আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ভাষা আন্দোলনের “বাঙাল” বয়ান - নয়া উপনিবেশ বিরোধিতার “পবিত্র দিবস” আর “আধ্যাত্মিক” উৎস সন্ধান (পর্ব-১)

হিন্দু না ওরা মুসলিম ঐ জিজ্ঞাসে কোনজন, কান্ডারি বলো ডুবিছে মানুষ সন্তান মোর মা'র

মুখোমুখিঃ আমি বনাম কলম্বাস “আমেরিকা আবিষ্কার করিয়াছেন কে?” “মহামতি কলম্বাস”। এই বয়ান আমাদের কি বলে? স্কুলে ছোটবেলায় শেখা এ বয়ান আমাদের কি বলে? এ বয়ান যখন আমাদের বয়ান হয়, তখন আসলে কি হয়? এ অংশে আমাদের আলোচনা এই কয়টা প্রশ্ন ঘিরেই। এই “বয়ান” থেকে আমরা যা পাই তাকে মোটামোটি এইভাবে ব্যাখ্যা করা যায়- ১। কলম্বাস নামক কোন একজন ব্যাক্তি “আমেরিকা” নামক স্থানটি সৃষ্টি করেছেন। অথবা ২।

কলম্বাস নামক কোন একজন ব্যাক্তি আমেরিকা নামক কোন একটি যায়গা খুঁজে পেয়েছেন, যে যায়গার অস্তিত্ব আগে কেউ যানতোনা, এমনকি ঐ অঞ্চলের অধিবাসীরাও না। এই বয়ান থেকে আমরা কি সত্য কিছু পেলাম? কিছু তথ্য উপাত্ত ইতিহাস ঘাটতে গেলে এ বয়ানের পরিপূর্ণ অসততা আমরা খুঁজে পাবো অবশ্যই। ইউরোপ যে ভূখন্ডের নাম দিয়েছে “আমেরিকা”, ইনকা, এজটেক, মায়ান এহেন আরো শত জাতিগোষ্টি যাদের ছিলো এই ভূখন্ডে বসবাস, তারা নিজেদের দেশ, নিজেদের থাকার যায়গাকে নিজেদের ভাষায় দিয়েছিলো টিয়ুটিহুয়াকান, টিটিকাকা এইরকম আরো কত শত নাম। উত্তর আর দক্ষিন আমেরিকার মাটি-নদী-হাওয়া-জঙ্গলের আশ্রয়ে বেঁচে থাকা শহস্র জনগোষ্টি তাদের নিজ নিজ বাসভূমের যে নামই দিক, ইউরোপের চোখে এই পুরো ভূখন্ডের একটাই নাম, আর তা হলো “আমেরিকা”। একটা নাম জানা সহজ, আয়ত্ত করা সহজ, এই নামের সাথে জড়িত ভূমি, সেই ভূমির মানুষ, সেই ভূমির সম্পদের সরলিকৃত ধারণা পাওয়া সম্ভব, এ কারণেই হয়তো।

লক্ষ/কোটি মানুষের কাছে যেই ভূমির অস্তিত্ব সবসময়ই ছিলো, ১৪৯২ সালে একজন ইতালিয়ানের সেই ভূমি আবিষ্কারের দাবী তাই অসত্য ছাড়া আর কিছু না। তারপরও যদি ইউরোপিয় “জানা পৃথিবী” তত্ত্ব মেনে নেই। যদি মেনে নেই, এশিয়া-ইউরোপ-আফ্রিকা এই তিন ভূখন্ডের পারস্পরিক যোগাযোগ জানা-পড়ায় এই তিন ভূখন্ডই ছিলো তখন পর্যন্ত “জানা পৃথিবী”, আর এই “জানা পৃথিবী”র মানুষ হিসেবে আমেরিকা আবিষ্কারের কৃতিত্ব কলোম্বাসের তাহলেও কি এই বয়ান সত্য হয়ে যায়। মোটেও না। আমেরিকার অস্তিত্ব যানতো প্রাচীন মিশরিয়রা, আমেরিকায় “চীন” দেশিয়দের অভিযান ইতিহাস স্বিকৃত এবং প্রত্নতাত্মিক প্রমান সর্বস্ব সত্য।

কিছু প্রাচীন ভারতীয় গ্রন্থেও “আমেরিকা” সদৃশ ভূখন্ডের সন্ধান পাওয়া যায়। এমনকি কলোম্বাসের ৫০০ বছর আগেই ইউরোপের অধিবাসী নরওয়েজিয়ান ভাইকিংরা আমেরিকায় গেছে, অস্থায়ী কলোনিও গেড়েছে, অবশ্য তৎকালিন ইউরোপিয়রা নরওয়েজিয়ানদের সভ্য ইউরোপিয়ান না বরং জংলি ভাইকিং হিসাবেই গণ্য করতো। “কলম্বাস আমেরিকার আবিষ্কারক” তাই কার চোখে, কার জানা শোনায়? কলোম্বাসের জন্ম ১৪৫১ খৃষ্টাব্দে, ইতালিতে। আটলান্টিক মহাসাগর পাড় হয়ে উল্টোপথে “ইন্ডিয়া” নামক ঐশ্বর্যময় ভূখন্ডে পাড়ি জমানোর তার পরিকল্পনা পর্তুগাল, জেনোয়া, ভেনিস আর ইংল্যান্ডের রাজ দরবারে উপেক্ষিত হওয়ার পর স্পেনের দরবারে আদৃত হয়, চুক্তি হয়, তিনি পান সাগরের এডমিরাল পদ, পান নতুন আবিষ্কৃত উপনিবেশের গভর্ণরের পদ, ব্যাবসা আর লুন্ঠনের লভ্যাংশের ভাগ। নিজের আবিষ্কৃত ভূখন্ডের নাম অবশ্য তিনি “আমেরিকা” দেন নাই।

তিনি এই ভুখন্ডকে ভেবেছেন “ইন্ডিয়া”, তার ভাষায় “ইন্ডিজ” আর এই ভুখন্ডের অধিবাসীরা “রেড ইন্ডিয়ান”, লাল রঙের ইন্ডিয়ান। এই ভুখন্ড যে ইন্ডিয়া না বরং অন্য কোন মহাদেশ তা বুঝতে ইউরোপিয়দের সময় বেশি লাগে নাই, বোঝার সাথে সাথে এর নাম পরিবর্তন হয়ে আমেরিকা হয়েছে। কিন্ত দুর্ভাগ্য, এর অধিবাসীরা, তারা নিজেরা নিজেদের যে নামেই ডাকুক, তারা লাল ইন্ডিয়ানই রয়ে গেছে, তাদের এই পরিচয়ের মধ্যে বেধে ফেলে তাদের শোষন করা, ধ্বংস করা ইউরোপিয়দের জন্য হয়েছে অনেক সহজ। এই শোষন, এই লুন্ঠন, এই আগ্রাসনের নাম “উপনিবেশ”। মানব সভ্যতার ইতিহাসে ভিন্ন দেশ ও জাতির ওপর আগ্রাসন, দখলদারিত্ম, শোষন নতুন কিছুনা, কিন্ত সাম্প্রতিক কালে ইউরোপের কতিপয় দেশের ক্ষমতা বিস্তার, শোষন আর দখলের দৌরাত্মের ইতিহাসময় “উপনিবেশ” বিশ্ব সভ্যতায় অস্বাভাবিক আর নতুন একটা ঘটনা, গতিময় কিন্তু নিষ্ঠুর।

জল পথে ইউরোপিয়দের বিশ্ববিজয়ের প্রতিযোগিতার প্রথম দিককার নায়ক ক্রিস্টোফার কলোম্বাস, ইউরোপিয় উপনিবেশেরও। আমেরিকার একের পর এক দ্বীপ আবিষ্কার করেছেন তিনি, ইউরোপিয় বয়ানে সৃষ্টি করেছেন, উপনিবেশ স্থাপন করেছেন, শোষন করেছেন। “কলোম্বাস আমেরিকা আবিষ্কার করেছেন” এই বয়ান তাই উপনিবেশী ইউরোপিয় বয়ান, এই দৃষ্টিভঙ্গি তাই উপনিবেশি ইউরোপিয় দৃষ্টিভঙ্গি। এই বয়ান, এই দৃষ্টিভঙ্গি আমাদের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি হলো কেমন করে, কবে থেকে? স্কুলে কাঁচা বয়সেই সমাজ বিদ্যার পাঠে এই উপনিবেশী জ্ঞান আমি পেলাম কেমন করে ? দুইশ বছরের উপনিবেশী চাবুকের আঘাতে ক্ষুদ্ধ বাঙালির পাঠ্যক্রমে উপনিবেশি কলম্বাস কেনো একজন “ভিলেন” না, কেনো একজন “শয়তান” না। উপনিবেশী ইউরোপের এই নায়ক কেমন করে আমাদের নায়ক হয়? এতে লাভ কার, ক্ষতিই বা কার? আমাদের শিক্ষায়, জানা শোনায় এইরকম উপনিবেশি জ্ঞানের প্রভাব কতোটুকু ? উদাহরণ আর প্রভাব খুঁজতে গেলে খুঁজে পাওয়া মোটেও কষ্ঠসাধ্য হবেনা।

“কলোম্বাসের আমেরিকা” আবিষ্কারের মতো “মার্কো পোলোর প্রথম চীন ভ্রমন” এমন আরো অনেক সাধারণ উদাহরণ খুঁজে পাওয়া যাবে। তবে উপনিবেশী জ্ঞানের বিস্তার আর গভীরতা বুঝতে গেলে কষ্ট একটু করতেই হবে। উপরের প্রশ্নগুলোর উত্তর জানতেই কষ্টটুকু করতে হবে। উপনিবেশী জ্ঞান ও আমাদের অবস্থান উপনিবেশী জ্ঞানের বিস্তার আর গভীরতা আমরা যতটুকু ভাবছি, তারচেয়ে অনেক বেশি বিস্তৃত, অনেক বেশি গভীরে কার্যকর তার ক্রিয়া তৎপরতা। আমাদের শিক্ষা, নৈতিকতা, সমাজ চিন্তা সবকিছুই উপনিবেশী জ্ঞান শাসিত, এমন কি অনেক ক্ষেত্রে আমাদের বিপ্লব চিন্তাও।

বিষয়টা দুই ভাবে বোঝা যায়। প্রথমত নন্দনতত্ত্ব আর নৈতিকতা সম্বন্ধে আমাদের প্রতিদিনকার ধারণাগুলোর উদাহরণ বিশ্লেষন করে। দ্বিতীয়ত, আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা আর শিল্প-সাহিত্য বিশ্লেষনের মাধ্যমে। “উপনিবেশী জ্ঞান” শব্দটাকে এর্ডওয়ার্ড সাইদ বলেছেন “উপনিবেশী ডিসকোর্স”, “জ্ঞান” শব্দটার বদলে ডিসকোর্স শব্দটা ব্যবহার করলে বিশয়টা বুঝতে সুবিধা হয় বেশি। “ডিসকোর্স” শব্দটা সাইদ যে অর্থে ব্যবহার করেছেন সে অর্থে শব্দটাকে প্রথম ব্যবহার করেন প্রক্ষাত ফরাসি দার্শনিক “মিশেল ফুকো”।

“ডিসকোর্স” শব্দটা দিয়ে বোঝানো হয় বই-পত্র, সভা-সেমিনার, নাটক-সিনেমা এরুপ সংস্কৃতির মাধ্যমগুলোতে কোন একটা বিষয়ে জ্ঞানের প্রবাহকে, যার মাধ্যমে একটা সাধারণ ধারণা প্রতিষ্ঠিত হয়। উদাহরণ স্বরুপ বলা যায়, “আমেরিকার বিরুদ্ধে যারা অবস্থান নেয়, তারা সবাই সন্ত্রাসী” এই বয়ান একটা ডিসকোর্স। বহু বই-পুস্তক, সভা-সেমিনার, নাটক-সিনেমার মাধ্যমে, বহু রাজনীতিবীদ আর বুদ্ধিজীবীর অক্লান্ত শ্রমে বিশ্বের একটা বড় অংশের মানুষের চিন্তা জগতে প্রতিষ্ঠিত এ ডিসকোর্স। এইসব ডিসকোর্স আমাদের ভালো/মন্দ আরা গ্রহণ/বর্জনের মতো ম্যানিকিয় ধারণাকে নিয়ন্ত্রন করে অনেক ক্ষেত্রেই। এডওয়ার্ড সাইদ তার “অরিয়েন্টালিজম” নামক পুস্তকে পশ্চিমের সাহিত্য বিশ্লেষন করে দেখিয়েছেন কিভাবে ইউরোপের সাধারণ মানবতাবাদী অথবা প্রগতিবাদী সাহিত্যও “উপনিবেশী ডিসকোর্স” তৈরি করে, আর উপনিবেশ তৈরি করতে, টিকিয়ে রাখতে কিভাবে ব্যবহার করে সেই ডিসকোর্স।

উপনিবেশী এই ডিসকোর্সকেই সাইদ বলেছেন অরিয়েন্টালিজম বা প্রাচ্যবাদ। প্রাচ্যকে জানার জন্য ইউরোপিয় যে জ্ঞান তা প্রাচ্যকে এমন ভাবে জানতে চায়, যেমন ভাবে জানলে প্রাচ্যকে শোষন করা যায়, দখলে রাখা যায়। আবার প্রাচ্যতত্ত্ব পাঠ করে প্রাচ্যের মানুষ নিজেকে চেনে ইউরোপের চোখে, উপনিবেশী শাসকের চোখে সে দেখে তার সমাজ বাস্তবতা। একটু উদাহরণ সহযোগে আলোচনা করা যাক। আমি কে? এই প্রশ্নটা অধিবিদ্যার বিশয়, কিন্তু এই প্রশ্নটা এইখানে আমি করতে চাই, অধিবিদ্যক প্রশ্ন হিসেবে নয়, সমাজতাত্মিক প্রশ্ন হিসেবে।

ব্যক্তি হিসেবে আমার পরিচয় অবশ্যই আমার সমাজ নির্ধারণ করে, প্রথমে আমার নাম দিয়ে আমি একটা পরিচয় পাই। তারপর, আমি একজন বাঙালি, একজন মুসলমান বাঙালী বা হিন্দু বাঙালি ইত্যাদি। এইবার দেখি এই বাঙালি জাতটা সম্বন্ধে ঠিক কি ধরণের ডিসকোর্স এর মুখোমুখি হই আমরা প্রতিদিন। আপামর বাঙালির ক্ষেত্রে “বাঙালি মিশ্র জাতি”, “বাঙালি আলসে জাতি”, “বাঙালি দূর্ণীতিপরায়ন”, “বাঙালি ঘরকূনো, এডভেঞ্চার তার ধাতে নেই”, “মধ্যবিত্ত বাঙালি মানেই ছা পোষা চাকুরিজীবী”, “বাঙালি আরাম প্রিয়, খাদক, পেটুক”, বাঙালি নারীর ক্ষেত্রে “বাঙালি নারী শান্ত শিষ্ট আনত নয়না, পুরুষ সেবীকা”, বাঙালি মুসলমানের ক্ষেত্রে “ইসলাম শান্তির ধর্ম, রিপুর বিরুদ্ধে জেহাদই আসল জেহাদ” এইরকম নানাবিধ ডিসকোর্স সেই ব্রিটিশ আমল থেকে শুরু হয়ে এখন পর্যন্ত তার কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। উপরের এইসব বয়ানের কোনটাই যৌক্তিক ভাবে প্রতিষ্ঠিত সত্য নয়, এইসব বৈশিষ্ট বাঙালি জেনেটিক ভাবে ধারণ করেনা, বাঙালি র আবহাওয়ার সাথেও এর সম্পর্ক নাই।

অসংখ্য বই-পুস্তক, গল্প-কবিতা-প্রবন্ধের বয়ানে, অনেক লেখক-বুদ্ধিজীবীর সচেতন অথবা অচেতন বারংবার প্রয়োগে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এইসব ডিসকোর্স, জন্ম দিয়েছে বাঙালি সম্বন্ধে নির্বিষ, হিনমন্য এক হেজিমোনির। এইসব ডিসকোর্স, এইসব হেজিমোনিক ধারণা তৈরির কাজ প্রথম করেছে ব্রিটিশরা, অত্যন্ত সচেতন ভাবে। যে ব্রিটিশরা বাঙলার বুকে জগদ্দল পাথরের মতো চেপে বসেছিলো দুইশ বছর, বাঙালির রক্ত নিংড়ানো সম্পদে যারা জন্মদিয়েছে নিজ দেশে শিল্পবিপ্লব, সেই ব্রিটিশ সেই সময়টায় বিশ্বের অন্যতম সভ্য জাতি, সেই সভ্য জাতি যখন আরেক জাতির ওপর আগ্রাসন, শোষন চালায়, বজায় রাখে দখলদারিত্ব তখন তার পক্ষে উচ্চ মূল্যবোধ সম্পন্ন যৌক্তিক কারণ দেখানো দরকার হয়ে পরে। ঠিক যেমন এখন আমেরিকা প্রতিষ্ঠিত করতে চায়, “ইরাক বা আফগানিস্তানের জণগোষ্ঠি অনগ্রসর, অশিক্ষিত, বর্বর, নিজেদের শাসন করার ক্ষমতা তাদের এখনো হয়নি, হলেই মার্কিণ সৈন্য তাদের দেশ ছেড়ে দেবে”, বাঙলা দখল করা এবং করে রাখার এই রকমই কিছু যৌক্তিক ধারণা সেই সময় দরকার হয়ে পরেছিলো ব্রিটিশ উপনিবেশীদের, আর ঐসব যৌক্তিকতাই তখন তাদের হাতে তুলে দিয়েছিলেন ব্রিটিশ অরিয়েন্টালিস্টরা। এইসব অরিয়েন্টালিস্টদের গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, ভ্রমণ সাহিত্যে বারবার উঠে এসেছে ভারতীয় উপমহাদেশের অনগ্রসর, আলসে, বর্বর, পেটুক সার্বভৌম শাসনের ক্ষমতাহীন মানুষের কথা, যারা জ্ঞান গরীমায় চিন্তা চেতনায় সবদিক থেকেই শাদা ব্রিটিশদের চেয়ে পশ্চাতপদ।

এদের কোন স্বাধীন ইতিহাস নেই, নেই কোন সভ্যতা, এদের ইতিহাস মানে স্বৈরশাসকের হাতে শোষিত হওয়ার ইতিহাস। ব্রিটিশরাতো বরং এদের মুক্ত করবে। অরিয়েন্টালিস্টরা শুরুতে এই কাজগুলো করেছেন উপনিবেশী শাসন সুবিধার ব্যাপারে অচেতন থেকেই, অনেক ক্ষেত্রেই অজ্ঞতা আর রোমান্টিকতা থেকে। রবার্ট ওরেম অথবা রিচার্ড জোসেফ সুলিভানের মতো লেখকদের রচনা যুগিয়েছে এই সব উপনিবেশী জ্ঞান, যার সার কথা ব্রিটিশ উত্তম, ইন্ডিয়ান অধম। এসময় যে উপনিবেশী ধারার প্রাচ্য চর্চাই হয়েছে তা না।

এর ব্যাতিক্রমও আছে। “জ্ঞান ই ক্ষমতা”। কথাটা অনেকেই জানি আমরা, কিন্তু পুরো অর্থটা ধরতে পারি বা না পারি। পলাশির প্রান্তরে বাঙালির পরাজয়ই যে ব্রিটিশ শাসন টিকিয়ে রাখার জন্য পর্যাপ্ত না এটা ব্রিটিশরা বুঝতো ঠিকই। ১৭৫৭ খৃষ্টাব্দ পলাশির যুদ্ধ, আর ১৭৮৪ খৃষ্টাব্দেই ব্রিটিশরা প্রতিষ্ঠিত করে “ দি এশিয়াটিক সোসাইটি অফ বেঙ্গল”।

বাঙালী আর ভারতীয়দের জানার উদ্দেশ্যে তাদের ভাষা, ইতিহাস, ধর্ম তাবৎ বিষয়ে জানা, অনুসন্ধান করাই ছিলো এই সোসাইটির কাজ। এই সোসাইটিতে কাজ করেছেন উইলিয়াম জোনস, এইচ টি কোলব্রুক, জেমস প্রিনসেপের মতো নিখাদ জ্ঞান পিপাষু প্রাচ্যবীদরা। তবে তাদের এই জ্ঞান পিপাসায় ব্রিটিশ শাসক অর্থ যোগান দিয়েছে যতদিন পর্যন্ত শাসনের জ্ঞান আহরণ সমাপ্ত না হয়। ১৮৩৩ খৃষ্টাব্দ থেকেই গবেষনা কাজে অর্থ যোগানের পরিমাণ কমিয়ে দেয় ব্রিটিশ সরকার। তখন থেকে শুরু জেমস মিল আর লর্ড ব্যারিংটন ম্যাকলের পলিসির সময়।

ভারতীয় উপমহাদেশে প্রাচ্যবাদের দ্বিতীয় ধাপের শুরু এখান থেকেই। আধুনিক গণতন্ত্রের দার্শনিক প্রবক্তাদের অন্যতম প্রবাদ পুরুষ জেমস মিল ছিলেন একজন উগ্র বর্ণবাদী হোয়াইট সুপ্রিমিস্ট। ভারত বর্ষের ইতিহাস ঐতিহ্যকে তিনি অভিহিত করেছিলেন “শুন্য পাতা” বলে। এ শুন্য পাতা ভরার কাজ করতে হবে সভ্য ঐতিহ্যবান ব্রিটিশকেই। ১৮১৮ সালে প্রকাশিত তার পুস্তক “ দি হিস্ট্রি অফ ব্রিটিশ ইন্ডিয়া”তেই তিনি প্রকাশ করেন এই ধরণের দৃষ্টিভঙ্গি।

সেই সময় অত্যন্ত জনপ্রিয় এ পুস্তক পরবর্তি সময়ে বিবেচিত হয়েছে ভারতীয় ইতিহাসের অন্যতম রেফারেন্স পুস্তক হিসেবে, ইউরোপিয় এমনকি অনেক ভারতীয় ইতিহাসবিদের কাছেও। ভারতীয় উপমহাদেশে শিক্ষানীতি প্রনয়োনের দায়িত্বে ছিলেন লর্ড ম্যাকলে, যিনি মনে করতেন বাঙালি ইতিহাস, শিক্ষা, সংস্কৃতি সবকিছুতেই হীন। ভারতের ইতিহাসকে তিনি বলেছেন, ত্রিশফুট উচ্চতার রাজা আর ত্রিশ হাজার বছরব্যাপী শাসনের মতো উদ্ভট ইতিহাস। তিনি মনে করতেন, সারা পৃথিবীর সব সাহিত্য এক করলেও তা ইংরেজি সাহিত্যের সমপরিমান হতে পারবেনা। ভারতে শিক্ষানীতি প্রনয়োনের সময় যে নীতি তিনি মেনে চলেন, তাকে তিনি ব্যাখ্যা করেছেন এইভাবে- “আমাদের সীমিত ক্ষমতা দিয়ে গোটা জনগোষ্ঠীকে শিক্ষিত করা অসম্ভব।

আপাতত আমরা দোভাষী-ব্যাখ্যানকারের এমন একটা শ্রেণী তৈরি করব যারা হবে আমাদের এবং আমাদের শাসিত মিলিয়ন মিলিয়ন মানুষের মধ্যকার দোভাষী। রক্তে বর্ণে এরা হবে ভারতীয়, কিন্তু রূচি, মতামত, নৈতিকতা আর বোধ বুদ্ধিতে ইংরেজ। এদের ওপর আমরা ছেড়ে দেবো উপ-মাতৃ ভাষাগুলো পরিমার্জনের ভার, পশ্চিমা শ্রেনীকরণবিদ্যা থেকে ধার করা বৈজ্ঞানিক জ্ঞান দিয়ে সেই সব ভাষা সমৃদ্ধ করার দায়িত্ব”। এই পর্যায়ে এইরকমই সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য নিয়ে সচেতন ভাবে প্রয়োগ শুরু হয় প্রাচ্যতত্ত্বের, যেইসব ডিসকোর্স তৈরি করে “বাঙালি কে শাসন” করা নিজেদের জন্য ফরজ করেছে ব্রিটিশ উপনিবেশী শাসক, ঠিক সেইসব ডিসকোর্স শিক্ষা দেয়ার মাধ্যমেই তৈরি করা হয় রক্তে বাঙালী আর রুচি/নৈতিকতায় ইংরেজ একটা মধ্যবিত্ত শ্রেনী। এই শ্রেনীর একটা ট্রাজেডি আছে।

এই শ্রেনীর একটা নাম আছে। এই শ্রেনীর নাম “বাঙালী বাবু”। ব্রিটিশ বোধ বুদ্ধি আর নৈতিকতা গ্রহণ করে কিন্তু সে তার প্রভু ব্রিটিশের সমান মর্জাদা পায় না। কারন সম্পর্কটা এখানে শোষক আর শাষিতের। যে প্রাচ্যতত্ত্ব ব্রিটিশকে প্রভু করে সেই একই প্রাচ্যতত্ত্ব বাঙালিকে করে দাস।

এই ট্রাজেডি সেই ব্রিটিশ উপনিবেশীক সময় থেকে এখনো বহন করে চলেছি আমরা। এই বাঙালি বাবু, ব্রিটিশ দাসানুদাসরাই আমাদের শিক্ষা, সাহিত্য, রাজনীতির বৃহত ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দিয়েছে ব্রিটিশ আমলে, জন্ম দিয়েছে ইউরোপের অনুকরণে বাঙালি রেঁনেসা, জন্ম দিয়েছে এক জাতি তত্ত্ব, দ্বিজাতি তত্ত্বের মতো নয়া উপনিবেশের বন্ধু বৎসল রাজনৈতিক তত্ত্ব। আর তার ফল ভোগ করে চলেছি আমরা আজো। নিহাররঞ্জন রায় শেষ বয়সে বিষয়টা বুঝেছিলেন। দুঃখের সঙ্গে তিনিত বলেন, যে- রেনেসাঁস ও য্যোতির্ময়কাল একান্তভবে ইউরোপের ঘটনা তকে বাঙালি বুদ্ধিজীবীরা নিজেদের বলে ভাবলেন, এবং এভবে রেনেসাঁসের মীথ তৈরি হলো ভারতবর্ষে।

ঔপনিবেশিক ভারতে রেনেসাঁস কেন ঘটতে পারেনা তার কারণ বিশ্লেষন করে গেছেন নিহাররঞ্জন। (চলবে)

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.