আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

কালো ঘোড়ার ফ্যান্টাসি

ব্যাঘ্র যুগে শুধু মৃত হরিণীর মাংস পাওয়া যায় ''যুদ্ধজয়ী বীর মোহাম্মদ হানিফা এজিদ-হননে ব্যর্থ হওয়ায় রাগে উন্মাদপ্রায় হয়ে ঘোড়া চালাতে চালাতে শহরে ঢুকলেন। হাতে তাঁর উদ্যত তলওয়ার। দুই প্রহরী আর এক পথিক প্রাণ দিল তাঁর হাতে। তখন আকাশবাণী হল, তাঁকে নির্দেশ দেওয়া হল থামতে। কিন্তু একদিকে স্রষ্টার প্রতি ভয় আর আরেকদিকে এজিদের প্রতি তীব্র রোষানল ও ক্ষোভের এক করুণ সংমিশ্রণ তাঁকে থামতে দিল না।

তিনি দুলদুল চালনা অব্যাহত রাখলেন। তখন পুনরায় বজ্রনির্ঘোষে বাণী ভেসে এলো, ' মোহাম্মদ হানিফা! বিনাশ করা অতি সহজ, রক্ষা করা কঠিন! সৃজন করা আরও কঠিন। এত প্রাণী বধ করিয়াও তোমার বধেচ্ছা নিবৃত্তি হইল না! জয়ের পর বধ অপেক্ষা পাপের কার্য জগতে আর কি আছে? তুমি মহাপাপী! তোমার প্রতি ঈশ্বরের এই আজ্ঞা যে, দুলদুল সহিত রণবেশে রোজ কেয়ামত পর্যন্ত প্রস্তরময় প্রাচীরে বেষ্টিত হইয়া আবদ্ধ থাক। ' সাথে সাথে মাটি ফুঁড়ে বিশাল বিশাল পাথরের স্তম্ভ উঠে দাঁড়াল, হানিফাকে ঘিরে ধরে এক অভেদ্য দেয়াল গড়ে তুলল। আজ সে দেয়াল পরিণত হয়েছে বিশালাকার এক পাহাড়ে, কান পাতলে আজো শোনা যায় ঘোড়ার পদধ্বনি।

হানিফা ছুটে চলেছেন আজো। '' বড়বু'র গল্প ঠিক এভাবেই প্রতি রাতে শেষ হত। কথার ভঙ্গি এমন ছিল, আমরা হানিফাকে ঠিক যেন চোখের সামনে দেখতে পেতাম। বুক উথালপাথাল করে উঠত কি জানি অদম্য এক বেদনায়। বিনা কারনেই চোয়াল দৃঢ় হয়ে যেতো।

রণবেশে হানিফাকে ভাবতে ভাবতে একটা সময় ঘুমিয়ে পড়তাম। সকালে উঠেও কি ভাবনাটা যেত? সারাদিন ঘুরে বেড়াতাম এবাড়ি ওবাড়ি, তারপর চলে যেতাম পুকুরপাড়ে। হাতের কঞ্চিটা হত তলোয়ার, আর পুকুরপাড় ঘেঁষে ঝুঁকে থাকা আমগাছটার যে ডালটা একেবারে পুকুরের মাঝ পর্যন্ত চলে গেছে, সেটা হত ঘোড়ার রাজা, দুলদুল। সমস্যা হল দুলদুলে একা বেশিক্ষণ চড়া যেত না। বাকিরা উঠে এসে ডাল ঝাঁকাতে শুরু করত।

তারপর আর কি, ঝপ্পাস! সময় কাটতে লাগল। বড়বু'র বিয়ে হল, আমরা হাতে পায়ে বাড়ছি, গোঁফের ক্ষীণ রেখা বেরোচ্ছে নাকের নিচে। একসময় স্কুলের বড় ভাই হয়ে গেলাম, উঠলাম টেনে। ক্লাস টেনে উঠে নতুন এক বাংলা সারকে পেলাম। প্রথম ক্লাসেই সার বললেন, 'দেখি তো, তোমরা 'মুক্তহস্তে' কিরকম লিখতে শিখেছ।

যার যার ফ্যান্টাসি নিয়ে দু'লাইন লেখ। ' আমরা ভেবেছিলাম নারীজাতির মুক্তি বা বেকার সমস্যা এই টাইপের কিছু নিয়ে লিখতে হবে। কিন্তু ফ্যান্টাসি আবার কি জিনিস? সার বুঝিয়ে দিলেন, 'ধর এমন কোন কাজ যা তুমি করার কথা প্রায়ই চিন্তা কর, কিন্তু বাস্তবে তা করার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। কিংবা অলীক কোন কল্পনা, যা স্রেফ ভাবার জন্যে ভাবা, ভেবে তুমি আনন্দ পাচ্ছ, রোমাঞ্চ হচ্ছে - সেটাই ফ্যান্টাসি। ' আমি কিছু না ভেবেই লিখতে শুরু করলাম।

আমার 'ফ্যান্টাসি' ততদিনে আরও পূর্ণ ও আধুনিক হয়েছে। এমনটা কিছু লিখেছিলাম বোধহয়- 'রাত হয়েছে। বিশাল এক চাঁদ সীমাহীন এক সবুজ উপত্যকায় নেমে এসে আলো ছড়াচ্ছে। আকাশ মেঘে ভরতি, চারিদিক নিস্তব্ধ। হঠাৎ ঘোড়ার খুরের শব্দ।

অমাবস্যার মত কালো এক আরবি ঘোড়া চাঁদ লক্ষ্য করে ছুটে চলেছে। টগবগ টগবগ, টগবগ টগবগ। আর ঘোড়ার পিঠের সাথে শরীর মিশিয়ে বেদুইনের পোশাকে আমি বসে। চাঁদের চোখে চোখ রেখে এগুচ্ছি। হাতে বুনোফুল তৈরি।

অখণ্ড মনোযোগ, সতর্ক লাগাম, তীক্ষ্ণ দৃষ্টি। চন্দ্র-শিকারির কি অমনোযোগী হলে চলে?' সার সেদিন লেখা পড়ে পিঠ চাপড়ে দিয়েছিলেন। আর আমি, ক্লাসের সবচে হাবা ছেলে, একটুও যে গর্বিত হইনি তা বললে মিথ্যে বলা হবে। অন্যরা কি লিখেছিল সব বিস্তারিত মনে নেই। দু'একটা মাথায় আসছে।

শিরিন, ক্লাসের ফার্স্ট গার্ল, লিখেছিল, 'আমি কবিগান করব। বাংলাদেশের মানুষ এক নামে আমাকে চিনবে, আর বিদেশ থেকে আমাকে ডাকবে গান করার জন্য। ' আমরা কলেজে উঠতেই শিরিনের বিয়ে হয়ে গেল। কি করবে, বেচারির বাবা-মা ভাল পাত্র হাতছাড়া করতে চান নি। শিরিন এখন দুই ছেলের মা, জামাই কোন এক ব্যাঙ্কের একাউন্ট্যান্ট।

বনানী থাকে। কাদের, পাগলাটে কাদের লিখেছিল সাধুভাষায়, 'হিমালয় অত্যন্ত দুর্গম-সঙ্কুল স্থান। এই রহস্যময় স্থানে বহু ক্ষমতাশালী সাধু আসিয়া সাধনা করেন। আমি উক্ত স্থানে গিয়া তাহাদের শিষ্যত্ব গ্রহণ করিয়া সন্ন্যাস লইব। ' অবশ্য ক্লাসের বাইরে এসে ফিচেল হাসি দিয়ে বলেছিল, 'দোস্তো, আসল ইচ্ছাটা তো লিখতেই পারলাম না।

আমি নাগা সন্ন্যাসী হবো। ' নাগা সন্ন্যাসী কাদের বর্তমানে আছে লন্ডনে। ওর ভাষায় 'কামলা' দিতে গিয়েছিল, ভাগ্যগুণে এখন ছোটখাটো রেস্তোরাঁয় কাজ করে। মাঝেমধ্যে কল-টল করে। অনেক পাল্টেছে, তবু আমাদের কাছে এখনও নাঙা বাবা-ই আছে।

আর হ্যাঁ, আমির। আমির লিখেছিল, 'আমি সবচে বড় ডাক্তার হব। বিশ্বের সবচে বড় ডাক্তার। ' সার লেখা পড়ে হেসেছিলেন। 'বোকা ছেলে, এটা তো অ্যাম্বিশন।

জীবনের লক্ষ্য। আমি লিখতে বলেছি ফ্যান্টাসি। ' আমরা কেউ হাসিনি। সার জানেন না। আমিরের মা মানসিক রোগী।

বছরে আট মাস তিনি ঘরে বন্দি থাকেন। কেউ কাছে গেলে বিশ্রী গালিগালাজ করেন। তখন আমিরকেও দেখতে পারেন না। আমির আট মাস থাকে এখানে, ওর মামার বাড়িতে। বাকি চার মাস মায়ের কাছে থাকে।

এসএসসির পরে আমি এলাম ঢাকায়। ছ'মাস পর ছুটিতে বাড়ি গিয়ে ওকে আর পাইনি। আর কখনো দেখাও হয় নি। কে জানে, হয়তো আমাদের মাঝে ওরই ফ্যান্টাসি একমাত্র সফল হবে। সবার লেখা পড়ার পর রাকিব সারকে জিগ্যেস করেছিল, 'সার, আপনার ফ্যান্টাসি কি, বলেন না।

' সার বলেছিলেন, 'আমার একটা ইচ্ছে আছে বটে। ধর, সুন্দর সুন্দর যে সব গল্প উপন্যাস তোমরা পড়, সেগুলোর প্রধান প্রধান চরিত্রকে যদি চাক্ষুষ দেখতে পেতে, কি দারুন হত না? তেমনি আমার যদি এমন ক্ষমতা থাকত যে আমি কোন স্টোরি পড়লে সেটাকে সত্যে, রিয়ালিটিতে পরিণত করতে পারি, তাহলে কেমন হত ভাব? কাফকার মেটামরফসিস, শেক্সপিয়ারের হেলেন অফ ট্রয়ের হেলেন- আমি পড়ছি আর এরা শূন্য হতে আমার সামনে ধীরে ধীরে পূর্ণ আকার ধারণ করছে, ভাবতে পার? আবার ধর আমার ইচ্ছে হল, নিজেই একটা গল্প বা উপন্যাস লিখলাম, তারপর নিজের সৃষ্টিকে বিমূর্ত থেকে মূর্ত করলাম। নিজের চোখে দেখলাম। কোন সাহিত্যিক এর চেয়ে বেশি আর কিছু চাইতে পারে, বল? বলতে বলতে সার একটু এক্সাইটেড হয়ে পড়েছিলেন। চোখে অদ্ভুত আলো জ্বলে উঠেছিল।

পরদিন থেকেই সারের নাম হয়ে গেল 'ফ্যান্টাসি সার'। গতকাল, আমাদের সেই ফ্যান্টাসি সার মারা গেছেন। রোড অ্যাকসিডেন্ট। সারের নাম, তিনি কি করতেন, সেসব অর্থহীন। তিনি আমাদের মাঝে অন্য কিছুর বিকাশ ঘটিয়েছিলেন, সেটাই গুরুত্বপূর্ণ।

যেখানে অন্যান্য সাররা ক্লাসে পড়া দিয়েই বেঁচে যেতেন, পরেরদিন বেত হাতে পড়া আদায় করাটাকে স্বাভাবিক ভাবতেন, সেখানে ছাত্রদের অন্য কিছু, নতুন কিছু শেখানোর দায়টা সার স্বেচ্ছায় ঘাড়ে তুলে নিয়েছিলেন। কত কত প্রোজেক্ট সারের! টেনের শেষে আমরা নাটক করলাম, সারের উৎসাহে। বিজ্ঞানের মেলায় আমাদের স্কুল সেবার প্রথম গেল, তাও সারের দৌড়াদৌড়ির ফসল। আসাদ চারুকলায় যাবে, ওর বাবা মাকে রাজি করালেন সার। ভালো ছাত্র রাকিব ঢাকার কলেজে ভর্তি হবে, সার তাঁর এক আত্মীয়কে দিয়ে ওর থাকার ব্যবস্থা করালেন।

তাঁকে সম্মান জানিয়ে কিছু লিখব, সে ক্ষমতা আমার নেই। যারা স্বপ্ন দেখাতে পারেন, তারা এ তুচ্ছ অর্ঘ্যের বহু ঊর্ধ্বে। স্রেফ বলতে পারি, 'দেখি তো, আপনারা 'মুক্ত মস্তিষ্কে' কেমন ভাবতে শিখেছেন। যার যার ফ্যান্টাসি নিয়ে দু'মিনিট ভাবুন। ' কালো কুচকুচে ঘোড়ারা দৌড়াক না, ক্ষতি কি তাতে? ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে ১৬ বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.