থাকবো নাকো বদ্ধ ঘরে, দেখবো এবার জগৎটাকে
অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন গত ৩১ জানুয়ারি দৈনিক যুগান্তরে ‘কোথাও কোন ক্রন্দন নেই’ শিরোনামে প্রকাশিত এক প্রবন্ধে লিখেছেন— ‘অপরাধীকে দণ্ড দিলেও আমরা সময় সময় সহানুভূতি দেখাই। কিন্তু এই প্রথমবার এক অভূতপূর্ব দৃশ্য দেখা গেল। বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের হত্যাকারী পাঁচ খুনিকে ফাঁসি দেয়ার পর দেখা গেল মানুষ কোথাও কোথাও উল্লাস প্রকাশ করছে। কোথাও কোন ক্রন্দন নেই। ’ লেখার শেষ পর্যায়ে লিখেছেন, হত্যাকারীদের ফাঁসি কার্যকরে সমর্থন না থাকলে কোথাও না কোথাও ক্রন্দনধ্বনি শোনা যেত।
কিন্তু ২৮ জানুয়ারি বাংলাদেশের কোথাও কোন ক্রন্দনধ্বনি শোনা যায়নি। ’ আমি যতটুকু জানি, ইতিহাসের একজন শিক্ষক হিসেবে অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের অতীত সম্পর্কে জ্ঞান দিয়ে থাকেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট আমি খুব ছোট ছিলাম। তবে আনন্দ-বেদনা, সুখ ও দুঃখবোধ এবং ক্রন্দন সম্পর্কে ওয়াকিবহাল ছিলাম। কেউ আনন্দ প্রকাশ করলে কিংবা ক্রন্দন করলে সহজেই বুঝতে পারতাম।
অতটুকু জ্ঞান তখন আমার হয়েছিল। সপরিবারে শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ডের পর দেশের কোনো মানুষ কিংবা আওয়ামী লীগের কোনো নেতা কেঁদেছেন অথবা হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে স্বতঃস্ফূর্তভাবে বিক্ষোভ মিছিল ও প্রতিবাদ সভা করেছেন বলে শোনা যায়নি। এসব বিষয় নিয়ে কেউ দাবিও করেননি। মাত্র তিন বছরের ব্যবধানে তার মৃত্যুর পর আনন্দ মিছিল ও মিষ্টি বিতরণের ছবিও ওই সময়ের পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। দৈনিক ইত্তেফাকসহ সব পত্রিকাতেই পটপরিবর্তনকে স্বাগত জানিয়ে সম্পাদকীয় প্রকাশ করে বলা হয়েছে, দেশ জগদ্দল পাথর থেকে মুক্ত হলো।
দেশের মানুষ এই দিনটির অপেক্ষায়ই ছিল বলে দৈনিক ইত্তেফাকে উল্লেখ করা হয়েছে। ট্রায়াল কোর্টে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার বিচার প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার দিন থেকেই একজন নগণ্য সংবাদকর্মী হিসেবে আমি এ মামলায় আদালতের কার্যবিবরণী সংগ্রহ করেছি। মামলার সাক্ষীদের জবানবন্দি ও যুক্তিতর্ক থেকে জানতে পেরেছি, টুঙ্গিপাড়ায় দাফনের জন্য মরহুম শেখ মুজিবুর রহমানের লাশ নিতে কিছুটা বিলম্ব হয়েছে। কারণ, ওই সময়ের বিমান বাহিনী প্রধান বর্তমান পরিকল্পনামন্ত্রী একে খন্দকার লাশ বহনের জন্য প্রথমে হেলিকপ্টার দিতে রাজি হননি। পরে ঊর্ধ্বতন সেনা কর্মকর্তাদের পীড়াপীড়িতে হেলিকপ্টার দিয়েছেন।
টুঙ্গিপাড়ায় তার একমাত্র জানাজায় ইমাম সাহেবসহ ৭ জন লোক অংশ নিয়েছেন বলে মামলার সাক্ষী আদালতকে জানিয়েছেন। সম্প্রতি বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় মৃত্যদণ্ডাদেশপ্রাপ্ত আসামিদের জানাজা ও দাফন অনুষ্ঠানের ছবি বিভিন্ন টিভি চ্যানেলের মাধ্যমে দেশের অনেকেই দেখেছেন। টিভি প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, কর্নেল ফারুকের দুটি জানাজা হয়েছে। প্রতিটি জানাজায় হাজার হাজার মানুষের উপস্থিতি দেখানো হয়েছে। ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খানের গ্রামের বাড়িতে ভোর ৬টায় তার লাশ পৌঁছানো হয় এবং পৌনে ৭টায় জানাজা হয়।
পৌনে এক ঘণ্টার ব্যবধানে গ্রামের একটি জানাজায় দুই হাজারের বেশি মানুষের উপস্থিতি হয়েছে বলে চ্যানেল ওয়ানের প্রতিবেদক তার সচিত্র প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছেন।
বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় হাইকোর্টের দ্বিধাবিভক্ত রায়ের পর আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের লাঠি মিছিল বিচার ইতিহাসের একটি অধ্যায় হয়ে থাকবে। এ ঘটনার পর মামলার রাষ্ট্রপক্ষের প্রধান আইনজীবী অ্যাডভোকেট সিরাজুল হককেও আদালতে বিচারকদের সামনে বেশ বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে দেখা গেছে। তিনি বলেছিলেন, আমরা আদালতকে স্বাভাবিক গতিতেই চলতে দিতে চাই। কোনো ধরনের হুমকি-ধামকি দিয়ে ন্যায়বিচার আদায় করা যায় না।
মাঝখান থেকে আদালতকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলা হয়। এতে আদালত ও আইনজীবীরা বিব্রত হন। সম্প্রতি ভারতের অন্ধ্র প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী মারা গেছেন। তার মৃত্যুর শোক সইতে না পেরে আত্মহত্যা ও হার্ট অ্যাটাক করে অনেকে মারা গেছে বলে বাংলাদেশ ও ভারতের সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশ করা হয়েছে। কাজেই নেতাদের জনপ্রিয়তা যাচাইয়ের ব্যারোমিটার সম্পর্কে কারোরই অজানা নেই।
তাছাড়া অধ্যাপক মুনতাসীর মামুনসহ বর্তমানে যারা বঙ্গবন্ধুর আদর্শ বাস্তবায়নের সংগ্রামে লিপ্ত, ‘হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি’র মৃত্যুর পর তাদের কী ভূমিকা ছিল, সেই বিষয়ে জাতি আজও অজ্ঞাতই থেকে গেল।
অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের মর্মান্তিক ওই হত্যাকাণ্ডের জন্য বিএনপি, জামায়াতে ইসলামীসহ সব ইসলামী দলকেও দায়ী করে প্রবন্ধের মাঝখানে উল্লেখ করেছেন, ‘বিএনপি-জামায়াত ও ইসলাম ব্যবসায়ী দলগুলো বঙ্গবন্ধু হত্যাকে সমর্থন করেছিল। ’ বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীকে তিনি বঙ্গবন্ধু হত্যার সুবিধাভোগী হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। ইতিহাসের শিক্ষক ও একজন সমাজ সচেতন নাগরিক হিসেবে অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন বেশ ভালো করেই জানেন, ১৫ আগস্টের পটপরিবর্তনের পর দেশের শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন শেখ মুজিবুর রহমানেরই অত্যন্ত বিশ্বস্ত ও আস্থাভাজন ব্যক্তিত্ব এবং তার সরকারের প্রভাবশালী মন্ত্রী খন্দকার মোশতাক আহমদ। খন্দকার মোশতাকের মন্ত্রিসভার সদস্যরাও সব আওয়ামী লীগেরই নেতা ছিলেন।
বিএনপির প্রতিষ্ঠা হয়েছে ১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর। জামায়াতে ইসলামীসহ সব ইসলামী ও ডানপন্থী রাজনীতি বাংলাদেশে শুরু থেকেই নিষিদ্ধ ছিল। সংবিধানের ৪র্থ সংশোধনীর মাধ্যমে ১৯৭৫ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি একদলীয় বাকশাল প্রতিষ্ঠা করার পাশাপাশি রাজনৈতিক দল হিসেবে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ, বর্তমান মহাজোট সরকারের সংসদ সদস্য হাসানুল হক ইনুর জাসদ, রাশেদ খান মেননের ওয়ার্কার্স পার্টি, বর্তমান শিল্পমন্ত্রী দীলিপ বড়ুয়ার পিপলস পার্টি, কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরীর ন্যাপ, সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের গণতন্ত্রী পার্টিসহ সব রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করা হয় (সূত্র : সরকারি প্রজ্ঞাপন)। ইতিহাস থেকে যতটুকু জেনেছি, জাসদের রাজনীতি নিষিদ্ধ করায় হাসানুল হক ইনুর নেতৃত্বে গণবাহিনী গঠন করে শেখ মুজিবকে হত্যার মাধ্যমে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য একটি শক্তিশালী স্যুইসাইডাল স্কোয়াডও গঠন করে। তাদের প্রথম অপারেশন হিসেবে ভারতীয় রাষ্ট্রদূত সমর সেনকে জিম্মি করতে গিয়ে এই স্কোয়াডের ৭ সদস্য নিরাপত্তা রক্ষীদের গুলিতে নিহত হয় (সূত্র : ক্রাচের কর্নেল)।
একদলীয় বাকশাল গঠন করায় একই বছর ১৬ জুন রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান প্রজ্ঞাপন জারির মাধ্যমে ৪টি পত্রিকা সরকারের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে অবশিষ্ট ২৮৭টি পত্রিকার প্রকাশনা বন্ধ করা হয়। এতে হাজার হাজার সাংবাদিক বেকার হয়ে পড়েন। ‘বেকার সাংবাদিকের দোকান’ নামে পান ও সিগারেটের দোকান দিয়ে অনেক খ্যাতনামা সাংবাদিক বেঁচে থাকার চেষ্টা করেন। স্ত্রী-সন্তানের ভরণ-পোষণের খরচ মেটাতে ব্যর্থ হয়ে কয়েকজন আত্মহত্যা করে মুক্তি পান। অধ্যাপক মুনতাসীর মামুনসহ অনেক কলামিস্ট স্বাধীন মত প্রকাশ থেকে বঞ্চিত হন।
শেখ মুজিবের মৃত্যুর পর সংবিধানের ৫ম সংশোধনীর মাধ্যমে একদলীয় বাকশালের পরিবর্তে দেশে বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হলে আওয়ামী লীগ, জাসদ, ওয়ার্কার্স পার্টি, সিপিবি, ন্যাপ, গণতন্ত্রী পার্টি, একতা পার্টি এবং জামায়াতে ইসলামীসহ ডানপন্থী, বামপন্থী ও মধ্যপন্থীসহ অন্যরাও প্রকাশ্য রাজনীতির সুযোগ পান। সাবেক রাষ্ট্রপতি এরশাদও জাতীয় পার্টির গঠন করেন সংবিধানের ৫ম সংশোধনীর বহুদলীয় গণতন্ত্র সম্পর্কিত অনুচ্ছেদের ক্ষমতাবলে। এছাড়াও বামপন্থী দু’একটি রাজনৈতিক দল বহুভাগে বিভক্ত হয়ে ১৪ দলীয় মহাজোটের শরিক হওয়ার সুযোগ লাভ করে সংবিধানের ৫ম সংশোধনীর ক্ষমতাবলে। একই ক্ষমতাবলে দ্বিতীয়বার জন্ম নেয়া আওয়ামী লীগের সভানেত্রী হিসেবে শেখ হাসিনা প্রথম মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ৫ বছর পূর্ণ করার পর দ্বিতীয় মেয়াদে ৫ বছরের জন্য প্রধানমন্ত্রী হয়ে এরশাদসহ মহাজোটের শরিকদের সঙ্গে নিয়ে এরই মধ্যে ক্ষমতার এক বছর এক মাস অতিবাহিত করেছেন। কাজেই বঙ্গবন্ধু হত্যার সুবিধাভোগী রাজনৈতিক দল ও ব্যক্তিদের ইতিহাস লেখতে গেলে আওয়ামী লীগের প্রকাশ্য রাজনীতির সুযোগ লাভ, শেখ হাসিনার দু’বার প্রধানমন্ত্রী হওয়া এবং ১৪ দলীয় মহাজোটের শরিকদের রাজনৈতিক দল করার অধিকার লাভ ও ক্ষমতারোহণ এবং বেকার হয়ে পড়া সাংবাদিকদের কর্মসংস্থান ও অধ্যাপক মুনতাসীর মামুনের স্বাধীন মত প্রকাশের বিষয়টিও অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবেই স্থান পাওয়া উচিত।
কেননা, ১৫ আগস্টের পটপরিবর্তনের পর সংবিধানের ৫ম সংশোধনীর মাধ্যমে দেশে বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত না হলে আওয়ামী লীগসহ নিষিদ্ধ হওয়া রাজনৈতিক দলগুলো প্রকাশ্য রাজনীতি করার সুযোগ পেত না এবং মতিয়া চৌধুরী, রাশেদ খান মেনন, হাসানুল হক ইনু ও দীলিপ বড়ুয়াসহ মহাজোট সরকারের অনেকেই হয়তো মন্ত্রী কিংবা এমপি হতেন না।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।