এম এম আকাশআমি ছোটবেলায় একটি বিশেষ প্রজন্মের বিপ্লবীদের দূর থেকে হলেও চাক্ষুষ দেখার সৌভাগ্য অর্জন করেছিলাম। তাদের মধ্যে সবচেয়ে আকর্ষণীয় ছিলেন কমরেড মণি সিংহ। লম্বা, শক্ত গড়নের নির্ভীক এ বৃদ্ধকে দেখেছি জনসভায় দু'পায়ের ওপর খাড়া হয়ে দাঁড়িয়ে মাথার ওপর হাত ঘুরিয়ে হুঙ্কার দিয়ে ঘোষণা করতেন, 'যারাই কমিউনিস্ট পার্টিকে ধ্বংস করতে চেষ্টা করেছে, তারাই শেষ পর্যন্ত ধ্বংস হয়ে গেছে। '
তার সেই তেজোদীপ্ত কণ্ঠস্বর শুনে তখন তরুণ বয়সে অনুপ্রাণিত হয়েছি, শিহরিত হয়েছি।
তারই পাশে আবার লক্ষ্য করেছি, অত্যন্ত স্থিতধী অভিজাত চেহারার সম্পূর্ণ সাদা চুলের অধিকারী, আত্মপ্রত্যয়ী, পুর লেন্সের চমশা পরা আরেক বিপ্লবী কমরেড অনীল মুখার্জিকে।
তার পৃথিবী বিখ্যাত বই 'শ্রমিক আন্দোলনে হাতেখড়ি' পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়ে প্রকাশিত হয়েছে। তার 'সাম্যবাদের ভূমিকা' পাঠ করে পরবর্তী প্রজন্ম বাম আন্দোলনে দীক্ষিত হয়েছে; আবার মুক্তিযুদ্ধের সময় গোকুলনগর ট্রানজিট ক্যাম্প অসীম ন্যায়পরায়ণ, কঠোর নিয়মানুবর্তী ও মিতব্যয়ী বিপ্লবী জ্ঞান চক্রবর্তীকে দেখেছি নিখুঁত দক্ষতায় ক্যাম্প পরিচালনা করতে।
তাদের দেখে বুঝেছি কেন এবং কীভাবে তদানীন্তন 'পূর্ব পাকিস্তান'-এ অত্যন্ত প্রতিকূল পরিবেশেও একটু করে একটি যৌথ শিল্পকর্মের মতো কমিউনিস্ট পার্টি বিকশিত হয়েছিল। কমিউনিস্ট পার্টি গড়ে তোলার বাস্তব ভিত্তি নিশ্চিয়ই ছিল। কিন্তু কমিউনিস্ট পার্টির বাড়তি সৌভাগ্য যে, সেখানে ছিলেন মণি সিংহের মতো বিপ্লবী নেতা, অনীল মুখার্জির মতো তাত্তি্বক এবং জ্ঞান চক্রবর্তীর মতো দক্ষ ব্যবস্থাপক।
এ রকম ত্রিগুণের সমাহার থাকলে একটি বামপন্থি আদর্শভিত্তিক পার্টির বিকাশ ত্বরান্বিত হবেই।
তাদের একত্রে আমি 'পূর্বজন্মের বিপ্লবী' হিসেবে অভিহিত করেছি। পরাধীন ভারতবর্ষেই তাদের যাত্রা শুরু হয়েছে এবং শুরুতে তারা কেউ-ই কমিউনিস্ট ছিলেন না। তারা প্রায় সবাই সাধারণভাবে ছিলেন জাতীয়তাবাদী দেশপ্রেমিক। মধ্যবিত্ত-উচ্চবিত্ত ঘরের শিক্ষিত সন্তান হয়েও তারা বৈপ্লবিক কায়দায় তীব্র সংগ্রামের মাধ্যমে ভারত থেকে ব্রিটিশকে বিতাড়িত করতে বদ্ধপরিকর হয়েছিলেন।
এ জন্য ঘর ছাড়তেও দ্বিধা করেননি তারা। তাই মণি সিংহসহ তারা প্রায় প্রত্যেকেই কিশোর বয়সেই পরাধীন ভারতবর্ষের তথাকথিত 'সন্ত্রাসবাদী' দুটি সংগঠন 'অনুশীলন' ও 'যুগান্তর'-এর সদস্যপদ গ্রহণ করেছিলেন। কংগ্রেসের নিরামিষ গণআন্দোলন এবং দোদুল্যমানতা তাদের কাছে মোটেও গ্রহণযোগ্য হয়নি। তাদের বিপ্লবী রোমান্টিক হৃদয়কে আকৃষ্ট করেনি। তারা শুরুতে, এমনকি সশস্ত্রভাবে ইংরেজ শত্রুদের ব্যক্তিগতভাবে বোমা মেরে হত্যা করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিলেন।
কিন্তু প্রত্যেকেই কোনো না কোনো সময় এ উপলব্ধিতে পেঁৗছেছিলেন, সন্ত্রাসবাদী কায়দায় ব্যক্তি হত্যার মাধ্যমে দেশমাতৃকার স্বাধীনতা অর্জিত হবে না। কারো কারো উপলব্ধি এখানেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। বিশেষ করে তাদের মধ্যে যারা জেলে মার্কসবাদী সাহিত্য পড়ার সুযোগ পেয়েছিলেন, তারা দ্রুত এ সিদ্ধান্তে উপনীত হন, ভারতের স্বাধীনতার জন্য প্রয়োজন ভারতীয় জনগণের যৌথ জাগরণ এবং তাদের উদ্দীপ্ত জাগরণের জন্য শুধু রাজনৈতিক স্বাধীনতার আদর্শ যথেষ্ট হবে না। এ জন্য প্রয়োজন হবে মূর্ত অর্থনৈতিক মুক্তির একটি নির্ভরযোগ্য দর্শনের। সে সময় হাতের কাছে এ ধরনের মাটির কাছাকাছি আদর্শ যেটি ছিল, তা হচ্ছে মার্কসবাদ-লেনিনবাদ কমিউনিজমের আদর্শ।
জেলের অখণ্ড অবসর অথবা গ্রামের বাড়িতে অন্তরীণ থেকে ব্রিটিশ শাসকদের আমদানিকৃত সস্তা মার্কসবাদী লিটারেচার (কারণ ব্রিটিশরাজ তখন সন্ত্রাসবাদের তুলনায় কমিউনিজমকে অধিক নিরাপদ ভেবেছিলেন) পড়ে ঝাঁকে ঝাঁকে তরুণ সন্ত্রাসবাদী কমিউনিস্ট মতবাদে দীক্ষিত হতে শুরু করেছিলেন। এ প্রক্রিয়ার একটি অনন্য চিত্র আমি নিচে তুলে ধরছি এর প্রতীক প্রবাদপ্রতিম কমরেড মণি সিংহের নিজস্ব জবানবন্দিতে। তিনি তার 'জীবন-সংগ্রাম' গ্রন্থের 'আন্দোলনে হাতেখড়ি' অধ্যায়ের লিখেছেন_ '১৯২১ সালে ভারতব্যাপী যখন অসহযোগ ও খিলাফত আন্দোলনের ব্যাপক জাগরণ সৃষ্টি হয়, তখন অনুশীলন পার্টির পক্ষ থেকে আমাদের এই বলে বিরত করা হয়, সশস্ত্র সংগ্রাম ছাড়া অহিংস উপায়ে ব্রিটিশ সরকারকে উচ্ছেদ করা যাবে না। অহিংসা প্রচার করে বিপ্লবী চেতনাকে খর্ব করা হচ্ছে। ... কংগ্রেস খিলাফতের আন্দোলনে আমরা কিছুটা প্রভাবাম্বিত হয়েছিলাম।
এ আন্দোলনে সন্ত্রাসবাদীদের ভূমিকা দেখে আমরা সন্ত্রাসবাদী নীতিতে কিছুটা হতাশ হয়ে পড়ি। আমাদের মধ্যে একটা চিন্তা আসে, ব্রিটিশ সরকারের কয়েকজন উচ্চপদস্থ কর্মচারীকে খতম করে দেশের স্বাধীনতা অর্জন করা যাবে না। বিপ্লব করা দরকার। সে জন্য চাই অনেক মানুষ, জঙ্গি লোক। নচেৎ কিছুই করা যাবে না।
' [কমরেড মণি সিংহ স্মারকগ্রন্থ, সম্পাদনা এম এম আকাশ ও অন্যান্য, জাতীয় সাহিত্য প্রকাশনী, ২০০৫ সেপ্টেম্বর, ঢাকা,পৃ. ৬৬]
উলি্লখিত উদ্ধৃতি থেকে বোঝা যায়, কমরেড মণি সিংহের ভেতরে ভেতরে সন্ত্রাসবাদের অপর্যাপ্ততা নিয়ে একটি বোধ ১৯২১ সালেই ধীরে ধীরে ঘনীভূত হচ্ছিল। কিন্তু গণআন্দোলনের প্রয়োজন অনুভব করা এক জিনিস আর এ জন্য প্রয়োজনীয় গণভিত্তি গড়ে তোলা হচ্ছে আরেক জিনিস। কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের যে অবাম ধর্মভিত্তিক মতাদর্শ ছিল, বুর্জোয়া, পেটিবর্জোয়া বা জমিদার-ভূস্বামী শ্রেণীর সদস্য হিসেবে সমাজে তাদের যে শক্ত সামাজিক ভিত্তি ছিল, তা কমরেড মণি সিংহ ও তার সহচরদের ছিল না। সমস্যাটিকে আমরা গ্রামসির ভাষায় 'হেজিমনি' (ঐবমবসড়হু) বা 'প্রাতিষ্ঠানিক আধিপত্যের' অভাবের সমস্যা হিসেবেও বর্ণনা করতে পারি। এ ধরনের প্রাতিষ্ঠানিক বা সংগঠিত গণভিত্তি ছাড়া গণআন্দোলন গড়ে তোলা এবং তাকে দৃঢ়ভাবে সামনে এগিয়ে নেওয়া সম্ভব হচ্ছিল না।
লক্ষ্যস্থির করার পরের প্রশ্ন হচ্ছে উপায় বা কৌশলের প্রশ্ন, সেটি সমাধানের এক অভিনব পন্থা গ্রহণ করলেন দুই বন্ধু। তারা ঠিক করলেন, নিজেদের গ্রাম ছেড়ে (সুসং-দুর্গাপুর থেকে ১০ মাইল দূরে 'কালিকাবাড়ী'তে) দূরে গিয়ে তারা কাজ শুরু করবেন, যাতে অভিভাবকরা তাদের কাজের কথা না জানতে পারেন। কিন্তু কী কাজ করবেন তারা সেখানে? সেটি তারাও প্রথমে জানতেন না এবং এই অকপট অভিজ্ঞতা ঘাটতি থেকে তারা ঠিক করলেন, ব্যাপারটি তারা হাজং মাতবরদের কাছ থেকেই জেনে নেওয়ার চেষ্টা করবেন। 'জনগণ কী চায়, তা জনগণই বলুক'_ এ রকম একটি ধারণা থেকে এ অপকস্ফ কিশোরদ্বয় জনগণের কাছে গেলেন। বাকিটুকু আবার শোনা যাক কমরেড মণি সিংহের মুখ থেকে।
তিনি বলছেন_
''তাদের কাছে জানতে চাইলাম, তারা কেমন আছেন? কি হালচাল চলছে ইত্যাদি। এর উত্তরে তারা বললেন, 'কে আমাদের দেখে? আমাদের ছেলেপেলেদের লেখাপড়া শেখানোর জন্য এখানে কোনো স্কুল নেই। এরা মূর্খ হয়ে থাকবে। আপনারা সরকারকে বলে আমাদের এখানে ছোট ছেলেদের পড়ার জন্য যদি স্কুল বসাতে পারেন, তবে খুব উপকার হয়। তাছাড়া আমরা হচ্ছি হিন্দু ধর্মাবলম্বী।
আমাদের হাতে উচ্চ শ্রেণীর হিন্দুরা পানি খান না। আমরা সমাজে পতিত হয়ে রয়েছি। এর প্রতিকার চাই। আর একটি বিষয় হচ্ছে কোনো বাঙালি পুরোহিত আমাদের কোনো পূজা করেন না। এসবই আমাদের সমস্যা।
[প্রাগুক্ত, পৃ. ২৬৭]
তিনটি সমস্যার কথা সেদিন হাজং জনগণ মণি সিংহ এবং তার সহকর্মীকে জানিয়েছিলেন। শিক্ষার সমস্যা, মর্যাদার সমস্যা এবং ধর্মীয় সমস্যা। মণি সিংহরা প্রথম কাজ শুরু করলেন এসব সমস্যা সমাধানের জন্য সমাজসেবার মাধ্যমে। ফলাফল কী হলো? মণি সিংহই লিখেছেন, 'পাহাড় এলাকায় কয়েক মাইল দূরে দূরে স্কুল স্থাপন করেছিলাম। হারান বাগচী নামে আমাদের এক সমর্থককে পুরোহিত হিসেবে হাজংদের পূজা করার জন্য পাঠানো হয়।
তাতে তার কিছু অর্থপ্রাপ্তিও হতো। আমরা তো হাজংদের পানি পান করতামই। ' [প্রাগুক্ত পৃ. ২৬৭]
বোঝা যাচ্ছে 'ব্যক্তিগত হত্যা-সন্ত্রাসবাদ' থেকে মণি সিংহ মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন। মনোযোগ দিচ্ছেন গণসম্পৃক্তি এবং গণকাজের দিকে। ঠিক এই সময় ১৯২৫ সালের ডিসেম্বরে ময়মনসিংহ থেকে রুশফেরত বিপ্লবী গোপেন চক্রবর্তীকে সুসং-দুর্গাপুরে পাঠানো হয়।
গোপেন চক্রবর্তী তখন রাশিয়া থেকে সন্ত্রাসবাদ শিখতে গিয়ে উল্টো কমিউনিস্ট হয়ে ভারতবর্ষে ফিরে এসেছেন। তিনি সুসং-দুর্গাপুরে এসে মণি সিংহদের স্বতঃস্ফূর্ত শুভ চেতনার সীমাবদ্ধতা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন। পুরো ঘটনাটা ঘটল গোপেন চক্রবর্তী এবং মণি সিংহদের মধ্যে পারস্পরিক এক স্বাধীন সংলাপের মাধ্যমে। এখানে কোনো উচ্চ-নীচ 'হায়ারার্কি' (ঐরবৎধৎপযু) ছিল না। দুই স্বাধীন শক্তির দ্বান্দ্বিক সংলাপের মাধ্যমেই বিষয়টি অগ্রসর হয়েছিল।
সমগ্র প্রক্রিয়াটি চমৎকার বর্ণনা দিয়েছেন মণি সিংহ_
''গোপেন চক্রবর্তী জিজ্ঞাসা করলেন, 'তোমরা এখানে কি করছ?' আমরা বললাম, 'আমরা স্কুল করেছি। এদের ব্রাহ্মণ দিয়েছি এবং এদের ইচ্ছা অনুযায়ী এদের হাতে আমরা পানি খাচ্ছি। এদের পক্ষে আনার চেষ্টা করছি। কারণ ব্রিটিশদের তাড়াতে হলে বহু লোকের দরকার। এরা সাহসী, সৎ এবং দুর্ধর্ষও বটে।
তাছাড়া এদের মধ্যে আমাদের জনপ্রিয়তা বেড়েছে। এদের আমরা সঙ্গে পাব। ' এ কথা শুনে গোপেন চক্রবর্তী বললেন, 'তোমরা ভস্মে ঘি ঢালছ। ' আমরা এতে খুব ক্ষুব্ধ হয়ে উঠলাম। আমাদের এসব কাজের কোনো স্বীকৃতি না-ই একেবারে তুচ্ছ করে দিচ্ছে।
" [প্রাগুক্ত পৃ. ২৬৮]
সেদিন আসলে বামপন্থি আন্দোলনের অতি পুরনো একটি 'ডিসকোর্স' বা 'পাঠকে' কেন্দ্র করে গোপেন চক্রবর্তী এবং মণি সিংহের মধ্যে আলোচনা হয়েছিল। সেটি হচ্ছে 'সংস্কার' আন্তঃসম্পর্ক নিয়ে। গোপেন চক্রবর্তী বিপ্লবের বার্তা নিয়ে এসেছিলেন। আর মণি সিংহ ও তার সহচররা তখন সংস্কারের মধ্যে নিমজ্জিত ছিলেন। আসলে দুই বার্তা ও কর্মক্ষেত্র পরস্পর পৃথক হলেও চুম্বকের দুই মেরুর মতো তা পরস্পর অন্তঃপ্রবিষ্টও বটে।
একই সংগ্রামের নিম্নতম পর্যায় হচ্ছে সংস্কারমূলক আন্দোলন এবং এরই উচ্চতর পর্যায় হচ্ছে রাজনৈতিক বিপ্লবী আন্দোলন। জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত অর্থনীতিবাদী চিন্তাকে সচেতন রাজনৈতিক আন্দোলনে উন্নীত না করলে তা কার্যকর ও টেকসই হয় না। মণি সিংহরা 'মাইক্রো'টা (ব্যাষ্টি) জানতেন; কিন্তু কীভাবে এর 'ম্যাক্রো'র (সমষ্টির) সঙ্গে মেলবন্ধন ঘটাতে হবে, তা তারা জানতেন না। সেদিন সুসং-দুর্গাপুরে সেই নতুন 'ম্যাক্রো' ভাবাদর্শের বীজটি বহন করে এনেছিলেন গোপেন চক্রবর্তী। গোপেন চক্রবর্তীর যুক্তিগুলো কী ছিল, তা মণি সিংহের ভাষাতেই শোনা যাক_ মণি সিংহ লিখেছেন, 'তিনি বললেন,... এ দেশে প্রথমে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদকে উচ্ছেদ করতে হবে সত্য; কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে সামন্ত্রতান্ত্রিক প্রথারও উচ্ছেদ প্রয়োজন।
দেশের গরিব জনসাধারণকে ঐক্যবদ্ধ করতে হলে অর্থনৈতিক ভিত্তিতে আন্দোলন করে তাদের রাজনৈতিকভাবে সচেতন করতে হবে। কেন আমাদের দুর্দশা, কেন আমরা বঞ্চিত-শোষিত, তা জনগণকে বোঝাতে হবে। সামাজিক সংস্কার দিয়ে রাজনৈতিক সাফল্য আনা যায় না। তিনি শ্রেণীসংগ্রামের ওপর বিশেষ জোর দিলেন। গলা ফাটিয়ে তর্কবিতর্ক হলো।
এমন আওয়াজ হলো, বাড়ির বয়স্করা ঘরের সামনে দিয়ে যাতায়াত করতে লাগলেন। তারা ভাবছিলেন ঝগড়া বাধল নাকি! আমি যুবক, আমার গলা ছিল সবচেয়ে চড়া। ' [প্রাগুক্ত, পৃ. ২৬৮] এই তর্কে অবশ্য শেষ পর্যন্ত গোপেন চক্রবর্তী জয়ী হয়েছিলেন। মণি সিংহের দল সন্ত্রাসবাদ পরিত্যাগ করে একজন করে ক্রমেই নিজেদের সীমাবদ্ধতা অনুধাবন করে কমিউনিস্ট আন্দোলনের কাতারে শামিল হতে থাকেন। এ 'আদি বিতর্কের' সমাপ্তি পর্বটি মণি সিংহের রচনায় বর্ণিত হয়েছে নিম্নোক্ত ভাষায়_
"এ অবস্থায় তর্কবিতর্ক কয়েকদিন হলো বটে; কিন্তু গোপেনদা সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে যতটুকু জ্ঞান সঞ্চয় করে এনেছিলেন, তা আমাদের জন্য যথেষ্ট।
কারণ শ্রেণীসংগ্রামের রাজনীতির কথা এর আগে আমরা কখনো শুনিনি। আমরা গোপেনদার যুক্তি মেনে নিলাম। প্রভাত চক্রবর্তী (মণি সিংহের আরেক সাথী) তখন কিছু বলেননি। আমাদের মনে হলো, তিনিও এটি মেনে নিয়েছিলেন। অবশ্য পরে আন্দামান বন্দিশালায় তিনি কমিউনিস্ট মতবাদ গ্রহণ করেন।
এ সময়ে কথা হয়, শ্রমিকরাই সবচেয়ে বিপ্লবী। কাজেই তাদের মধ্যে কাজ আরম্ভ করতে হবে। পরে কৃষকদের মধ্যে আমি বললাম, 'আমি কলকাতায় গিয়ে কাজের একটা ব্যবস্থা করে অন্যদের সেখানে নিয়ে যাব। '' [প্রাগুক্ত, পৃ.-২৬৮]
এরপরের কাহিনী আমাদের অনেকেরই জানা। কীভাবে মণি সিংহ মেটিয়াবুরুজে উর্দুভাষী কারখানা শ্রমিকদের মধ্যে কমিউনিস্ট পরিচালিত ট্রেড ইউনিয়ন গড়ে তুললেন।
গান্ধীজি ও সুভাষ বোসের কংগ্রেসের সঙ্গে কীভাবে তার অম্লমধুর মোকাবেলা হলো, কীভাবে পুনরায় সুসং-দুর্গাপুরে তিনি ফিরে এলেন, কীভাবে কালক্রমে টঙ্গ বিদ্রোহের মহানায়কে পরিণত হলেন, কীভাবে নতুন ইতিহাস নির্মিত হলো এবং কৃষক মননে মণি সিংহ পরিণত হলে এক কিংবদন্তি বীরে, যিনি মুক্তির শিঙ্গা ফুঁকেন এবং বিপদের সময়ে সাদা ঘোড়ায় চড়ে এক পাহাড় থেকে আরেক পাহাড় বিদ্যুৎগতিতে ছুটে বেড়ান! তাই বাংলার আকাশে যখনই মেঘ জমে, তখনই মণি সিংহকে দেখা যায়। দেখা যায় তার দুই তরুণ বন্ধুকে_ অনিল মুখার্জি এবং পাশেই সহাস্যে দাঁড়িয়ে থাকা জ্ঞান চক্রবর্তীকে।
এম এম আকাশ : অধ্যাপক, অর্থনীতি
বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।