সঙ্গে সাহিত্যের সুবাস ...
সামাজিক সৃজনশীলতার স্বরূপ ও শিশুতোষ চলচ্চিত্র
আমাদের শিশুরা টেলিভিশনে প্রচারিত শিশুবিষয়ক অনুষ্ঠান দেখলে উঠে যান, কিন্তু বিজ্ঞাপন শুরু হলে ফিরে আসেন। এমনকি মায়েরাও শিখে গেছেন খাদ্যের প্রতি নিদারুণ অরুচিপ্রবণ শিশুদের খাবার গেলাতে হয় বিজ্ঞাপন গেলানো সহযোগে। এর অর্থ এই যে আমরা শিশুদের জন্য যে-অনুষ্ঠান বানাই তা শিশুদের আকৃষ্ট করতে ব্যর্থ। অথচ ছোট ছোট শটে বিভক্ত বিজ্ঞাপনের আধা মিনিটের কাহিনীচিত্র তাদের আটকে রাখে। কার্টুনছবিও শিশুদের কাছে আকর্ষণীয় হয় কারণ এর সম্পাদনার গতি তড়িৎ, শটসমূহ হ্রস্বতম, ক্ষণে ক্ষণে এর দৃশ্যপট পাল্টে যায়।
উভয় মাধ্যমের আরেকটি মিলের জায়গা হলো ফ্যান্টাসি, মিথ্যামিথ্যি গল্প, লাগামহীন কল্পনার বিস্তার। আমরা জানি যে পণ্যের প্রতি আকর্ষণ তৈরি করতে বিজ্ঞাপন পণ্যটিকে ঘিরে অনেক ভ্রান্তি-মিথ্যার মিশেলে একটা ফ্যান্টাসি তৈরি করে। বিজ্ঞাপন ও কার্টুনের এই সাধারণ বৈশিষ্ট্যের বরাতে বলা যায়, শিশুরা গতিশীল-বর্ণিল ভিস্যুয়াল, ফ্যান্টাসি-রূপকথা, হতচ্ছাড়া কল্পলোককে আপন মনে করে। নিরেট বাস্তবতা, বা বাস্তবতার অবিকল উপস্থাপন তাদের কাছে পানসে, অনাকর্ষণীয় ঠেকে। ওয়াল্ট ডিজনি এটা জানতেন, তাই বিশ্বব্যাপী শিশুমানসে এখন ডিজনির উপনিবেশ।
বলা যায় বিটিভি ও কিছু বেসরকারী চ্যানেলে প্রচারিত শিশুদের জন্য নির্মিত অনুষ্ঠান শিশুদের আকর্ষণ করতে ব্যর্থ। টেলিভিশন-দেখতে-বাধ্য শহুরে শিশুরা বরং কার্টুন বাদে বড়োদের অনুষ্ঠান দেখতেই বেশি পছন্দ করে Ñ বিশেষত বিজ্ঞাপন এবং এমনকি বলিউডের নাচ-গান। বলিউডের গানেও রয়েছে গতিশীল-বর্ণির ভিস্যুয়াল, ফ্যান্টাসি।
তুলনাটা টেলিভিশনের অনুষ্ঠানের সঙ্গেই করছি, কারণ বাংলাদেশে শিশুতোষ চলচ্চিত্রের সংখ্যা এতই নগণ্য যে তা নিয়মিত কোনো ভিস্যুয়াল উপাদান হিসেবে আমাদের সামনে হাজির নেই।
কিন্তু আমাদের শিশুরা কীরকম সৃজনশীল ভিস্যুয়াল উপাদান আস্বাদন করছে? আমরা কী সামাজিক সৃজনশীলতার জগত তাদের উপহার দিচ্ছি? সেখানে শিশুতোষ চলচ্চিত্রের অবস্থান কোথায়? সমাজ ও রাষ্ট্রের দায়িত্ব কী সেক্ষত্রে? এই উত্তরগুলো অনুসন্ধান-বিশ্লেষণের পূর্বে বাংলাদেশের শিশুতোষ চলচ্চিত্র নির্মাণের একটি প্রেক্ষাপট হাজির করা দরকার।
শিশুতোষ চলচ্চিত্র নির্মাণ: ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট
শিশুতোষ চলচ্চিত্র, চলচ্চিত্রের ইতিহাসে অন্যতম জঁরা হিসেবেই বিবেচিত। চার্লি চ্যাপলিনের দি কিড (১৯২০), ডি-সিকার বাইসাইকেল থিফ (১৯৪৮), ফ্রাঁসোয়া ত্র“ফোর ফোর হান্ড্রেড ব্লোজ (১৯৫৯), সত্যজিৎ রায়ের পথের পাঁচালী (১৯৫৫) কিংবা সোনার কেল্লা (১৯৭৪), আব্বাস কিয়োরোস্তামির হোয়ার ইজ মাই ফ্রেন্ডস হোম (১৯৮৭), মজিদ মজিদির চিল্ড্রেন অব হ্যাভেন (১৯৯৭) -- এরকম অনেক মাস্টারপিস ছবির প্রধান কিংবা অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র শিশু-কিশোররা।
কিন্তু বাংলাদেশে নির্মিত শিশুতোষ চলচ্চিত্রের সংখ্যা একেবারে নগণ্য, সংখ্যাটা হাতে গোনা যায়। বাংলাদেশে প্রথম শিশুতোষ চলচ্চিত্র নির্মিত হয় ১৯৬৬ সালে, ছবিটির নাম ছিল দি সান অব পাকিস্তান, পরিচালক ছিলেন ফজলুল হক। পাকিস্তান আমলে আর কোনো শিশুতোষ চলচ্চিত্রের নাম শোনা যায়না।
মুক্তিযুদ্ধকালে মুজিবনগর সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় নির্মিত বাবুল চৌধুরীর প্রামাণ্যচিত্র ইনোসেন্ট মিলিয়নস-এ (১৯৭১) যুদ্ধের শিকার নারী ও শিশুদের ওপরে আলোকপাত করা হয়েছিল। এরপরে স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম সর্বাঙ্গীন শিশুতোষ চলচ্চিত্র হিসেবে পাওয়া যায় এমিলের গোয়েন্দা বাহিনী (১৯৮০)। বাদল রহমান পরিচালিত এই চলচ্চিত্রটি সরকারী অনুদানে নির্মিত হয়েছিল। অনুদানপ্রাপ্ত আরেকটি শিশুতোষ চলচ্চিত্র হলো দীপু নাম্বার টু (১৯৯৬)। মোরশেদুল ইসলামের দূরত্ব (২০০৪) ছবিটি নির্মিত হয়েছে বেসরকারী পর্যায়ে, ইমপ্রেস টেলিফিল্মের প্রযোজনায়।
বেসরকারী পর্যায়ে বা এফডিসি থেকে আর কোনো সর্বাঙ্গীন শিশুতোষ ছবি নির্মাণের খবর পাওয়া যায়না।
তবে পূর্ণাঙ্গ শিশুতোষ না হলেও একসময় বাংলাদেশের মূলধারার চলচ্চিত্রে শিশুচরিত্রের বেশ প্রাধান্য ছিলো। এরকম কিছু চলচ্চিত্র নির্মিত হতো যেখানে শিশুচরিত্রই ছবিত্রে প্রধান চরিত্র থাকতো এবং তাকে ঘিরেই ছবির কাহিনী আবর্তিত হতো। সুভাষ দত্তের ডুমুরের ফুল (১৯৭৮), আজিজুর রহমানের অশিক্ষিত (১৯৭৮) কিংবা ছুটির ঘণ্টা (১৯৮০), শেখ নজরুল ইসলামের এতিম (১৯৮০) কিংবা মাসুম (১৯৮১), শহীদুল আমিনের রামের সুমতি (১৯৮৫) ইত্যাদি ছবির প্রধান চরিত্র বা অন্যতম প্রধান চরিত্র ছিল শিশু-কিশোর। আশির দশকে মাস্টার সুমন কিংবা মাস্টার শাকিল তারকাখ্যাতি পেয়েছিলেন, কারণ তারকা হয়ে ওঠার মতো যথেষ্ট পরিসরজুড়ে শিশু-কিশোর চরিত্রের উপস্থিতি থাকতো।
সেসময়ের অনেক ছবিতেই ‘মাস্টার’ উপাধির কোনো না কোনো শিশু-অভিনেতার উপস্থিতি থাকতো। নব্বই দশক থেকে পারাবারিক-সামাজিক জঁরার ছবি কমে যাওয়ায়, এবং সহিংস-অপরিশীলিত রুচির ছবির সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায়, সা¤প্রতিক ছবিগুলোতে শিশুচরিত্র থাকে না বললেই চলে, থাকলেও তার উপস্থিতি স্বল্প সময়ের জন্য এবং সেও সহিংসতার কারণ বা অনুষঙ্গ হিসেবেই ছবিতে হাজির হয়। স্বাধীনধারার চলচ্চিত্র মাটির ময়নায় (২০০২) অবশ্য মূল চরিত্রসহ গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি চরিত্রে শিশুদের উপস্থিতি রয়েছে।
তবে মূল সিনে-সংস্কৃতির বাইরে, অনেকটা অগোচরে, বাংলাদেশ শিশু একাডেমী ১৯৮০ সাল থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত ৫০টি ছবি প্রযোজনা করেছে। এরমধ্যে ২০০৮ সালে ৪টি ও ২০০৯ সালে ৪টি করে মোট ৮টি ছবি নির্মাণ করেছে শিশু-কিশোররাই।
শিশু একাডেমী আয়োজিত ওয়ার্কশপের প্রডাকশন হিসেবে শিশু-কিশোররা এই ছবিগুলো নির্মাণ করেছে। কিছু ব্যতিক্রম বাদে শিশু একাডেমীর প্রাথমিকভাবে পছন্দের ফরম্যাট ছিল ১৬ মিমি এবং স¤প্রতি বেটাক্যাম ভিডিও এবং ডিজিটাল ভিডিওকে অনুমোদন দেয়া হচ্ছে। নানা দৈর্ঘ্যে এসব ছবি নির্মিত হয়েছে, কিন্তু বেশিরভাগেরই দৈর্ঘ্য ৩০ থেকে ৬০ মিনিটের মধ্যে। কিন্তু প্রডাকশন হিসেবে এইসব চলচ্চিত্র সিনে-সংস্কৃতি এবং শিশুমানসে খুব বেশি প্রভাব রাখতে পারেনি। এসব চলচ্চিত্রের পরিবেশন ও প্রদর্শনও জনমুখী হয়নি, বড়জোর শিশু একাডেমীর জেলা শাখার মধ্যেই ঘুরপাক খায় চলচ্চিত্রগুলো।
এমনকি রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন বিটিভিতেও সবগুলো ছবি প্রচার হয়নি, বেসরকারী চ্যানেলের কাছে এসব ছবি একেবারে অনাকর্ষণীয়, কারণ এগুলো বিজ্ঞাপন আনতে সক্ষম নয়। খান আতাউর রহমানের ডানপিটে ছেলে (১৯৮০) এবং সি বি জামানের পুরস্কার (১৯৮৫) শিশুদের আকৃষ্ট করতে পেরেছিল। আর কোনো ছবিই শিশুদর্শকদের আকৃষ্ট করতে পারেনি। সংবাদপত্র বা সমালোচকদের দৃষ্টি আকর্ষণও এসব ছবি করতে পারেনি। বাদল রহমানের ছানা ও মুক্তিযুদ্ধ (১৯৯৯) ছবিটি খানিক আলোচিত হয়েছিল ছবিটি নিয়ে মামলা-মোকদ্দমা হবার কারণে।
শিশু একাডেমীর ছবিগুলো শিশুদের আকৃষ্ট করতে ব্যর্থ হবার কারণ কয়েকটি। একটি হলো ছবির গল্প ও নির্মাণশৈলীর দুর্বলতা। শিশু একাডেমী থেকে জানা যায়, একবছরে মোট ১৮/১৯ লাখ টাকা বরাদ্দ থাকে শিশুতোষ চলচ্চিত্র নির্মাণের জন্য এবং তা বণ্টন করা হয় ৪/৫ জন পরিচালকের মধ্যে। এভাবে একজন পরিচালক পান সাড়ে ৩ লাখের মতো। এই অল্প টাকায় একটা ভালো মানের ছবি নির্মাণ একেবারেই সম্ভব নয়।
আরেকটি কারণ হিসেবে উল্লেখ করা যায়, ছবিগুলোর বিষয়বস্তু। শিশু একাডেমী প্রযোজিত বেশিরভাগ চলচ্চিত্রের বিষয়বস্তু মুক্তিযুদ্ধ। একথা ঠিক যে শিশুদের দেশীয় সংস্কৃতি, ইতিহাস ও ঐতিহ্য বিষয়ে সচেতন করে তোলা দরকার বিভিন্ন সৃজনশীল প্রকাশের মধ্য দিয়ে, তবে মনে রাখতে হবে শিশুদের নিজস্ব পছন্দের কিছু জঁরা আছে। যেমন তারা অ্যাডভেঞ্চার ও রূপকথা বা ফ্যান্টাসি পছন্দ করে। আর পছন্দ করে অ্যানিমেশন।
কিন্তু শিশু একাডেমীর চলচ্চিত্রগুলো সেসব বিষয় স্পর্শ করেনি বললেই চলে। বাংলাদেশে নির্মিত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দু’টি শিশুতোষ চলচ্চিত্র হলো এমিলের গোয়েন্দা বাহিনী ও দীপু নাম্বার টু -- দুটিই ডিটেকটিভ/অ্যাডভেঞ্চার জঁরার ছবি।
চিল্ড্রেনস ফিল্ম সোসাইটির উদ্যোগে আন্তর্জাতিক শিশু চলচ্চিত্র উৎসব আয়োজন নিশ্চয়ই বাংলাদেশে সিনে-সংস্কৃতিতে একটি উল্লেখযোগ্য সংযোজন। সারা বিশ্বের বিভিন্ন স্বাদের শিশু-কিশোরউপযোগী চলচ্চিত্র দেখার সুযোগ করে দেবার পাশাপাশি এবারের ৩য় উৎসবে প্রতিযোগিতার জন্য শিশুদের নির্মিত চলচ্চিত্র আহ্বান করা হয়েছিল। ৬০টি চলচ্চিত্রের মধ্যে ৩৪ ছবি মনোনীত হয়েছে পুরস্কারের জন্য।
এর মধ্য থেকে ৫টি ছবিকে পুরস্কৃত করা হবে। এদের মধ্য থেকে আমরা পাবো ভবিষ্যতের নির্মাতা, এটা আশা করা আতিশয্য হবেনা।
শিশুতোষ চলচ্চিত্র ও রাষ্ট্রের দায়িত্ব
শিশুতোষ চলচ্চিত্র যেহেতু ব্যবসায়িক নিশ্চয়তা দেয়না তাই বাণিজ্যিক স্টুডিও থেকে শিশুতোষ চলচ্চিত্র নির্মাণের সংখ্যা কম থাকে। এই শূন্যস্থান পূরণে সরকারকেই এগিয়ে আসতে হয়। ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহারলাল নেহেরুর আগ্রহ এবং উদ্যোগে ১৯৫৫ সালে চিলড্রেন্স ফিল্ম সোসাইটি গঠন করা হয়।
সরকারের সহযোগিতায় এখান থেকে প্রতিবছর ভারতের বিভিন্ন আঞ্চলিক ভাষায় ২০-২৫টি শিশুতোষ চলচ্চিত্র তৈরী হয়। স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশ নরওয়ে, সুইডেন ও ডেনমার্কে শিশুতোষ চলচ্চিত্র নির্মাণের জন্য সরকার নানা ধরনের কর্মসূচি হাতে নেয়। এজন্য এসব দেশ শিশুতোষ চলচ্চিত্রের মান ও সংখ্যা উভয় দিক থেকেই সমৃদ্ধ। নরওয়েতে ২০০০-২০০৬ সময়কালে ১৭টি শিশুতোষ চলচ্চিত্র নির্মিত হয়। নরওয়েজিয়ান ফিল্ম ইনস্টিটিউট শিশুতোষ চলচ্চিত্র নির্মাণের জন্য সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেয়।
সরকারী নানা সমর্থনের কারণে নরওয়েতে আজ ৭০টি চিল্ড্রেনস ফিল্ম সোসাইটি রয়েছে যার সদস্যসংখ্যা ৯ হাজার। আমরা যদি (সাবেক) সোভিয়েত ইউনিয়ন, চেকোস্লাভিয়া, হাঙ্গেরী, বুলগেরিয়া, পোল্যান্ডের দিকে তাকাই, তখন দেখি অগুনতি সব শিল্পবোধসম্পন্ন নান্দনিক শিশুতোষ চলচ্চিত্রের এক বিশাল ভাণ্ডার। এক পর্যায়ে কেবলমাত্র বুলগেরিয়াতেই প্রায় হাজার খানেক ১৬ মিমি প্রেক্ষাগৃহ নির্মিত হয়েছিল শিশুতোষ চলচ্চিত্র প্রদর্শনীর জন্য। এরকম পৃথিবীর নানা সমৃদ্ধ-সিনে-সংস্কৃতির দেশে শিশুতোষ চলচ্চিত্র নির্মাণে সরকারী পৃষ্ঠপোষকতার নিদর্শন পাওয়া যায়।
বাংলাদেশেও শিশুতোষ চলচ্চিত্র নির্মাণে সরকারের কিছু উদ্যোগ লক্ষ করা যায়।
শিশু একাডেমীর মাধ্যমে এপর্যন্ত ৫০টি শিশুতোষ ছবি নির্মাণের কথা আগেই বলেছি। আর রয়েছে অনুদান প্রথা। জানা যায় ১৯৭৮ সালে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ভালো চলচ্চিত্র নির্মাণকে উৎসাহিত করতে সরকারী অনুদান প্রদানের ঘোষণা দেন। এর আওতায় প্রতিবছর ৩টি ছবি নির্মাণে সরকারী অনুদান প্রদানের সিদ্ধান্ত হয়, যার মধ্যে একটি অবশ্যই শিশুতোষ চলচ্চিত্র হবে বলে শর্ত আরোপ করা হয়। এরই আওতায় এমিলের গোয়েন্দা বাহিনী চলচ্চিত্রটি নির্মিত হয়।
তবে এই অনুদানপ্রথা নিয়মিত থাকেনি। বেশ কয়েকবছর পরে অনুদানের মাধ্যমেই দীপু নাম্বার টু নির্মিত হয়। দেখা যাচ্ছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দুটি শিশুতোষ চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে সরকারী অনুদানে। ৩য় আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব-এ বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘোষণা দেন যে এখন থেকে প্রতিবছর ৫টি চলচ্চিত্রকে অনুদান দেয়া হবে এবং এর মধ্যে অবশ্যই একটি শিশুতোষ চলচ্চিত্র অন্তর্ভুক্ত থাকবে। প্রধানমন্ত্রীর এই ঘোষিত শর্ত শিশুতোষ চলচ্চিত্র নির্মাণে উল্লেখযোগ্য নিয়ামক হবার সম্ভবনা রয়েছে।
প্রতিবছর যদি অনুদানের মাধ্যমে একটি করে শিশুতোষ ছবি নির্মিত হয়, তবে আমরা আরও অনেক এমিল বা দীপুর কাহিনী পেতে থাকবো। এখন দেখতে হবে অনুদানপ্রথা নিয়মিত থাকছে কিনা এবং যোগ্য লোককে অনুদান দেয়া হচ্ছে কিনা।
শিশু একাডেমীর চলচ্চিত্র প্রযোজনার প্রকল্পটি নতুনভাবে ভাবা দরকার। কারণ এতগুলো চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে কিন্তু তার প্রভাব তেমন অনুভূত হয়না। অর্থবরাদ্দ বাড়ানো দরকার, দরকার এর সুষ্ঠু পরিবেশন ও প্রদর্শন।
বিটিভিতে ক্রমান্বয়ে সবগুলো ছবি প্রচারের ব্যবস্থা নেয়া দরকার। অন্য বেসরকারী চ্যানেলগুলোতে ছবিগুলো স¤প্রচার করার উদ্যোগও নেয়া দরকার। ১৯৮০ থেকে ১৯৮৪ সালে নির্মিত কিছু চলচ্চিত্রের প্রিন্ট নষ্ট হয়ে গেছে। যেগুলো ভালো আছে সেগুলোকে ডিভিডি ফরম্যাটে ট্রান্সফার করে ফেলা দরকার। শিশুদের নির্মিত চলচ্চিত্র প্রযোজনার উদ্যোগটি ভালো।
তবে প্রতিবছর অন্তঃত ১টি ছবির অর্থ অ্যানিমেশনের জন্য বরাদ্দ করা দরকার। অ্যানিমেশন ছবি শিশুরা খুব পছন্দ করে, কেবল ডিজনি বা পিক্সারের অ্যানিমেশন নয়, বাংলা অ্যানিমেশনই বাংলাদেশে জনপ্রিয় হতে পারে। মীনা সিরিজ বা টোনাটুনির প্রডাকশন এক্ষেত্রে উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা যায়। বাংলাদেশে এখন কম্পিউটারনির্ভর থ্রি-ডি অ্যানিমেশন দুর্লভ নয়।
শিশুর সৃজনশীলতা, সমাজ ও চলচ্চিত্র
আমরা শিশুদের জন্য যে ভিস্যুয়াল জগত উপহার দিচ্ছি তা খুব বেশি নিরাপদ নয়।
গ্রামীণ শিশুরা অবশ্য এইসব ভিস্যুয়াল জগত থেকে বেশ দূরে রয়েছে। কিন্তু শহুরে বা আধা শহুরে পরিমণ্ডলে শিশুদের জন্য রয়েছে টেলিভিশন যাতে তারা উপভোগ করছে কার্টুন নেটওয়ার্ক আর বিজ্ঞাপন। কার্টুন ধারবাহিকগুলো সহিংসতায় পরিপূর্ণ। আমেরিকান সাইকোলজিকাল এসোসিয়েশনের এক জরিপে দেখা গেছে আমেরিকান শিশু ও টিন এজাররা বছরে ১০,০০০ খুন, ধর্ষণ ও শারীরিক আক্রমণের ঘটনা দেখে টেলিভিশন থেকে। আমাদের এদিকে যে কার্টুন সিরিয়াল প্রচার হয় তা তো আমেরিকারই প্রডাকশন।
আর শিশুরা বিজ্ঞাপনে তো এমনি এমনি আকৃষ্ট হয়না, খোদ শিশুই বিপণনকারীদের অন্যতম টার্গেট-অডিয়েন্স। স্ট্রাসবার্গার এবং উইলসন মনে করেন তিন কারণে বিপণনকারীরা শিশুদের টার্গেট করে: এক. শিশুরা একইসঙ্গে ক্রেতাও (টিফিনের পয়সা ও আত্মীয়ের দেয়া পকেটখরচ একেবারে কম হয়না), দুই. শিশুরা পিতা-মাতার ভোক্তা আচরণে প্রভাবিত করে (জেদ-কান্নাকাটির মাধ্যমে), তিন. আজকের শিশুই কালকের প্রাপ্তবয়ষ্ক ভোক্তা। এভাবে শিশুর মানসিক বিকাশ মানুষ হিসেবে নয়, ভোক্তা হিসেবে গড়ে উঠছে। অন্যদিকে যেসব শিশু-কিশোর ইন্টারনেট ব্যবহার করে, তাদের জন্য ভার্চুয়াল জগত হয়ে উঠেছে অধিক অনিরাপদ। পর্নোগ্রাফির পাশাপাশি শিশু পর্নোগ্রাফিও ইন্টারনেটে সুলভ।
সবমিলিয়ে তার জন্য একটি রুচিশীল, সৃজনশীল, আনন্দময় জগত উপহার দিতে আমরা ব্যর্থ হচ্ছি। এই ভিস্যুয়াল জগতে চলচ্চিত্র একটি বড়ো অংশীদার। সমাজের নীতিনির্ধারক, মিডিয়াকর্ণধার, চলচ্চিত্রনির্মাতা-প্রযোজকদের দায়িত্ব রয়েছে শিশুদের জন্য নিরাপদ ও আনন্দময় একটি জগত উপহার দেবার।
ডিজনি-পিক্সার যেমন পিনোকিও, শ্রেক, ফাইন্ডিং নিমো, আইস এজ-এর মতো রূপকথাকাহিনী আমাদের উপহার দিতে পারে, তেমনি বাংলাভাষী পরিচালক সত্যজিৎ রায় গুপি গাইন বাঘা বাইন ফ্যান্টাসি-সিরিজ আমাদের উপহার দিয়েছেন। টিভি সিরিয়ালের তুলনায় একক চলচ্চিত্র অনেক বেশি সৃজনশীল, শক্তিধর কল্পনায় ভরপুর হতে পারে।
এবং আকর্ষণীয় শিশুতোষ চলচ্চিত্র ব্যবসায়িকভাবে সফলও হতে পারে -- দীপু নাম্বার টু যেমন ব্যবসায়িকভাবে সফল ছিল। তাই প্রযোজনা-প্রতিষ্ঠানগুলোকে শিশুতোষ চলচ্চিত্র নির্মাণে এগিয়ে আসতে হবে। প্রদর্শকদেরও এসব ছবি প্রদর্শনের আগ্রহ দেখাতে হবে। স্কুল এবং শিশুতোষ প্রতিষ্ঠানগুলোও কিন্তু দেশী-বিদেশী শিশুতোষ চলচ্চিত্রের প্রদর্শনের ব্যবস্থা করতে পারে। আজকাল ডিভিডি সার্কিটে এককালে দুর্লভ অনেক ছবিই পাওয়া যায়।
প্রসঙ্গটি অধিকারের
সৃজনশীল উপকরণসমৃদ্ধ চলচ্চিত্র দেখতে পাওয়া শিশুদের অধিকারের মধ্যে পড়ে। শিশুরাই রাষ্ট্র ও সমাজের ভবিষ্যত, তাই তাদের জন্য নিরাপদ, সৃজনশীল, আনন্দময় জগত উপহার দেয়া বড়োদেরই কর্তব্য। সমাজের সব ক্ষমতা বড়োদের হাতে, তাই শিশুবান্ধব পরিবেশ তৈরির দায়িত্ব বড়োদেরই।
শিশুতোষ চলচ্চিত্রের বিষয়টি তাই সামগ্রিক প্রেক্ষাপট থেকে দেখতে হবে। একটি সমন্বিত চলচ্চিত্র নীতিমালা প্রণয়ন করা প্রয়োজন যেখানে শিশু চলচ্চিত্রের বিষয়টি গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করতে হবে।
সেখানে অনুদানপ্রথা বিষয়ক প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণাটির বাস্তবায়নের নিশ্চয়তা থাকতে হবে। শিশুদের জন্য নির্মিত চলচ্চিত্রকে প্রমোদকরমুক্ত করতে হবে। শিশুদর্শকদের টিকেটমূল্য যথাসম্ভব কম রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। শিশু একাডেমীর চলচ্চিত্রগুলোকে আরও সমৃদ্ধ করতে হবে, বিষয়বস্তুতে বৈচিত্র্য আনতে হবে এবং ছবিগুলোকে শিশুদের কাছে পৌঁছে দিতে হবে। পুরনো ছবিগুলোকে বিটিভিসহ অন্যান্য চ্যানেলে পর্যায়ক্রমে প্রচার করার ব্যবস্থা নিতে হবে।
অ্যানিমেশন চলচ্চিত্রের বিকাশ ঘটাতে হবে। কেবল অ্যানিমেশন দিয়েই শিশুদর্শকদের আকৃষ্ট করা শুরু হোক তবে।
[তৃতীয় ‘আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব, বাংলাদেশ’-এ ২৭ জানুয়ারি, ২০০৯ তারিখে পঠিত প্রবন্ধের পরিমার্জিত রূপ এই লেখাটি। ]
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।