হিন্দু না ওরা মুসলিম ঐ জিজ্ঞাসে কোনজন, কান্ডারি বলো ডুবিছে মানুষ সন্তান মোর মা'র
নয়া উপনিবেশী বাস্তবতা
বুঝি বা না বুঝি, মানি বা না মানি, আমাদের, এই বাঙলা অঞ্চলের মানুষের বাস্তবতা এক নির্মম নয়া উপনিবেশী বাস্তবতা। আমাদের আনন্দ, বোধ, নন্দনচিন্তা, নৈতিকতায় গর্বিত স্বাতন্ত্র নেই, নেই এগিয়ে যাবার উপযোগিতা, আছে শুধু উপনিবেশিক দাসত্তের মূঢ়তা। “সাদা” এখন আমাদের ভাষায় ‘সুন্দর”এর প্রতিশব্দ, কিভাবে আরো সাদা হতে হবে তার বিজ্ঞাপন দেখে কসমেটিক্সের বাজারে এখন শুধু নারীরাই না, পুরুষও ভির জমায়, ঘরে-বাইরে-বনে-বাদারে-অফিস-আদালতে সবখানেই আচারে-চলনে-বলনে সাদা প্রভুর মতো হয়ে ওঠার চেষ্টা। এ অনুকরণ যে যত ভালো ভাবে করতে পারে, সেই ক্ষমতা আর সম্ভ্রমের কাতারে ততো ওপরে। গোটা জাতিই এক মনোবৈকল্য, জাতিগত ইনফেরিওরিটি কমপ্লেক্স, হিনমন্যতায় আক্রান্ত।
বাঙালি হওয়া যেনো এক অপরাধ। এমনকি আমাদের মুক্তচিন্তা আর বুদ্ধিবৃত্তির জগৎও এই দাসত্ত্ব মুক্ত না। আমার এই লেখার মান অনেক বাড়ে যখন এখানে পাশ্চাত্যের দার্শনিকদের নাম থাকে, “আধুনিকতা” আর “উত্তর আধুনিকতা” নামক পাশ্চাত্য ধারণার আলোচনা থাকে। “নয়া উপনিবেশী বাস্তবতা” আমাদের একজন বুদ্ধিজীবীকে সম্পূর্ণভাবে বিচ্ছিন্ন করে সাধারণ জনতার কাতার থেকে। একেবারেই সাধারণ কিছু উদাহরণ দেয়া যাক।
“আমেরিকা খারাপ, আমেরিকার ক্ষমতা খারাপ, আমেরিকা আমাদের জন্য ভালোনা, মার্কিণ সাম্রাজ্যবাদ আমাদের শত্রু ” এই সব কথা এদেশের একটা ধারণ খেটে খাওয়া বিদ্যালয়ের বিদ্যাহীন মানুষও বোঝে। তাকে যদি জিজ্ঞাসা করা হয়, কেনো আমেরিকা এইরকম, তার উত্তর হবে “আমেরিকার ক্ষমতা বেশি, ক্ষমতালিপ্সু, আমেরিকা অন্যদের ওপর প্রভুত্ত্ব করতে চায়, আমেরিকা সারা দুনিয়া শাসন করতে চায়” এইরকম কিছু কথা। তার কথার সীমাবদ্ধতা আছে, অর্থনীতির বিষয়টা নাই, পুজিবাদের বিশ্লেষন নাই, কর্পোরেট বিশ্ববিক্ষার ধারণা হয়তো তার নাই, কিন্তু আমেরিকা সম্বন্ধে তার এই বিশ্লেষন আমেরিকার সাম্রাজ্যবাদি অবস্থানের কিছু সত্য কারণও কিন্তু নির্দেশ করে, ক্ষমতাবানের অন্যের ওপর কর্তৃত্ব করার চীরকালিন বোধের কথা সে জানে। অন্যদিকে আমাদের প্রচলিত বুদ্ধিবৃত্তি চর্চার জগতে সাম্রাজ্যবাদের পুজিবাদী উৎস খুঁজতে গিয়ে, সাম্রাজ্যবাদের অপেক্ষাকৃত তাত্ত্বিক ব্যাখ্যাও যে শেষ পর্যন্ত একটা খন্ডিত ধারণায় পরিণত হয়, আমরা অনেকেই তা বুঝিনা। সাম্রাজ্যবাদের শুধু অর্থনৈতিক কারণ খুঁজতে গিয়ে এর মানবিক কারণটাই আমরা খুঁজে পাই না।
এতে দুইটা সমস্যা তৈরি হয়। প্রথমত, আমাদের নিজেদের ধারণাটাই হয় খন্ডিত, অসম্পূর্ণ, আবার সাম্রাজ্যবাদ কেনো খারাপ সেটা বোঝাতে গিয়ে যখন আমরা দ্বান্দিক বস্তুবাদি কায়দায় পৃথিবীর ইতিহাস, অর্থনীতি, পুঁজিবাদ এইসব বোঝানো শুরু করি তখন এইসব বুদ্ধিবৃত্তিক আলোচন সাধারণ মানুষের মাথার উপর দিয়েই চলে যায়। সাম্রাজ্যবাদ যে খারাপ এটা মানুষ জানে, সাম্রাজ্যবাদ কিভাবে কাজ করে তাকে কিভাবে মোকাবেলা করতে হবে সেটা বোঝানোই বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আর এইকাজে এদেশের প্রগতিশীল বামপন্থিদের চেয়ে অনেক এগিয়ে গেছে এখন সাম্প্রদায়িক মৌলবাদিরা। “আমেরিকা ইসলামের শত্রু, সাম্রাজ্যবাদ ইসলামের শত্রু, সাম্রাজ্যবাদ মুসলমানদের দাস বানিয়ে রাখতে চায়, ধ্বংস করতে চায়, আমেরিকার বিরুদ্ধে জিহাদে নামতে হবে” এইসব বক্তব্যের সাথে একজন সাধারণ মানুষ নিজেকে যেভাবে সম্পর্কিত করতে পারে তার সাথে “পুঁজিবাদের সর্বোচ্চ বিকাশ সাম্রাজ্যবাদ, সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নামতে হলে পুঁজিবাদ বুঝতে হবে, পুঁজিবাদ বুঝতে হলে ঐতিহাসিক বস্তুবাদ বুঝতে হবে” এহেন ইউরোপিয় কায়দার সাম্রাজ্যবাদ বিশ্লেষনের সাথে সেভাবে নিজেকে সম্পর্কিত করতে পারে না।
আমাদের প্রধান শত্রু এই সাম্রাজ্যবাদের ব্যাখ্যায়, মোকাবেলায় তাই কার্যকর বয়ান প্রয়োজন, ওহাবী/পাকিস্তানী সাম্প্রদায়িক বয়ান না, ইউরোপিয়/মার্ক্সবাদী বয়ানও না, প্রয়োজন “বাঙাল” বয়ান।
বাঙাল বয়ান
“বাঙাল” বয়ান কেনো? “বাঙাল” শব্দটা কেনো? এটা আমার ব্যাক্তিগত পছন্দের ব্যাপার, শব্দটার প্রতি আমার একধরণের স্বপ্নময় আধ্যাত্মিক মমতা আছে। অন্যকেউ চাইলে অন্য শব্দ ব্যাবহার করতে পারে। “বাঙাল” শব্দটা এখানে আমি কোন ক্ষুদ্র জাতিগত অরতথে ব্যবহার করছিনা, করছি উপনিবেশী জ্ঞানের দাসত্বের বাইরের একটা মুক্ত লোকায়ত অবস্থান কে। শব্দটার একটা বিপ্লবী আমেজ আছে, ঐতিহাসিক ভাবে।
ব্রিটিশদের মনোজগতে উপনিবেশের প্রথম শিকার পশ্চিম বঙ্গের ইউরোপিয় উপনিবেশীক শিক্ষায় শিক্ষিত “বাঙালি বাবু”রা পূর্ব বঙ্গের অইউরোপিয় মন মানষিকতার লোকজনদের “বাঙাল” ডাকতেন, অনেকে এখনও ডাকেন। এই “বাঙাল”ত্ম আমার গর্ব, “বাঙাল”ত্ম আমার মুক্তির পয়গাম। এই “বাঙাল”ত্ম, এই “অইউরোপিয় মূর্খতা”ই একজাতি তত্ত্ব আর দ্বিজাতি তত্ম্বের ভ্রোম থেকে আমাদের প্রাথমিক মুক্তি দিয়েছে, বায়ান্ন দিয়েছে, একাত্তর দিয়েছে, ভবিষ্যতে সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে চুড়ান্ত লড়াইয়ে বিজয় দিবে।
বাঙাল বয়ানের আরেকটু ব্যাখ্যা প্রয়োজন। এই বয়ান কোন পদ্ধতিগত বিষয় না, বরং দৃষ্টিভঙ্গিগত।
প্রভূ আর দাসের মাঝে অবস্থানগত মূল পার্থক্য আসলে অর্থনৈতিক না, বরং দৃষ্টিভঙ্গিগত। একজন দাস আসলে জানেই না, তার প্রতি অন্যায় করা হচ্ছে, তার কাছে তার দাসত্বই বাস্তবতা, স্বাভাবিক। তার উপর তার প্রভুর শোষনে অনৈতিক কিছু সে কখনো দেখেনা, শোষনকে সে তার ভবিতব্যই মানে। তার নিজের প্রতিযোগিতা, লড়াই, বিজয় এইসবের সিমারেখা সে বজায়ে রাখে অন্যান্য দাসের সাথে। প্রভু তার দৃষ্টিভঙ্গিতে প্রতিযোগিতা আর লড়াইয়ের অতিত সত্ত্বা।
এইসব সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি টিকে থাকে ভাষা দিয়ে তৈরি করা সবকিছুতে। একটা চিঠী, একটা বিজ্ঞাপন, একটা বই, গান, ধর্ম পূস্তক, আইন শাস্ত্র, সংবিধান ইত্যাদি আদায় করে নেয় আমাদের দৃষ্টিভঙ্গীগত লয়ালিটি। প্রভুর তৈরি আইন যখন দাস পড়ে দাস দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে তখন সেই দাসের মুক্তি নাই। প্রকৃতি মানুষকে এমনভাবে বানিয়েছে যেখানে সবাই নেতা না, কেউ কেউ নেতা, বাকিরা অনুসারিরা। এই অনুসারিরা নেতার দৃষ্টিভঙ্গিকেই নিজেদের আইন হিসেবে মাথায় তুলে রাখে, এটা চরম বাস্তবতা, সমাজের সৃষ্টি এভাবেই।
কিন্তু আমার নেতা যদি আমার নিজের নেতা না হয়, বরং হয় অন্য কারো দাস, সে যদি আমার সার্থ রক্ষা না করে রক্ষা করে অন্যকোন প্রভুর সারতথ, আমিও তখন টিকে থাকি অন্য কোন সাম্রাজ্যের দাস হয়ে। এর এই দাসত্ব থেকে মুক্তির জন্যই দরকার বাঙাল বয়ানের। মানুষের সভ্যতার একটা মোটামুটি ধরণের ইতিহাস আছে, তার জ্ঞানেরও একটা ইতিহাস আছে। এই ইতিহাসে এক জাতি অধ্যয়ন করে আরেক জাতির জ্ঞান, বাড়ায় নিজের জ্ঞান, জন্ম দেয় নিজের জ্ঞান, আবার একসময় সেই জ্ঞানের আলো নিয়ে সামনে আগায় অন্য কোন জাতি। জ্ঞানের এই আদান প্রদানের সময় ঠিক কি কি ধরণের পারস্পারিক দৃষ্টিভঙ্গি কাজ করতে পার তার সামান্য আলোচনা করে বিতর্ক বারাবোনা।
তবে প্রভুত্ব বিস্তারের দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে যে ভিন্ন জাতির জ্ঞান অনুশিলন করা যায় তা আগে আলোচন করেছি। এখন, ইউরোপিয় প্রভুত্তের জ্ঞান যখন বাঙালির জন্য পরিণত হয় দাসত্বের জ্ঞানে, তখন বাঙালি কি করবে? মৌলিক জ্ঞানের আদান প্রদান আর উপনিবেশী জ্ঞানের আগ্রাসনের পার্থক্য সে কিভাবে করবে। একমাত্র উপায় দৃষ্টিভঙ্গিগত পরিবর্তন, বাঙাল বয়ানের আবিষ্কার। ইউরোপিয় জ্ঞান অর্জন করতে হবে, দাসত্বের মন মানসিকতা নিয়ে নয়, ইউরোপিয় জ্ঞানের সিমাবদ্ধতাকে পরিহাস করে, তুচ্ছতাচ্ছিল্ল করে, প্রভুসুলভ মন মানসিকতা থেকে। হিনমন্যতার চিকিৎসা উন্নাসিকতা, ইনফেরিওরিটি কমপ্লেক্স এর ঔষধ সুপিরিওরিটি কমপ্লেক্স, আগ্রাসনের জবাব দিতে হয় আগ্রাসনে, সন্ত্রাসের জবাব সন্ত্রাসে।
এর মাঝখানে কিছু নাই। সমানে সমানে লড়াই হলেই ক্ষতি এড়ানোর প্রয়োজনে মধ্যপন্থার আগমন হয়, তার আগে না। ফ্রাঞ্জ ফেনো তার “হোয়াইট স্কিন ব্লাক মাস্ক” আর “রেচেড অব দা আরতথ” পুস্তকে দেখিয়েছেন কিভাবে উপনিবেশী আগ্রাসন কিভাবে মনোবৈকল্য তৈরি করে। ফরাসি উপনিবেশের বিরুদ্ধে আলজেরিয়ার মুক্তিকামী মানুষের পক্ষে লড়েছেন ফ্রাঞ্জ ফেনো, নয়া উপনিবেশের চেহারা প্রথম যে কয়জন মানুষ চিনেছেন, ফেনো তাদের অন্যতম। ফেনো ডাক্তার ছিলেন, মনোবিজ্ঞান ছিল তার গবেষনার যায়গা।
উপনিবেশী শোষন সন্ত্রাসে যে মনোবৈকল্য তৈরি হয় প্রতিরোধ, সংগ্রামই হয় তার চিকিৎসা, দেখিয়েছেন ফ্রাঞ্জ ফেনো। অহিংসা মুক্তি দেয় না। উপনিবেশের পর আমাদের নয়া উপনিবেশের দাস করে এই অহিংসা। লড়াই তাই হতে হবে হিংসাত্মক। সেই হিংসা, সেই বিদ্বেশ থাকতে হবে কবিতা থেকে রাজপথে।
বুদ্ধিজীবীর কলম, রাজপথে সংগ্রামির প্ল্যাকার্ড, হাতের লাঠি, ছুড়ে দেয়া ইট, প্রয়োজনে গেরিলা যোদ্ধার অস্ত্রের বুলেট এই প্রতিহিংসা কায়েম করবে। প্রভু-দাস সম্পর্কের যে ক্ষমতা কাঠামো আর সেই ক্ষমতা কাঠামোকে টিকিয়ে রাখে যেইসব হেজিমনিক ধারণা, আর সেইসব হেজিমনিক ধারণাকে টিকিয়ে রাখে যেইসব ডিসকোর্স, সেইসব প্রত্যেকটা ডিসকোর্সকে চিহ্নিত করতে হবে, আগ্রাসি হেজিমনিকে নিশ্চিহ্ন করে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে সংগ্রামী হেজিমনি।
বাঙাল বয়ানে সাম্রাজ্যবাদ
আমি সাম্রাজ্যবাদ বুঝতে চাই। আমার জীবনে, আমার বাস্তবতায়, আমার শিক্ষা ব্যবস্থায়, আমার নৈতিক ধারণায়, আমার অর্থনীতিতে সাম্রাজ্যবাদ জগদ্দল পাথরের মতো কিভাবে চেপে বসে আছে আমি বুঝতে চাই। এর শুরু কোথায়?
এর আগে “আধুনিক” আর “উত্তর আধুনিক” শব্দ দুটো নিয়া একটু কথা না বললে হয় না।
প্রথম যখন আমি আবিষ্কার করলাম “আধুনিক” বলতে একটা সূনির্দিষ্ট সময়, একটা কালখন্ড বোঝানো হয়, তখন আমার “বাঙাল” মাথায় ব্যাপারটা ঢোকে নাই। যা কিছু অধুনা তাই আধুনিক এমনই জানতাম এক কালে, সেই হিসেবে ১৪০০ বছর আগে হজরত মোহাম্মদের সময়ের লোকজন তাদের সময়কে আধুনিক কাল ভাবতো, আমার দাদা ভাবতো তার সময়কে, আর আমি ভাবি আমার সময়কে, আমার নাতী ভাববে তার সময়কে আধুনিক আর আমার সময়কে সেকেলে। অথচ ইউরোপিয় বয়ানে modern একটা সময়, মানুষের চুড়ান্ত বিকাষের মুহুর্ত। অথচ যা কিনা আসলে শুধুমাত্র ইউরোপের বিকাষের একটা মুহুর্ত, তাও আবার চুড়ান্ত কিছু না। নিজেদের সময়কে মানবেতিহাস আর মানুষের বিকাষের চুরান্ত সময় ভাবার একটা রোগ অবশ্য ইউরোপের অনেক আগে থেকেই আছে।
এরা প্রতি শতাব্দিতেই ভাবে শেষ কাল আর বেশি দূরে নাই, প্রতি শহস্রাব্দে দাজ্জালের আগমন আর দুনিয়া ধ্বংসের জন্য পুরোপুরি তৈরি হয়, আর এদের মহামনিষিরা সবসময়ই নিজেদের সময়কে ভাবে মানুষের বিকাষের চুড়ান্ত সময়। রেঁনেসা আর উপনিবেশী লুন্ঠনের জোরে ইউরোপে যে য্যোতির্ময়কালের আবির্ভাব তা মোটেই সারা বিশ্বের জন্য কোন য্যোতির্ময়কাল না, বরং অনেকের জন্যই অন্ধকারকাল। ইউরোপে আধুনিক কাল, গণতন্ত্র আর শিল্প বিপ্লবের সাথে উপনিবেশের একটা যোগসূত্র আছে। যে সাম্রাজ্যবাদের কথা আজ আমরা বলি সেই সাম্রাজ্যবাদ আর নয়া উপনিবেশ একই জিনিস। আর এর জন্ম ইউরোপে গণতন্ত্রের আবির্ভাব আর শিল্পবিপ্লবের সাথে সম্পর্কিত।
উপনিবেশি ব্যবসায়িদের ব্যক্তিগত সম্পত্তির অধিকার রক্ষার স্বার্থেই আধুনিক কালের প্রথম গণতান্ত্রিক সংসদ ব্রিটিশ পার্লামেন্টের আবির্ভাব। যে শিল্প বিপ্লবের মাধ্যমে ইউরোপ আমেরিকার এতো প্রভাব প্রতিপত্তি, সেই শিল্প বিপ্লব চুড়ান্তভাবে নির্ভর করতো উপনিবেশের উপর। শিল্প বিপ্লবের জন্য উপনিবেশের প্রয়োজনিয়তা স্বিকার করতে কার্পণ্য করেনা পশ্চিমা ঐতিহাসিকরাও। তিন দিক দিয়ে শিল্প বিপ্লবে ভূমিকা রেখেছে উপনিবেশ।
১।
উপনিবেশ থেকে উপনিবেশক পেয়েছে কাঁচামাল (Raw Materials)।
২। উপনিবেশ থেকে উপনিবেশক পেয়েছে সস্তা শ্রম।
৩। উপনিবেশে উপনিবেশক পেয়েছে নিজেদের প্রক্রিয়াজাত পণ্যের (Finished Goods) বাজার।
আর তরতরিয়ে গড়ে উঠেছে শিল্প বিপ্লব। বাঙলার রক্ত চুষে গড়ে উঠেছে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য। মজার ব্যাপার হচ্ছে ব্রিটিশরা এ দেশ থেকে সৈন্য সামন্ত আর লর্ড ভাইসরয়দের সরিয়েছে সে আজ পঁঞ্চাস বছরের অধিক। অথচ উপরের যে তিনটা কারনে ইউরোপিয় শিল্প বিপ্লব গড়ে উঠেছে তরতর করে, সেই তিনটা ঘটনা এখনো ঘটে চলেছে খুব সহজ স্বাভাবিক ভাবে। আমরা এখনো পশ্চিমে কাঁচামাল আর সস্তা শ্রম বিক্রি করি আর পশ্চিমের সাদা চামরার প্রভুর মতো হতে খরিদ করি পশ্চিমের ফিনিশড পণ্য।
উপনিবেশ তাই এখনো বিদ্যমান, নয়া উপনিবেশের চেহারায়। পশ্চিমের প্রভুত্ত টিকিয়ে রাখতেই পশ্চিম কখনো এই উপনিবেশের মৃত্যু চাইবেনা। আমরা চাইবো, আমাদের মুক্তির জন্য।
অথচ, যেই “আধুনিক” শব্দটার পশ্চিমা ব্যাখ্যা শুনে প্রথমে মেনে নিতে চাই নি, সেই আধুনিক কাল বুঝতে গিয়ে আমরা যখন পাঠ করি আধুনিক কবিতা, আধুনিক দর্শন, আধুনিক সমাজ বিদ্যা আর মেনে নেই “আধুনিক” নামক সময়কে একটা কালখন্ড বলে, পশ্চিমের জ্ঞানে জ্ঞানি বলে নিজে নিজে গর্বিত বোধ করি, অন্যকে শিখাই আধুনিকতা কি, তখন আমি হই পশ্চিমা দাস। অথচ গত চার-পাঁচশ বছরের পশ্চিমা জ্ঞানকে যদি দাস মনমানসিকতা থেকে পাঠ না করি, জানার কাজটাও হয় আবার আধুনিক যুগ নামক কোন চুড়ান্ত যুগের বিভ্রান্তীতেও পড়তে হয় না।
শুরু করেছিলাম, আধুনিক নামক শব্দের বিভ্রান্তী নিয়ে। অনেকে হাসতে পারেন, কিন্তু প্রথম যখন উত্তর আধুনিক শব্দটা শুনি, আমার “বাঙাল মাথা” এর অর্থ পুরোপুরি ভূল বুঝেছে। আমি ভেবেছিলাম উত্তর আধুনিক বলতে বুঝি অতি আধুনিক বোঝায়। “উত্তর আধুনিক প্রজন্ম ও আমাদের ভাবনা” নামের একটা পাঠচক্রে যাওয়ার সময় আমি ভেবেছিলাম ইদানিংকার আলট্রা মডার্ণ পোলাপান ঐ পাঠচক্রের বিষয়বস্তু, কিন্তু বিষয়টা যে আলট্রা মডার্ণ না বরং পোস্ট মডার্ণ তা বোঝার পর আকাশ থেকে পরার যোগার। আমার এক বন্ধুর অভিজ্ঞতা তো আরো মজার, “উত্তর আধুনিক মতবাদ” বলতে সে বুঝেছিলো পৃথিবীর উত্তরাঞ্চলে বিকোষিত কোন আধুনিক মতবাদ।
অথচ নিজেদেরকে ইউরোপিয় জ্ঞান গরিমায় গর্বিত করতে আমি এবং আমার বন্ধু উভয়েই উত্তর আধুনিকতা পাঠ করে আধুনিকতায় পরে থাকা বাঙালিদের চেয়ে নিজেদের এগিয়ে থাকা নিয়ে গর্ব করেছি, অন্তত অল্প কিছুদিনের জন্য হলেও।
আর একারণেই দরকার বাঙাল বয়ান। বাঙাল বয়ানে আমার কাছে আধুনিক কাল খন্ড বলে কিছু নাই। আধুনিক ধ্যান ধারণার বিরোধিতা করার জন্য তাই উত্তর আধুনিক বলেও আমার কাছে কিছু নাই। শিল্প বিপ্লব-পুজিবাদ-সাম্রাজ্যবাদের ধারাবাহিকতা এইসব কিছুও আমার কাছে নাই।
আমার কাছে আছে শুধু জাজ্বল্যমান উপনিবেশ, মাথা হেট করা দাসত্বের লজ্জা। আমার সামনে শত্রু আছে উপনিবেশ, দুইশ বছর আগেও ছিলো, এখনো আছে। এই উপনিবেশ পশ্চিমের উপনিবেশ, পশ্চিমকে আমি তাই সন্দেহ করি। এই সন্দেহ আমাকে বাঁচাবে। আমি পশ্চিমের অর্জিত মৌলিক জ্ঞান আর উপনিবেশী জ্ঞানের পার্থক্য করতে পারবো।
দাস মন মানসিকতা না থাকলে পশ্চিমের কোন তত্ত্ব বা ধারণা আমি অন্ধের মতো মেনে নেবোনা। আমার দেশে জন্ম নেয়া জ্ঞান ভান্ডারই হোক, আর হোক আরব থেকে আসা জীবন বিধান, অথবা ইউরোপিয় সাম্প্রতিক সমাজতত্ত্ব, এই সবের কোন কিছুই আমি সন্দেহ ছাড়া, বিচার বিশ্লেষন ছাড়া, নিজের স্বার্থের সাথে উপযোগিতা ছাড়া গ্রহণ করবোনা। এভাবেই আমি সামনে এগোতে চাই। ইউরোপে শিল্পবিপ্লব হইছে তাতে আমার কি? আমার তো হয় নাই। আবার আমার দেশে যে ইউরোপের মতোই শিল্পবিপ্লব হইতে হবে সেই বাদ্ধবাধকতাই বা কে দিলো।
(চলবে)
লেখার প্রুফ দেখি নাই। লেখার সাথে সাথে পোস্ট দিলাম। অনেক বানান ভুল আছে। মাফ কইরা দিয়েন। বানান পরে ঠিক করবো।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।