বাংলার মাটি বাংলার জল, বাংলার বায়ু, বাংলার ফল, পুন্য হউক, পুন্য হউক, পুন্য হউক, হে ভগবান। বাংলার ঘর, বাংলার হাট, বাংলার বন, বাংলার মাঠ, পুর্ন হউক, পূর্ন হউক, পূর্ন হ্উক, হে ভগবান। রবীন্দ্রনাথ
আমি কাল সকালের ট্রেনে ঐশীকে নিয়ে ওসমানপুর যাচ্ছি। সালমা বলল।
সময়টা মাঘের শেষ।
আশরাফের ভ্রুঁজোড়া কুঁচকে ওঠে। প্রতিবছর মাঘের শেষে সালমা ওসমানপুর যায় । ওসমানপুর সালমার বাবার বাড়ি। জায়গাটা মেঘনা নদীর পশ্চিম পাড়ে। অফুরন্ত ধানের ক্ষেত আর সেই অফুরন্ত ধানের ক্ষেতের মাঝখান দিয়ে চলে গেছে একটি উত্তরমুখি রেললাইন ।
আশরাফের শ্বশুড়বাড়ির আঙিনা থেকে দেখা যায় সে অফুরন্ত সোনালি শষ্যক্ষেত্র। সাত বছর বিয়ে হয়েছে, আশরাফ জানে না, ওসমানপুরে বিল আছে কি না; প্রশ্নটি কখনও সে সালমাকে জিজ্ঞেস করেনি। ওসমানপুর গ্রামটি যদিও শ্যামল। শ্যামল আর সবুজ।
আজ সকালের ট্রেনে ঐশীকে নিয়ে ওসমানপুর চলে গেল সালমা।
অফিস থেকে ফিরে ফাঁকা ঘরদোর। বুকের ভিতরে জমে ওঠা ক্রস্ত শূন্যতা টের পায় আশরাফ। পুরনো কিছু অভ্যেস ফিরিয়ে আনে সে। একটার পর একটা সিগারেট টানে। সিগারেটের ধোঁওয়া সালমা সহ্য করতে পারে না।
ওদের বিয়েটা লাভ ম্যারেজ নয় বলেই বিয়ের আগে দু-পক্ষই অচেনা ছিল দু’পক্ষের কাছে। বিয়ের পর জানা গেল সিগারেট বস্তুটি সালমার দুচক্ষের বিষ। তবে সালমার রান্নার হাত ভালো। কিশোরগঞ্জের মেয়ে বলেই হয়তো। মফস্সল থেকে আসা সংগ্রামী মানুষ আশরাফ; মেসের রান্না খেয়ে খেয়ে পেটে চার পড়ে গেছে, যে কারণে সিগারেট একেবারে ছেড়ে দিতে না পারলেও কমিয়ে দিতে থাকে ।
সংসারে দু-পক্ষ সম্ভবত এভাবেই ব্যালেন্স করে ; বিয়ে হয়েছে বছর সাতেক, একটাই মেয়ে, ঐশী; ঐশী ক্লাস ওয়ানে পড়ে।
ফাঁকা ঘরদোরে ভাববার অবসর মেলে। ব্যাঙ্কের কাজ আর ঘর-সংসার ভালো লাগার কথা না আশরাফের। মাঘের শুনশান অটুট নীরবতায় ফাঁকা ঘরদোরে মূলত ঝুমুরের স্মৃতিই মনে হয় তার। ধোঁওয়ার কুন্ডলীতে পাক খায় একটি শ্যামলা কিশোরী মুখ।
ঘটনা সামান্য। সম্ভবত মহাকাল মনে রাখেনি। ঘটনা এই- আশরাফের চাচাতো বোন ছিল ঝুমুর। দু’জনই কিশোরগঞ্জ জেলার মিটামইন উপজেলার কেওড়জরি গ্রামে বেড়ে উঠছিল। বালক বয়েসের শেষে পৌঁছে একটা সময়ে সচেতন হয়ে উঠেছিল কিশোর আশরাফ-ঝুমুর অন্যরকম।
ঝুমুরকে নিয়ে সবার চোখের আড়ালে গেলে সমস্ত শরীর ঝমঝম করে বাজতে থাকে । কানের লতি উষ্ণ হয়ে উঠতে থাকে, ঠোঁট দুটি স্ফুরিত হয়ে উঠতে থাকে একটি দীর্ঘ চুম্বনের তৃষ্ণায়। এবং কেওড়জরি গ্রামটি শ্যামল। শ্যামল আর সবুজ। সেই সবুজে শ্যামলে জড়াজড়ি করে বেড়ে উঠছিল দুটি কিশোর-কিশোরী- সবার চোখের আড়াল হলেই যাদের শরীর দুটি ঝমঝম করে বাজত।
মিটামইন উপজেলাটি আসলে বিলময় একটি স্থান। সে বিল আবার শীতকালীন পাখিদের আবাস। ভোরবেলা বিলের চরে দৌড়ে যেত দুটি বালক-বালিকা আর চুরি করে আনা বড় আব্বার ইয়ারগানের গুলিতে নিরীহ বালিহাঁস হত্যার গভীর গ্লানী পরস্পরকে পরস্পরের আরও কাছাকাছি করে তুলছিল ...
আর, সে সবের ওপর ঝরেছিল মাঘ শেষের বিস্ময়কর রোদ ।
কিশোর আশরাফের বিস্ময় ও বেদনা সৃষ্টি করে কিশোরী ঝুমুর মাত্র দু-দিনের জ্বরে আচ্ছন্ন হয়ে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেছিল ; বিস্ময় ও বেদনা এই কারণে যে, তখনও মাঘের ঝলমলে ক’টা দিন বাকি, শীত শেষ হয়ে আসছে যদিও।
এখনও মাঘের দিনে সেসব কথা মনে হয়।
ফাঁকা ঘরে ঝুমুরের সঙ্গে কত কথা হয়।
আরেকবার।
না।
এই শেষ।
না।
মাঘ শেষে এলোমেলো হয়ে যায় আশরাফ।
সালমা ওসমানপুর গেলে সাধারনত ২/১ দিনের বেশি থাকে না। থাকা যায় না। সম্পত্তি নিয়ে তিন ভাইয়ের নিত্য লাঠালাঠি; বোনেরা গেলে সন্দেহ করে। আশরাফের অন্ধ শ্বশুর দাওয়ায় বসে ঝিমোন ।
কখনও আশরাফ যায় ওসমানপুর, সালমা-ঐশীদের নিয়ে আসতে । বৃহস্পতিবার রাতের ট্রেন ধরে। ট্রেন থেকে নেমে একটি অমলিন ভোর। স্টেশন-সংলগ্ন চাস্টলে চা খেয়ে সিগারেট ধরায় আশরাফ। রিকশায় ওঠে।
প্রচন্ড শীতবোধ হয় তার। আর, ধূসর কুয়াশা। নির্জন গ্রাম্যপথ। রিকশার টুংটাং। সারা পথে একটি প্রশ্নই ওকে তাড়া করে ফেরে।
প্রতিবছর মাঘের শেষে সালমাকে ওসমানপুর আসতেই হয় । কেন? সাত বছর বিয়ে হয়েছে, আশরাফ এখনও জানে না, ওসমানপুরে বিল আছে কি না; ওসমানপুর গ্রামটি যদিও শ্যামল। শ্যামল আর সবুজ। সেই শ্যামলে সবুজে জড়াজড়ি করে দুটি কিশোর-কিশোরী বেড়ে উঠছিল কি? যাদের শরীর দুটি সবার চোখের আড়াল হলেই ঝমঝম করে বাজত? আর, সে সবের ওপর ঝরত মাঘ শেষের বিস্ময়কর রোদ?
ওসমানপুর থেকে ফেরার পথে হয়তো শেষ মাঘের ঝকঝকে রোদ।
সালমার করুন মুখ ট্রেনের জানালায়- বাইরে তাকিয়ে থাকে।
ঐশী বসেছে মায়ের কোলে। আশরাফের চোখ পত্রিকায় । হয়তো একটি ছোট্ট শিরোনামে চোখ আটকে যায়: কিশোরগঞ্জ জেলার মিটামইন উপজেলায় বাস- ট্রাকের সংঘর্ষে তিন জন নিহত।
কতকাল আগে দেখা ঝুমুরের মুখটা চকিতে ভেসে ওঠে।
দীর্ঘশ্বাস ফেলে আশরাফ।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।