মোহাম্মদ আবুল হোসেন: পশ্চিম গোলার্ধের সবচেয়ে দরিদ্র দেশ হাইতিতে লাশের টালি দীর্ঘ থেকে দীর্ঘ হচ্ছে। রাসত্মায় লাশ। ঘরবাড়ির ধ্বংসস্তূপে লাশ। ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে লাশ। ধসে বিলিন হওয়া পোর্ট অব প্রিন্সে লাশ।
ধসে পড়া স্কুল-কলেজে লাশ। সারি সারি লাশ। বিধ্বংসী ৭.৩ মাত্রার ভূমিকম্পে সেদেশে মোট কত মানুষ মারা গেছেন তার সঠিক কোন পরিসংখ্যান মেলেনি। অনেকের আশংকা নিহতের সংখ্যা এক লাখ ছাড়িয়ে যাবে। তবে হাইতির এক সিনেটরের উদ্ধৃতি দিয়ে ডেইলি মেইল জানিয়েছে, নিহতের সংখ্যা ৫ লাখ ছাড়িয়ে যেতে পারে।
যারা বেঁচে আছেন তাদের অবস্থা আরও ভয়াবহ। কোথাও মাথা গোঁজার ঠাঁই পর্যনত্ম অবশেষ নেই। চোখ খুললেই শুধু ধ্বংসস্তূপ। সেদিকে তাকিয়ে বুকে কান্না উতলে উঠছে তাদের। কে কাকে সানত্মনা দেবেন! সবারই এক অবস্থা।
কারও পরিবারের প্রায় সবাই চিরদিনের জন্য নিসত্মব্ধ হয়ে আছেন ওই ধ্বংসস্তূপের নিচে। কেউ মা, বাবা, স্ত্রী, সনত্মান হারিয়ে পাগলপ্রায়। তার বা তাদের বুক চাপড়ানো কান্নায় আকাশ বাতাস ভারি হয়ে উঠেছে। টেলিভিশনে সে দৃশ্য দেখে বিশ্বের সচেতন অসংখ্য মানুষ অশ্রম্ন সংবরণ করতে পারেন নি। হাইতিতে আহত অন্যরা ধ্বংসস্তূপের দিকে তাকিয়ে হাউমাউ করে কাঁদছেন।
তাদের শরীরে এখনও শুকিয়ে আছে ড়্গত চিহ্ন। সেখান থেকে ঝরছে রক্ত। চারদিকে শুধুই আহাজারি। এমনই এক পরিস্থিতিতে গত তিনটি রাত খোলা আকাশের নিচে অবর্ণনীয় কষ্টের মধ্যে কাটিয়েছেন হাইতির হাজার হাজার মানুষ। তাদের চোখেমুখে আতঙ্ক।
ফের ভূমিকম্প হতে পারে এ ভয়ে রাতে ঘুম নেই কারো চোখে। তার ওপর বিদ্যুত নেই। রাসত্মাঘাট ভেঙে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। টেলিফোন সংযোগ বিচ্ছিন্ন। একদিকে শোক, অন্যদিকে দুঃসহ দুর্ভোগ নিয়ে কোন মতে বেঁচে আছেন জীবিতরা।
এখনও ধ্বংসস্তূপের মাঝে আটকে আছেন অসংখ্য মানুষ। শরীরের অর্ধাংশ তাতে প্রোথিত। এ রকম জীবনমৃত্যুর সন্ধিড়্গণে রয়েছেন অসংখ্য মানুষ। শিগগিরই উদ্ধারের ব্যবস্থা নিতে না পারলে তাদের জীবন প্রদীপ নিভে যেতে পারে। সরঞ্জামের অভাবে সেখানে উদ্ধার অভিযান বেগবান করা যাচ্ছে না।
মারা গেছেন শানিত্মরড়্গীরাও
হাইতির জাতিসংঘ শানিত্মরড়্গী মিশনের সদর দপ্তর ধসে পড়ায় সেখানে অনেক শানিত্মরড়্গী মারা গেছেন। অনেকে রয়েছেন নিখোঁজ। জাতিসংঘ তার ১৬ শানিত্মরড়্গী মারা যাওয়ার কথা নিশ্চিত করেছে। এর মধ্যে ১০ জনের বাড়ি ব্রাজিলে, ৩ জনের বাড়ি জর্ডানে, ১ জনের বাড়ি হাইতিতেই। চীনের রাষ্ট্রীয় মিডিয়া বলেছেন, এ ঘটনায় মারা গেছেন চীনের ৮ শাসিত্মরড়্গী।
আরও ১০ জনের কোন খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। ধারণা করা হচ্ছে, আরও শ’খানেক মারা যেয়ে থাকতে পারেন। ঘটনার সময় জাতিসংঘ সদর দপ্তরে ছিলেন ১৪১ জন শানিত্মরড়্গী সহ প্রায় ২০০ ভারতীয়। বুধবার রাতে ওই দপ্তরের সঙ্গে যোগাযোগ রড়্গা করতে পারে নি দিলিস্ন। তবে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রী এস এম কৃষ্ণ বলেছেন, সেখানে ১৪১ জন শানিত্মরড়্গী নিরাপদেই আছেন।
তবে নিখোঁজ ৫০ জন ভারতীয় কনস্যুলার অফিসার। নিখোঁজ রয়েছেন ১৬ বৃটিশ। জাতিসংঘ বলেছে, নিখোঁজদের মধ্যে আছেন মিশন প্রধান হেদি আনাবি এবং তার চিফ ডেপুটি লুইস কারলোস দা কসত্মা। জাতিসংঘ শানিত্মমিশনে নিয়োজিত সেখানে বাংলাদেশী সদস্যদের অবস্থা সম্পর্কে ওয়েবসাইটে পাওয়া যায়নি। তবে তাদের কোন ড়্গতি হয়নি বলে জানা গেছে।
হাসপাতালে মৃতদের সঙ্গে রাত্রিযাপন
ভূমিকম্পের ধ্বংসলীলা থেকে যারা বেঁচে গেছেন তারা বিধ্বসত্ম ভবনের পাশে, কোন একটি দেয়ালের পাশে রাত কাটাচ্ছেন দুর্বিষহ যন্ত্রণা নিয়ে। পাশেই ধ্বংসস্তূপের নিচে হয়তো নিরব, নিথর হয়ে পড়ে আছেন তাদের স্বজন। এজন্য কেউ কেউ তাদের বেঁচে থাকাকে ‘মৃতদের সঙ্গে বসবাস’ বলে উলেস্নখ করেছেন। আহতদের আর্তনাদে হাসপাতালের পরিবেশ ভারি হয়ে উঠেছে। সরকারি বা বেসরকার হাসপাতালগুলো ধসে পড়েছে।
ফলে হাসপাতাল বলতে অস্থায়ী ভিত্তিতে স্থাপন করা সেবাকেন্দ্রগুরো কাজ করছে। সেখানে জায়গা ঠাঁই হচ্ছে না। তবুও উদ্ধার করা মানুষদের নিয়ে লোকজন ছুটছে হাসপাতালে। পর্যাপ্ত ওষুধ নেই। নেই সেখানে লোকবল।
সে দৃশ্য দেখতে সরেজমিনে হাজির হয়েছিলেন বিবিসির সাংবাদিক ম্যাথিউ প্রাসি। তিনি সেখানে দেখেছেন ১০০ মৃতদেহ। তিনি বলেছেন, সেখানে রক্তে ভিজে যাচ্ছে অনেক আহত ব্যক্তি। তারা নিহতদের পাশে অবস্থান নিয়ে বাঁচার নিরনত্মর চেষ্টা করছেন। অন্ধকার রাতে লাশের পাশে এভাবে জীবনমৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করা খুবই কঠিন।
চিলির এক শানিত্মরড়্গী বলেছেন, উদ্ধার অভিযান কিভাবে চালাবো, কি করবো আমরা জানি না। হাইতির তিনটি হাসপাতাল বাজেভাবে বিধ্বন্ত হওয়ার পরে অস্থায়ী কেন্দ্রে চিকিৎসকরা সেবা দিচ্ছেন। কানাডার চিকিৎসক দলের ব্যবস্থাপক পল ম্যাকফান বলেন, আমাদের কাছে মাথায় গুরুতর আঘাত, থেঁতলে যাওয়া অঙ্গপ্রতঙ্গ এবং অন্যান্য গুরুতর রোগী আছে, যাদের এই সীমিত আয়োজনে চিকিৎসা দেয়া সম্ভব নয়। ইউনির্ভাসিটি অব মিয়ামি’র মেডিকেল স্কুল একটি বিমান ভর্তি করে একদল চিকিৎসক ও নার্স পাঠিয়েছে।
সব দেশের প্রতি সাহায্যের আহ্বান
হাইতি পশ্চিম গোলার্ধের সবচেয়ে দরিদ্র দেশ।
সেখানে অবকাঠামো এবং কৃষিখাতে কোন বিনিয়োগ নেই। এর ফলে দেশটি সবচেয়ে ‘দরিদ্র’ নাম ধারণ করেছে। সেখানে মোট জনসংখ্যার তিন-চতুর্থাং মানুষ দিনে দুই ডলারেরও কম উপার্জন করে। শতকরা ৫০ ভাগের উপার্জন এক ডলার। সাব-সাহারা এলাকার সবচেয়ে দরিদ্র এ দেশ।
সেখানে মাটি আর লবণ দিয়ে বানানো হয় বিস্কুট। মানুষ বেঁচে থাকার তাগিদে তাই কিনে খায়। পোর্ট অব প্রিন্সে বসবাসকারীদের অর্ধেক মানুষ পায় না সুপেয় পানি। এই হতদরিদ্র মানুষদের প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে আহ্বান জানানো হয়েছে। গতকাল এ রিপোর্ট লেখা পর্যনত্ম আনত্মর্জাতিক সমপ্রদায়ের সাহায্য তৎপরতা প্রক্রিয়াধীন ছিল।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশ সেখানে দ্রম্নত উদ্ধার অভিযান ও সাহায্য সরবরাহের জন্য সহায়তা পাঠানোর পর্যায়ে ছিল। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক হোসেন ওবামা হাইতিকে পূর্ণউদ্যোমে সাহায্য করার জন্য আহ্বান জানিয়েছেন। ইতিমধ্যে যুক্তরাষ্ট্র বিমানবাহী বিমান, তিনটি জাহাজ পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছেন। ওই তিনটি জাহাজের একটিতে বহন করা যাবে ২ হাজার নৌসেনা। যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন স্থানে অবস্থান করছেন প্রায় ২ লাখ ৭৫ হাজার হাইতির নাগরিক।
তারাও দেশের জন্য অর্থ সাহায্য তুলছেন। ইতিমধ্যে হাইতিতে আনত্মর্জাতিক সাহায্য সংস্থার কর্মকর্তা, কর্মচারীরা তৎপরতা শুরম্ন করেছেন। জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি মুন বলেছেন, জাতিসংঘের কেন্দ্রীয় জরম্নরি তৎপরতা বিষয়ক তহবিল থেকে অবিলম্বে এক কোটি ডলার ছাড় দেয়া হচ্ছে। সাহায্য দিচ্ছে বাংলাদেশ, ফ্রান্স, স্পেন, জার্মানি, নেদারল্যান্ড, ইউরোপিয় ইউনিয়ন, চীন, কিউবা, কানাডা প্রভৃতি দেশ। জাতিসংঘে হাইতির বিশেষ প্রতিনিধি ও সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন বলেছেন, আমাদের আরো হেলিকপ্টার লাগবে।
সবচেয়ে জরুরি হলো ধ্বংসাবশেষের ভেতরে আটকে থাকাদের মধ্যে যতো বেশি সম্ভব মানুষ জীবিত অবস্থায় উদ্ধার করা। বিশ্বব্যাংক অতিরিক্ত ১০ কোটি ডলার তহবিলের প্রস্তাব করেছে।
দৈনিক মানবজমিন, ১৪ই জানুয়ারিতে প্রকাশিত
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।