ভুল করেও যদি মনে পড়ে...ভুলে যাওয়া কোন স্মৃতি.. ঘুমহারা রাতে..নীরবে তুমি কেঁদে নিও কিছুক্ষণ...একদিন মুছে যাবে সব আয়োজন...
ভালবেসেই বিয়ে হয়েছিল ব্রেন্ডা-এরিকের। দশ বছর ধরে সুখেই ছিল আমেরিকান এই দম্পতি। তারপর একদিন ব্রেন্ডার পরিচয় ঘটে ইন্টারনেটের সাথে। তার সামনে খুলে যায় এক নতুন জগত। ধীরে ধীরে অন্তর্জালের মায়াবী জগত আর ‘চ্যাটিং’ হয়ে ওঠে তার ধ্যান-জ্ঞান।
শুধু বাথরুমে যাওয়া আর খাওয়ার সময়টুকু ছাড়া বাকী সময় তার কাটে কম্পিউটারের সামনে। রাতে সে যখন শুতে যায়, এরিক গভীর ঘুমে তলিয়ে গেছে তারও কয়েক ঘন্টা আগে। তাদের দাম্পত্য জীবনে ফাটল ধরে। নেট নিয়ে প্রতিদিন তাদের মাঝে খিটিমিটি লেগেই থাকে। এরিক বহুবার চেষ্টা করে ব্রেন্ডাকে আগের জীবনে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে।
কিন্তু ব্রেন্ডার কোন পরিবর্তন হয় না। সে বরং বলে - ‘ইন্টারনেট এখন আমার জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। আমি এটা ছাড়তে পারবো না, এমনকি এরিকের জন্যেও না। ’
ব্রাজিলের সাওপাওলোর ১৫ বছর বয়সী কিশোরের কাহিনীটি আরও উদ্বেগের। এ বছরের মার্চ মাসে প্রকাশিত এক গবেষণা-প্রতিবেদনে নাম উল্লেখ না করে তার বর্ণনা দেয়া হয়।
ঐ কিশোর ২ বছর ধরে প্রতিদিন গড়ে ১২-১৮ ঘন্টা বাড়িতেই থাকতো, শুধুমাত্র ইন্টারনেট নিয়ে। এমনও হয়েছে, টানা ৩৮ ঘন্টা ধরে সে রয়েছে ভার্চুয়াল জগতে। শুরুর পর ধীরে ধীরে ইন্টারনেট ব্যবহারের সময় বাড়তে থাকে তার, একসময় পুরোপুরিই সময়ের ব্যাপারে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে। সর্বক্ষণ ইন্টারনেটে বা ইন্টারনেট সংক্রান্ত চিন্তায় ডুবে থাকতো সে। এমনকি দু বছর ধরে স্কুলে পর্যন্ত যায়নি।
এই অতিমাত্রায় ইন্টারনেট ব্যবহারের কারণে মা কম্পিউটারের তার খুলে ফেললে সে খুবই রেগে যেত এবং তিনবার এ কারণে মা’কে মারধর পর্যন্ত করেছে ঐ কিশোর।
কি এমন আছে এই অন্তর্জালে? কেন এর মায়াচক্রে মানুষ আটকে থাকছে ঘন্টার পর ঘন্টা ? গবেষণা করেছেন আমেরিকান মনোবিজ্ঞানী ডঃ ডেভ গ্রীনফিল্ড। তিনি জানাচ্ছেন, অনেকগুলো বিষয় ইন্টারনেটকে করে তুলছে এতটা আকর্ষক। অন্যতম হচ্ছে - মাল্টিমিডিয়া। মাল্টিমিডিয়া সংশ্লিষ্ট অসংখ্য বিষয় পাওয়া যাচ্ছে ইন্টারনেটে, যা টেলিভিশন দেখার মতো অনুভূতি সৃষ্টি করছে মনে।
আরেকটি ব্যাপার হচ্ছে, মানুষ যখনই চাইছে, তখনই ইন্টারনেটে প্রবেশ করতে পারছে। সপ্তাহের সাত দিনই, দিনের চব্বিশ ঘন্টাই ইন্টারনেট তার দ্বার খুলে রেখেছে। দিনে- রাতে যে কোন সময়, মানুষ সহজেই প্রবেশ করতে পারছে অন্তর্জালের জগতে। বাস্তব জগতে ইচ্ছেমতো কিছু করতে গেলে যেসব বাধা আসে, ভার্চুয়াল জগতে সেই বাধা নেই বললেই চলে। মানুষ ভার্চুয়াল মহাসড়কে উঠে যেখানে মন চায় যেতে পারছে, সেখানে যা করা সম্ভব করতে পারছে বিনা বাধায়।
এছাড়া তথ্যের অবাধ আদান-প্রদান, নতুন নতুন মানুষের সাথে পরিচয়, বিষয়-বৈচিত্র্য তো রয়েছেই।
ফলে, ইন্টারনেটের ব্যবহার বাড়ছে। ইন্টারনেট এখন যুগের চাহিদা। শুধু কম্পিউটার থেকেই নয়, মোবাইল থেকেও সহজেই ব্যবহার করা যাচ্ছে ইন্টারনেট। কাজের পাশাপাশি অকাজে বা বিনা কাজেও নেটে থাকছে মানুষ।
একটা সময় ব্যবহারের মাত্রা বাড়তে বাড়তে তা চলে যাচ্ছে আসক্তির পর্যায়ে। আসক্তরা সাধারণত প্রথমে বুঝতে পারে না অথবা স্বীকার করতে চায় না যে সে আসক্ত। আশপাশের মানুষরা টের পায়। ইন্টারনেট আসক্তির লক্ষণ-উপসর্গগুলো ব্যক্তিভেদে ভিন্ন হতে পারে। তবে কিছু সাধারণ বিষয় রয়েছে যা থেকে একজন ইন্টারনেট ব্যবহারকারী যে আসক্তির পর্যায়ে চলে গেছে তা বোঝা যায়।
আসক্ত ব্যক্তি প্রায় প্রতিদিনই ইন্টারনেট ব্যবহার করেন। ইন্টারনেটে বসার পর সময়জ্ঞান বলতে কিছু থাকে না তার। হয়তো বসার আগে ভাবলেন, এইতো পাঁচ মিনিটের জন্য বসছি, মেইলটা চেক করেই সাইন-আউট করবো। বসার পর কখন ঘন্টা পেরিয়ে যায়, খবরই থাকে না। চীনের একদল বিশেষজ্ঞ বলেছেন, সাধারণত আসক্তরা ইন্টারনেটে ৫ ধরণের কাজে বেশী ডুবে থাকে - অনলাইন গেম খেলতে খেলতে কারো সময় কেটে যায়, কেউ সুপ্ত অথবা বিকৃত যৌনাকাঙ্খা মেটাতে বিরতিহীন ঘুরে বেড়ায় পর্ণোগ্রাফি-সংক্রান্ত সাইটগুলোতে, বাস্তব-জীবনে লাজুক-অন্তর্মুখী কেউ নতুন বন্ধুদের নিয়ে নিরবচ্ছিন্ন আড্ডায় মেতে ওঠে সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটে, ইন্টারনেট শপিং হয়ে ওঠে কারো ধ্যান-জ্ঞান, কেউ বা এমনিতেই ঘুরে বেড়ায় সাইবার দুনিয়ার অলি-গলিতে।
ভার্চুয়াল জগতে থাকাকালীন বাস্তবের কেউ যদি সেই সময়ে ভাগ বসায়, ধরুন, বাবা বা মা কোন কথা বলতে আসেন বা মোবাইল ফোনটা বেজে ওঠে, তাহলে আসক্ত ব্যক্তির মেজাজ তিরিক্ষি হয়ে ওঠে। অন-লাইনে সময় কাটানোর কারণে পূর্ব-নির্ধারিত সাক্ষাতে সময়মতো উপস্থিত হওয়া যায় না। অন্যরা যখন অফিসের কাজ শেষ করে বাড়ির পথ ধরে, তখনও আসক্ত ব্যক্তি ঐ দিনের কাজ গুছিয়ে উঠতে পারেন না। বাসার দৈনন্দিন কাজেও অবহেলা করতে শুরু করেন তিনি। কাপড়টা হয়তো লন্ড্রীতে দেয়া দরকার- দেয়া হয় না।
প্রাত্যহিক বাজার করতে বের হওয়া হয় না স্বামীর, ফলে যা আছে তা দিয়েই কোনমতে রাতের খাবারটা হয়তো চালিয়ে নিতে হয় স্ত্রীর। ব্যক্তি ধীরে ধীরে বিচ্ছিন্ন হতে থাকে - বাস্তব সমাজ থেকে। ওদিকে ফেসবুক, টুইটার, মাইস্পেসের মতো অন্তর্জালিক সামাজিক ওয়েবসাইটগুলোতে তার সরব পদচারণা। সামাজিক অনুষ্ঠানগুলোতে ব্যক্তির উপস্থিতি কমতে থাকে, পাশের বাড়ির বন্ধুটির সাথে বিকেলে আর বাইরে বের হওয়া হয় না, ‘অন-লাইন’ বন্ধুরাই হয়ে ওঠে প্রিয় সঙ্গী। অনেকেই এক এক সময় বুঝতে পারেন যে বাড়াবাড়ি রকমের হয়ে যাচ্ছে।
তারা ইন্টারনেটে কাটানো দৈনিক সময়ের পরিমাণ কমাতে চেষ্টা করেন, কিন্তু খুব একটা সফল হন না। ‘কতক্ষণ নেটে ছিলে ?’ এমন প্রশ্নের উত্তরে সময় কমিয়ে বলেন। ‘কি করছিলে?’ -এর উত্তর এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন বা মিথ্যে বলতে শুরু করেন।
ইন্টারনেটে এই বাড়াবাড়ি রকমের সময়-ক্ষেপনকে আমরা ‘আসক্তি’ বলব কেন? অ্যাডিকশন (অফফরপঃরড়হ) বা আসক্তি তো একটি ব্যাধি। ইন্টারনেটের কারণে ব্যক্তির এই পরিবর্তন কি ব্যাধি? আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন অনেক মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ও চিকিৎসা মনোবিজ্ঞানীর মতে, তা-ই।
‘আসক্তি’ আমরা কখন বলি? যখন মানুষ কোন কিছুতে, তা ভাল-মন্দ যা-ই হোক, অতিমাত্রায় নির্ভরশীল হয়ে পড়ে অর্থাৎ কোন কিছুর প্রতি ‘ডিপেনডেন্স’ (উবঢ়বহফবহপব) তৈরী হয়। একই সাথে তৈরী হয় টলারেন্স (ঞড়ষবৎধহপব), অর্থাৎ একই সমান তৃপ্তির জন্য ধীরে ধীরে ঐ ‘কিছু’র পরিমাণ বাড়াতে হয়। এবং সেই ‘কিছু’র প্রতি এই ‘ডিপেনডেন্স’ এবং ‘টলারেন্স’ যখন মানুষের জীবনের নানাক্ষেত্রে বিরূপ প্রভাব ফেলতে থাকে। যেমন, আমরা বলে থাকি মাদকাসক্তির কথা। মাদক নেয়ার পর ব্যক্তির মনে আনন্দের অনুভূতি হয়।
ধীরে ধীরে ব্যক্তি আনন্দের জন্য মাদকের উপর পুরোপুরি নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। একই তীব্রতার আনন্দের অনুভূতির জন্য ধীরে ধীরে বাড়াতে হয় মাদকের পরিমাণ। মাদক সংগ্রহ ও গ্রহণকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হয় ব্যক্তির চিন্তা ও দৈনন্দিন জীবন। ধ্বংস হতে থাকে শিক্ষাজীবন, ব্যর্থতা বাড়তে থাকে কর্মক্ষেত্রে, সামাজিক জীবন বলতে কিছুই থাকে না আর। একই ঘটনা আমরা দেখতে পাই ইন্টারনেটের ক্ষেত্রেও।
ইন্টারনেট-আসক্তদেরও তৈরী হয় ‘টলারেন্স’। প্রতিদিন একটু একটু করে বাড়তে থাকে ইন্টারনেটে কাটানো সময়ের পরিমাণ। মানসিকভাবে এর উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে তারা। ‘সাইন-আউট’ করার পর থেকে মাথায় একই চিন্তা ঘুরতে থাকে - কখন আবার ‘সাইন-ইন’ হবো, নেটে ঢোকার পর কি করবো, কিভাবে করবো ইত্যাদি। বেশীক্ষণ অফ-লাইন থাকলে তাদের মাঝে অস্থিরতা,দুশ্চিন্তা, উদ্বেগ, খিটখিটে মেজাজসহ নানা উপসর্গ দেখা দেয়, মাদকাসক্তদের যেমন কয়েক ঘন্টা মাদক না নিলে দেখা দেয় শারীরিক-মানসিক নানা উপসর্গ বা ‘উইথড্রল সিম্পটম’- চলতি বাংলায় আসক্তরা যাকে বলে ‘ব্যাড়া ওঠা’।
মাদক আবার গ্রহণ করলেই যেমন উইথড্রল সিম্পটম চলে যায়, ইন্টারনেট-আসক্তরা আবার অন-লাইন হলেই স্বস্তি বোধ করে। অনেক মাদকাসক্ত যেমন বাস্তব-জীবনের বেদনা-কষ্টকে ভুলে থাকতে কিছুক্ষণের জন্য হলেও অন্য জগতে হারিয়ে যাওয়ার জন্য মাদকের আশ্রয় নেয়, তেমনি এই ভার্চুয়াল জগতও বাস্তব থেকে পালিয়ে ফ্যান্টাসীতে বুদ হয়ে থাকার অনন্য মাধ্যম।
অন্য যে কোন আসক্তির মতোই ইন্টারনেট-আসক্তিও মানুষের বাস্তব জীবনে বিরূপ প্রভাব ফেলে। প্রথম যে সমস্যাটি দেখা দেয়, তা হচ্ছে স্বামী/স্ত্রী, প্রিয়জন, বাবা-মা বা বাস্তবের বন্ধুদের সাথে সম্পর্কের অবনতি। যেহেতু আসক্তরা দিনের বেশীরভাগ সময় একাকী ঘরের কোণে কাটায়, ঘন্টার পর ঘন্টা কেটে যায় ওয়েবে, তারা প্রিয়জনদের সময় দেয় কম।
এ নিয়ে ঝগড়া, বিতন্ডা; আসক্ত ব্যক্তি তার ইন্টারনেটে কাটানো সময় ও কৃত কাজের ব্যাপারে মিথ্যা বলা শুরু করে, এ নিয়ে দেখা দেয় পারস্পরিক আস্থা ও বিশ্বাসের সংকট। অনেক রাত জেগে নেট-সার্ফিং ঘুমের ব্যাঘাত ঘটায়। অনিদ্রা জন্ম দেয় আরও নানা শারীরিক-মানসিক উপসর্গের। আগে যেসব কাজ করতে ভাল লাগতো, সেসব কাজে ব্যক্তি আর উৎসাহ পায় না।
ইন্টারনেট অনেকেই ব্যবহার করেন।
সবাই আসক্ত নন, সবাই আসক্ত হননা। কারো কারো ক্ষেত্রে নেট তাদের কাজেরই অবিচ্ছেদ্য অংশ। ইন্টারনেট-আসক্তিকে নির্দিষ্ট সময়ের ফ্রেমে সংজ্ঞায়িত করা যায় না। দৈনিক ‘এত’ ঘন্টার বেশী অন-লাইন থাকলে তা আসক্তি এরকমটা বলা যাবে না। তবে, কেউ কেউ কাজের প্রয়োজন ছাড়াই বা কাজ ফেলে রেখে নেট-সার্ফিং করতে থাকেন।
গবেষণায় দেখা গেছে, যারা বিষণœতা, উদ্বেগ, বাইপোলার মুড ডিসঅর্ডার প্রভৃতি রোগে ভোগেন তাদের আসক্ত হবার সম্ভাবনা বেশী থাকে। একাকীত্ব, অসুখী দাম্পত্য, পেশাগত চাপ,অর্থনৈতিক দুরবস্থা, কর্মহীনতা, শারীরিক আকৃতি নিয়ে হীনমন্যতা, আত্মবিশ্বাসের অভাবও ইন্টারনেট ব্যবহারকারীকে আসক্তির দিকে ঠেলে দিতে পারে। অধিকাংশ গবেষকই একমত যে, দৈনন্দিন জীবনের সমস্যা থেকে পলায়নমুখী মানসিকতাই আসক্তির জন্ম দেয়। সেই সমস্যা হতে পারে ব্যক্তিগত, পারিবারিক, পেশাগত বা শিক্ষাগত। আসক্তি অবশ্য ঐ সমস্যার কোন সমাধান নয়।
কিন্তু তারপরও মানুষ সেখানে আশ্রয় খোঁজে। অনেকে অন্য আসক্তি, যেমন মাদকাসক্তি থেকে মুক্ত হতে গিয়ে ইন্টারনেটে আসক্ত হয়ে পড়ে। বয়ঃসন্ধির কিশোর-কিশোরী এমনকি শিশুদেরও এই আসক্তির ঝুঁকি রয়েছে। যারা বাবা-মার তত্ত্বাবধান ছাড়া অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য ইন্টারনেট ব্যবহার করার সুযোগ পায়, তাদের আসক্তির ঝুঁকি বেশী। বর্তমান যুগে অধিকাংশ ক্ষেত্রে বাবা-মার চেয়ে ছেলে-মেয়েরা কম্পিউটার ও ইন্টারনেট সম্পর্কে অনেক বেশী জ্ঞান রাখে।
এ কারণে বাবা-মারা বুঝতে পারেন না, তাদের ছেলেমেয়েরা নেটে কখন কি করছে। কিশোর-কিশোরী ও শিশুদের আসক্তির কারণ অনেকটা বড়দের মতোই, তবে, তারা মূলত অনলাইন গেমস ও সামাজিক নেটওয়ার্কগুলোতে বেশী আসক্ত। বয়ঃসন্ধির সমস্যা, স্কুলের চাপ, বিশৃংখল বা কঠোর পারিবারিক পরিবেশ - প্রভৃতি ভুলে থাকতেই অনেকে নেটের আশ্রয় নেয়। বাবা-মারা অনেক সময় এই আসক্তির ব্যাপারটা বুঝতে পারেন না, যতক্ষণ না বাচ্চার আচরণে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আসে, স্কুলে খারাপ ফলাফল হতে থাকে, বাচ্চারা সহজেই ক্লান্ত হয়ে যায়, তাদের শখের ব্যাপারগুলোতেও উৎসাহ হারিয়ে ফেলে।
আসক্তির প্রকৃতি যদি গুরুতর না হয়, তাহলে নিজে নিজেই এ থেকে বেরিয়ে আসা সম্ভব।
অনেক ক্ষেত্রে আপনা-আপনি এ আসক্তি চলে যায়। কিছু ক্ষেত্রে সক্রিয় প্রচেষ্টার প্রয়োজন। সেক্ষেত্রে, আপনি যে আসক্ত এ ব্যাপারটি আপনাকে অনুধাবন করতে হবে। যদি কেউ হৃদয়ঙ্গম করতে পারেন যে, তিনি আসক্ত, তবে চিকিৎসার ক্ষেত্রে প্রধান বাধাটি পার করে ফেললেন। এর পর দেখুন, এই আসক্তির ফলে আপনি জীবনে কি হারাচ্ছেন বা মিস করছেন।
‘মিস করা’ বিষয়গুলোর একটি তালিকা তৈরী করুন। অনেক সময় না লেখা পর্যন্ত বোঝা যায় না, আপনি কতটুকু এবং কি হারাচ্ছেন। আপনার ওয়েব-সার্ফিংয়ের সময় নির্দিষ্ট করুন। প্রতিদিনই না হয় বসুন, কিন্তু নির্দিষ্ট সময়ে এবং নির্দিষ্ট সময়ের জন্য। অ্যালার্ম ব্যবহার করুন।
অ্যালার্ম বেজে উঠলেই অফ-লাইন হয়ে যান। প্রতি রাতে একটি নির্দিষ্ট সময়ে কম্পিউটার বন্ধ করে ঘুমাতে যান এবং অবশ্যই তা মাঝরাত পেরিয়ে যাওয়ার পর নয়। ভার্চুয়াল জগত থেকে বেরিয়ে আসুন, বন্ধু খুঁজুন বাস্তবে। পরিবার ও বাস্তবের বন্ধুদের সহায়তা এক্ষেত্রে অত্যন্ত জরুরী। বাস্তবে আপনার বন্ধুসংখ্যা যত বাড়বে, তত ভার্চুয়াল জগতের বন্ধুত্বের প্রয়োজন পড়বে কম।
তবে অনেকের ক্ষেত্রে শুধুমাত্র নিজস্ব প্রচেষ্টায় এ আসক্তি থেকে মুক্তি লাভ কঠিন। তাদের জন্য বিশেষজ্ঞ সহায়তার প্রয়োজন। কাউন্সেলিং, সাইকোথেরাপী, সাপোর্ট গ্র“প, এমনকি নির্দিষ্ট আসক্তি চিকিৎসার বিশেষ প্রোগ্রাম দরকার হতে পারে। সমস্যার গুরুত্ব অনুধাবন করে আমেরিকার ওয়াশিংটনে সিয়াটলের কাছে ‘হেভেনসফিল্ড রিট্রিট সেন্টার’ ইন্টারনেট-আসক্তদের চিকিৎসার জন্য এ বছরের অগাস্ট মাস থেকে বিশেষ আবাসিক চিকিৎসা-পদ্ধতি শুরু করেছে। এটি সম্ভবত ইন্টারনেট-আসক্তদের জন্য প্রথম কোন বিশেষায়িত আবাসিক চিকিৎসা ব্যবস্থা।
যদিও কোন প্রমাণ নেই, তবু ধারণা করা হয়, যখন থেকে ইন্টারনেট ব্যবহার শুরু তখন থেকেই ইন্টারনেট-আসক্তিজনিত সমস্যারও সূচনা। তবে এটি আলোচনায় আসে ১৯৯৫ সালে, ‘নিউইয়র্ক টাইমসে’ এ সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হওয়ার পর। ঐ প্রতিবেদনে অন্যান্য আসক্তি যেমন, মাদক, জুয়া প্রভৃতির সাথে ইন্টারনেট-আসক্তির তুলনা করা হয়। সেখানে কিছু স্ব-ঘোষিত ইন্টারনেট-আসক্তের বক্তব্যও ছাপা হয়। নিক নামের এক ব্যক্তির উক্তি প্রণিধানযোগ্য - ‘আমি বাকি দুনিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারি না, কিন্তু আমার কম্পিউটার, আমার ভার্চুয়াল জগত আমার হাতের মুঠোয়।
’
পরবর্তী বছরগুলোতে এ বিষয়টি নিয়ে আরো কিছু লেখা প্রকাশিত হয় আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে। তবে, এ ব্যাপারে প্রথম বিজ্ঞানসম্মত গবেষণা করেন ডাঃ ইয়াং, আমেরিকান সাইকিয়াট্রিক অ্যাসোসিয়েশনে তার গবেষণা প্রতিবেদন উপস্থাপিত হয়। এর পর বিশ্বের নানা স্থানে গবেষকরা এই আসক্তির আশংকাজনক চিত্র তুলে ধরেন। হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির কম্পিউটার অ্যাডিকশন স্টাডি সেন্টারের পরিচালক মারিসা ওরজাকের মতে, ৫-১০ শতাংশ ওয়েব-সার্ফারের মধ্যে ওয়েবের প্রতি নির্ভরশীলতা তৈরী হয়। সিউলের হ্যানইয়াং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিশু মনোরোগ বিশেষজ্ঞ আন ডং হিউনের মতে, দক্ষিণ কোরিয়ার ১৮ বছরের কম বয়সী শিশুদের প্রায় ৩০ শতাংশই ইন্টারনেট-আসক্তির ঝুঁকিতে রয়েছে।
এক গবেষণায় দেখা গেছে, তাইওয়ানের কলেজ ছাত্রদের মাঝে ৫.৯ শতাংশ ইন্টারনেট-আসক্ত, অপর এক গবেষণায় দেখা যায়, চীনের কলেজ ছাত্রদের মাঝে এ হার ১০.৬%।
২০০৮ সালে ‘আমেরিকান জার্নাল অব সাইকিয়াট্রি’তে প্রকাশিত সম্পাদকীয়তে মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডাঃ জেরাল্ড জে ব্লক যুক্তি উপস্থাপনসহ ইন্টারনেট-আসক্তিকে ডায়াগনস্টিক এন্ড স্ট্যাটিসটিক্যাল ম্যানুয়ালের (ডিএসএম) ৫ম সংস্করণে ‘ইন্টারনেট অ্যাডিকশন ডিসঅর্ডার’ নামে গুরুত্ব সহকারে আলাদা ‘ডিসঅর্ডার’ বা ‘ব্যাধি’ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করার দাবী জানান।
তবে, এর বিরুদ্ধ মতও রয়েছে। ইন্টারনেটে মাত্রাতিরিক্ত সময়-ক্ষেপনকে কয়েকজন বিশেষজ্ঞ আলাদা ‘ব্যাধি’র মর্যাদা দিতে অনিচ্ছুক। অনেক মনোরোগ বিশেষজ্ঞের মতে, ইন্টারনেট-আসক্তি চিকিৎসা বিজ্ঞানের ‘রোগ-নির্ণয়’ সংক্রান্ত সার্বজনীন অভিধানে স্থান পাবার মতো স্বতন্ত্র কোন ব্যাধি নয়, বরং অন্য কোন রোগের একটি উপসর্গ।
যেমন, বিষণœতা, উদ্বেগজনিত রোগ, ইমপালস-কন্ট্রোল ডিসঅর্ডার প্রভৃতি রোগের একটি উপসর্গ হতে পারে এই ইন্টারনেট-আসক্তি।
স্বতন্ত্র কোন ব্যাধি হিসেবে চিকিৎসা-বিজ্ঞানের ‘বাইবেলে’ এর নাম অন্তর্ভুক্ত হোক বা না হোক, ইন্টারনেট-আসক্তি যে গুরুতর সমস্যা হয়ে দাঁড়াচ্ছে তা মানতে আপত্তি নেই কারো। আমাদের দেশেও ইন্টারনেটের ব্যবহার বাড়ছে। বাড়ছে ফেসবুকের মতো সামাজিক যোগাযোগের ওয়েবসাইটের জনপ্রিয়তা। জনপ্রিয় হয়ে উঠছে ব্লগিং।
চ্যাটিংয়ের জন্য এখন আর কম্পিউটারের সামনে বসতে হচ্ছে না, মিগ৩৩-এর মতো সাইট মোবাইলে সহজে ও কম খরচে চ্যাটিংয়ের সুযোগ করে দিচ্ছে। অফিসে কাজের সময় কেউ কেউ ফেসবুক বা ম্যাসেঞ্জারে অন-লাইন থাকছেন সর্বক্ষণ, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রছাত্রীরা লেকচার ক্লাসে বসে মোবাইল ফোনে লগ-ইন করছে চ্যাটিং সাইটে। শিক্ষক শিক্ষকের মতো পড়িয়ে যাচ্ছেন, শিক্ষার্থী তখন ক্লাসে বসেও ঘুরে বেড়াচ্ছে অন্য জগতে। এই মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার বাড়াচ্ছে আসক্তির ঝুঁকি। সাবধান হতে হবে এখনই।
........
সাপ্তাহিক ২০০০ বর্ষ ১২ সংখ্যা ৩১ (১১ ডিসেম্বর, ২০০৯) এ প্রকাশিত।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।