আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

শহীদ শফিউর রহমান

মানুষ আর প্রাণীর মধ্যে পার্থক্য হলো-চেতনাগত ও সংস্কৃতিগত।

শহীদ শফিউর রহমান একজন ভাষা শহীদ। ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ এই দাবিতে জীবন উৎসর্গ করেছেন। মাতৃভাষা রক্ষার দাবিতে পৃথিবীতে যে সকল আন্দোলন এ যাবতকালে সংগঠিত হয়েছে, তার মধ্যে বাঙ্গালীর ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারীর ভাষা আন্দোলন শ্রেষ্টতম। যার কারণে ২১ ফেব্রুয়ারীকে আন্তর্জাতিক মর্যাদায় ভাষা দিবস হিসেবে পালিত হয়।

ভাষা সৈনিক শফিউর রহমানের জন্ম ১৯১৮ সালের ২৪ জানুয়ারী। শফিউর রহমান বর্তমানে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কোন্নগরে। বাবা মাহবুবুর রহমান। তিনি ছিলেন ঢাকার পোস্ট এন্ড টেলিগ্রাফ অফিসের সুপারিনটেনডেন্ট। পড়াশুনার হাতেখড়ি পরিবারে।

প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পড়াশুনা শেষ করে কলকাতার গভর্ণমেন্ট কমার্শিয়াল কলেজে ভর্তি হন। ওই কলেজ হতে তিনি আই.কম. পাস করেন। আই.কম. পাসের পর শফিউর রহমান চব্বিশ পরগনা সিভিল সাপ্লাই অফিসে কেরানীর চাকরি শুরু করেন। ১৯৪৫ সালের ২৮ মে শফিউর রহমান কলকাতার তমিজউদ্দিনের কন্যা আকিলা খাতুনকে বিবাহ করেন। আকিলা খাতুনের বয়স তখন ১২ বছর।

১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর তার পিতা মাহবুবুর রহমান পশ্চিমবঙ্গ থেকে ঢাকা আসেন। তিনি ঢাকাতে পাকিস্তান পোস্ট অ্যান্ড টেলিগ্রাফ অফিসে সুপারিনটেনডেন্ট পদে চাকুরি নেন। শফিউর রহমান ও তাঁর পিতার সঙ্গে ঢাকা আসেন। ঢাকায় এসে তিনি বি.এ. ক্লাসে ভর্তি হন। পড়াশুনার পাশাপাশি তিনি ঢাকা হাইকোর্টে হিসাবরক্ষণ শাখায় কেরানী পদে চাকুরী শুরু করেন।

শফিউর রহমানের পাঁচ ভাই ছিল। আজাদুর রহমান নামে তাঁর এক ভাই সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজে ডাক্তারি করতেন। ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারী রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ঢাকা ছিল উত্তাল। এ আন্দোলন ছড়িয়ে গিয়েছিল সারাদেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে, অফিস আদালতে এবং রাজপথের সবখানে। ৫২’ সালের একুশে ফেব্রুয়ারী ছিল রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে সারা দেশে আন্দোলনের প্রস্তুতি দিবস।

ওই দিন সকাল ৯টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে জিমনেসিয়াম মাঠের পাশে ঢাকা মেডিকেল কলেজের (তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্গত) গেটের পাশে ছাত্র-ছাত্রীদের জমায়েত শুরু হতে থাকে। সকাল ১১ টায় কাজী গোলাম মাহবুব, অলি আহাদ, আব্দুল মতিন, গাজীউল হক প্রমুখের উপস্থিতিতে ছাত্র-ছাত্রীদের সমাবেশ শুরু হয়। ২০ ফেব্রুয়ারী পাকিস্থান সরকার ভাষা আন্দোলনের প্রস্তুতিকে তছনছ করে দেয়ার জন্য ঢাকাতে সমাবেশ, মিছিল-মিটিংযের উপর ১৪৪ ধারা জারি করে। সকালের দিকে ১৪৪ ধারা ভংগের ব্যাপারে ছাত্র-রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের মধ্যে মতানৈক্য দেখা দেয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর ড. এস এম হোসেইন এর নেতৃত্বে কয়েকজন শিক্ষক সমাবেশ স্থলে যান এবং ১৪৪ ধারা ভংগ না করার জন্য ছাত্রদের অনুরোধ করেন।

বেলা ১২টা থেকে বিকেল ৩টা পর্যন্ত সময় ধরে উপস্থিত ছাত্রনেতাদের মধ্যে আব্দুল মতিন এবং গাজীউল হক ১৪৪ ধারা ভংগের পক্ষে মত দিলেও সমাবেশ থেকে নেতৃবৃন্দ এ ব্যাপারে কোন সুনির্দিষ্ট ঘোষণা দিতে ব্যর্থ হন। এ অবস্থায় বাংলার দামাল ছেলেরা দমনমূলক সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে রুখে দাড়ায়। উপস্থিত সাধারণ ছাত্ররা স্বত:স্ফূর্তভাবে ১৪৪ ধারা ভংগের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে এবং মিছিল নিয়ে পূর্ব বাংলা আইন পরিষদের (বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলের অন্তর্গত) দিকে যাবার উদ্যোগ নেয়। অধিকার আদায়ের দাবিতে শত শত বিদ্রোহী কন্ঠে “রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই” এই দাবীতে আন্দোলোন তীব্র হয়ে উঠে। পুলিশের সঙ্গে ছাত্র জনতার সংঘর্ষ হয়।

শ্লোগানে শ্লোগানে কেঁপে উঠে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যামপাস। বুলেট আর লড়াই শুরু হয়। পুলিশ লাঠিচার্জ এবং গুলি বর্ষণ শুরু করে। গুলিতে ঘটনাস্থলেই আবুল বরকত (ঢাবি এর রাষ্ট্রবিজ্ঞান এর মাষ্টার্সের ছাত্র), রফিক উদ্দীন, এবং আব্দুল জব্বার নামের তিন তরুণ মারা যায়। রফিক, জাব্বার, বরকত সহ নাম না জানা আরও অনেকের সাথে সালামও সেদিন গুলিবিদ্ধ হন।

২২ ফেব্রুয়ারী শফিউর রহমান সকাল দশটায় অফিসে রওনা হন। সেদিন পাজামা, শার্ট, গেঞ্জি এবং কোট পরেছিলেন। পায়ে ছিল জুতা। সাইকেলে তিনি অফিসে যাতায়াত করতেন। সকাল সাড়ে দশটার দিকে নবাবপুর রোডে বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্র ভাষা করার দাবিতে বিক্ষোভরত জনতার উপর পুলিশ বেপরোয়া গুলিবর্ষণ করে।

শফিউর রহমান গুলিবিদ্ধ হয়ে গুরুতরভাবে আহত হন। তাঁকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হয়। অস্ত্রোপচার সফল হয়নি। ওই দিন সন্ধা সাতটায় হাসপাতালে তিনি মারা যান। শফিউর রহমানের এক মেয়ে এবং এক ছেলে।

মেয়ে শাহনাজের বয়স তখন মাত্র তিন বছর। মেয়েকে তিনি অত্যন- স্নেহ করতেন। গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত অবস্থায় তিনি মেয়ের কথা স্মরণ করেন। আহত অবস্থায় তাঁর ডাক্তার ভাইকে তিনি বলেন, 'আমার মেয়েকে দেখো। আমি বুঝতে পারছি আমি তার কাছে আর ফিরে যেতে পারব না'।

ছেলে শফিকুর রহমান তখন মায়ের পেটে। ১৯৫২ সালের মে মাসে সে জন্ম গ্রহণ করে। গৌরদীপ্ত ভাষা আন্দোলনের অমর শহীদ শফিউর রহমানকে বাংলাদেশ সরকার মরণোত্তর একুশে পদক (২০০০) প্রদান করেন। শহীদ শফিউর রহমানকে আজিমপুর কবরস্থানে দাফন করা হয়।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.