আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

কম্পমান পৃথিবীর ছায়া



কম্পমান পৃথিবীর ছায়া ফকির ইলিয়াস -------------------------------------------------------------- "কম্পমান পৃথিবীর ছায়া ধরে দাঁড়িয়ে আছো তুমি/ক্রমশঃ দেহ থেকে সরে যাচ্ছে তোমার মুখ, মুখমন্ডল/চোখের জ্যোতি; অন্ধ হয়ে যাচ্ছি আমিও ক্রমশঃ/তবে কী পৃথিবী হারিয়েছে আমাদেরকে গ্রহণের যোগ্যতা/তবে কী কালের দুষ্ট দূষণই আমাদের ভবিষ্যৎ ...." আজ থেকে প্রায় দুই দশকের বেশি সময় আগে এই পঙ্ক্তিগুলো যখন লিখি তখনও এভাবে ফ্ল্যাট প্রজন্ম গড়ে উঠেনি। গড়ে উঠেনি প্লট বাণিজ্যের অবিন্যস্ত পসরা। ছিল না মোবাইল ফোনের দাপট, কম্পিউটারের সহজলভ্যতা। আমাদের চারপাশে আরও খোলা বাতাস ছিল। ছিল প্রকৃতির অবারিত কৃপা।

তা এখন ক্রমশই সঙ্কুচিত হয়ে আসছে। দেশে-বিদেশে, সবখানেই। মানুষের ব্যস্ততা বাড়ছে। বাড়ছে তাড়না। ধনীরা আরও ধনকুবের হওয়ার সুযোগ পেলেও দরিদ্র শ্রেণী, সীমা অতিক্রম করে উঠে আসতে পারছে না।

কেউ কেউ কিছুটা স্বমিল খুঁজে, নিজে নিজে ধন্য হতে চাইছে। কারও হাতে ব্ল্যাকবেরি, আইফোন, সনি এরিকসন। কারও হাতে নেহায়েত একটি 'নকিয়া'। মোবাইল তো আমার হাতেও আছে ,তা-ই এখন পরম শান্তনা! এক ধরনের আত্মতৃপ্তি। বিদেশের সিংহভাগ মানুষ মোবাইলবিহীন জীবন ভাবতেও পারছে না এখন।

ব্লুটুথ লাগিয়ে পাশ দিয়ে যখন কেউ একা একা কথা বলে রাস্তায় চলে, তখন মনে করার কোন সুযোগ নেই, লোকটি প্রলাপ বকছে। কারণ হ্যান্ডসেট ফ্রি, আনমনে হেঁটে হেঁটে কথা বলছে। ব্রাউজ করে দেখে নিচ্ছে দূরান্তের ছবিও। এটা বর্তমান সভ্যতার স্বরূপ। কিন্তু এই স্বরূপের বাস্তবতাকে প্রকৃতি কতটা সাহায্য করছে? এই সাহায্য পেতে মানুষের করণীয় কী? এই প্রশ্নটি গোটা বিশ্বে আবারও উত্থাপিত হচ্ছে।

আবারও ভাবতে হচ্ছে, মানুষ প্রকৃতির সঙ্গে লড়াই করে কীভাবে টিকে থাকবে। কীভাবে এগিয়ে নেবে প্রজন্মের পথ। কোপেনহেগেনে বিশ্ব পরিবেশ সম্মেলনটি শেষ হয়েছে নানা আশা-দূরাশার দোলাচলের মধ্য দিয়ে। তা নিয়ে কথা হচ্ছে পক্ষে-বিপক্ষে। এই কথার তপ্ততা শেষ হতে না হতেই হাইতিতে ঘটে গেছে ইতিহাসের নির্মমতম ভূমিকম্প।

এই ভূমিকম্পে প্রায় পঞ্চাশ লাখ প্রাণহানির আশঙ্কা করা হচ্ছে। উদ্ধার কাজ শেষ হতে কয়েক মাস সময় লেগে যেতে পারে। আর দেশটির পুনঃনির্মাণে লাগতে পারে কয়েক বছর। মানুষের প্রতি প্রকৃতির এই বৈরী আচরণ অত্যন্তই বেদনাদায়ক। কারণ নির্বোধ শিশু থেকে নির্বাক বৃদ্ধ- সবাইকেই হরণ করেছে এই ভূমিকম্প।

এ থেকে মানুষ কী শিখতে পারে? কী করণীয় আছে তাদের? সে প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে একটি ঘটনা বলি। হাইতিতে এই ভয়াবহ ভূমিকম্পের ঘটনাকে পুঁজি করে রীতিমতো অমানবিক বাণিজ্যে উঠেপড়ে লেগেছে একটি মহল। এরা মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করে হাতিয়ে নিতে চাইছে লাখ লাখ ডলার। পত্র-পত্রিকায় ভুয়া বিজ্ঞাপন, ওয়েবসাইটে প্রচারণা, ব্যক্তিগত ফোনকল কিছুই তারা বাকি রাখছে না। যুক্তরাষ্ট্রে এসব প্রতারক চক্র গড়ে উঠেছে রাতারাতি।

ইউরোপের অন্যান্য দেশেও এমন চক্র বেড়ে ওঠার খবর প্রকাশিত হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী এবিসি টিভি চ্যানেল তা নিয়ে সচিত্র প্রতিবেদন প্রচার করেছে। গেল ক'সপ্তাহে ব্যক্তিগতভাবে আমি দশটির মতো ফোনকল পেয়েছি। 'চ্যারিটি গিল্ড অফ আমেরিকা' নামধারী একটি সংস্থার পক্ষ থেকে আমাকে ফোন করার পর আমি বললাম, 'আমি কি তোমাদের ট্যাক্স আইডি নম্বরটি পেতে পারি?' অপরপ্রান্ত থেকে মহিলা হেসে দিলেন। বললেন- 'তুমি বেশি জানো' (ইউ নো টু মাচ)।

বলেই আমার মুখের উপর ফোন লাইনটা কেটে দিলেন। কিছুটা রাগ হলো আমার। কলার আইডি দেখে ফোন করলাম। মেশিনে বেজে উঠল 'ইওর কল ক্যান নট বি রিচড....'। এরা সবই প্রতারক।

প্রতারকদেরকে চিনতে 'টু মাচ' জানতে হয় না। যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিটি নন প্রফিট অর্গানাইজেশন, আয়কর বিভাগ, সিটি সরকারের কাছে নিবন্ধনকৃত। রয়েছে ফেডারেল সরকারের তদারকিও। তাই ভুয়া চাঁদা কিংবা ডোনেশন আদায় সহজ কাজ নয়। তারপরও যে চুরি-চামারি হচ্ছে না, তা আমি বলছি না।

হচ্ছে। কিন্তু সরকারি সংস্থাগুলোও এদের ধরতে চালিয়ে যাচ্ছে নানা তৎপরতা। সাঁড়াশি অভিযান। ফলে সেসব অবৈধ কর্মতৎপরতা সরকারি মদদ পাচ্ছে না। আর সচেতন মানুষজন তো রয়েছেই।

যারা এর প্রতিবাদ করছে। প্রয়োজনে প্রতিরোধ গড়ে তুলছে। রয়েছে মিডিয়াগুলোর সাহসী ভূমিকা। প্রাকৃতিক দুর্যোগ, পরিবেশ বিপন্নতা বর্তমান বিশ্বের একটি চরম সঙ্কট। যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া, সাউথ ক্যারোলিনা, নর্থ ক্যারোলিনা, অরিজোনা, লুজিয়ানা, ফ্লোরিডা প্রভৃতি অঙ্গরাজ্যে বিভিন্ন সময়ে ভয়াবহ দুর্যোগের ঘটনা আমরা দেখেছি।

আগ্নেয়গিরির লেলিহান শিখা প্রায়ই পুড়িয়ে দেয় ক্যালিফোর্নিয়ার জমি-বৃক্ষ-গাছগাছালি। তা রোধের উপায় যে যুক্তরাষ্ট্র সরকার খুঁজছে না, তা নয়। তারা চেষ্টা করেই যাচ্ছে। চলছে নানা গবেষণা। মোট কথা মানুষকে প্রকৃতির সঙ্গে লড়াই করেই বাঁচতে হবে।

রক্ষা করতে হবে প্রাকৃতিক ভারসাম্য। এই যে, প্রকৃতির সঙ্গে সংগ্রাম, তা করার জন্য বাংলাদেশ কতটা প্রস্তুত? এই প্রশ্নটি আসছে খুব সঙ্গত কারণে। কোপেনহেগেন পরিবেশ সামিটে বাংলাদেশ বলেছে, আমরা ভুক্তভোগী-ক্ষতিগ্রস্ত দেশ। কিন্তু এটাই তো শেষ কথা নয়। দুই. ভূমিকম্পের দিক দিয়ে বাংলাদেশ একটি ঝুঁকিপূর্ণ দেশ।

একথা সব বিশেষজ্ঞই বলছেন সমস্বরে। কিন্তু বাংলাদেশ, এই ২০১০ সালে তা মোকাবেলার জন্য কতটা প্রস্তুত? বাংলাদেশে প্রথম ও প্রধান সমস্যাটি হচ্ছে, অপরিকল্পিত নগরায়ন। এর কারণে যত্রতত্র গড়ে উঠছে ইমারত। বৃক্ষ নিধনও হচ্ছে বিভিন্ন প্রভাবশালী মহলের ছত্রছায়ায়। একটি বড় ধরনের বহুতল ভবন হবে, আর তাতে পর্যাপ্ত পরিমাণ অগ্নিপ্রতিরোধক ব্যবস্থা থাকবে না- তা কী মানা যায়? লেখার শুরুতেই আমি ফ্ল্যাটপ্রজন্মের কথা বলেছি।

এই প্রজন্ম বড় হচ্ছে, তারা কী তাদের প্রাপ্য প্রাকৃতিক বিনোদনটুকু পাচ্ছে? না, পাচ্ছে না। বরং মাথা গোঁজার ঠিকানাই হয়ে উঠছে এখন আরাধ্য বিষয়। যারা ধনকুবের, যারা বহু রঙবিশিষ্ট বাংলা বাড়ি বানাবার জন্য বিভোর তারাও নিরাপদ না। কারণ তার প্রতিবেশ দূষিত হচ্ছে আবর্জনায়। 'পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ঈমানের অঙ্গ'-এমন আপ্তবাক্যটিকেও চরমভাবে অপমান করছে একশ্রেণীর মানুষ।

সংবাদ মাধ্যমে, বাংলাদেশের এখন একটি অন্যতম খবর 'ভূমিখেকোদের দৌরাত্ম্য'। এরা কারা, কী তাদের পরিচয়? দেশের ভূমিমন্ত্রী যখন বলেন, ভূমিখেকোদের শিকড় বড় বেশি শক্ত, তখন সাধারণ মানুষের আর কোন ভরসাই থাকে না। দেশের বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের সচিব যখন বলেন, সরকারি বনাঞ্চল দখলদাররা দখল করে নিয়েছে, তখন আমাদের লজ্জায় মুখ ঢাকতে হয়। এসব তো প্রকৃতির পরিহাস নয়। এগুলো হচ্ছে-মানব শক্তি নির্মিত অপপ্রয়াস।

সমাজ, প্রজন্মকে ধ্বংস করে দেয়ার অপচেষ্টা। বাংলাদেশের বিভিন্ন স্যাটেলাইট চ্যানেল, নদী দখলের ওপর ইতোমধ্যে সচিত্র প্রতিবেদন দেখিয়েছে। বিস্তর লেখালেখি হয়েছে নানা মিডিয়ায়। তারপরও এসব ভূমিখেকো দখলদার, বৃক্ষনিধনকারী, দুষ্টুচক্র নানাভাবে সরকারি মদদ পাওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশে যে সব নতুন বহুতল ভবন নির্মাণ করা হচ্ছে, তারা রাষ্ট্রীয় ধারা অনুযায়ী 'বিল্ডিং কোড' মানছে কী না, সে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে।

এরা একটিবারও ভাবছে না, এই অপরিকল্পিত নির্মাণ স্থাপনা একদিন তাদের মাথার উপরই ভেঙে পড়তে পারে। এরা তাৎক্ষণিক সুবিধাদিকে, মুনাফার লুটপাটতন্ত্রকে ধারণ করছে। স্থায়ী পরিশুদ্ধ পরিকল্পনাকে ধারণ করছে না। ভূমিকম্পসহ সব প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলায় সরকার ও জনগণ প্রতিটি শক্তিকেই সচেতন হতে হবে। কয়েক কোটি মানুষের জীবন ধারণকারী শহর ঢাকায় পর্যাপ্ত পরিমাণ ফায়ার ব্রিগেড স্টেশন এবং ফায়ার ফোর্স নেই-তা ভাবতেও কষ্ট হয়।

এই মানসিকতা নিয়ে তো 'ডিজিটাল বাংলাদেশ' এর স্বপ্ন আমরা দেখতে পারি না। গ্লোবাল ওয়ার্মিং থেকে কারোরই সহজে রক্ষা পাওয়ার কোন সুযোগ নেই। তাই শক্ত প্রস্তুতি নিতে হবে। বাংলাদেশের প্রতিটি উপজেলা পর্যায়ে শক্তিশালী ফায়ার ব্রিগেড স্টেশন স্থাপনে সরকারকে গুরুত্ব দেয়া উচিত। বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনীর যে সুনাম রয়েছে, তাকে আরও পরিপূর্ণ করতে 'তাৎক্ষণিক সাহায্য টিম' গড়ে তুলতে হবে তাদের মধ্য থেকেই।

যেভাবে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে স্পেশাল উদ্ধারকারী টিম থাকে। পৃথিবী কাঁপছে। আমরা এর মুখোমুখি দাঁড়িয়েই করছি সব জৈবিক লেনাদেনা। তাই সব প্রতিকূলতাকে ডিঙিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি আমাদের থাকতেই হবে। নিউইয়র্ক ২৭ জানুয়ারি, ২০১০।

----------------------------------------------------------------------- দৈনিক সংবাদ । ঢাকা। ২৯ জানুয়ারি ২০১০ শুক্রবার প্রকাশিত ছবি- এন্ডি অন

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।