ফোঁটায় ফোঁটায় জহর আমি জমা করে রাখি তোর নাম করে বুড়ি জপি নতুন রুবাই ।
আজ প্রকাশিত হলো আমার প্রথম গদ্যের বই কন্সপিরেসি অফ সাইলেন্স। বইটি প্রকাশ করেছে ভাষাচিত্র। বইটি পাওয়া যাচ্ছে বইমেলার ২৫০ নাম্বার স্টলে। সামু পাঠকদের জন্য নাম গদ্যটি এখানে প্রকাশ করছি।
আমাদের পৃথিবীটা নির্ঝঞ্জাট ছিলো না কখনোই। আর শিল্প-সাহিত্যের জায়গাটা তো নয়ই। কেউ বুকে হাত দিয়ে বলতে পারবে না যে তার শিল্পের জায়গাটা সে মসৃণ পেয়েছে। কতরকমের অদৃশ্য বাধা যে আমাদের সামনে এসে হাজির হয় তার ইয়ত্তা নেই। কবি-শিল্পীদের হাজার রকম বাধা পেরোতে হয়।
সে সমস্ত বাধা পেরোতে তারা একটু থ্রিলও অনুভব করেন বটে। কিন্তু যে বাধা পেরোতে কবিকে হতে হয় অসৎ? কবিকে নামতে হয় ভিলেজ পলিটিক্সের চেয়েও নোংরা রাজনীতিতে সেটা কেমনতর বাধা? অথচ আজকের কবি-শিল্পীদের সেখানেই নামতে হচ্ছে। হচ্ছে মানে তারা নামতে বাধ্য হচ্ছে। কেননা আজকের এই সময়ে সাহিত্যের বি¯তৃত ভূমিতে একজন কবি অথবা কলমশিল্পীকে যতরকমের সমস্যার মুখোমুখি হতে হয় তার মধ্যে প্রধানতম হলো সাহিত্যের নোংরা রাজনীতি। অবশ্য এই নোংরা রাজনীতি বেশি প্রকট হয় সেখানে, যেখানে সচেতন পাঠক সমাজের অভাব অনুভূত হয়।
কারণ যেখানে সচেতন পাঠকসমাজের অভাব থাকে সেখানে সাহিত্যের মূল নিয়ন্ত্রণটা আপাত হাতে নিয়ে নেয় মিডিয়া। আর একথা সর্বজন বিদিত যে, মিডিয়ার নিয়ন্ত্রণটা সবসময় থাকে ভাঁড় সম্পাদক ও তাদের সৃষ্ট মিডিওকার কবি-সাহিত্যিকদের হাতে।
কবিতে কবিতে ঈর্ষা ও অসূয়ার যে ধারাটি আমাদের সমাজে প্রচলিত তা একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। কালিদাস থেকে চণ্ডীদাস, হোমার থেকে চসার কেউ-ই বোধ হয় এই সমস্যার হাত থেকে রেহাই পায়নি। কিন্তু পাঠকই সবসময় এই সমস্যার সমুচিত জবাব দিয়ে দিয়েছে কূট-চাল চালকদের বিরুদ্ধে।
ফলে এই ঈর্ষা ও অসূয়ার ধারাটি মেনে নিয়েই আমাদের পথ চলতে হয়। পাঠক সচেতন থাকলে এই সমস্যার সুরাহা আপনা-আপনিই হয়ে যায়। অবশ্য সচেতন পাঠক কোন না কোন সময় পাওয়াই যায়। আজকের পাঠক অচেতন থাকলেও ভবিষ্যতের পাঠক সচেতন হবেই। কিন্তু সমস্যা হলো আজকের পাঠক যদি অচেতন বা অসচেতন থাকেন তাহলেই গা নেড়ে চেড়ে বসে ভাঁড় সম্পাদক ও মিডিওকারেরা।
পাঠকের এই অসচেতন অবস্থার সুযোগে দলে ভারি মিডিওকার ও ভাঁড় সম্পাদকেরা নিজের গোষ্ঠীর লেখকদের এমনভাবে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে প্রচার করে যেন তারা এক একজন কালিদাস বটে। বর্ষসেরা, যুগসেরা, শতাব্দীসেরা, এই বাছাই, সেই বাছাই ইত্যাদি বিশেষণে বিশেষিত করে পাঠকের চোখ কপালে তুলে দিয়ে পাঠককে বাধ্য করে সেই সব বস্তাপচা গিলে খেতে (অবশ্য তাদের সবাই যে নষ্ট হয়ে যাওয়া বাতিল তা আমি বলছি না। অবশ্যই সত্যিকারের ভাল লেখকরাও সেই তালিকায় ঠাঁই পায়। তা না হলে নষ্টদের তারা কাদের ঘাড়ে চাপিয়ে নদী পার করাবে)। অপরদিকে এর বিপরীত ঘটনাও ঘটেÑ যদি তারা দেখে যে তাদের গোষ্ঠীর কোন লেখকের ভাল কিছু একবারেই বলা যাচ্ছে না তখন শুরু হয় পরিকল্পিত সমালোচনা।
চতুর্দিক থেকে এমন বিশেষ বিশেষ কায়দায় সমালোচনা শুরু হয় তখন পাঠক ভাবতে বাধ্য হয়- না জানি এর ভেতরে কী বিশেষ মাহাত্ম্য লুকিয়ে আছে? এই তো আমাদের নষ্টভ্রষ্ট সময়। আমাদেরই অসচেতনতার সুযোগে আমাদেরই মাথায় কাঁঠাল ভেঙে খাচ্ছে একদল পরজীবী।
১৮৭৩ সালের শেষ দিককার কথা। পড়ন্ত বিকেলে প্যারির এক ক্যাফেতে এসে উঠলেন আঠার বছর বয়সের এক যুবক। এর প্রায় চার মাস আগে যুবক এক কাব্য রচনা করে মায়ের কাছ থেকে পয়সা চেয়ে নিয়ে নিজেই তা প্রকাশ করেন।
বইটি ডাকযোগে পরিচিতদের মাধ্যমে পাঠিয়েছিলেন প্যারির প্রায় প্রতিটি সাহিত্যপত্রিকা, কবি ও আলোচকদের। কারণ তিনি আশা করেছিলেন বইটির অনুকূলে যথেষ্ট রিভিউ হবে এবং সাড়া পড়বে। কিন্তু তিনি প্যারি এসে দেখেন যে, তার বইটি সম্পর্কে কেউ কোন কথা বলছে না। এমনকী তার বইটি যারা পড়েছেন এবং জেনেছেন তারাও মুখে কুলুপ এঁটে বসে আছেন। রাগে, দুঃখে ােভে যুবক প্যারি থেকে পায়ে হেঁটে চলে আসেন নিজের গ্রাম শার্লে ভিলে।
বাড়ি ফিরে সমস্ত পাণ্ডুলিপি এবং বইটির অবশিষ্ট কপি রাস্তায় জড়ো করে আগুন ধরিয়ে দেন। বাকি জীবনে আর কবিতার পথে পা বাড়াননি। ফ্রান্সের সুরম্য নগর ছেড়ে আফ্রিকার জঙ্গলে গিয়ে শুরু করেছিলেন বন্দুক চোরাচালানের ব্যবসা। অথচ ঐ ঘটনার বছর কয়েক পরে প্যারির এক পত্রিকার জনৈক সহ-সম্পাদক তাকে চিঠি লিখে জানিয়েছিলেন যে, ফরাসি কবিতার জগতে তিনি এখন কিংবদন্তী। প্যারি তার জন্য অপো করছে।
কিন্তু তিনি গা করেননি। কারণ ঐ আঘাত তার পে সহ্য করা সম্ভব হয়নি। মৃত্যু পরবর্তীতে ঐ যুবক কবিতার ইতিহাসে ফিরে এসেছিলেন সিম্বলিস্ট ও সুররিয়ালিস্টদের প্রধান পুরুষ হয়ে। তিনি জ্যাঁ আর্তুর র্যাঁবো। আর যে গ্রন্থটি নিয়ে এত কাণ্ড হয়ে গেল সে গ্রন্থটি তার শ্রেষ্ঠ কীর্তি নরকে এক ঋতু।
তাহলে কী হয়েছিল সেদিন? কেন এমনটি হয়েছিল? সেদিন যা হয়েছিল তাকে এক কথায় বলা যায় কন্সপিরেসি অফ সাইলেন্স। আর এমনটি হয়েছিল এইজন্য যে আর্তুর র্যাঁবো ভাঁড় সম্পাদক ও পরজীবী লেখকদের গোষ্ঠীভূক্ত বা অনুগামী হতে চাননি বা পারেননি বলে।
কন্সপিরেসি অফ সাইলেন্স। নিরবতা পালনের মধ্য দিয়ে একটি ভাল কাজ, একটি ভাল শিল্পকর্মকে লোক চুর অন্তরালে রেখে দিয়ে তাকে অকাল মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়ার ষড়যন্ত্রই হলো কন্সপিরেসি অফ সাইলেন্স। অর্থাৎ ভাল কাজটিকে নিয়ে তারা ভাল বা মন্দ কোন কথাই বলবে না।
তাদের ধারণা অচর্চিত হতে হতে একদিন তা কালের গহব্বরে হারিয়ে যাবে। যদিও তেমনটি হয় না কোনদিন। একদিন তা সত্যি সত্যি সূর্যের আলো ফোটে বেরিয়ে আসে। তথাপি ণিকের জন্য হলেওÑসাহিত্যের মাঠে যারা নোংরা রাজনীতি নিয়ে ব্যস্ত থাকে তাদের হাতেÑ কন্সপিরেসি অফ সাইলেন্স হয়ে ওঠে এক ভয়ঙ্কর নিরব মারণাস্ত্র। কারণ এই খেলায় অনভ্যস্ত বা অনীহা প্রকাশকারী কবি-শিল্পীরা রাগে, দুঃখে, সাহিত্য থেকে অকাল বিদায় নিতে পারেন।
যা একার্থে একজন কবির মৃত্যুই। অন্যদিকে যারা এই খেলায় সিদ্ধি লাভ করেন তাদেরও মননের মৃত্যু ঘটে। আর কমিটেড কেউ যদি পাঁকে পড়ে এই খেলায় অংশগ্রহণ করে তবে একদিন টের পায় ভণ্ডামী এবং মুখোশ দুটোকেই একত্রে ধারণ করে আছে তারা। সেদিন নিজের ভেতরের ফাঁপা সত্যটা টের পায় তারা। একজন কবি বা শিল্পীর জীবনে এর চেয়ে তো মৃত্যু ভাল।
ভাঁড় সম্পাদক ও পরজীবী মিডিওকার কবি লেখকরা সুশীল কায়দায় কন্সপিরেসি অফ সাইলেন্সকে কাজে লাগাতে চায় পাঠকের অসচেতনতার সুযোগে। কিন্তু পাঠক চিরকাল বোকা হয়ে থাকে না। চিরকাল তারা অন্যের চোখ দিয়ে দেখে না। কোন না কোনদিন তারা নিজের চোখ দিয়ে বিশ্বব্রহ্মাণ্ড দেখে। সেদিন এইসব সুশীল ভাঁড়দের সমস্ত বুজরুকি ফাঁস হয়ে যায়।
সেদিন ঠিকই স্বমহিমায় হাজির হন র্যাঁবো, জীবনানন্দ। কিন্তু এটাও তো সত্যি, এই কন্সপিরেসির জন্যই র্যাঁবো, জীবনানন্দের জীবন দুর্বিষহ হয়ে পড়ে। যে র্যাঁবো দুনিয়াজোড়া কবিতাকে মুক্তি দিয়েছিলেন অনুশাসন থেকে সেই র্যাঁবো এই কন্সপিরেসির কারণেই অকালে মাত্র ১৮ বছর বয়সে বিদায় নিয়েছিলেন কবিতা এবং ৩৭ বছর বয়সে বিদায় নিয়েছিলেন পৃথিবী থেকে। আজকে একজন জীবনানন্দ গবেষক জীবনানন্দের উপর একটি গবেষণাকর্ম সম্পাদন করে যে অর্থ উপার্জন করেন এই কন্সপিরেসির কারণে জীবনানন্দ জীবদ্দশায় নিজের লেখা থেকে তার সিকিভাগও অর্জন করতে পারেননি। অথচ কে জানে জীবনানন্দের পারিবারিক কলহের মূলে ছিল আর্থিক দৈন্যতা।
অপরদিকে দলে ভারি মিডিওকার লেখকরা ভাঁড় সম্পাদকের কল্যাণে গাড়ি বাড়ি ও সেলিব্রেটির ফানুস নিয়ে কী বড়াই-ই না করছে।
আগেই বলেছি, সুশীল ষড়যন্ত্রকারীদের ধারনা, অচর্চিত হতে হতে একটি ভাল কাজ কালের গহব্বরে হারিয়ে যাবে। যদিও তেমনটি কখনও হয় না। একদিন না একদিন তা ঠিকই সূর্যের আড়াল ভেঙে বেরিয়ে আসে মানুষের সামনে। আর এটাই তো প্রত্যেক সৎ লেখকের প্রকৃত ভরসার জায়গা।
কিন্তু তারপরও কথা থাকে। কালের বিচার সমকালে হলে তি কী? একজন সৎ লেখক যদি সমকালে, জীবদ্দশায় নিজের অর্জন দেখে যেতে পারেন, নিজের প্রাপ্য সম্মান নিয়ে যেতে পারেন, তাতে মন্দ কী? এমনটি হলে জাতি হিসেবে আমাদেরই তো গর্বিত হওয়ার কথা। পাঠক হিসেবে আমাদেরও সম্মানিত হওয়ার কথা। তবে তার জন্য চাই কন্সপিরেসি অফ সাইলেন্সের বিরুদ্ধে সচেতন হওয়া। প্রয়োজন পাঠকের জেগে ওঠা।
ভাঁড় সম্পাদক ও পরজীবী মিডিওকারদের বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে নিজের চোখ দিয়ে পৃথিবী দেখা। নিজের সৎ সাহিত্যকে নিজেদেরই কদর করা। কেননা যে জাতি সৎ সাহিত্যের কদর করে না সে জাতির কেউ সৎ সাহিত্য তৈরিও করে না।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।