজ ধুর্তমী করা। সে সারাক্ষণ কি করে গাধা এবং হরিণগুলোর সংগ্রহ করা খাবার খাওয়া যায় সেই চিন্তাতেই মত্ত থাকে এবং তাদের সংগৃহীত খাবার কু-কৌশলে কুক্ষিগত করে ভোগ করে।
যেহেতু এই বনরাজ্যের রাজা হিসাবে বাঘ চলমান মেয়াদের দায়িত্ব পালন করছে। প্রত্যেক প্রাণীই রাজস্ব হিসাবে তাদের সংগৃহীত খাবারের একটি অংশ বাঘকে দিয়ে থাকে।
যেহেতু বনের কোটি কোটি হরিণ, গাধা ও শেয়াল তাদের খাবারের একটি অংশ বনের বাঘকে রাজস্ব হিসাবে দেয় সেহেতু বাঘ বসে বসে তার প্রয়োজনীয় সমস্ত খাবার পেয়ে যায় এবং কিছুটা অবশিষ্ট্য থেকে যায়। দেশে যখন খাবারের সংকট দেখো দেয় তখন অবশিষ্ট্য এই খাবার হরিণ, গাধা ও শেয়ালদের মাঝে বিক্রি করে দেয়। ফলে বাঘগুলো একদিকে যেমন স্বাস্থ্যবান হয়ে উঠছে অন্যদিকে সম্পদেও সমৃদ্ধ হয়ে উঠছে। বাঘের সুখ, স্বাচ্ছন্দ বাঘকে স্বৈরতান্ত্রিক আচরণে অভ্যস্ত করে তুলছে। আর এসব দেখে পরবর্তী মেয়াদের বন রাজার তা সহ্য হচ্ছে না।
তবে ঝামেলা শুরু হল তখন যখন বন রাজা বাঘ ও তার চেলারা হরিণ শাবকদের ধরে ধরে খাওয়া শুরু করল।
আজকে বনের সমস্ত হরিণ, গাধা ও শেয়াল একজায়গায় সমবেত হয়েছে। সমবেত হওয়ার কারণ বন রাজা বাঘ ও বাঘের চেলারা হরিণের বাচ্চাদেরকে ধরে ধরে খাচ্ছে। রাজ্য ক্ষমতা দেওয়ার সময় শর্তছিল বনের সকল প্রাণী যে খাবার সংগ্রহ করবে সেখান থেকে একটা অংশ বনের রাজাকে দেবে। বিনিময়ে বনের রাজা বনে বসবাসরত সকল প্রাণীদের জান ও মালের নিরপত্তা বিধান করবে।
বন রাজা বাঘ এখন অন্য প্র্রাণীদের তো নিরাপত্তা দিচ্ছেই না বরং রাজাদের পরিবারের অন্যান্য বাঘেরা হরিণদের বাচ্চাদের ধরে ধরে ধরে খাচ্ছে।
-আমরা রাজা বাঘের পরিবারের সদস্যদের এই সব অনিয়ম মেনে নেবনা। একটি হরিণ বলল। আমরা সবাই মিলে এর প্রতিবাদ করব।
হরিণ সর্দারের এই কথা শুনে কিছু হরিণ তার সাথে একাত্মতা ঘোষনা করল।
-বল্ল-হ্যাঁ হ্যাঁ বাঘেদের এই অত্যাচার অনিয়ম মেনে নিতে পারিনা। এর একটা বিধি ব্যবস্থা করতেই হবে।
হরিণদের এই প্রতিবাদের ফলে সুবিধাভোগী কুচক্রী শেয়াল গোপনে গোপনে কিছু হরিণের সাথে যোগাযোগ করে তাদেরকে বিশ্বাসঘাতক হতে প্ররোচিত করল এবং সেই বিশ্বাঘতক হরিণদেরকে রাজা বাঘের সাথে যোগাযোগ করিয়ে দিল। শেয়াল বল্লল-
-তোমারা যদি রাজার বিরুদ্ধে আন্দোলন না কর তাহলে রাজা তোমাদের বা তোমাদের সন্তানদেরকে ধরে খাবেনা।
বিপন্ন জীবন বাঁচাতে কিছু হরিণ শেয়ালের এই কুচক্রের সাথে যোগ দিল এবং তারা আন্দোলনে যাওয়া থেকে নিজেদেরকে বিরত রাখল।
প্রোরোচিত হরিণদেরকে শেয়াল বল্ল-
-রাজা সাহেব বলেছে, যে সকল হরিণেরা প্রতিবাদ করছে তোমরা যদি তাদের নাম ও ঠিকানা আমাদেরকে জানিয়ে দাও তাহলে রাজা তোমাদের নিকট থেকে তোমাদের উৎপাদিত ফসলের যে অংশ নেন তা নেবেন না। তাছাড়া পুরষ্কার হিসাবে রাজা তোমাদেরকে রাজ পরিবারের খাবারও খেতে দিবে।
এই শুনে কিছু হরিণ প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে প্রতিবাদ করা বন্ধ করে দিল এবং কিছু হরিণ প্রতিবাদ বন্ধ করার পাশা-পাশি প্রতিবাদী অন্য হরিণের তালিকা শেয়ালের মাধ্যমে রাজাকে পৌঁছে দিল।
কিছুদিন পর বনে একটা মজার ব্যাপার লক্ষ্য করা গেলো। যে হরিণগুলো বন রাজার অন্যায়ের প্রতিবাদ করা বন্ধ করে দিল তারা গাধায় পরিণত হলো এবং যারা প্রতিবাদী হরিণদের তালিকা রাজার কাছে পৌঁছে দিল তারা শেয়ালে পরিণত হলো।
একদিকে বনরাজা ও বনরাজার পরিবারের সদস্যগণ হরিণ ধরে ধরে খেতে লাগল, আর একদিকে নিরব হরিণেরা গাধায় পরিণত হতে লাগল, অন্যদিকে বিশ্বাস ঘাতক হরিণেরা শেয়ালে পরিণত হতে লাগল। এতসব ঘটনার প্রেক্ষিতে বনে হরিণের সংখ্যা জ্যামিতিক হারে কমতে লাগল।
সংক্ষুব্ধ হরিণেরা বাধ্য হয়ে বাঁচার তাগিদে সিংহকে সাথে নিয়ে দূর্বার আন্দোলন করতে শুরু করল। সিংহও রাজ্যভার পাওয়ার লোভে সংক্ষুব্ধ হরিণদের আন্দোলনের নেতৃত্ব দিল। ধীরে ধীরে আন্দোলন জোরালো হতে লাগল।
বনের সকল প্রাণী বুঝতে পারল বাঘের মেয়াদ শেষের পথে। ধূর্ত শেয়ালেরা ভাব বেগতিক দেখে তারাও সিংহ-হরিণের দলে যোগ দিল। বনের সম্মিলিত সকল প্রাণীর দূর্বার আন্দোলনের ফলে সময়ের আগেই বাঘ ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হলো।
পরবর্তী মেয়াদের জন্য সিংহ বন রাজ্যের দায়িত্বভার গ্রহণ করল। কিছুদিন যাওয়ার পর যে সকল হরিণেরা শেয়াল এবং গাধায় রুপান্তর হয়ে গিয়েছিল তারা আবার হরিণ হয়ে গেল এবং নতুন নতুন হরিণ জন্মগ্রহণ করায় হরিণের সংখ্যা বনে যথেষ্ঠ পরিমাণে বেড়ে গেলো।
আন্দোলনরত হরিণেরা আবার নিরিহ হতে শুরু করল। বনে শান্তি ফিরতে শুরু করল। তবে ধূর্ত শেয়ালদের ধূর্তমী আবার নতুন করে শুরু হলো।
বনে হরিণের সংখ্যা বর্ধন দেখে এবং এই বর্ধিত হরিণের কচি মাংশ দেখে সিংহ এবং তার পরিবারের সদস্যরা লালায়িত হলো। একদিকে তাদের লালসা চরম পর্যায়ে, অন্যদিকে বনের হরিণসহ সকল প্রাণীর শান্ত অবস্থা দেখে তারা লোভ সামলাতে পারলনা।
বাঘের শাসন আমলের শেয়ালের ভূমিকার কথা সিংহের জানা ছিল সেই অভিজ্ঞতা থেকে সিংহরা শেয়ালকে তাদের স্বার্থ হাছিলে কাজে লাগাতে শুরু করল। শেয়ালেরা তাদের পুরাতন ভূমিকায় ফিরে গেলো, প্রোরোচিত হরিণেরাও তাদের পূর্বের ভূমিকায় ফিরে গেলো।
কিছুদনি পর
বিশ্বাস ঘাতক হরিণেরা আবার শেয়ালে রুপান্তর হতে শুরু করল, প্রতিবাদ বিমুখ হরিণেরা গাধায় পরিণত হতে শুরু করল।
সুযোগ বুঝে বাঘ সিংহর উপর প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য হরিণ ও শেয়ালদের সংঘবদ্ধ করার প্রয়াসে হরিণ, বাঘ, গাধাসহ সকল প্রাণীকে একত্র করে বল্ল-
-সিংহ তোমাদের উপর যে অত্যাচার শুরু করেছে আমি এর প্রতিবাদ করতে চাই। (এই কথা বলার সময় বাঘ মনে মনে খুব লজ্জা পেলো।
ভাবল আমি যে কাজ করেছি এরাওতো সেই একই কাজই করছে তা হলে আমি.....)। সিংহর এই অন্যায় মেনে নেওয়া যায়না। নিরিহ হরিণদেরকে যে ভাবে ধরে ধরে খাচ্ছে এটা চরম অন্যায়। (এবার বাঘ আনমনে তার ভুড়িতে হাত বুলিয়ে মনে মনে বল্র আমার এই ভুড়ি তো এই হরিণদের মাংশেই গড়া। )আমার সবাই মিলে এর প্রতিবাদ করব।
আর আমি এবার এই বনরাজ্যের দায়িত্ব পেলে আমি তোমাদের জীবনের নিরাপত্তা দেব, তোমাদের জন্য উন্নত মানের খাবারের ব্যবস্থা করব।
-বাঘ ভাই আপনি এবং আপনার চেলারা আমাদের যেভাবে অত্যাচার করেছিলেন তা আমরা আজও ভুলতে পরিনি। সিংহ এখন যা করছে আপনি ক্ষমতায় থাকা কালীন সময়ে তাই করেছিলেন। আমরা সেটা ভুলে যায়নি। তবুও বাঁচার তাগিদে আপনার সাথে আন্দোলন করছি।
একটি হরিণ বল্ল।
-বাঘ খর্বকায় এক হরিণের এই কথা শুনে খুক খুক করে কেশে উঠল।
বনের দায়িত্বে কখনও বাঘ আসে, কখনও সিংহ আসে কিন্তু যিনিই বন রাজ্য চালানোর দায়িত্ব পান না কেন তিনি সেই একই ভূমিকায় অবতীর্ণ হন।
কয়েক বছর পর-
বাঘ, শেয়াল এবং হরিণ অথবা সিংহ, শেয়াল এবং হরিণ এখন আর যুগপৎ আন্দোলন করতে যাইনা। বাঘ এবং সিংহ তারা দুই পক্ষই শলা পরার্শ করে এই সিদ্ধান্তে উপনিত হয় যে-তারা যেহেতু উভয় পক্ষই কচি হরিণের মাংশ খেতে পছন্দ করে সেহেতু তারা এখন আর গন্ডগোল করবে না।
বরং মিলে মিশে পালাক্রমে হরিণ ধরে ধরে খাবে।
আরও কয়েক বছর-
বনে এখন আর কোন হরিণ নেই, বাঘে সিংহে প্রচুর পরিমাণে হরিণ তারা ধরে ধরে খেয়েছে। বিশ্বাস ঘাতক হরিণগুলো শেয়ালে পরিণত হয়েছে, প্রতিবাদ বিমুখ হরিণগুলো গাধায় পরিণত হয়েছে। হরিণ এই বনের এখন এক বিলুপ্ত প্রাণী। তাই সিংহ বাঘের রসনা বিলাসের জন্য এখন আর কচি হরিণের সুস্বাদু মাংশ ভক্ষণ করতে পারেনা।
বাঘ সিংহ হরিণে সুস্বাদু মাংশ আস্বাদনের অভাবে কাঁদে, শেয়াল এখন ধূর্তমীর খেলা করার জন্য কাউকে পায়না, তাই সে কাঁদে। যে সকল নির্বোধ হরিণ গাঁধাদের সঙ্গী ছিল তাদের হারানোর বেদনায় কাঁদে। বনের সকল প্রাণীদের সময় এখন শুধুমাত্র স্মৃতি চারণ ও দীর্ঘশ্বাস ফেলে কাটে।
পরিবর্তনের প্রত্যাশায় কিছু কিছু প্রাণী ভাবে হাতি অনেক বড়, শক্তিশালী ও শান্ত প্রকৃতির প্রাণী হাতি এসে নিশ্চয় তাদের সুদিন ফিরিয়ে দেবে। আবার তখনই আরেক ভাবনা এসে সুভাবনাকে প্রতিহত করে; ভাবে হাতির পেটতো সিংহ বা বাঘের চেয়ে আরও অনেক বড়।
আলমগীর কবির
দর্শনা
8/27/2013 8:13:06 PM
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।