প্রাককথনঃ তার বাড়ী থকে আমার বাড়ীর দূরত্ব খুব বেশী নয়। কিন্তু আমি যখন বাড়ীতে যাই তখন তিনি থাকেন ঢাকায়। আবার যখন আমি ঢাকা আসি তখন তিনি নিউইয়র্কে। ফলে তার সাথে আমার সাক্ষাত হচ্ছিলই না। বেশ কয়েক বছর ধরেই ভাবছি এই মানুষটির একটি সাক্ষাতকার নেব।
গত কয়েক বছর ধরে একটু ভয়ও ঢুকেছে মনের মধ্যে। কারণ মানুষটির বয়স প্রায় আশি ছুঁই ছুঁই; যদি আর কখনোই আমার সাক্ষাতকারটি নেয়া সম্ভব না হয়….!
যাই হোক, অবশেষে আকস্মিকভাবে সুযোগ এলো। আমারা প্রায় তিন ঘন্টা আলাপ করলাম। বিষয় মুক্তিযুদ্ধ ও পরবর্তী সময়। দীর্ঘ আলাপচারিতার কিছু অংশ নীচে তুলে ধরলাম।
------------------------------------------------------------------------
পা.মাঃ আলাদা বাহিনী গঠন করে যুদ্ধ করার কথা কেন ভাবলেন? তখন তো প্রবাসী সরকারের অধীনে সেক্টর কমান্ডারদের নেতৃত্বে বাহিনী ছিলই।
আ.হোঃ আমি তো যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম অনেক আগে থেকেই। সেই ১৯৫১ সালে ৬ বন্ধু মিলে প্রথম প্ল্যান করি যুদ্ধ করার, তারপর পয়ষট্টিতে অস্ত্র সংগ্রহ শুরু করি। একাত্তরের মার্চের ১৩ তারিখে আমি ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ থেকে পুলিশের কাছ থেকে অস্ত্র ছিনিয়ে নিই। ওখান থেকেই আনুষ্ঠানিকভাবে আমার যুদ্ধ শুরু।
এরপরে আমার সাথে আরো অনেকেই যোগ দেয়। ধীরে ধীরে লোকে এটাকে ‘আকবর বাহিনী’ বলা শুরু করে। তাছাড়া, সেক্টরগুলো গঠনের আগে থেকেই তো আমরা যুদ্ধ শুরু করি।
পা.মাঃ কতজন যোদ্ধা ছিল আপনার বাহিনীতে?
আ.হোঃ এটা ঠিক নির্দিষ্ট করে বলা মুশকিল। আমার বাহিনীর সব সদস্যের নামের তালিকা একটা ডায়েরীতে আমি লিখে রেখেছিলাম।
কিন্তু পাকবাহিনী যখন আমার বাড়ী পুড়িয়ে দেয়, সেটাও পুড়ে যায়। তাছাড়া সদস্য মুক্তিযুদ্ধের শেষ দিন পর্যন্ত বৃদ্ধি পাচ্ছিল। যখন যুদ্ধে গেছি, রাস্তার পথচারীও আমার বাহিনীর সাথে যোগ দিয়েছে।
পা.মাঃ তবুও নিয়মিত কতজনকে আপনি পেতেন যুদ্ধের সময়?
আ.হোঃ দুই হাজারের উপরে হবে। অনেকেই পরে তালিকাভূক্ত হয়েছে, অনেকে হয়নি।
মা.পাঃ যুদ্ধের পুরোটা সময় জুড়েই কি আপনি ও আপনার বাহিনী এলাকায় ছিলেন?
আ.হোঃ হ্যা, আমি এলাকাতেই ছিলাম। তবে আমার বাহিনীর অনেকেই ভারতে গিয়েছিল ট্রেনিং নিতে।
মা.পাঃ আপনি ভারতে যাননি কেন?
আ. হোঃ আমি ভারতে যাবো কেন? আমি নিজেই তো পাকিস্থান বাহিনীতে ট্রেনিং ইন্সট্রাক্টর ছিলাম। আমি নিজেই আমার বাহিনীর সদস্যদের ট্রেনিং দিতাম।
পা.মাঃ প্রবাসী সরকারের নেতারা যুদ্ধের সময় আপনার সাথে যোগাযোগ রাখতেন?
আ.হোঃ সরাসরি তারা কেউ আমার সাথে যোগাযোগ করেননি।
তবে আমার বাহিনীর খবর যেহেতু নিয়মিত বেতারে প্রচারিত হতো, তারা আমার বাহিনী সম্পর্কে জানতেন। আর মূলত তাদের নির্দেশেই মেজর মঞ্জুর আমার সাথে যোগাযোগ করেন।
পা. মাঃ প্রবাসী সরকার কোন সাহায্য সহযোগিতা করত না?
আ. হোঃ হ্যা, যেহেতু এটা একটা স্বীকৃত বাহিনী ছিল, তারা বিভিন্ন সময় অস্ত্র, গোলাবারুদ পাঠাতেন। তবে সেটা মুক্তিযুদ্ধের শেষের দিকে। প্রথম দিকে আমরা নিজেরাই অস্ত্র সংগ্রহ করে নিজেদের মতো করে যুদ্ধ করেছি।
পা. মাঃ এবার আসি মুক্তিযুদ্ধের পরবর্তী দিনের কথায়। দেশ স্বাধীন হবার পরে সরকারের সাথে আপনার সম্পর্ক কেমন ছিল? কখনো বঙ্গবন্ধুর সাথে দেখা হয়েছে?
আ.হোঃ বাহাত্তর সালে বঙ্গবন্ধু একবার এলেন যশোরে। উনি সার্কিট হাউজে বসে যশোরের এমএনএ-দের সাথে মিটিং করছিলেন। অনেকের সাথে আমিও গিয়েছিলাম সেখানে। বারান্দায় দাড়িয়ে আমি কথা বলছিলাম সোহরাব হোসেনের (বঙ্গবন্ধু সরকারের মন্ত্রী)সাথে।
এক সময় সোহরাব হোসেন বললেন, ‘যাবা নাকি ভেতরে বঙ্গবন্ধুর সাথে পরিচিত হতে?’
আমি বললাম, ‘বঙ্গবন্ধুর সাথে…তা পরিচিত হওয়া যায়’। সোহরাব হোসেন দরজা ঠেলে বললেন ‘মাগুরার আকবর হোসেন আপনার সাথে দেখা করতে চায়’। আমি দরজার বাইরে সোহরাব হোসেনের পেছনে দাড়িয়ে ছিলাম, কিন্তু বঙ্গবন্ধু আমাকে দেখতে পেলেন। উঠে দাড়িয়ে দুই হাত শুন্যে তুলে দরাজ গলায় বঙ্গবন্ধু বলে উঠলেন, ‘আরে..মাগুরার বীর সেনাপতি। আমি তোমাকে নিয়ে গর্ব করি।
তুমি আমার বুকে আসো..’।
পা.মাঃ সৈয়দ নজরুল ইসলামের সাথে দেখা হয়েছিল কখনো?
আ.হোঃ একবার মন্ত্রী সোহরাব হোসেনের বাসায় কয়েকদিন ছিলাম। একদিন বিকেলে মিন্টো রোডে হাটতে বের হয়েছি। শুনলাম পাশেই নাকি সৈয়দ নজরুল ইসলামের বাড়ী। ভাবলাম যুদ্ধের সময় প্রেসিডেন্ট ছিলেন, যাই দেখা করে আসি।
যেয়ে দেখি বাড়ীর আঙ্গিনায় অন্তত দুইশ লোক অপেক্ষা করছে তার সাথে দেখা করার জন্যে। আমি একটা কাগজে নাম লিখে জমা দিয়ে আসলাম। খুজতেছিলাম কোথাও কোন চেয়ার ফাঁকা আছে কিনা বসার জন্যে। হঠাৎ পেছন থেকে একটা লোক এসে জাপটে ধরে আমাকে ঘুরিয়ে ফেললো। জোর করেই কোলাকুলি করল।
ছোটখাটো খুবই নরম শরীর। দেখলাম সৈয়দ নজরুল ইসলাম। হাত ধরে টেনে ভেতরে নিয়ে গেলেন। জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনি বলেন আমি আপনার জন্যে কি করতে পারি? কেন এসেছেন আমাকে বলেন?’ আমি বললাম, ‘আপনি সৈয়দ বংশের মানুষ। দেখা করলেও নেক হাসিল হয়।
তাই দেখা করতে আসলাম’।
পা.মাঃ কখনো কি তাজউদ্দীন আহমেদের সাথে দেখা হয়েছে? যুদ্ধের সময় প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। আপনার কি কখনো তার সাথে দেখা করতে ইচ্ছে হয়েছে?
আ.হোঃ না, তাজউদ্দীনের সাথে কখনো দেখা হয়নি। তাছাড়া আমার তো দরকারও পড়েনি দেখা করার।
পা.মাঃ বঙ্গবন্ধু কেবিনেটের আর কারো সাথে কখনো দেখা হয়েছে?
আ.হোঃ আমার প্রতিবশী এক হিন্দু ছেলে ধর্মান্তরিত হয়ে মুসলিম হয়।
ফলে সে পারিবারিক সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত হয়। তার আত্মীয় স্বজনও তার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে। খুব আর্থিক কষ্টে থাকা এই ছেলেটার একটা চাকরির জন্যে একবার সচিবালয়ে গিয়েছিলাম খোন্দকার মোশতাক আহমেদের অফিসে। যেয়ে দেখি খোন্দকার মোশতাকের রুমের বাইরে বসে আছে তোফায়েল আহমদ। আমাকে দেখে উঠে দাড়ালো।
আমার সাথে খোন্দকার মোশতাকের পরিচয় নেই জেনে তোফায়েল আর বসলো না। আমাকে নিয়ে ভেতরে গেল। সব শুনে খোন্দকার মোশতাক টেলিফোনে তার সেক্রেটারিকে বললো, ‘আকবর সাহেবের ক্যান্ডিডেটের নামে নিয়োগ পত্র লেখে নিয়ে আমার রুমে আসো’।
পা.মাঃ শীর্ষ সব নেতাই আপনার সম্পর্কে জানতেন। দেশ স্বাধীনের পরে আপনি কেন কেন্দ্রীয় রাজনীতে সম্পৃক্ত হননি বা কেন তাদের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রাখেননি?
আ.হোঃ আমার প্রয়োজন পড়েনি।
আমার এলাকার উন্নয়নের জন্যে, এলাকার মানুষের জন্যে যখন যেখানে প্রয়োজন পড়েছে আমি গেছি। আমার তো তাদের সাথে নিয়মিত যোগাযোগের দরকার ছিল না।
পা.মাঃ কিন্তু আপনি তো রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন। কেন্দ্রীয় রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হলে আপনার দ্বারা আরো বেশী করে এলাকার উন্নয়নে অবদান রাখা সম্ভব হতো…..
আ.হোঃ আই এ্যম ইনাফ ফর মাই লোক্যাল ডেভেলপমেন্ট। এলাকার উন্নয়ন করা আমার লক্ষ্য ছিল, আমি সেটা করেছি।
কেন্দ্রীয় নেতা হলে কি এমন বেশী হতো?
পা.মাঃ এই যে এতগুলো স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা আপনি প্রতিষ্ঠা করলেন, কিসের অনুপ্রেরণায়?
আ.হোঃ দেখো, আমি যখন স্কুলে পড়ি তখন আমাদের সাথে কোন মেয়ে পড়তো না। পুরো স্কুলেই কোন মেয়ে ছিল না। সমগ্র উপজেলাতে কোন ছাত্রী ছিল না। মেয়েদের জন্যে স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছি বলেই আজ শুধু শ্রীপুর শহরেই স্কুল কলেজ মিলিয়ে চৌদ্দ- পনেরশ ছাত্রী লেখাপড়া করছে। এটা তো আমার জন্যে কম বড় অর্জন না।
আমি একবার ভারতেশ্বরী হোমস দেখতে গিয়েছিলাম। আমার প্ল্যান ছিল খামারপাড়াতে যে মাদ্রাসাটি করেছিলাম সেটা ভারতেশ্বরী হোমসের আদলে করবো। কিন্তু টাকা পয়সার অভাবে পারছিলাম না। ভেবেছিলাম বঙ্গবন্ধুর কাছে যাবো। ভাবতে ভাবতেই একদিন বঙ্গবন্ধু খুন হলেন।
আমারও আর মাদ্রাসার জন্যে হোস্টেল করা হয়ে উঠলো না।
পা. মাঃ এই যে যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করলেন। স্বাধীন দেশে কি পেলেন? কোন প্রতিদান কি পেলেন?
আ. হোঃ কিছু পাবার আশায় যুদ্ধ করিনি।
পা. মাঃ আপনার তো কমপক্ষে একটা খেতাব পাওয়া উচিৎ ছিল..
আ. হোঃ ক্যাপ্টেন এটিএম ওয়াহহাব (৮ নং সেক্টরের সাব সেক্টর কমান্ডার) আমার নাম সুপারিশ করেছিলেন খেতাবের জন্যে। কিন্তু পাই নি।
এখন তো সরকারী কোন অনুষ্ঠানেও আমাকে ডাকে না।
***************************************************************
শ্রীপুর বাহিনী ও আকবর হোসেন সম্পর্কে পূর্বে প্রকাশিত একটি পোস্ট।
***************************************************************
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।