হিন্দু না ওরা মুসলিম ঐ জিজ্ঞাসে কোনজন, কান্ডারি বলো ডুবিছে মানুষ সন্তান মোর মা'র
আগ্রাসনের চেহারা
বর্তমান পৃথিবীতে প্রতি দুই সপ্তাহে একটা করে ভাষার মৃত্যু হয়। একটা ভাষার মৃত্যু মানে একটা জাতির মৃত্যু, আর একটা জাতির মৃত্যু মানে ঐ জাতি অর্জিত হাজার বছরের জ্ঞান, নৈতিক অবধারণার বিলুপ্তি। ৩৮৩ টা ভাষা এই মূহুর্তে দাঁড়িয়ে আছে বিলুপ্তির দাঁর প্রান্তে। এর মধ্যে চীন আর জাপানের ২৩ টা ভাষা বাদে বাকি সবগুলো ভাষাই আমেরিকা আর অষ্ট্রেলিয়া মহাদেশের, এই ভাষাগুলো উপনিবেশের প্রত্যক্ষ শিকার। এই হচ্ছে ভাষা আর ভাষা জাতি বিলুপ্তির বর্তমান সংখ্যাতাত্বিক চেহারা।
এই সংখ্যতাত্বিক চেহারার বাইরেও ভাষা, প্রতিক, পন্য ফেটিসে ভর করে রোজ রোজ গোপনে আর প্রকাশ্যে চলছে সাংস্কৃতিক আগ্রাসন, গ্লোবালাইজেশনের নামে। ব্রিটিশ রাজ নয়, বরং নয়া উপনিবেশী শাসনের সিংহাসন এখন মার্কিণ যুক্তরাষ্ট্র নামক দেশের হাতে। আর এই মার্কিণ যুক্তরাষ্ট্রের তাবেদারী করে শোষনের ভাগ নিচ্ছে ব্রিটেন, ফ্রান্সের মতো পুরোনো সাম্রাজ্যবাদী আর ভারতের মতো নয়া সাম্রাজ্যবাদী শক্তি। এরাই বর্তমানের তথাকথিত উন্নত বিশ্ব আর এদের উপনিবেশের নাম তৃতীয় বিশ্ব। আধুনিক এ বিশ্ব, শিল্প বিপ্লবের ফলশ্রুতিতে শিল্পপতিদের বিশ্ব।
পশ্চিমা কর্পোরেট শিল্পপতিদের যৌথ উদ্যোগ আর মার্কিন মোরলের মাতবোরিতে গত শতাব্দিতে তৈরি করা হয়েছে বর্তমান বিশ্ব অর্থনীতি, মুক্ত বাজার অর্থনীতির আদর্শ প্রচার করে। পশ্চিমা কায়দায় গণতন্ত্র আর স্বাধিনতার নামে এই অর্থনীতিকে বৈধ করে উপনিবেশের সস্তা কাঁচামাল, সস্তা শ্রম নিয়ে শেষমেশ সেই উপনিবেশেই প্রক্রিয়াজাত পণ্য বিক্রি করে টিকে থাকে পশ্চিমের শিল্প, বিলাস বেসন। এই উপনিবেশ টিকিয়ে রাখতে একসময় শিক্ষার মতো মৌলিক এবং প্রাথমিক মাধ্যমকে ব্যাবহার কর হয়েছে। উপনিবেশের সাংস্কৃতিক আগ্রাসন এখন আরো ব্যাপক, বিস্তৃত। বিজ্ঞাপন, নাটক, সিনেমা, উপন্যাস, কবিতা, শিল্প-সাহিত্যের নানা অঙ্গন অর্থাৎ পণ্যের প্রচার থেকে শুরু করে বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা সবখানেই এই সাংস্কৃতিক আগ্রাসন।
আধুনিক আগ্রাসনবাদী ডিসকোর্স টিকিয়ে রাখতে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখছে গণমাধ্যম। গণমাধ্যম আমাদের শেখাচ্ছে কি ভালো আর কি মন্দ, কি করা উচিত, কেমন করে কথা বলা উচিত, কি খাওয়া উচিত, কি পড়া উচিত, কি পরা উচিত, এমনকি আমাদের গায়ের রঙ কেমন হওয়া উচিত। উচিত গিলিয়েই তো কেনানো যায় পশ্চিমের নানাবিধ পণ্য। ম্যাকলের শিক্ষা ব্যবস্থা একসময় তৈরি করেছে ব্রিটিশ শাসনের সহায়ক কেরানী শ্রেনী আর এখনকার শিক্ষা ব্যবস্থা আর গণমাধ্যম তৈরি করে নয়া উপনিবেশের সহায়ক এক্সিকিউটিভ শ্রেনী, মোবাইল ফোনের সার্ভিস সেন্টার, কল সেন্টার আর আউটসোর্সের বাজারে। দাসত্ব সুলভ গর্বে গর্বিত হয় এই নয়া কেরানী শ্রেনী প্রভুদের নির্দেশিত পথে প্রভুর মতো হতে পেরে।
এই শিক্ষা ব্যবস্থা, এই গণ মাধ্যমের চেতনা শুধু তৈরি করেনা বিজ্ঞানী, উদ্ভাবক, উৎপাদক, তা করলে তো উপনিবেশের ক্ষতি। ধর্মের দোহাই দিয়ে, রাজপথে গুলি চালিয়ে যে কাজ করতে পারেনি পাকিস্তানি শাসক শ্রেনী, সেই কাজই এখন নিরবে নিশ্চিন্তে করে চলেছে নয়া উপনিবেশী শক্তি, গণমাধ্যমের মাধ্যমে। উর্দু যে কাজ করতে পারেনি সে কাজই করে দেখাচ্ছে আজ হিন্দী ভাষা, আর দেশের উচ্চ শ্রেনীতে ইংরেজি ভাষার দাস হওয়াতো সেই ব্রিটিশ আমল থেকে এখনো অব্যাহতই আছে। সাম্রাজ্যবাদের মোরল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আর নয়া সাম্রাজ্যবাদী শক্তি ভারতের মধ্যে বেশ গুরুত্বপূর্ণ কিছু মিল আছে। দুইটা দেশই নিজেদের প্রচার করে মহা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসাবে, দুইটা দেশেরই কোন ইতিহাস, ঐতিহ্য সর্বপোরি কোন ঐতিহাসিক জাতীয়তা নাই, দুইটা দেশই নিজেদের জাতীয়তাবাদী আদর্শ টিকিয়ে রেখেছে চলচিত্র আর গানের মতো জণপ্রিয় গণমাধ্যমের সাহায্য নিয়ে তৈরি করা ডিসকোর্স দিয়ে।
এছাড়া এই দুইটা দেশের উপায়ও নাই।
শিল্পপতিদের হাতে ক্ষমতা থাকায় বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে চরম আদর্শহীনতা। আদর্শহীনতায় ভর করে মুক্তবাজারের নাম পুঁজিবাদের ডানায় চেপে পৃথিবী শাসন করে শিল্পপতি-আমলা-রাজনীতিকের সিন্ডিকেট। মানুষের আদর্শ আর নৈতিকতা বজায় রাখার জন্য পুরোপুরি অক্ষম এখন পুরোন ধর্ম গুলো। আধুনিক আদর্শবাদগুলোর মধ্যে মার্ক্সবাদ এই ঘৃণিত পুঁজিবাদের বিপরীতে শ্রমিক শ্রেনীর নৈতিকতার ধারণা নিয়ে এলেও এই আদর্শবাদ এখন বিলুপ্ত প্রায়।
জাতীয়তাবাদি আদর্শকে ফেসিজমের ধোয়া তুলে অপাঙক্তেও করা হয়েছে। বাধাহীন, প্রতিবাদহীন পশ্চিমা লোভের স্বিকার হয়ে শুধু ভাষা আর জাতিই বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছেনা, বিলুপ্ত হচ্ছে সারা বিশ্বের প্রাণি বৈচিত্র, বন জঙ্গল, বিলুপ্ত হচ্ছে ওজন স্তর, কদিন পরে বিলুপ্ত হবে সমুদ্রের কনভেয়ার বেল্ট, তার কদিন পরে মানুষ নামের আর কোন প্রাণিই থাকবেনা। পশ্চিমা সভ্যতা মানুষকে দার করিয়ে দিয়েছে প্রকৃতির বিরুদ্ধে। মানুষ আর এখন আশরাফুল মাখলুকাত নামক প্রাণিকূল শ্রেষ্ঠ প্রাণি নাই, মানুষ এখন প্রকৃতিতে সবচেয়ে ঘৃণিত পশু।
বাঙালির ভাষা আন্দোলনঃ বি-উপনেবিশায়নের আধ্যাত্মিক উৎস
ভাষা, ঐতিহ্য, প্রকৃতি এইসবের সাথে মানুষের সম্পর্ক আধ্যাত্মিক সম্পর্ক।
আধ্যাত্মিক মানেই অতিপ্রাকৃত কোন কিছু এমন না। প্রাচীন মানুষের ধর্ম চিন্তায় একটা নদী যার উপর তার জীবন নির্ভরশীল প্রকৃতির সেই মহাশক্তি সেই নদী অথবা সূর্য অথবা বৃষ্টি, প্রাণি হিসাবে যা কিছুর সাথে তার সম্পর্ক সেই সব কিছুর প্রতি শ্রদ্ধা আর ভালবাসার সম্পর্ক নিয়েই গড়ে উঠেছিলো প্রাচীন ধর্মগুলো, পরিবেশের সাথে মানুষের এই সম্পর্ক আধ্যাত্মিক, পশ্চিমা শিল্পায়ন প্রভাবিত সমাজের বাইরের সমাজের মানুষেরা এখনো প্রকৃতির সাথে আধ্যাত্মিক সম্পর্কের ব্যাপারে সচেতন, প্রকৃতির বাস্তুসংস্থানের উপর শ্রদ্ধাশীল বলেই প্রকৃতি থেকে আদিবসীরা অতটুকুই নেয় যতটুকু প্রয়োজন, বাকিটা রেখে দেয় প্রকৃতি অন্য সন্তানদের জন্য। এদেরকে বর্বর বানিয়েই পশ্চিমের অমানবিক বর্বর সভ্যতা গড়ে উঠেছে মানবতাবাদ আর গণতন্ত্রের মুখোস এটে। সেই সাথে নিজের ঐতিহ্য, ইতিহাস, পূর্বপুরুষের বিরত্বগাথা, শোকগাথা এসব কিছুর সাথেই মানুষের সম্পর্ক আধ্যাত্মিক, এসবও ধর্মবিশ্বাসের অন্তর্গত। বহুত্ববাদ থেকে একত্ববাদে এসে মানুষ তার আধ্যাত্মিক সম্পর্ক স্থাপন করেছে গোটা বিশ্বজগতের একত্বের সাথে, তারপরও ঐতিহ্য, গাথা আর পূর্বপুরুষের সাথে আধ্যাত্মিক সম্পর্ক শেষ হয়ে যায় নাই।
আর একারনেই নবী, পীর দরবেশের নীতিকথা, শহিদ আর শাহাদাতের গাথার সাথে মানুষের সম্পর্ক আধ্যাত্মিক। অথচ পশ্চিমা উপনিবেশ আমাদের ওপর চালিয়েছে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর আর নিষ্ঠুর কসাইকর্ম। আধুনিক পশ্চিমা সভ্যতা ব্যাক্তি মানুষকে তার প্রকৃতি, সমাজ আর ইতিহাসের আধ্যাত্মিকতা থেকে বিচ্ছিন্ন করেছে, অসহায় মানুষের চিন্তা আর ইচ্ছাশক্তিকে আবদ্ধ করেছে পণ্য ফেটিস আর ভোগবাদী জীবন বিধানে। আর এই ঘটনাটা সবচেয়ে নিদারুন ভাবে ঘটেছে পশ্চিমের উপনিবেশ গুলোয়।
তারপরও আমাদের আশা আছে, ভালোমতোই আছে।
কারন আমাদের ভাষা আন্দোলন আছে। ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস আছে, ভাষা শহীদ আছে। আমাদের অজান্তেই, বি-উপনিবেশায়নের প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গেছে। বাঙালির ভাষা আন্দোলন সেই বি-উপনিবেশায়নের প্রথম ভাগ। উপনিবেশী নিল নকশায়, উপনিবেশের প্রভু আর তাদের কড়ি বর্গাদের ইচ্ছা অনুযায়ী, শোষনের স্বার্থ রক্ষার্থে জন্ম ইন্ডিয়া নামক রাষ্ট্রের, জন্ম পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রের।
আর এই দুই উপনিবেশী নীল নকশায় তৈরি মানচিত্রে বন্দী হয়েছে বহু শোষিত জাতিসত্বার আত্মপরিচয়, মুক্তির আকাঙ্খা। ঐ বন্দীত্ব আমরা মানি নাই, বি-উপনিবেশায়নের প্রথম শর্ত, আত্ম পরিচয় উদঘাটনের পর্বটা আমরা শেষ করেছি ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে। এই ভারতীয় উপমহাদেশের অন্য জাতিসত্বাগুলো যখন আপন পরিচয় হাঁরিয়ে, ঐতিহ্য আর প্রকৃতির সাথে আধ্যাত্মিক সম্পর্ক বিচ্ছেদের ফলে মিথ্যা আত্মপরিচয় আর ভোগবাদী দাসত্বের অন্ধকারে নিমজ্জিত হচ্ছে ক্রমাগত, সেইখানে সেই ১৯৪৭ সাল থেকেই আমরা ঘুরে দাঁড়িয়েছি। সেই ঘুরে দাঁড়ানোর ফসল ১৯৫২ এর ভাষা আন্দোলন আর ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধ। ভাষা আর আপন ঐতিহ্যের সাথে আধ্যাত্মিক সম্পর্ক পূনস্থাপনের প্রক্রিয়াটা আমাদের মতো আর কোন জাতি এখনো শুরু করতে পারে নাই।
“শহীদ” শব্দটা বুৎপত্তিগতভাবে আরবী শব্দ, প্রচলিত ইসলামী অর্থে ধর্মযুদ্ধে জীবনদানকারী ব্যাক্তি, শহীদরা অমর, আমাদের সাথে আধ্যাত্মিক সম্পর্কের খাতিরে এরা মৃত্যুহীন, আমাদের সামগ্রিক চেতনায়, নৈতিক ধারণায় এদের অস্তিত্ব অবিনাশী। বি-উপনিবেশায়নের প্রক্রিয়া হিসাবে ভাষার জন্য জীবনদানকারী বীরদের আমরা “শহীদ” উপাধিতে আখ্যায়িত করেছি, এই বীর শহীদদের সাথে আমাদের সম্পর্ক তাই আধ্যাত্মিক সম্পর্ক। নিজ ভাষা বা নিজ ঐতিহ্যের জন্য জীবন দেয়ার ঘটনা আধুনিক যুগে বিরল, এই ধরণের ঘটনা ঘটতো উপনিবেশ পূর্ব পৃথিবীতে। উপনিবেশ পরবর্তি পৃথিবীতে বি-উপনিবেশায়নের লড়াইয়ে প্রথম শহীদ হওয়ার গর্ব তাই বাঙালির সন্তানের, আদিম গোত্রের দামাল সন্তান অথবা মধ্যযুগের নির্ভীক বীরের মতো নিজের ক্ষুদ্র ব্যাক্তি সত্বাকে বিলিয়ে দিয়ে ভাষা শহীদরা তাই অমর, আর তাদের সাথে আধ্যাত্মিক সম্পর্ক অটুট থাকলে উপনিবেশ বিরোধী লড়াইয়ে আমরাও নিঃসন্দেহে অজেয়। নিশ্চিহ্ন হতে পারি, পরাজিত কোনদিনও হবনা।
তবে ভাষা আন্দোলন একটা শুরু, শেষ না। এই আন্দোলনের পরের ধারাবাহিকতাও সহজ স্বাভাবিক হয় নাই, অর্থাৎ আমাদের স্বার্থের অনুকুলে হয় নাই। ভাষা আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় আমরা মুক্তিযুদ্ধ পেয়েছি, কিন্তু তার সব ফলাফলও আমাদের স্বার্থের অনুকুলে যায় নাই। এর পেছনেও দায়ী ঐ উপনিবেশের কড়ি-বর্গারা । এমনকি আদর্শবাদী রাজনীতিবিদদের ক্ষেত্রেও ভীনদেশি আনুগত্যের ব্যাপক উপস্থিতি ইতিহাস প্রমানিত।
ডানপন্থি রাজনীতিবিদরা যেমন পাকিস্তান থেকে আনুগত্য সরিয়ে ভারত-আমেরিকা-সোভিয়েত ইউনিয়ন নানামূখি আনুগত্যের স্বার্থের খেলায় শেষমেশ মার্কিন প্রভুত্বের কাছে মাথা নুইয়েছে, তেমনি প্রগতিশীল বামপন্থী রাজনীতির কর্মীরা মস্কো পন্থা, পিকিং পন্থা নামক নানাবিধ পন্থায় বহুধাবিভক্ত হয়ে জন বিচ্ছিন্ন হয়েছে। অথচ ভাষা আন্দোলনের সৈনিক যে ছাত্র, যে শ্রমিক সে এমন কোন ভীনদেশি আনুগত্যের অধীনে লড়াইয়ে নামে নাই। আমাদের ভরষা তাই ঐ ভাষা আন্দোলন।
সময়োপযগি নেতৃত্ব আর ভীনদেশি আনুগত্যের কারণে ভাষা আন্দোলনের ধারাবাহিক প্রক্রিয়া ব্যাহত হয়েছে। ইংলিশ মিডিয়ামে পড়ালেখা এখনো বিদেশী প্রভুদের ছায়াদাস তৈরির কারখানা হিসাবে কাজ করে যাচ্ছে।
নয়া সাম্রাজ্যবাদী শক্তি ভারতের স্যাটেলাইট সংস্কৃতির মাধ্যমে হিন্দী ভাষার আগ্রাসন যে ভয়াবহ ক্ষতি করে চলেছে, উর্দু ভাষা কখনোই তা করতে পারত না। এই সবে ভর করেই এসেছে ভ্যালেন্টাইন ডে এর মতো দিবস। ১৪ ফেব্রুয়ারী যেখানে আমার কাছে হওয়ার কথা স্বৈরাচার বিরোধী দিবস, যে দিবসের সাথে, যে ঐতিহাসিক গণ আন্দোলনের সাথে আমাদের আধ্যাত্মিক সম্পর্ক, যে নুর হোসেনের রক্তের সাথে আমার সম্পর্ক আমাকে মানুষ নামক আশরাফুল মাখলুকাতে পরিনত করে, পশ্চিমা সাংস্কৃতিক আগ্রাসন সেই পবিত্র ১৪ ফেব্রুয়ারীর সাথে আমার সম্পর্ক ছিন্ন করে আমাকে আবদ্ধ করে ভোগবাদী ভালোবাসা দিবসের ক্ষুদ্রতায়, ভালোবাসাকে পণ্য করে সেই পণ্য ফেটিসের গা জোয়ারি জীবন বিধানে আমি আমাকেই ভুলে যাই। ব্যাবসায়িক স্বার্থে এভাবেই এখনো ঠিক এভাবেই আমাকে কেটেকুটে বিচ্ছিন্ন, অসুস্থ্য করা হচ্ছে প্রতিদিন। উপনিবেশি দাস মানসিকতার আরেক উদাহরণ হতে পারে বিশ্ব মাতৃভাষা দিবস নিয়ে অতি উৎসাহ।
এমন একধরণের ডিসকোর্স তৈরি করা হচ্ছে যে বিশ্ব মাতৃভাষা দিবস হওয়াই হচ্ছে ভাষা আন্দোলনের সবচেয়ে বড় স্বিকৃতী। এধরণের ধারণা তৈরি করে রাজনৈতিক ফায়দা লুঠছে বিশেষ একধরণের পশ্চিমা সেবাদাস, আর আমরা সাধারণ জনগণও পশ্চিমা প্রভুদের এই স্বিকৃতীতে আহ্লাদিত হই, গর্বিত হই। সালাম-রফিক-বরকত’দের উত্তরপুরুষ হিসাবে আমাদের লজ্জা হওয়া উচিত। ভাষা আন্দোলনের আন্তর্জাতিক স্বিকৃতী আমাদের গড়িমা বারায় নাই, বারালে পুরা দুনিয়ার গড়িমা বারিয়েছে। এই স্বিকৃতী দিয়ে পশ্চিমের আমাদের কিছু দেয়ার নাই, বরং নেয়ার আছে।
বুদ্ধিজীবি, ছাত্র আর শ্রমিক, উপনিবেশী আগ্রাসনের প্রাথমিক শিকার এই তিনটা শ্রেনী। এই তিনটা শ্রেনীই যেমন পরিনত হতে পারে উপনিবেশের সেবাদাসে, অন্ধ চামচায়, ঠিক তেমনি এই তিনটা শ্রেনীই ঘুরে দাঁড়াতে পারে উপনিবেশের বিরুদ্ধে সবচেয়ে প্রবল ভাবে। ভাষা আন্দোলনে এই তিনটা শ্রেনীর ভূমিকাই মূখ্য। আমাদের বর্তমানের অবক্ষয়ের কালেও এই তিনটা শ্রেনীর অবক্ষয়ই মূখ্য। এই অবক্ষয় আদর্শবাদের অভাবে সৃষ্ট, এই অবক্ষয় ইতিহাস-ঐতিহ্যের সাথে আধ্যাত্মিক সম্পর্কহীনতার কারণে সৃষ্ট।
ভাষা আন্দোলন আর মুক্তিযুদ্ধের যে উপনিবেশ বিরোধী চরিত্র সেই চরিত্রকে বুঝে, এই ধারাবাহিক লড়াইয়ের সৈনিক হিসাবে শপথ নিয়েই লড়াই চালাতে হবে আমাদের।
প্রতিবাদের ভাষা
সাংস্কৃতিক আগ্রাসন, সে যত প্রবলই হোক, তার বিরুদ্ধে লড়াই করা যায়। লড়াই করার উপকরণও আমাদের কম নাই। আগ্রাসনের বিরুদ্ধে লড়াই করার সবচেয়ে বড় হাতিয়ারটাও ভাষা। রাজনৈতিক মুক্তি, পুঁজিবাদী আদর্শহীনতা আর সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য সবার আগে প্রয়োজন তাই চিন্তার মুক্তির, প্রয়োজন বি-উপনিবেশায়নের।
উপনিবেশ পূর্ববর্তী সাংস্কৃতিক পরিচয়, ঐতিহ্যের আবিষ্কার ছাড়া বি-উপনিবেশ সম্ভব না। আর একারণেই প্রয়োজন বাঙাল বয়ান। এই বাঙাল বয়ানের আবিষ্কার সম্ভব। ইতিহাস, সাহিত্য, গণমাধ্যম, বিজ্ঞাপন প্রতিটা ক্ষেত্রেই নামতে হবে তাই ভাষার লড়াইয়ে, তৈরি করতে হবে প্রতিবাদী ডিসকোর্স, প্রতিষ্ঠা করতে হবে ক্ষমতার নয়া স্তর বিন্যাস, যে স্তর বিন্যাসে বিদেশী প্রভূ আর তাদের এদেশিয় কড়ি বর্গাদের কোন অবস্থান থাকবেনা, নতুন এই স্তর বিন্যাসে থাকবে জনতা আর জনতার প্রকৃত প্রতিনিধীরা, এই স্তর বিন্যাসের ইট হবে জনতার শ্রম, সিমেন্ট হবে জনতার ইচ্ছা। উপনিবেশী দৃষ্টিভঙ্গীতে না, আমাদের ইতিহাস আমাদের লিখতে হবে বাঙাল বয়ানে, যে বয়ানে ছেলে ঘুমালে, পাড়া জুরালে বর্গী আসে, ধান খেয়ে যায় বুলবুলিতে আর আমরা থাকি খাজনা দেয়ার দুশ্চিন্তায়।
বাঙাল বয়ানের আবিষ্কার হলে ছেলে আর ঘুমাবেনা, ছেলে জাগবে, পাড়ায় পাড়ায় শনিরআখড়া, কানসাট আর ফুলবাড়ি হবে। বুলবুলির চুরি বন্ধ হবে, বর্গী পালাবে।
(সমাপ্ত)
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।