মঈনুল আহসান
যে চারা গাছটা মাত্র মাটি ফুঁড়ে বের হলো তার শক্ত সামর্থ্য হয়ে জমিনের বুকে গেড়ে বসার জন্যে প্রয়োজন হয় সময়ের। সব প্রতিকুলতা কাটিয়ে একবার দাঁড়াতে পারলে তার স্থায়ীত্ব হয় সাধারনত দীর্ঘ্য। মানুষের স্মৃতিও বোধকরি তেমনি। বেশীর ভাগ ঘটনাই মনে পড়েনা খুব একটা। কিন্তু কিছু ঘটনা আছে যার স্মৃতি যেন পরিপুষ্ট হতে থাকে দিন দিন।
আমার ছেলেবেলার তেমনি দুটি স্মৃতি এখন ডালপালা মেলে যেন মহীরূহ হয়ে উঠেছে আমার আন্তরের আঙ্গিনায়।
[এক]
সময়টা ১৯৭২ বা ৭৩। ফুরফুরে ঈদের সকল। আর সব ঈদের মতই বাবার হাত ধরে নামাজ সেরে ফিরেছি একটু আগে। ডাইনিং টেবিল জুড়ে সাজানো হরেক রকম খাবার।
আব্বা তাড়া দিলেন কিছু মুখে দিয়ে আবার তাঁর সাথে বের হওয়ার জন্যে। তাড়া খেয়ে খুশী হলাম। বুঝলাম বেড়াতে যওয়া হবে এখন। ঈদের দিন কে না চায় বেড়াতে।
আমরা তখন সোবহানবাগস্থ প্রথম শ্রেনীর সরকারী কর্মকর্তাদের কলোনীর বাসিন্দা।
ধানমন্ডির বিখ্যাত ৩২ নং রোডের উল্টো দিকের ঐ কলোনীতে তখন ছিল মোট সাতটি বিল্ডিং। প্রতি বিল্ডং-এ আটটি করে মোট ৫৬টি পরিবার বাস করতেন পুরো কলোনীতে। সমগোত্রীয় বলেই বোধকরি সবার মধ্যে ছিল আন্তরিক সখ্য। আমরা থাকতাম ৪ নং বিল্ডিং-এ। কলোনীতে ঢোকার প্রধান দুটো গেইটের একটার পাশ ঘেষে ছিল এই বিল্ডিংটা।
আব্বার হাত ধরে বিল্ডিং-এর গাড়ী বারান্দায় এসেছি। পা রাখবো রাস্তায়। অথচ হাতটা এনে ধরে আটকালেন আব্বা। ডানে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখি মেইন গেট পেরিয়ে এগিয়ে আসছে বিশাল এক কালো মার্সিডিজ। আমাদের চার চোখ তখন নিবদ্ধ ঐ গাড়ীর দিকে।
গাড়ীটা চলে গেলেই রাস্তায় নামবো। ধীরে গাড়ীটা এসে পড়েছে আমাদের সামনে। আমাদেরকে দেখে বোধকরি আরেকটু যেন থেমে এলো গাড়ীটার গতি। দেখলাম ড্রাইভারের ঠিক পেছনে, মুখে লাগানো ধুমায়িত পাইপটা বাম হাতে ধরে আব্বার দিকে তাকিয়ে ডান হাতটা নাড়ছেন স্বয়ং শেখ মুজিবর রহমান। জানতাম ৭ নং বিল্ডিং-এ উনার এক নিকটাত্মীয় থাকেন।
সম্ভবত সেখানেই এসেছিলেন শেখ মুজিব।
হূদয়ের জমিনে পুষ্ট হয়ে বেড়ে ওঠা সেই স্মৃতির মহীরূহ নাড়া দিলে এখনও স্পষ্ট দেখতে পাই স্মিতহাস্য, যেন সব পংকিলতামুক্ত অনাবিল উদার এক মুখ, আমাদের স্বাধীনতার প্রাণ পুরুষ শেখ মুজিবর রহমানের সেই মুখ।
[দুই]
কয়েক বছর পরের ঘটনা। আবার এক ঝকঝকে ঈদের সকাল। আবারও আব্বার সাথে আমি।
বসে আছি ঢাকা আউটার স্টেডিয়ামের বিশাল সামিয়ানার নীচে ঈদের প্রধান জামাতের একেবারে সামনের দিকে। নামাজের নির্ধারিত সময়ের সামান্য বাঁকি। সবাই অপেক্ষায় প্রধান ব্যক্তিত্বের। হঠাৎ দেখি মুসল্লীদের দিকে তাকিয়ে হাত নাড়তে নাড়তে এগিয়ে আসছেন একহারা গড়নের শুভ্র, সফেদ পাজামা-পাঞ্জাবী শোভিত হাস্যচ্ছল বলিষ্ঠ এক সুপুরুষ। যেন স্বপ্নে দেখা অতি চেনা পবিত্র এক রাজপুত্র।
আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রথম সারির অনন্য সমর নায়ক জেনারেল জিয়াউর রহমান। পবিত্র ঈদের দিনের সমস্ত নির্মল সৌন্দর্য্য আর আনন্দ যেন ঠিকরে বেরুচ্ছিল তাঁর উদ্ভাসিত চেহারায়। আজ এতকাল পরে সেই স্মৃতি এখনও পল্লবিত আমার অন্তরে। হূদয়ের চোখে যখনই দেখি সেই স্নিগ্ধ মুখ। অনাবিল হাসি।
মনে হয় জিয়া যেন বলছেন, ‘হে দেশবাসী, ভালবাসি, তোমাদেরকে বড় ভালবাসি’।
এখন আমি প্রবাসী। ঈদ করেছি, ঈদের নামাজ পড়েছি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। বাংলাদেশেও গেছি বেশ কয়েকবার সবার সাথে ঈদ করতে। প্রতিবারই সেই শৈশবের মত ভোরবেলাতেই ছুটে গেছি প্রথম জামাতের নামাজ ধরতে।
অবশ্য বাবাকে ছাড়া। তিনি গত হয়েছেন বেশ ক’বছর। জীবদ্দশার শেষ বছরগুলোতে ভারী শরীর নিয়ে আর যেতে পারতেন না ঈদের কোন জামাতে। কিন্তু এখনও প্রতিটি ঈদের ভোরে আমার ডান হাতের কব্জিতে অনুভব করি আমার বাবার সেই নিশ্চিত নিরাপত্তার শক্ত হাত। আর চোখের তারায় ভাসে নিষ্কলুষ ভালবাসায় পূর্ণ প্রশান্ত সেই দুটি মুখ।
দুই মহানায়কের মুখ।
নেতৃত্বের এত সুন্দর মুখ আমি আর কখনও কোথাও দেখিনি।
[তিন]
স্বাধীনতাকামী খুব জটিল এক জনগোষ্ঠির নেতৃত্বের চ্যালেঞ্জ তাঁরা খুব দৃঢ়তার সাথে মোকাবেলা করে গেছেন তাঁদের নিজ নিজ স্বকীয় পদ্ধতিতে। ব্যর্থতার শতভাগ দায়ভার কাঁধে নিয়ে প্রথমজনের রক্তাক্ত প্রস্থান স্বস্তির হাসি ফুটিয়েছিল দেশবাসীর মুখে। ৭৫-এর ইতিহাসে এই চরম সত্যটা অবিচ্ছেদ্য ভাবে গ্রথিত।
যেহেতু ইতিহাসের ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত ইচ্ছা-অনিচ্ছা, ভাল লাগা না লাগা মূল্যহীন তাই চরম এই সত্যটা মেনে নেয়া ছাড়া আর কোন উপায়ও নাই। অন্যদিকে নিশ্চিত ধ্বংসের কিনারা থেকে টেনে তুলে দেশকে সমৃদ্ধির রাজপথে পৌছে দিয়ে দ্বিতীয়জনও বিদায় নিয়েছিলেন একই ধরনের ট্রাজেডির শিকার হয়ে। তবে এই ক্ষেত্রে দেশবাসী কেঁদেছিল আকুল হয়ে। দু’জনের মৃত্যু পরবর্তি এই জন প্রতিক্রিয়াই মূলতঃ নির্ধারিত করে দিয়েছে ইতিহাসের পাতায় তাঁদের নিজ নিজ অবস্থান। এ অবস্থায়, তাঁদের অন্তর্ধানের এতকাল পরে, বর্তমানের এই আমাদের দ্বারা সময় সুযোগ বুঝে তাঁদের কাউকে তিরষ্কৃত কাউকে পুরষ্কৃত করার যে কোন প্রয়াস হবে এক ধরনের ‘মানসিক অসুস্থতা’ মাত্র।
আরও স্পষ্ট করে বললে একে অতি নিম্ন মান ও মনের ‘হীনমন্যতা’ বলাটাই বোধকরি হবে যথার্থ।
আমাদের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী, মুজিব কন্যা শেখ হাসিনা যে তার প্রতিপক্ষ খালেদা জিয়ার চাইতে এই রোগে বেশী কাতর তা বুঝবার জন্যে বিশেষ কোন পান্ডিত্যে দরকার পরে না। ভোট ভিক্ষার শত অভিনয়, কাকুতি-মিনতি আর সহস্র প্রতিশ্রুতি ভুলে ‘মৃত’ জিয়াই যেন বারবার মূখ্য হয়ে উঠছে শেখ হাসিনার কাছে। জাতির উদ্দেশ্যে দেয়া বক্তৃতায় জিয়াকে কটুক্তি করায় তিনি এবং তার দল যে গোহারা হেরেছিল ১৯৯১-এ এটা কিভাবে যে তারা ভুলে যান তা বুঝে আসে না। ‘গণতান্ত্রিক স্বৈরশাসনের’ জন্য তার দল ঘৃণিত হয়েছে বারবার কিন্তু কোন কিছুতেই এদের কেন যেন কোন পরওয়া নেই।
তারা নিজেদেরকে মুক্তিযুদ্ধের একমাত্র ধারক, বাহক, প্রচারক মনে করে অথচ তারাই বিবিধ স্থাপনা থেকে মুক্তিযুদ্ধের বীরশ্রেষ্ঠদের নাম পর্যন্ত মুছে ফেলতে দ্বিধা করছে না। অবস্থার বিবেচনায় গণতান্ত্রিক এই স্বৈরশাসনকে এখন একনায়কের শাসনের চাইতেও জঘন্য মনে হচ্ছে। মজার ব্যপার হলো শ্বাসরূদ্ধ এই কুটিল অবস্থার প্রেক্ষিতে এরই মধ্যে শেখ হাসিনা নিজেই আশংকা প্রকাশ করেছেন আরেকটি অনিবার্য ব্লাড বাথ-এর। কিন্তু তারপরও নিজেদের চরিত্র পরিবর্তনের কোন উদ্যোগ বা তাগিদ তাদের মধ্যে দেখা যাচ্ছে না। বারবার ধিক্কৃত, রক্তস্নাত হয়ে বিদায় নেয়াটাই যেন এদের দলীয় এজেন্ডা এবং নিয়তি।
প্রতিবার প্রধানমন্ত্রী হওয়া মাত্রই শেখ হাসিনার অতি কাম্য হয়ে দাঁড়ায় সুরক্ষিত বাড়ী-গাড়ী আর আর্মির নিরাপত্তা চাদর। অথচ সেই আর্মি অফিসাররাই যখন মরতে থাকেন তার চোখের সামনে তখন তাকে নির্লজ্জের মত বলতে শোনা যায়, ‘বিডিআর সদরে যে এত খুন-খারাবী হচ্ছে তা আমরা বুঝতেই পারিনি’! এমনকি ঘটনা শুরুর দুই ঘন্টার মধ্যে বিদেশী মিডিয়ার সুস্পষ্ট খবরের পরও তিনি ‘বুঝতেই পারেন না’ যে বিডিআর সদরে কি হচ্ছে। সেই তিনিই কিনা দেশের প্রধানমন্ত্রী ! শুধু কি তাই, কালক্ষেপনের আড়ালে বিদ্রোহীদের আদিম লালসার খোরাক হিসেবে অফিসারদের অসহায় পরিবারদের তুলে দিতেও তার কোন দ্বিধা বা সংকোচ হয় নি। অথচ জিয়ার নাম মুছতে, বীরশ্রষ্ঠদের নাম উপড়ে ফেলতে সেই তিনিই কত না তড়িৎ, কত না তৎপর। মুজিব কন্যার পক্ষে এমন হীনমন্যতা, এমন চশমখোরি যে শোভনীয় নয় সেটা বুঝবার জ্ঞান-বুদ্ধি যদি তার না থেকে থাকে তবে ইপ্সিত সেই রক্ত গঙ্গার আগেই ক্ষমতা ত্যাগ করে তার নির্জন বাসে চলে যাওয়া উচিৎ বলে মনে করছি।
ওদিকে খালেদা জিয়ার কেচ্ছা আবার আরেক কিসিমের। নূন্যতম শিক্ষাগত যোগ্যতা ছাড়াই তিনি যে সর্বাধিকবার দেশের প্রধানমন্ত্রী হতে পেরেছেন, বিপুল ভোটে বারবার নির্বাচিত হচ্ছেন দেশের যে কোন প্রান্ত থেকে, এসব যে তার কৃতিত্ব নয়, এসব যে জেনারেল জিয়ার প্রতি জন-মানুষের অপার, অব্যক্ত শ্রদ্ধা ও ভালবাসা তা তিনি ভুলে যান ক্ষমতায় বসা মাত্রই। তিনি ভুলে যান যে জিয়া কারিশমার মূল ভিত্তিই ছিল পারিবারিক আবেগ বিসর্জন দিয়ে কঠোরতম উপায়ে স্বজনপ্রীতি পরিহার করে গণমানুষের মাঝে নিজেকে একাকার করে দেয়া। সেই জিয়ার স্ত্রী হয়ে তৃতীয়বার প্রধানমন্ত্রীর গদিতে বসেই তিনি যে ভাবে ৬০ জন মন্ত্রী আর তার নাদান ছেলেকে দেশের উপর চাপিয়ে দিয়ে হাত-পা ছেড়ে নির্লিপ্ত থেকেছেন তাতে এটাই ধারনা হয় যে তিনি প্রধানমন্ত্রীত্ব তো অবশ্যই এমনকি ‘জিয়া’র নাম ব্যবহারের যোগ্যতাও হারিয়েছেন।
আমাদের আশা, ভরসা ও লক্ষ্যহীন এই বর্তমানের প্রেক্ষাপটে এটা এখন স্পষ্ট যে, এই দুই নেত্রী আর যাই হোক, শেখ মুজিব বা জেনারেল জিয়ার যোগ্য উত্তরাধিকার বা উত্তরসূরী নন।
উনারা দু’জন ছিলেন দেশের এবং জনগণের আর তাই এই দেশ ও তার জনগণই তাঁদের আসল উত্তরসূরী। আর তাই ঐ দুই মহান নেতার নাম নিয়ে ছিনিমিনি খেলার কোন অধিকার খালেদা বা হাসিনার নেই। এখনই যদি তারা মুজিব-জিয়াকে নিয়ে তাদের নোংরা ব্যক্তিস্বার্থের রাজনীতি বন্ধ না করেন তাহলে অদূর ভবিষ্যতে বাংলাদেশের ইতিহাসে এই দুই নেত্রীই ‘আবর্জনা’, ‘একবিংশ শতকের ঘষেটি বেগম’ বা ‘দুষ্টকীট’ হিসেবে চিহ্নিত হবেন বলে আমার বিশ্বাস।
লস এঞ্জেলেস, ইউএসএ
==========================
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।