অলসদের দিয়ে কী আর হয়। আলসেমি ছাড়া!
[আমার অনেক লেখা পল্লবের চাপে লেখা হয়। এই লেখাটিও তাই। ২০০৭ সালে প্রথম আলোর প্রজন্ম ডট কমে ছাপা হয়েছে। কম্পিউটার ও ভাষা সংক্রান্ত লেখাগুলো পড়তে গিয়ে মনে হল এখানে সেটি ব্যতিক্রম হবে না]
‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই'-ভাষা আন্দোলনের এই স্লোগানই কালক্রমে ‘বাংলাভাষার রাষ্ট্র চাই'-এ পরিণত হয়| কারণ আমরা বুঝেছিলাম ভাষার স্বাতন্ত্র্য ও স্বাধীনতা সমার্থক| ভাষা মানে কেবল মুখের ভাষা নয়, এ হলো একটি জাতির সংস্কৃতি, কৃষ্টি-তার স্বাতন্ত্র্যের একটি রূপ| বাংলা ভাষাকে বাদ দিয়ে তাই বাংলাদেশের কথা ভাবাটা বাতুলতা|
গেল শতকে ভৌগোলিক জাতীয়তাবাদের যে উন্মেষ, চলতি শতকে সেটি বিশ্বায়ন আর ইন্টারনেটের খপ্পরে পড়েছে| এটি শুরু হয়েছে উনিশ শতকের আশির দশকে যখন পার্সোনাল কম্পিউটার সত্যিকারের ‘পার্সোনাল' হয়ে উঠতে শুরু করে| পরবর্তী এক দশকে আবির্ভূত হয় ইন্টারনেট| ফলাফল দেশ-জাতি-ভাষার ভৌগোলিক কাঠামোর বাইরে একটি "ভার্চুয়াল" জগতের উত্থান| কম্পিউটার আসার সঙ্গে সঙ্গে আমরা বুঝেছি আমাদের ভাষার লড়াই শুরু হয়েছে আরেকবার| কারণ শুরু থেকে কম্পিউটার হলো ‘ইংরেজি জানা'দের জন্য, এর সবই ইংরেজি ভাষায়| চট করে আমাদের মাথায় এল ভাষাকে বাঁচানোর নতুন স্লোগান-কম্পিউটারে বাংলা চাই| বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে এ কর্মকাণ্ডের একটা ছোট পার্থক্য ছিল| কেননা এই আন্দোলনের অনেকখানি আমাদের পক্ষে করে ফেলা সম্ভব ছিল| যেমন কম্পিউটারে যেন আমার ভাষার বর্ণমালাকে দেখা বা পড়া যায়, সে জন্য ফন্ট বানিয়ে ফেলা, কম্পিউটার যেন ক, খ, গ, ঘ ‘বুঝতে' পারে, সে জন্য কোডিং (প্রোগ্রামিং সংকেত) ব্যবস্থায় একে সমন্বিত করা ইত্যাদি| এসবই কম-বেশি আশির দশকেই হয়ে যায়| সে সময়কার অ্যাপল ও আইবিএম-এই দুই ঘরানার কম্পিউটারে বাংলা ব্যবহারে সফলতা আসে|
‘কম্পিউটারে বাংলা চাই' ব্যাপারটা তাই দ্রুত একটা সফল হয়ে যায়| তবে এর পরপরই আমরা বুঝতে পারি ‘ইংরেজির ওপর বাংলাকে চড়িয়ে' দিয়ে কম্পিউটারে যে বাংলা আমরা পেয়েছি সেটা যথেষ্ট নয়| আমাদের ‘কম্পিউটারে বাংলা' শুধু চাই না, আমরা ‘বাংলায় কম্পিউটার' চাই!
প্রোগ্রামিং সংকেত ঘরানা
আসকি থেকে ইউনিকোড
প্রথমেই বোঝা গেল কম্পিউটারের ভাষা বাংলা বা ইংরেজি নয়| সেটি কেবল বুঝতে পারে বিদ্যুতের উপস্থিতি (১) বা অনুপস্থিতি (০)| অর্থাত শূন্য-একের নানা বিন্যাস ঘটিয়ে কম্পিউটারকে নির্দেশ দিতে হয়| যেহেতু আমেরিকানরা এ কাজে অগ্রণী ছিল এবং তারা ইংরেজিতে কথা বলত, কাজেই তারা কোন অক্ষরকে কোন বিন্যাসে বোঝাবে সেটির একটা মানচিত্র করে ফেলল| এর নাম দেওয়া হলো ‘আমেরিকান স্ট্যান্ডার্ড কোড অব ইনফরমেশন ইন্টারবেঞ্চ (এএসসিআইআই)' বা আসকি|এতে মোট ২৫৬টি বিন্যাস সম্ভব ছিল| যার অনেকগুলোই ছিল ফাঁকা| বিশ্বের অন্য ভাষাভাষীরা এই ফাঁকা অংশগুলোকে কাজে লাগিয়ে নিজেদের মান বানানো শুরু করল| যেমন ভারত বানাল আইএসসিআইআই বা ইসকি| ভারতীয়রা যখন ফন্ট বা কি-বোর্ডের চালক সফটওয়্যার (ড্রাইভার) লেখা শুরু করল তখন তারা এটি ব্যবহার করল| ফলে দেশে একটি মান বজায় থাকল এবং তারা সঠিক পথে এগোতে থাকল| ঠিক এ জায়গায় আমরা প্রথম ভুলটা করেছি| আসকি থেকে বাসকি (বাংলাদেশের আসকি) বানানোর দায়িত্ব ছিল বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিলের| কিন্তু তারা সেটি করেনি| ফলে আমাদের কোনো বাসকি হলো না, কিন্তু ফন্ট, কি-বোর্ড এগুলো হয়ে গেল! যাঁরা তৈরি করলেন, তাঁরা প্রত্যেকে নিজেদের মতো করে হায়ার আসকি সংকেতগুলোকে সাজিয়ে নিলেন| ফলাফল হলো আমার কম্পিউটারে লেখা বাংলা চিঠি আপনার কম্পিউটারে লেখা বা পড়া যায় না! একেবারে ‘ইনকম্প্যটিবল'!
এ ছাড়া আসকির ২৫৬ বিন্যাসে সর্বোচ্চ দুটি ভাষাকে একত্র করা সম্ভব| ফলে বহুভাষী কম্পিউটার দুর্লভ হতে পারে| এ বিবেচনায় পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষাভাষী লোক (এখন আর কেবল ‘ইংরেজি জানা' একমাত্র কম্পিউটার নয়) মিলে তৈরি করে ফেলল ইউনিকোড কনসোর্টিয়াম| তৈরি হলো প্রায় ৬৫ হাজার বিন্যাসের সাংকেতিক ব্যবস্থা| বিশ্বের জানা সব ভাষাকেই সেখানে রাখার সুযোগ হলো| আমরাও পেয়ে গেলাম এমন ব্যবস্থা যেখানে আমার ‘ক' আর আপনার ‘ক'কে কম্পিউটার একইভাবে বুঝতে পারে|
উন্মুক্ত অপারেটিং সিস্টেম
সংকেতের ঝামেলার পাশাপাশি আমরা এবং বিশ্বের অনেক দেশ আরও একটি সত্যের মুখোমুখি হলাম| ‘বাংলায় কম্পিউটার চাই'-এ কথাটির সাদামাটা অর্থ হলো একটি বাংলা অপারেটিং সিস্টেম| কিন্তু আমরা জানলাম বিশ্বের অন্যতম জনপ্রিয় অপারেটিং সিস্টেম উইন্ডোজের নির্মাতা মাইক্রোসফট করপোরেশন এবং তারা যদি দয়া করে সেটি বাংলা না করে তবে আমাদের বাংলা কম্পিউটারের কোনো সুযোগ নেই| সেই থেকে আমাদের একটি বড় অংশ মাইক্রোসফটের কাছে ধরনা দিয়ে বেড়াচ্ছে|
তরুণদের একটি দল সহসা আবিষ্কার করেন উইন্ডোজেরও বিকল্প আছে এবং সবচেয়ে বড় কথা সে বিকল্প ব্যবস্থার মালিক আমরা সবাই!
১৯৯০ সালে রিচার্ড স্টলম্যান নামে এক আমেরিকান রাগী যুবক উন্মুক্ত সোর্স কোডভিত্তিক (ওপেন সোর্স) সফটওয়্যার আন্দোলনের সূচনা করেন| সে আন্দোলনের ফলে সৃষ্টি হয় লিনাক্স নামের মুক্ত এক অপারেটিং সিস্টেম| এর প্রোগ্রামিংসংকেত সবার জন্য উন্মুক্ত| যে কেউ এর উন্নয়নেও কাজ করতে পারে| ফলে বিশ্বব্যাপী লাখ লাখ স্বেচ্ছাসেবীর শ্রমে গড়ে উঠেছে এই অপারেটিং সিস্টেম লিনাক্স|
লিনাক্স বা সে রকম উন্মুক্ত দর্শনের সফটওয়্যারগুলোকে এমনভাবে বানানো হয় যাতে বিশ্বের যেকোনো ভাষায় এগুলোকে রূপান্তর করা যায়| কয়েকটি ভাগে এ সফটওয়্যার কাজ করে এবং নির্দিষ্ট নিয়ম মেনে এগুলোকে নিজের ভাষায় রূপান্তর করে ফেলা যায়| সবচেয়ে আনন্দের বিষয় এ জন্য কোনো ধনবান লোকের কাছে আত্মা বিলিয়ে দিয়ে ধরনা দিতে হয় না! তানিম আহমেদ (বর্তমানে প্রবাসী) নামে আমাদেরই এক তরুণ তাঁর সতীর্থদের নিয়ে লিনাক্সের বাংলা করার কাজটি শুরু করেন| বাংলাদেশের তরুণদের সঙ্গে যুক্ত হয় ভারতের বাংলাভাষী তরুণেরা|
২০০৪ সালে ‘বাংলায় কম্পিউটার চাই'-এর প্রথম স্বপ্ন আমাদের পূরণ হয়| বাজারে আসে লিনাক্স অপারেটিং সিস্টেমের প্রথম বাংলা সংস্করণ ‘অঙ্কুর'| সেটি প্রকাশিত হয় ইন্টারনেটে|
তার পর থেকে ধারাবাহিকভাবে ইন্টারনেটে ‘আরও উন্নত' বাংলা লিনাক্স প্রকাশিত হচ্ছে| ঢাকায় ২০০৫ সালের সফটওয়্যার মেলায় প্রথম সিডি আকারে এটি প্রকাশিত হয়| আনন্দের আরও একটি বিষয় হলো, যেহেতু মুক্ত সফটওয়্যার দর্শনে এগুলো প্রকাশিত হয়, কাজেই লিনাক্সের বেশির ভাগ সংস্করণে বাংলা ঢুকে পড়ে অনায়াসে| কাজেই লিনাক্সের যেকোনো সংস্করণ-যেমন ফেডোরা, রেড হ্যাট, ডেবিয়ান বা হালের উবুন্টু-সবটাতেই এখন রয়েছে আমাদের ভাষা| চলতি বছরের অমর একুশের গ্রন্থমেলায় বাংলাদেশ ওপেন সোর্স নেটওয়ার্ক বিতরণ শুরু করে ‘উবুন্টু'র এবং সিসটেক প্রকাশনী বিতরণ শুরু করেছে অঙ্কুরের ‘শ্রাবণী'র দুটি বাংলা অপারেটিং সিস্টেম|
বলাবাহুল্য, এ দুটি অপারেটিং সিস্টেমে বাংলা করার কাজ এখনো শেষ হয়নি| এই বিশাল কর্মযজ্ঞের সবটুকুই করা হচ্ছে স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে| নেপাল, ভারত, কম্বোডিয়া বা আফ্রিকার দেশগুলোয় এ কাজগুলো করা হচ্ছে রাষ্ট্রীয়ভাবে বড় কোনো প্রকল্পের আওতায়| বাংলায় কম্পিউটার চাই মানে কেবল অপারেটিং সিস্টেম নয়| আমরা চাই চিঠিপত্র লেখা, হিসাব করা, তথ্যভাণ্ডার গড়ে তোলা, ই-মেইল আদান-প্রদান করা| এসবের সমাধানও হচ্ছে উন্মুক্ত সোর্স কোডভিত্তিক সফটওয়্যারের মাধ্যমে| এরই মধ্যে বাংলায় সাজানোর কাজটি অনেকাংশে সম্পন্ন হয়েছে ওপেন অফিস (অফিসের কাজের জন্য গুচ্ছ সফটওয়্যার), মজিলা ফায়ার বক্স (ওয়েবসাইট দেখার সফটওয়্যার), থান্ডারবার্ড (ই-মেইল), গেইম (বার্তা আদান-প্রদান), জুমলা (বিষয় ব্যবস্থাপনা) ইত্যাদি সফটওয়্যারের কাজ| তবে সবক্ষেত্রেই আরও কিছু কাজ বাকি রয়েছে|
ইন্টারনেট-দ্বিতীয় দুনিয়ায়
কেবল কম্পিউটার চালালে হবে না, আমাদের ভাষা, আমাদের জ্ঞান এবং আমাদের কৃষ্টিকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে সাইবার দুনিয়ায়-ইন্টারনেটে| ইউনিকোডের কারণে এ কাজটি এখন সহজ| দেশের অধিকাংশ সংবাদমাধ্যম এখন ইন্টারনেট সংস্করণ প্রকাশ করে বাংলায়| পাশাপাশি আমাদের তরুণেরা গড়ে তুলছে ইন্টারনেটে বাংলাভাষার সবচেয়ে বড় বিশ্বকোষউইকিপিডিয়ার বাংলা সংস্করণ| বিশ্বের প্রায় ২০০টির বেশি ভাষায় উইকিপিডিয়া প্রকাশিত| বাংলাভাষায় এর রয়েছে ১৫ হাজারেরও বেশি নিবন্ধ| সংখ্যার হিসাবে এর অবস্থান এখন ৪৪তম| বাংলাদেশ ওপেন সোর্স নেটওয়ার্কের (http://www.bdosn.org/) অঙ্গসংগঠন বাংলা উইকি এ কাজে নেতৃত্ব দিচ্ছে| কাজ করছে দেশে-বিদেশে প্রায় পাঁচ শতাধিক বাংলা উইকিপিডিয়ান| বাংলা উইকিপিডিয়ার পাশাপাশি ইন্টারনেটে আমাদের ভাষাকে তুলে ধরার জন্য চেষ্টা করছে নানা সংগঠন| গড়ে উঠছে বাংলা ওয়েবসাইট, সার্চ ইঞ্জিন ও বাংলা ব্লগ| বাংলা ব্লগের ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে ‘সামহোয়্যারইন•••'-এর সদস্যরা|
এ এক চিরন্তন লড়াই
ভাষা কিংবা জাতীয় স্বাধীনতাকে রক্ষা করা এক চিরন্তন সংগ্রাম| বারবার এর প্রেক্ষাপট পাল্টে যায়, কিন্তু মূল লড়াই একই থাকে| ইংরেজিনির্ভর তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) আমাদের ভৌগোলিক স্বাধীনতাকে অর্থবহ করবে না ৯৫ শতাংশ ‘ইংরেজি না জানা' জনগোষ্ঠীর কাছে! তাদের সরিয়ে রাখবে তথ্যপ্রযুক্তির সুফল থেকে| কাজেই ‘বাংলায় কম্পিউটার চাই'-এর এ আন্দোলনকে নিয়ে যেতে হবে তৃণমূলে| এ জন্য কারও কোনো কৃপা, করুণা, নিদেনপক্ষে অনুমতি কিছুই আপনার লাগবে না| কারণ এর সবই উন্মুক্ত| সবার জন্য উন্মুক্ত|
[এ প্রতিবেদনে স্বত্বাধিকারী সফটওয়্যারভিত্তিক বাংলা কম্পিউটারের বিষয়টিকে বর্ণনা করা হয়নি কারণ তা এর পরিধি নয়| স্বত্বাধিকারী সফটওয়্যারে বাংলা নিয়ে যাঁরা কাজ করছেন তাঁদের জানাই আমাদের অভিনন্দন]
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।