হিন্দু না ওরা মুসলিম ঐ জিজ্ঞাসে কোনজন, কান্ডারি বলো ডুবিছে মানুষ সন্তান মোর মা'র
ইন্ডিয়াঃ এক উপনিবেশী বয়ান
কলোম্বাস একজন মাত্র ব্যাক্তি। আমেরিকার আদিবাসীরা সংখ্যায় লক্ষ কোটি, অথচ সেই কলোম্বাসই এই লক্ষ কোটি মানুষের নাম পরিচয় বদলে দিয়ে তাদের বানালেন ইন্ডিয়ান, রেড ইন্ডিয়ান। আমেরিকার অধিবাসীরা যদি ইন্ডিয়ান না হয় তাহলে ইন্ডিয়ান কারা? ইন্ডিয়ান এই ভারতীয় উপমহাদেশ নামক ভূখন্ডের মানুষের পরিচয়। কিভাবে? এই ইন্ডিয়া আর ইন্ডিয়ান শব্দের উৎপত্তি কিভাবে। এই অঞ্চলের মানুষ কবে থেকে নিজেদের এই নামে ডাকা শুরু করলো? এই অঞ্চলের কোন মানুষের মুখে বা লেখা বইয়ের পাতায় না বরং শব্দটার প্রথম ব্যাবহার পাওয়া যায় প্রক্ষাত গ্রিক ইতিহাসবেত্তা হেরোডোটাসের (৪৮৪-৪২৫ খৃঃপূঃ) লেখায়, আজ থেকে প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে।
হেরোডোটাসের ব্যাবহৃত ইন্ডিয়া (India) শব্দটার অর্থ দাঁড়ায় সিন্ধুর ঐ পাড়ের ভূমি (Region beyond Indus)। তৎকালিন গ্রিকদের কাছে সিন্ধু নদের এই পাড়ের যে ভূমি সেই ভূমি আর সেই ভূমির মানুষ ছিলো অজানা, রহস্যময়। হেরোডোটাস তার অবস্থান থেকে সিন্ধু নদের ঐ পাড়ের পুরোপুরি অজানা আর রহস্যময় দুনিয়াটাকে একটামাত্র নাম দিয়া জয় করতে চাইলেন তার মানসে, আর সেই নামটা হলো ইন্ডিয়া। আলেক্সান্ডার দ্যা গ্রেট শুধু মানসে না বরং বাস্তবে জয় করতে চিয়েছিলেন এই “ইন্ডিয়া” নামক যায়গাটাকে, ইন্ডিয়া বিজয় করে শেষ করতে চেয়েছেন তার বিশ্ববিজয়। তিনি যানতেন না সিন্ধুর এই পারে ইন্ডিয়া নামে গ্রিসের মতো কোন ভূখন্ড নাই, সিন্ধুর এই পারে আরো কত লক্ষ কোটি মানুষের বাস কত বিস্তির্ণ ভূখন্ডে, তার জানা ছিলোনা।
যখন কিছুটা আঁচ করতে পারলেন, বিশ্বজয়ের স্বপ্ন বাদ দিয়ে ভগ্ন হৃদয়ে ফিরে যেতে হলো তাকে। আলেক্সান্ডার এই ভারতীয় উপমহাদেশের খুব সামান্য অংশই জয় করতে পেরেছিলেন, পশ্চিমের কিছুটা অংশ, পাঞ্জাব পর্যন্ত। হেরোডোটাস বা আলেক্সান্ডারের সময়কার ইউরোপিয় মানষে ইন্ডিয়া একটা রহস্যময় জগৎ, এই জগতের মাটি খুড়লে সোনা পাওয়া যায়, এই জগতে সম্পদের ছড়াছড়ি, ছড়াছড়ি জাদু-টোনার, ছড়াছড়ি যৌনতার। এই জগতের মানুষেরাও রহস্যময়, অজানা, অপর, অন্য কেউ, সভ্য মানুষ না, অসভ্য, এদের অঢেল সম্পদ আর যৌনতার মাদকতা ভরা শরীর শুধুমাত্র জয় করার আকর্ষনই বাড়ায়। ইন্ডিয়া শব্দটা গ্রিক থেকে ল্যাটিন আর ল্যাটিন থেকে ইংরেজিতে শুধু একটা শব্দ হিসেবেই আসেনি বরং এসেছে একটা ধারণা হিসেবে, রহস্যময়, অজানা আর অসভ্যের ভূখন্ড হিসেবে, যেই ভূখন্ড জয় করা জায়েজ।
ইন্ডিয়া শব্দটাই তাই একটা উপনিবেশী শব্দ, ইন্ডিয়া নামক ভূখন্ডের বয়ান তাই একটা উপনিবেশী বয়ান। ব্রিটিশ উপনিবেশী আমলে ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত এ অঞ্চলের মানুষও শেখে এই ইন্ডিয়া শব্দ, শেখে ইন্ডিয়া নামক ভূখন্ডের উপনিবেশী বয়ান। মহা পরাক্রমশালী আলেক্সান্ডার তার এশিয়া জয়ী অশ্বারোহী, ইরানী রাজকীয় বাহিনী আর অসাধারণ যুদ্ধ কৌশল দিয়ে যা করতে পারেন নি, শিক্ষার মাধ্যমে তাই করে দেখায় লর্ড ম্যাকলে। ফলাফল, আলেক্সান্ডারের অন্তর্ধানের দুই হাজার তিনশ বছর পর এই ভূখন্ডে শোনা যায় তার সেই অমৃত বানীর প্রতিদ্ধনী, “সত্যিই সেলুকাস, কি বিচিত্র এই দেশ”। আজকে যেই খানে পাকিস্তান, ঠিক সেই খানে দাঁড়িয়ে আলেক্সান্ডার তার চোখে দেখা অজানা দুনিয়ার বিচিত্রতা, অসভ্যতায় মুগ্ধ হয়ে করলেন যেই মন্তব্য আজ দাস মানসিকতা নিয়ে বাঙালীর অসভ্যতায় লজ্জিত হয়ে তার প্রতিদ্ধনী করেন বুদ্ধিজীবী থেকে শুরু করে টিভি ম্যাগাজিনের জোকার।
এক জাতি ও দ্বিজাতি তত্বঃ উপনিবেশী জ্ঞানে আত্ম পরিচয়
ইন্ডিয়ান নামক ভূখন্ডে ইন্ডিয়ান নামক জাতি বাস করে, এ এক উপনিবেশী বয়ান। এই বয়ানের সাথে বাস্তবতার কোন সম্পর্ক নাই। ইন্ডিয়ান নামক কোন জাতির কোন অস্তিত্ব ইতিহাসে নাই। এই জাতির উৎপত্তি ব্রিটিশ উপনিবেশী আমলে। তার আগে এই জাতির নাম নিশানাও ছিলো না।
দক্ষিন এশিয়া বা ভারতীয় উপমহাদেশ নামক এই অঞ্চলে বাঙালি, পাঞ্জাবি, মারাঠি, তামিল এহেন বহু জাতির অস্তিত্ব ছিলো, এখনো আছে, কিন্তু ইন্ডিয়ান নামক কোন জাতির অস্তিত্ব ছিলোনা, অস্তিত্ব ছিলোনা ইন্ডিয়া নামক কোন দেশের, অস্তিত্ব ছিলোনা পাকিস্তান নামক দেশের। দক্ষিন এশিয়ায় ছোট বড় মিলিয়ে ভাষার সংখ্যা প্রায় দুই হাজার, দশ লাখের বেশি মানুষের মাতৃভাষা ২৯ টা, বড় ভাষা জাতি আছে অন্তত ২২ টা। এই সব জাতির সংস্কৃতিতেও আছে পার্থক্য। একজন বাঙালির আর একজন পাঞ্জাবির ভাষা আর সংস্কৃতিতে পার্থক্যতো আকাশ প্রমান। এতো পার্থক্যের পরও ভারতিয় উপমহাদেশ নামক ভূখন্ডের এতো এতো জাতি গুলোকে একটা বিশেষ জাতিতে রুপান্তর করার পায়তারা শুরু হলো কেনো? আর এই ঘটনাটা ব্রিটিশ আমলেই কেনো হলো? আগেই বলেছি, উপনিবেশের জণগষ্ঠিকে সরলিকরণ করার কাজটা উপনিবেশী শাসকরাই করে আগে, আর সেই সরলিকৃত জ্ঞান পরে গ্রহণ অরে উপনিবেশের শিক্ষিত জণগোষ্ঠি।
আধুনিক কালে এসে ইন্ডিয়ান নামক জাতি আর ইন্ডিয়া নামক দেশের খাতা কলমে আবিষ্কার করে ব্রিটিশ শাসক গোষ্ঠি, শোষনের সুবিদার্থে। উপনিবেশী শাসনের সুবিধার্থে এই একজাতি তত্বের উদ্ভব, আর এই ভূখন্ড থেকে সৈন্য সামন্ত আর লর্ড ভাইসরয়দের সরিয়ে নিলেও যেনো উপনিবেশ টিকে থাকে তা নিশ্চিত করতেই এক জাতির ধারণার চারা গাছে পানি ঢালা। বহু জাতির চেয়ে এক জাতিকে শোষন করা সহজ। এক জাতি হলে, সেই জাতির সরকারের সাথে প্রভূ-দাস সম্পর্ক বজায় রাখা সহজ, বহু জাতির চেয়ে। এই সরকারের নাম দাস সরকার।
ব্রিটিশ উপনিবেশ থাকা কালিনই ব্রিটিশ সরকারের ছত্রছায়ায় এই দাস সরকারের উদ্ভব। খাতা কলমে উপনিবেশ শেষ হওয়ার পরও এই দাস সরকারের মাধ্যমেই বহাল থেকেছে উপনিবেশ। রক্ত মাংসে এদেশিয় আর চিন্তা চেতনায় ইউরোপিয় রাজনীতিবিদ, আমলা আর বুদ্ধিজীবিদের নিয়ে গঠিত এই দাস সরকার। ফয়েজ আলম তার “ভাষা ক্ষমতা ও আমাদের লড়াই প্রসঙ্গে” পুস্তকে এদের নামই দিয়েছেন “নয়া উপনিবেশের কড়ি-বর্গা”। এই কড়ি-বর্গারা এদেশিয় জনতার নয়, বরং বিদেশী প্রভূর স্বার্থ রক্ষা করে, আর বজায়ে রাখে নিজেদের লুটপাটের রাজত্ব।
ব্রিটিশ উপনিবেশী আমলে এই করি-বর্গাদের প্রতিনীধিই ছিলো তৎকালিন কংগ্রেস-মুসলিম লীগ। চরিত্রের দিক থেকে মৌলিক কোন পার্থক্য ছিলোনা এই দুই রাজনৈতিক দলের, যতটুকু পার্থক্য তা ছিলো ক্ষমতা নিয়ে কুত্তা কামড়াকামড়ি ঢাকার জন্য জনগণের চোখে ধুলা দেয়ার জন্য সৃষ্ট। উদাহরণ স্বরুপ, মহাত্মা গান্ধি একজন সাম্প্রদায়িক ব্যাক্তি হওয়া সত্ত্বেও রাজনৈতিক স্বার্থে ধর্ম নিরপেক্ষতার কথা বলেছেন, আর অন্যদিকে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর মতো চরম নাস্তিক ব্যাক্তি সাম্প্রদায়িক পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে নেতৃত্ব দিয়েছেন। ইন্ডিয়া নামক একটা জাতি, ইন্ডিয়া নামক একটা দেশ তাই তৈরি করেছে ব্রিটিশ শোষক শ্রেনী, আর তাদের তোষক শ্রেনী হিসেবে সেই সেই দেশ টিকিয়ে রাখতে চেয়েছে তাদের কড়ি-বর্গারা। এই কড়ি-বর্গাদের একটা শ্রেনী যখন দেখছে ক্ষমতায় ভাগ ঠিকমতো পাওয়া যাচ্ছেনা, তখন ইসলামী জাতীয়তাবাদের ধুয়া তুলে বিভক্তী চেয়েছে, দাবি তুলেছে পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রের, যেখানে তারা তাদের একচ্ছত্র শাসন কায়েম করবে, নয়া উপনিবেশের কড়ি-বর্গা হিসাবে নেবে লুটপাটের ভাগ।
ইতিহাস সাক্ষি দেয় ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে এই দুই দলই পালন করেছে হিনমন্য ভূমিকা, বারবার ব্রিটিশ সরকারের সাথে গেছে মিমাংসায়, অবলম্বন করেছে তোষন নীতি। সরাসরি স্বাধিনতার দাবি তোলার ক্ষেত্রে বরাবরই অনিহা দেখিয়েছে এই দল। নেতাজী সুভাষ বোস, মাষ্টার দা সূর্য স্যেন, ভগবত সিং এর মতো সহিংসতাবাদিদের সরাসরি স্বাধীনতার দাবির পক্ষে জনতার রাজনৈতিক আবেগ উপেক্ষা করা যখন আর সম্ভব হয় নাই তখনই কংগ্রেস সরাসরি স্বাধীওতার আন্দোলনে নেমেছে। গান্ধির অহিংস আন্দোলন কোন ফলাফলই আনতে পারতোনা, যদি না দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে চরম ক্ষতিগ্রস্ত ব্রিটেনের কাছে ইন্ডিয়া একটা বোঝায় পরিণত না হতো। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর চরম দুর্বল অবস্থায় ছিল ব্রিটেন।
গোটা অর্থনীতিই ভেঙে পরেছিলো। ভারতীয় উপমহাদেশে উপনিবেশের স্বর্ণযুগও তখন সমাপ্ত। তার উপর কড়ি-বর্গাদের মাধ্যমেই যদি শাসন টিকিয়ে রাখা যায় তো সরাসরি শাসনের মতো ব্যায়বহুল ব্যাবস্থা টিকিয়ে রেখেই বা কি লাভ। আর তাছাড়া দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ব্রিটেনকে সাম্রাজ্যের সিংহাসন ছেড়ে দিতে হয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে। ভারত আর পাকিস্তান নামক রাষ্ট্র দুটি তাই এই উপমহাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মুক্তি দিতে পারেনি, বরং কেড়ে নিয়েছে আত্ম পরিচয়, তাদের গলা থেকে শোষনের দড়ি খুলে পরিয়ে দিয়েছে শোষনের শেকল।
আমার বাঙাল মানসে তাই ভারত ভাগ বলে কিছু নাই, যেই দেশের কোন কালে কোন অস্তিত্বই ছিলো না, তার আবার বিভাগ কিসের। আমার বাঙাল মানসে আছে দগদগে ঘায়ের মতো বাঙলা ভাগ। সেই ঘায়ের নিদান খুঁজে, আত্মপরিচয় আর মুক্তির যে লড়াই আমার জাতি লড়ে চলেছে সেই বাঙলা ভাগের সময় থেকেই আমি সেই লড়াইয়ের সৈনিক।
ভাষাঃ আগ্রাসনের হাতিয়ার
ভাষা, সংস্কৃতির ধারক। ভাষা, মানব সভ্যতার ধারক।
এই একটা জিনিস, যা মানুষের সাথে মূল পার্থক্য গড়ে দিয়েছিলো অন্যান্য বাইপেডাল হোমিনিডদের ( বাইপেডাল হোমিনিডঃ দুই পায়ে হাটা নরবানর প্রজাতি, এদের মধ্যে এখন পর্যন্ত মানুষই টিকে আছে, অন্যরা বিলুপ্ত)। শুধু বড় মস্তিষ্ক আর বুদ্ধিমত্তা না, জটিল ভাষা তৈরির যোগ্যতা যার মাধ্যমে জ্ঞান আর শিক্ষা পরস্পরের মাঝে এমনকি পরবর্তি প্রজন্মের কাছে স্থানান্তর করা যায়, তাই মানুষকে দিয়েছে ভয়ঙ্কর ক্ষমতা। আজ থেকে প্রায় ৬৬ হাজার বছর আগে আমাদের পূর্ব পুরুষরা প্রবেশ করে ইউরোপে, ইউরোপে তখন অন্য এক বাইপেডাল হোমিনিড হোমো নিআনডারথালদের বসবাস। আমাদের চেয়েও বড় মস্তিষ্কের এই হোমিনিডদের নিজস্ব সংস্কৃতি ছিলো, ধর্ম ছিলো, ছিলো হাতিয়ার। অথচ আমাদের সাথে লড়াইয়ে টিকে থাকতে পারেনি নিআনডারথালরা, আজ থেকে প্রায় ৩০ হাজার বছর আগে পৃথিবীর বুক থেকে বেমালুম বিলুপ্তি ঘটে মানুষ ছাড়াও পৃথিবীর বুকে টিকে থাকে এখন পর্যন্ত স্বিকৃত স্বর্বশেষ বাইপেডাল হোমিনিডদের।
নিআনডারথালদের অপরিপক্ক সংগিত জাতীয় ভাষায় তৈরি সংস্কৃতি মার খেয়ে গেছে হোমো সাপিয়েন্সদের জটিল ভাষায় তৈরি পরিপক্ক সংস্কৃতির কাছে। শ্রেফ বুদ্ধিমত্তা না, ভাষাও মানুষকে মানুষ করেছে। এমনকি আমরা আজকে বুদ্ধিমত্তা বলতে যা বুঝি তার পিছেও আছে ভাষার অবদান, মানুষের বিবর্তনেও ভাষার রয়েছে ভূমিকা। ভাষাই ঘিড়ে রেখেছে আমাদের সামাজিক অস্তিত্বকে, ভাষাই তৈরি করেছে আমাদের সামাজিক জগত, আমাদের দিয়েছে প্রাকৃতিক জগৎকে মানবিয় বুদ্ধিমত্তার সাথে বোঝার ক্ষমতা। ভাষা, বুদ্ধিমত্তা, সংস্কৃতি, সভ্যতা, সাংস্কৃতিক বিবর্তনের প্রক্রিয়া এসব বিষয়ে আলোচনা করার অবকাশ এখানে নাই।
আমরা বরং আগ্রাসনের হাতিয়ার হিসাবে ভাষাকে কিভাবে ব্যাবহার করা যায়, এবং সম্প্রতি তার ব্যাবহার কত ব্যাপক আকার ধারণ করেছে তা খানিকটা বোঝার চেষ্টা করবো। আমাজন জঙ্গলে কোন জঙলি আদিবাসীর ঘরে জন্ম নেয়া একটা মানব শিশু আর নিউয়র্কের কোন অট্রালিকায় জন্ম নেয়া একটা মানব শিশুর মধ্যে বুদ্ধিমত্তার কোন ফারাক নেই, ফারাকটা তৈরি হয় বড় হতে হতে, দুই ভিন্ন সংস্কৃতিতে বড় হয়ে একজন হয়তো মহাকাশবিজ্ঞান নিয়ে গবেষনা করে তো অন্যজন জীবিন ধারণ করে পশু শিকার করে। আজ থেকে এক লাখ বছর আগে জন্ম নেয়া একজন আদীম মানুষ আর এখনকার আধুনিক মানুষের মধ্যে জিন, মস্তিষ্ক, আকার আকৃতিতে তেমন কোন পার্থক্য নেই, যে পার্থক্য তৈরি হয়েছে সে পার্থক্যটা গড়ে দিয়েছে ভাষার তৈরি সমাজ। এক লাখ বছর আগের একটা জংলি শিশু হিসেবেই আমরা জন্মগ্রহণ করি, কিন্তু তারপর খুব দ্রুত ভাষার জগতে অভ্যস্ত হতে হতে বড় হই, প্রথমে ভাষা দিয়ে তৈরি করা একটা নাম পাই, তারপর শিখি চাইতে, তারপর শিখি মানতে, কি বলতে হবে, কি করতে হবে, কি বিশ্বাস করতে হবে, পশু থেকে এভাবেই ভাষা আমাদের মানুষ করে। পূর্ব পুরুষের শেখানো শিকার, কৃষি, ধর্ম, দর্শন, প্রযুক্তি এই সব জ্ঞান নিয়ে আমরা পূর্ব পুরুষের সমান হই, আমাদের আলফা মেল’রা নতুন নতুন আবিষ্কার আর উদ্ভাবন আর ধর্ম দর্শন প্রচার, বীরত্মপূর্ণ সংগ্রামের মধ্য দিয়ে অর্জিত সবকিছু দিয়ে যায় পরের প্রজন্মে, সেই প্রজন্ম আবার তার পরের প্রজন্মকে, এইভাবে আমরা আগাই।
ভাষাই আমাদের প্রগতির বাহন। আমাদের জ্ঞানি ব্যাক্তি, আমাদের নেতাদের মুখের কথা, লিখে রাখা বাণী এই সব আমাদের সামাজিক জীবনকে নিয়ন্ত্রন করে। লেখার শুরুর দিকেই এ বিষয়ে কিছুটা আলোচনা করেছি। ভাষার জগতে অসংখ্য ডিসকোর্স নিয়ন্ত্রন করে আমাদের বিশ্বাস, আমাদের জীবন। অনেক প্রাচীন বিশ্বাস মানুষ আকড়ে ধরে রাখে ভাষার ওপর তার এই চরম নির্ভরতার কারণেই, বোকামি বা অজ্ঞতা অনেক গৌণ বিষয়।
প্রাচীন কালে যখন ছাপাখানা ছিলোনা, অথবা তারও আগে যখন ভাষার লিখিত রুপ সেভাবে গড়ে ওঠেনি মুখের কথার দাম তখন ছিলো অনেক বেশি। শুধুমাত্র মৌখিক কথায় হয়েছে বড় বড় ঐতিহাসিক চুক্তি, প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করা ছিলো মহা পাপ, মিথ্যা বলা মহাপাপ এখনো মানা হয় প্রত্যেক জাতি, প্রত্যেক সংস্কৃতিতেই। ভাষার সাথে আমাদের সম্পর্ক এমনি নিবির। যখন লেখার ভাষা ছিলোনা, অথবা ছিলোনা লেখার উপকরণের ছড়াছড়ি নিজের পূর্বপুরুষের ইতিহাস, বিশ্বাস আর প্রযুক্তি মানুষ আয়ত্ব করে রাখতো তার মুখস্ত বিদ্যায়, পূর্ব পুরুষের জ্ঞান আর গানের মিলিত প্রয়াসে গড়ে উঠেছিলো প্রাচীন ধর্ম। মুখস্ত এসব কাহিনী, ডিসকোর্স, নৈতিকতা যেহেতু লেখা হতোনা তাই এগুলো বদলে যেতো প্রতিনিয়ত।
পূর্ব পুরুষের যে গানের সাথে একটা প্রজন্মের আধ্যাত্মিক সম্পর্ক থাকে সেই গান সেই প্রজন্ম সময়ানুগ বাস্তবতার সাথে মিলিয়ে পালটে ফেলতে পারতো যেমন খুঁসি, এক্ষেত্রে স্বাধীনতা বেশি ছিলো, সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের বিষয়টা তখনো তাই তেমন শক্তিশালী হতে পারেনি। তবে লিখিত ভাষার প্রচলন হওয়ার পর এক্ষেত্রে কিছুটা বিপত্তী দেখা দেয়। লিখিত ভাষার মাধ্যমে জ্ঞানের স্থানান্তর অনেক সহজ হলো বটে, কিন্তু ভাষা লেখার সাথে সাথে তা একধরণের স্থবিরতা লাভ করে, সেই সাথে পায় অমরত্ব। ব্যাক্তির সাথে সম্পর্ক ছেদ করে ব্যাক্তির জ্ঞান লিখিত ভাষার মাধ্যমে আলাদা অস্তিত্ব পেয়ে যায়, আর সেই অস্তিত্ব ধিরে ধিরে পেতে থাকে অপরিবর্তনীয় আধ্যাত্মিক মর্যাদা। আর একারণেই প্রাচীন কালে লেখা প্রায় যেকোন পুস্তকই পেতো ধর্ম পুস্তকের মর্জাদা।
এই আমাদের সময়েও কোন দেশের সংবিধান পায় একধরণের আধ্যাত্মিক মর্জাদা। লিখিত ভাষার মাধ্যমে এক প্রজন্ম যেমন সহজেই তার অর্জিত জ্ঞান পরবর্তি প্রজন্মকে দিয়ে যায় তেমনি সহজেই দিয়ে যায় তার অজ্ঞানতা। আমাদের এই ছাপাখানার যুগের তৃতিয় বিশ্বের প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবীদের লড়াইটা তাই অনেক কঠিন। লড়াইটা একদিকে যেমন প্রাচীন কূপমন্ডুকতার বিরুদ্ধে ঠিক তেমনি আগ্রাসনবাদী উপনিবেশী ডিসকোর্সের বিরুদ্ধে।
মানুষের মতো সামাজিক প্রাণির ক্ষেত্রে আগ্রাসনের প্রাথমিক কাজটা সবসময়ই হয় ভাষার মাধ্যমে।
একেবারে ব্যাক্তিক ক্ষেত্রেও হাতাহাতির আগে শুধুমাত্র মৌখিক লড়াইই বেশিরভাগ সময় নির্ধারণ করতে পারে ফলাফল। জাতিগত আগ্রাসনের ক্ষেত্রেও একই কথা খাটে। হুমকি ধামকি, শ্রেষ্ঠত্বের বড়াই অথবা ছল চাতুরি দিয়ে তৈরি করা ডিসকোর্স, এসবই আগ্রাসনের ভাষা। ভূল তথ্য দিয়ে বিপক্ষ দলের সৈনিকের মনোবল ভেঙে দেয়ার ঘটনার অভাব নেই ইতিহাসে। ছাপাখানার যুগ হওয়ায়, আর গণমাধ্যমের ব্যাপক বিকাশের ফলে ভাষাকে আগ্রাসনের হাতিয়ার হিসেবে এযুগে যেভাবে ব্যাবহার করা হচ্ছে অন্য কোন যুগেই তা করা হয় নাই।
এই প্রবন্ধে বারবার উপনিবেশী আগ্রাসনের সাংস্কৃতিক রুপটার নানা গলি ঘুপচি সন্ধানের একটা চেষ্টা করা হয়েছে। আগেই একবার বলেছি, উপনিবেশী শাসক গোষ্ঠি প্রথমে তৈরি করেছে উপনিবেশ সহায়ক জ্ঞান, নিজেদের জন্য। আর তারপর, উপনিবেশী শিক্ষায় শিক্ষিত উপনিবেশের কড়ি-বর্গা তৈরি করার মধ্য দিয়ে উপনিবেশী জ্ঞান ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে উপনিবেশের জণগোষ্ঠির মন মানসিকতায়। এক্ষেত্রে শুধু ভাষার অন্তর্গত ডিসকোর্সই নয়, ভূমিকা পালন করেছে ভাষা নিজেই। কোন জাতিকে পদানত করতে হলে হয় তার সংস্কৃতিকে ধ্বংস করতে হবে অথবা তার সংস্কৃতিকে অসভ্য ছোটলোকের সংস্কৃতি হিসবে প্রমান করতে হবে।
ভাষা দিয়ে কাজটা শুরু করলে বাকিটা একেবারেই সহজ হয়ে যায়। লর্ড ম্যাকলের আগে ব্রিটিশ জ্ঞানতাত্মিকরা নিজেরাই ভারতীয় ভাষায় শিক্ষিত হয়েছে। আর যখন তাদের প্রয়োজন ফুরিয়েছে, ম্যাকলের মতো উপনিবেশকর তখন মনোনিবেশ করেছেন ইংরেজি ভাষায় শিক্ষিত কড়ি-বর্গা তৈরি করার কাজে। ইংরেজি ভাষাকে স্থাপন করা হয়েছে এ অঞ্চলের ভাষার তুলনায় শ্রেষ্ঠত্বের মর্জাদায়। যে মাতৃ ভাষার সাথে একজন মানুষের সম্পর্ক আধ্যাত্মিক, আপন পরিচয়ের, সেই মাতৃভাষার এ অমর্জাদা সেদিন মেনে নিয়েছে এদেশের শিক্ষিত সমাজ।
ইংরেজি ভাষা শেখাই হয়ে পরে উপনিবেশী প্রভূর ক্ষমতার কাছাকাছি যাওয়ার, লুটপাটের ভাগ পাওয়ার একমাত্র উপায়। তৈরি হয় বাঙালি বাবু। ব্রিটিশ উপনিবেশের আগে এ অঞ্চলে একেবারেই সাম্প্রতিক সময়ের একটা সাম্রাজ্য ছিলো, সেই সাম্রাজ্য মুঘোল সাম্রাজ্য। এই মুঘোল সাম্রাজ্যের সময়টাতেই দিল্লী এবং তার আশেপাশের উত্তর ভারতীয় অঞ্চলটাতে হিন্দী/উর্দু ভাষার জন্ম। ভাষাতাত্মিকরা হিন্দী আর উর্দুকে একই ভাষার দুই ডায়ালেক্ট বলে স্বিকার করেন।
দুটি ভাষাই উত্তর ভারতীয় প্রাকৃত ডায়ালেক্ট খাড়ি-বলীর সাথে ফারসী ভাষার প্রভাবে সৃষ্ট ভাষা। হিন্দি আর উর্দুর মূল পার্থক্য হলো হিন্দির চেয়ে উর্দুতে ফারসী ভাষার প্রভাব বেশি। ভারতীয় উপমহাদেশ যেহেতু ইউরোপিয় জ্ঞানে একটা মাত্র দেশ, যে দেশের নাম “ইন্ডিয়া” সেই বিশাল দেশকে ইংরেজি ভাষার মাধ্যমে একদেশে পরিণত করার চেষ্টা চালায় ইংরেজরা। তবে নিজেরা ইংরেজি শিক্ষিত হলেও ব্রিটিশদের কড়ি-বর্গারা এই কাজে ব্যাবহার করার চেষ্টা করেছে হিন্দি/উর্দু ভাষাকে। সেই ১৯১৮ সালেই মহাত্মা গান্ধি প্রতিষ্ঠা করেন “দক্ষিন ভারত হিন্দি প্রচার সভা”, উদ্দেশ্য ছিলো দক্ষিন ভারতের মানুষকে হিন্দুস্তানী ভাষায় শিক্ষিত হতে প্ররোচিত করা, ভারতিয় উপমহাদেশে অন্য সব ভাষা, অন্য সব সংস্কৃতি ধ্বংস করে এক ভাষার এক জাতি প্রতিষ্ঠা করা।
মহাত্মা গান্ধি আর জওহরলাল নেহেরু দুজনেই চাইতেন এক ভাষার এক জাতির হিন্দুস্তান প্রতিষ্ঠা করতে। ১৯২৫ সালে ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেসে ইংরেজির বদলে হিন্দি ভাষার প্রচলন শুরু করা হয়। তবে এধরণের আগ্রাসী প্রচেষ্টার প্রতিবাদ হয় করা হয় একেবারে প্রথম থেকেই। তামিল ভাষী রাজনীতিক পেরিয়ার রামাসামি এর প্রতিবাদ করেন সেই শুরুর দিকেই। (চলবে)
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।