অনুচ্ছেদ
আমার একজন পিতা আছেন
আমি তাকে আব্বা বলে ডাকতাম...
আমার খুব মনে আছে,
তিনি যখন কোরান পড়তেন -
সুবেহ সাদিকের স্বর্গীয় নীরবতার মধ্যে
তার কণ্ঠস্বর অদ্ভুতভাবে বেজে উঠত
তার সৌম্য অবয়ব হতে কোন এক
অন্য ভুবনের আলো ঠিকরে বেরুতে দেখতাম -
আমি, তখন ভুল শুনতাম
আমার দেখায় ভুল ছিল ।
আমার একজন আম্মাও ছিলেন
আমি তাকে কোনদিন হাসতে শুনিনি...
সারাটা বছর থাকতেন রোগাক্রান্ত
পর্দার আড়ালে দুর্বল, শীর্ণ, কালো
কোন গভীর রাতে ঘুম ভেঙে গেলে
আম্মার ফোঁপানো কান্নার শব্দ শুনতে পেতাম,
আমি তাকে বেশিদিন আম্মা ডাকতে পারিনি -
আমার বয়স যখন ছয়,
পিতা দ্বিতীয়বার বিবাহ করলেন...
কিছুদিন পর মারা গেলেন আমার আম্মা,
আমার আম্মা ...
আমার পিতার আরও তিন ছেলে ছিল
তাই বোধহয় তিনি আমাকে -
আদর করার মত যথেষ্ট সময় পাননি
নাকী আমি কালো ব'লে ভ্রু কুঁচকাতেন...
আজও জানি না,
একা একা বড় হয়েছি, খুব একা...
বয়স তখন উনিশ ছুঁই ছুঁই...
শেখ মুজিব মুক্তির ডাক দিলেন,
আগুন জ্বলা তার অনবদ্য ভাষণে...
আমার পিতা এই দেবতার মতন ব্যক্তিকে মোনাফেক, কাফের
এবং ইসলামের ঘোরতর শত্রু হিসেবে সাব্যস্ত করলেন,
পাকিস্তান.. পাকিস্তান.. মাতম শুরু করলেন
এপ্রিলের মাঝামাঝি, পাকসেনারা গ্রামে আসতে লাগল
আমার পিতার সেকী উচ্ছ্বাস,
ভীষণ তৎপর হয়ে উঠলেন তিনি...
পাকসেনাদের সামনে তিনি এমনভাবে গলে গলে পড়তেন যে -
ভ্রম হত.. তারা বোধহয় আল্লাহর পাঠানো ফেরেশতা...
এই ফেরেশতাদের ছিল পিশাচের মতন ক্ষুধা.
সব খেত ওরা, স-ব... যাকে সন্দেহ হত, গুলি করে মারত...
মেয়েদের ধরে ধরে খুবলে খেত...
এক দুপুরে পিতা, আমার ছোটখালাকে নিয়ে গেলেন -
পাকসেনাদের ক্যাম্পে, আমি তাকে আর কোনদিন দেখিনি...
আমার জগতটুকু ভীষণ এক আগুনে পুড়িয়ে দিলো কেউ...
আমি সেই রাতিই পালিয়ে গেলাম... যুদ্ধে গেলাম...
আমি তখন রংপুরের পথে,
লোক মারফত জানতে পারলাম -
মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের শাস্তিস্বরূপ
পিতা আমায় ত্যাজ্য ঘোষণা করেছেন,
আর এই মহান কর্মের স্বীকৃতিস্বরূপ -
পাকসেনারা তাকে আলবদর বাহিনীর কমান্ডার বানিয়েছে
আমার পিতা...
যুদ্ধের সেই দিনগুলো আজও চোখের সামনে জ্বলজ্বল...
রক্তের মহাসমুদ্র সাঁতরে আমার বাংলাদেশ স্বাধীন হ'ল ।
আট মাস পর.. ডিসেম্বরের আঠারো তারিখ..
গ্রামে ফিরলাম আমি,
দেখলাম আমাদের বাড়িটাকে পোড়ানো হয়েছে,
শুনলাম পিতার দ্বিতীয় স্ত্রী, তিন পুত্র কেউ-ই আর বেঁচে নেই,
পিতাকে বেঁধে রাখা হয়েছে.. মেরে ফেলা হবে হয়তো...
পিতা আমায় দেখে চমকে উঠলেন...
তার সমগ্র শরীর কোন এক উচ্ছ্বাসে কেঁপে কেঁপে উঠছিল,
আমি পিঠ সোজা করে দাঁড়ালাম,
ভাবলাম মেরেই ফেলুক.. এই পশুটার শাস্তি হওয়া উচিত...
পরে আর পারিনি...
পিতা স-ব ভুলে গিয়ে আমায় গ্রহণ করতে চাইলেন
কিন্তু আমি তার কাছে আর ফিরে যেতে পারিনি...
আমি এখন এক সুতার কলে কাজ করি,
ভয় এবং দুশ্চিন্তার বিষয় এই, পিতা এখন
মস্ত এক নেতা হয়েছেন, স্ত্রী-পুত্র-কন্যা নিয়ে
তার এখন বিলাসী জীবন...
মন্ত্রীও নাকি হয়ে যেতে পারেন সামনের নির্বাচনে...
কী করেছি আমি... কত বড় পাপ...
অপরাধবোধে, এখন নিজের সামনে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারিনা,
পারিনা...
আমার পিতা এখনও আছেন -
আমি ভুলেও তাকে আব্বা বলে ডাকিনা...
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।