শিশুতোষ যে কোন রচনা।
'...শেষমেশ গিয়ে থামলাম পাখপাখালি, নৈসর্গিক গাছপালা আর পাহাড়ে ঘেরা সুন্দরবনে। '
'সুন্দরবনে?' মিন্টু অবাক হয়।
'নয়তো কী, আকাশ থেকে পড়লি মনে হয়?'
'কিন্তু সুন্দরবনে পাহাড় কই, কেবল তো খাল আর বাঘ হরিণেরা। ' মিন্টু ফের বলে।
'বড়জোর শিকার হওয়া হরিণের পায়ের হাড় থাকতে পারে কিন্তু 'পাহাড়-অসম্ভব!'
মামা এতক্ষণে বুঝতে পারেন। 'ওরে মুখ্যু, ওটা তো তুই ম্যানগ্রোভ বনের কথা বলছিস। ওটা সুন্দরবন হলো নাকি, আসল সুন্দর আর মনোহরা বন তো চিটাগং হিলট্রাক্টস আর সিলেটের বনগুলো। আর ওই ম্যানগ্রোভ বন-ওকে বলা চলে অন্ধকার বন। '
'অন্ধকার বন?' আমরা বিস্মিত হই।
'কেন, বাঘের ভয় আছে না? অন্ধকার না হয়ে উপায় কি? 'যেখানে বাঘের ভয় সেখানে রাত হয়'-জানিসনে কথাটা?'
আর ওই সুন্দরী গাছ, যা চেহারা ওই গাছের, নাম হওয়া উচিত পেত্নী গাছ, কিম্ভূত ধাঁচের সব গাছ, শিকড়-বাকড় সব মাটির ওপর বের হয়ে আছে-এক অশরীরী পরিবেশ। ম্যানগ্রোভ না বলে ও বনকে বরং গেস্টগ্রোভ বলা উচিত। অমাবস্যার রাতে গাছগুলো ওই শিকড় দিয়ে হেঁটে বেড়ায়। '
'ওগুলো শ্বাসমূল মামা। ' সোৎসাহে বিলু বলে।
'হয়েছে বিদ্যে ফলাতে হবে না, ওসব পুঁথিগত বিদ্যে দিয়ে ওখানে এক মুহূর্ত টিকতে পারবিনে, ওখানে গিয়ে আমি যে অবস্থায় পড়েছিলাম শুনলেই তো শিউরে উঠবি। '
আমাদের মাকনা মামা এতক্ষণ ধরে আমাদের তার জীবনে ঘটে যাওয়া বৈচিত্র্যময় ঘটনার মধ্য থেকে এক রোমাঞ্চকর ঘটনা শোনাচ্ছিলেন। হঠাৎ মিন্টুর প্রশ্নে গল্পখানার মাঝে ছেদ পড়ল।
আমি বললাম, 'মামা ম্যানগ্রোভ বনের গল্প আরেক দিন শোনা যাবে, আগে তো যে সুন্দরবনের গল্প বলছিলে, সেটা শেষ কর। '
'উঁহু, মামা ঘাড় নাড়েন, তোরা আমার মুডখানাই নষ্ট করে দিয়েছিস, ও গল্প আরেকদিন শেষ করব, এখন তোদের ম্যানগ্রোভ বনের কাহিনীটাই শোনাই।
'
বাইরে বৃষ্টি পড়ছিল। সন্ধ্যা থেকে আমি, মিন্টু, বিলু আর হাবু মামার রুমে বসে গল্প শুনছি। মাকনা মামা মিন্টুর আপন মামা, তার পরিচয় বলতে গেলে দুভাবে বলা যায়। নিন্দুকের ভাষায় টো টো কোম্পানির স্থায়ী ম্যানেজার, আর আমাদের চোখে দুর্লভ অ্যাডভেঞ্চার-প্রিয় গপ্পোবাজ মানুষ। বছরের বেশির ভাগ সময় কাটে নানা জায়গায় ঘুরে।
তাই যখন মামাকে বাগে পাই আমাদের বিকেলের আড্ডাটা মামার রুমেই দিয়ে থাকি। অবশ্য মামা আমাদের যেসব কাহিনী বলেন, কিংবা নিন্দুকের ভাষায় যেসব 'গালগল্প' ঝাড়েন, তার সত্যি মিথ্যে যাচাইয়ে আমাদের উৎসাহ নেই।
আমাদের সবার এখন ছুটি। তাড়াতাড়ি বাড়ি ফেরার তাড়া নেই। মিন্টুদের চাকর এসে মাঝখানে চা-মুড়ি দিয়ে গেছে।
গল্প শোনার অতি উপযুক্ত পরিবেশ, তাই মামা নতুন গল্প শুরু করেছেন শুনে কেউ গাঁইগুঁই করল না।
'..সেবার খুলনা গিয়েছিলাম এক কাজে' মামা তার কাহিনী শুরু করলেন।
'তো কাজ শেষে ভাবলাম, এতে কাছে এসে ম্যানগ্রোভ বন না দেখে যাওয়াটা ঠিক হবে না। তাই একদিন এক এয়ারগান আর হ্যান্ডমাইকসহ বনের উদ্দেশে রওনা দিলাম। '
'হ্যান্ডমাইক?'
'হ্যাঁ, মানে যদি ধর দুর্ভাগ্যক্রমে বাঘের সামনে পড়েই যাই, তবে মাইকে মুখ ঠেকিয়ে ধমক-টমক দেওয়া যাবে' (মামা বাঁচাও বলে চিৎকারের জন্যই যে নিয়েছে, সেটা আমাদের বুঝতে বাকি থাকে না)।
'আর এয়ারগান দিয়ে তো লোকে পাখি মারে' আমরা বলি।
'এয়ার গান তো সাজ। বাঘ যাতে আমাকে দেখেই শিকারি ভেবে শিকার করা থেকে বিরত থাকে-এ জন্য আর কি!
তো প্রথমেই বনের পাশের এক গ্রামে ঢুকলাম। গ্রামের লোকদের মধ্যে বাঘ, হরিণ নিয়ে কোনো আগ্রহ দেখলাম না, বরং আমাকে দেখেই তাদের চোখে আগ্রহ ফুটে উঠল। এরা অধিকাংশ মৌয়াল।
বুড়ো মতন একজন এসে বললেন,
'কী বাবু, বাঘ শিকারে যাচ্ছ?'
আমি বললাম, 'না মানে এই একটু পরিদর্শনে যাচ্ছি। তা আপনাদের এখানে বাঘ-টাঘ আসে নাকি তেমন!'
বুড়ো নাক দিয়ে তাচ্ছিল্যের শব্দ করলেন, 'প্রতি রাতেই আসে, প্রতিদিন লোকালয়ে ঢুঁ মারা ওদের চাই বুঝলে!'
'তাই নাকি! লোকজনকে কামড়ে দেয় না?'
বুড়ো এবার তার লাঠি উঁচু করলেন, যেটাতে ভর দিয়ে উনি হাঁটেন,
'যত দিন এ লাঠি আছে আর ওটা আমার হাতে আছে তত দিন ব্যাটারাও সাহস করবে না। '
আমি লাঠিটা ভালো কর দেখি। বাঁশের কঞ্চির লাঠি। কিন্তু এ লাঠির কী মাহাত্ম্য, শুনে অবাক হই।
'এ লাঠির বাড়ি খায়নি, এমন বাঘ এ জঙ্গলে নেই' বুড়ো বলে চলে।
'এ লাঠির গন্ধ পেলেই বাঘ বাবাজীরা লেজ গুটিয়ে পালায়। '
শুনে আমি অবাক না হয়ে পারি না।
তারপর আরেকটু সামনে গিয়ে দেখি এক রাখাল ছেলে গরু চরাচ্ছে। এমন নির্জন স্থানে রাখাল ছেলেটা গরুগুলো চরাচ্ছে, অথচ সামান্য দূরেই বন, ছেলের সাহসের তারিফ করতে করতে ওর কাছে যাই।
'কিহে ছোকড়া, এখানে একলা গরু চরাচ্ছে, বাঘের ভয় নেই?'
ছেলেটা আমার দিকে সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকাল। তারপর বলল, 'বাঘরা তো গরু না। '
আমি অবাক হই, 'গরু নয় বলেই তো গুরুতর ব্যাপার!'
'না মিয়া কইছিলাম যে, বাঘরা এত গরু না যে ওই নাদুসনুদুস গরুগুলান ছাইড়া আমার পিছে লাগব। '
আমি বললাম, 'তা না হয় লাগবে না, আর তোমার মতন বস্তু ওর পেটে পড়লে নির্ঘাত ফুড পয়জনিং হবে তা বুঝতে পারছি। কিন্তু গরুর ক্ষতিও তো একটা ক্ষতি, না কি বল!'
'তার আর আমি কী করুম, বাঘ দ্যাখলেই চ্যাঁচাই, তয় প্রথোম প্রথোম লোকজন দৌড়াইয়া আইত, এহন আর আহে না।
'
'ও তারা বুঝি তোমাক মিথ্যাবাদী রাখাল ভেবেছে?'
'আসলে বাঘ আইলে যেই আমি চ্যাঁচাই, অমনি ওগুলা আমার চেঁচামেচিতে ভয় পাইয়া যেই না বনের মধ্য লুকায়, তা দেইখা আমরা ভীষণ হাসি পায়। আর লোকজন আইসা ভাবে আমি মনে হয় মশকরা করছি। '
রাখাল বালকের সঙ্গে বেশিক্ষণ কথা না বাড়িয়ে সামনে হাঁটা দিলাম।
মনের আনন্দে বনের মধ্যে ঘুরে ঘুরে দেখছি। বেশ অনেকক্ষণ যাওয়ার পরও কোনো বাঘ বাবাজীর দেখা মিলল না, ব্যাপারটা স্বস্তিকর হলেও মনের মধ্যে সামান্য আফসোস থেকে গিয়েছিল।
বাঘদের আবাসস্থলে এসেও তাদের আভাস না পাওয়া মেনে নেওয়া যায় না। তাই আরো গভীরবনে ঢুকে গেলাম। যা থাকে কপালে, বাঘ না দেখে আজ ফিরছি না-এই প্রতিজ্ঞা করলাম।
প্রতিজ্ঞার সঙ্গে সঙ্গেই আমার প্রতি আজ্ঞা হলো ব্যাঘ্র দর্শনের। কোথা থেকে এক বাঘ এসে লাফ দিয়ে আমার কোলে চড়ে বসল।
'কোলে চড়ে বসল!' আমরা সমস্বরে চেঁচিয়ে উঠি।
'হ্যাঁ, ওটা ছিল এক বাচ্চা বাঘ। গায়ে উজ্জ্বল হলুদ রং, সঙ্গে কালো ডোরাকাটা চিনতে মোটেও কষ্ট হলো না যে, বাঘ শাবক।
ব্যাপারটায় আমি কিছুটা ভড়কে গেলাম। বাচ্চা বাঘ, তার মানে মা বাঘ আছে নিশ্চয়ই আশপাশে।
আর ওটা এসে যদি দেখে আমার হাতে ওর বাচ্চা, ওটা নিশ্চয় আমাকে ছেড়ে কথা বলবে না! এমনকি কোনো কথাই হয়তো বলবে না, হালুম করে আমার গায়ে ঝাঁপিয়ে পড়বে বলেই মালুম হলো।
কিন্তু আমি যতই ওটাকে ছাড়াতে চাই, ততই যেন ওটা আমার জ্যাকেট আঁকড়ে ধরে। এমন সময় শুনলাম দুদ্দাড় বেগে বনজঙ্গল ভেঙে কিছু একটা আসছে আমার দিকে। আমরা জীবনের 'দ্য এন্ড' যে ঘোষিত হতে যাচ্ছে, তা বেশ বুঝলাম। নিয়তির দাঁড়া, কী আর করা।
যমালয় যাওয়ার জন্য তৈরি হলাম, এমনকি বাঘ শাবকটিকে মাথায় হাত বুলিয়ে সামান্য আদর করতেও ভুললাম না। 'এসেছে নতুন শিশু, তাকে ছেড়ে দিতে হবে স্থান' এ চির সত্য বিধান না মেনে উপায় নেই, এসব ভেবে মনটা খানিক শান্ত হলো। এমন সময়ই অশান্ত বেগে সেই সে গতিশীল আমার ঘাড়ে এসে পড়ল। '
'ঘাড়ে এসে পড়ল?' আমরা দ্বিতীয়বারের মতো সমস্বরে বলি।
'হ্যাঁ, আরেকটু হলেই আমার প্রাণবায়ু ভ্যাকুয়াম হয়ে যেত, লোকটার যা ওজন!'
'লোকটা মানে?' আমরা সপ্রশ্নক হই।
'হ্যাঁ, দেখলাম চুলদাড়ি জটাধারী এক বুড়ো মতন লোক। হাতে একখানা জাল আর অন্য হাতে ছোট এ খুপরি মতন। এসেই আমার হাত থেকে বাঘের বাচ্চাটা কেড়ে নিয়ে জালের ভেতর ভরে রাখল। '
'এতক্ষণে একটাকে পেলাম। ' লোকটা বলে।
আমি বললাম,
'এ বাঘের বাচ্চা বুঝি আপনার?'
লোকটা আমার দিকে সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকাল। 'তুমি কে হে ছোকড়া? বন বিভাগের কেউ নও তো? নাকি ফেরারি আসামি!'
আমি বললাম, 'না মানে, এই একটু ঘুরতে এসেছিলাম, হঠাৎ আপনার বাঘের বাচ্চাটা কোলে চড়ে বসল। '
'তাই নাকি, দেখি কাছে এসো তো। ' আমাকে শুঁকে বলল,
'হ্যাঁ, এ জন্যই তো। গায়ে তো মেছো ভূতের মতো গন্ধ খাঁটি আঁশটে গন্ধ।
কাঁচা মাছ-মাংস খাও নাকি?'
আমি বিনীতভাবে বললাম, 'জি না, তবে গন্ধের উৎস বোধহয় জানি, মাঝখানে এক মাছের ট্রলারে করে খানিকটা পথ এসেছিলাম, ট্রলারে বসার জায়গা ছিল না, মাছের স্তূপেই জেলেরা বসতে দিয়েছিল তো। '
শুনে তাকে চিন্তিত মনে হলো, 'তাহলে মনে হয়ে তোমাকে দিয়েই হবে। সব কয়টা বদমাশ সুযোগ পেয়ে ভেগেছে। শোন, সব কয়টাকে ধরে দিতে পারলে হাজার দুই টাকা করে তোমাকে দেব। বল রাজি।
'
এ গহিন বলে হঠাৎ এ অর্থ প্রাপ্তির দারুণ সম্ভাবনা আমাকে ভাবিত করল। আমি বললাম, 'ব্যাপারটা কী! কোনো মেজর ব্যাপার নাকি?'
তিনি বললেন, 'মেজর কী বলছ খোকা, একেবারে জেনারেল ব্যাপার। এমনকি গুরুত্বের দিক দিয়ে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ব্যাপারও বলা যায়। '
অগত্যা কী আর করা! এ গহিন বনে অমন দশাসই লোকের বিরুদ্ধে যাওয়া অপ্রাসঙ্গিক ও অযৌক্তিক মনে হয়। উপরন্তু টু পার থাউজেন্ড নামক কমিশনের কথাও শোনা গেল।
তাই কথা না বাড়িয়ে কাজে লেগে পড়লাম। আমার সাহায্য নিয়ে, অর্থাৎ আমাকে এ আকর্ষণীয় গন্ধে লালায়িত করে আরো খানচারেক বাঘের বাচ্চা উদ্ধার করা গেল। আর তিনিও তাদের ধরে ধরে জালে পুরলেন।
তারপর তার পিছু পিছু বনের ভেতর আরেকটু গিয়ে দেখি এক বড় তাঁবু টাঙানো। বুড়োর সঙ্গে তাঁবুতে গিয়ে দেখি সেখানে নানা আধুনিক শিকার যন্ত্র।
দোনলা বন্দুক থেকে শুরু করে আরো কত যন্ত্রপাতি তাতে ঠাসা। এক কোনায় এক রেডিও ট্রান্সমিটার। আমি তো একেবারে হাঁ হয়ে দাঁড়িয়ে আছি। তিনি সে হাঁ করা মুখে একখানা পাউরুটি গুঁজে দিয়ে বললেন,
'এবার এসো খানিক খাওয়া-দাওয়া করা যাক। '
খেতে খেতে তার সঙ্গে পরিচয় হয়।
তাঁর নাম লেফটেন্যান্ট কাকন্দ। সেনাবাহিনীতে সৈনিক হিসেবে ঢুকে লেফটেন্যান্ট হয়েছেন, আরো প্রমোশন হতো কিন্তু পায়ের বাতের ব্যথা বাড়াতে চাকরি ছেড়ে দেন। এখন শখ শিকার করা আর ঘুরে বেড়ানো, পেশাও তাই। তবে বর্তমানে এখানে আছেন অন্য উদ্দেশ্যে। এক বিদেশি পশু পাচারকারীদের সঙ্গে হঠাৎ তাঁর যোগাযোগ হয়েছে।
তাদের চারটি রয়েল বেঙ্গল টাইগার চাই, বাচ্চা হলেও আপত্তি নেই। সেই কারণেই এখানে ঘাঁটি গেড়েছেন, আজ রাতে তারা আসবে, তাদের কাছে মাল খালাস করেই তিনি আবার ফিরে যাবেন।
আমি বললাম, 'কিন্তু কাজটা তো ভালো হচ্ছে না, এমনিতেই দেশে বাঘের সংখ্যা কমে যাচ্ছে যখন, তখন কী এ কাজটা করা ঠিক হবে ? উপরন্তু ওগুলো জাতীয় পশু, তাই না। '
শুনে কাকন্দ এমন অট্টহাসি দিলেন যে আশপাশের গাছগাছালিতে বসে থাকা কয়েকটা বাঁদর আর কয়েকটা কাক ত্রাহি ত্রাহি ডাক ছেড়ে পালাল।
মিনিট দুয়েক হেসে চোখের পানি মুছে কাকন্দ আমাকে বললেন, 'নীতিবান হয়েছ না? আর চিড়িয়াখানায় আটকে নাস্তা না দিয়ে নাস্তানাবুদ করে রেখেছ সেদিকে খেয়াল নেই।
'
আমি আর কথা বাড়ালাম না, কারণ দেখলাম কাকন্দ তাঁর কোমরে একখানা পিস্তল গুঁজে রাখলেন। তারপর তিনি বাঘের বাচ্চাদের নিয়ে লাগলেন। তাঁবুর একপাশে সারি সারি খাঁচা। সেখানে ওগুলোকে ধরে ধরে রাখলেন। অগত্যা কী করা! রাত না হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষার পালা।
বনের ভেতর এমন জায়গা পেয়ে তাঁবুর ভেতর আমিও খানিকটা ঘুমিয়ে নিলাম। সন্ধ্যার দিকে যখন ঘুম ভাঙল তখন দেখি কাকন্দ বাঘের বাচ্চাগুলোকে ধরে ধরে কী যেন ওষুধ খাওয়াচ্ছেন। আমাকে জাগতে দেখে তিনি বললেন, 'এ ওষুধ আমার আবিষ্কার বুঝলে, এ বাচ্চাগুলো বড় চেঁচায়, এ জন্য এ ব্যবস্থা। এটি একবার পেটে পড়লে টানা ১২ ঘণ্টা ডাকাডাকি বন্ধ, গলা দিয়ে আওয়াজ বেরোবে না। আমি নিজেও এটা খেয়ে দেখেছি।
কী বিপদেই না পড়েছিলাম! বার বার ফোন করা সত্ত্বেও আমি কেন রিসিভ করছিলাম না গিনি্নর কাছে এই কৈফিয়ত দিতে দিতে আমার চুলের একপাশ পেকে গিয়েছিল। '
আমি লোকটার নিষ্ঠুরতায় অবাক না হয় পারলাম না। মহান জাতীয় পশুশাবকদের সঙ্গে নাকি এই ব্যবহার!
এরপর রাত গড়িয়ে যখন মধ্যরাত হলো তখন ট্রলারে করে একদল লোক এসে হাজির। তারা বাচ্চাগুলো দেখে শুনে দাম দিয়ে খাঁচাসমেত নিয়ে গেল। প্রতিটার দাম দিল দুলাখ টাকা করে।
দাম শুনে মনে হলো, কেন যে আমাদের কৃষকরা ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগল চাষ না করে ব্ল্যাক ইয়্যেলো বেঙ্গল টাইগার চাষ করেছেন না!
তারপর তাঁবুতেই রাতটা কাটালাম। সকালে কাকন্দ আমাকে ভাগের টাকা দিতে চাইলে আমি নিতে অসম্মতি জানালাম। কেন যেন মনে হচ্ছিল, টাকা নেওয়া মানেই হবে এদেশের বিরুদ্ধে এক মহা ষড়যন্ত্রে জড়িয়ে পড়া।
কাকন্দও দ্বিতীয়বার টাকা সাধলেন না। হেসে বললেন, 'বুঝতে পেরেছি তুমি অভিমান করেছ।
তোমার মতো দেশপ্রেমিকেরই প্রয়োজন এদেশের ক্রান্তিলগ্নে। '
চোরের মার বড় গলা আর কি!
'তবে তোমাকে আমি খালি হাতে ফিরিয়ে দেব না। ' এই বলে কাকন্দ আমার হাতে যা ধরিয়ে দিলেন তা হলো অপর একটি খাঁচা, বাঘের বাচ্চাসমেত।
'ওদের চারটি দরকার ছিল, একটা এক্সট্রা রয়ে গেল, নাও এটা তোমার। '
কাকন্দ মালপত্র গুছিয়ে পাশের খালে রাখা তাঁর ট্রলারে ওঠে পড়লেন।
আমি আর কী করব। খাঁচা হাতে দাঁড়িয়ে রইলাম। ট্রলার ছাড়ার আগ মুহূর্তে কাকন্দ আমার উদ্দেশে মুচকি হাসি দিয়ে চেঁচিয়ে বললেন,
'আমার ওষুধের কার্যকারিতা কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই শেষ হয়ে যাবে, তখন কিন্তু ওটা বেশ চেঁচামেচি করবে, টেক কেয়ার। '
এই বলে কাকন্দ আমাকে বনের মাঝে রেখে ভট ভট করে ট্রলার চালিয়ে চলে গেলেন।
আমি মনে মনে তবু সামান্য সান্ত্বনা পেলাম যে, একটি বাচ্চা তো বাঁচানো গেল।
সিদ্ধান্ত নিলাম, ভালো কোনো জায়গা দেখে ব্যাটাকে ছেড়ে দেব। ঠিকই ওটা আপনজন খুঁজে নেবে।
প্রায় আধঘণ্টা পর যখন ভালো একটা ঘন গাছগাছালিপূর্ণ গহিন বনে বাচ্চাটাকে ছাড়তে যাব, তখন একটা ব্যাপার ঘটল। '
'মা বাঘটা কি ফিরে এল?' হাবু জিজ্ঞেস করে।
মামা মাথা নাড়েন, 'উহু'।
'তবে কেউ কি ঘাড়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল। ' মিন্টু আশঙ্কা প্রকাশ করে।
'উহু তা নয়, বাঘের বাচ্চাটা হাত থেকে লাফ দিতে গিয়ে পড়ল গিয়ে পাশের খালের পানিতে। তারপর আমিও কুমিরের ভয় উপেক্ষা করে বাচ্চাটাকে পানি থেকে উদ্ধার করে যেই না ডাঙায় নিয়ে এলাম, অমনি ওটা আমার হাত চেটে দিয়ে ডেকে উঠল, 'মিয়াঁও'।
'মিয়াঁও?' আমরা সমস্বরে চেঁচালাম।
'হ্যাঁ, মিয়াঁও, তারপর দেখি আমার হাতে কাঁচা হলুদ রং লেগে আছে। আর ওর হলুদ ছোপের ভেতর থেকে সাদা সাদা লোম বেরিয়ে এসেছে। '
'তার মানে, ওটা বিড়াল' আমরা বলি।
'তাই তো, কাকন্দ সবাইকে বোকা বানিয়ে মওকা লুটে নিলেন। পরে বিড়ালটাকে বনের পাশের গ্রামটায় ছেড়ে দিয়ে পরদিনই ঢাকা এসে পৌঁছাই।
' মামার গল্প শেষ হলো।
'তবে আফসোস একটাই, মামা আবার বললেন, 'পুরো এক দিন এক রাত থেকেও আসল রয়েল বেঙ্গলের দেখা মিলল না, রয়েল বেঙ্গল মার্জারেই সাধ মেটাতে হলো। '
প্রকাশিত: দৈনিক কালের কন্ঠ এর সাপ্তাহিক ক্রোড়পত্র টুনটুন টিনটিন এর আজকের সংখ্যায় লিঙ্ক
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।