নাইকন ৫৫ ৩.৫ মাইক্রো নিক্কর অটো। নেট থেকে সংগৃহীত আলোকচিত্র
শিরোনাম দেখেই পাঠকরা নিশ্চয়ই ধারণা করতে পারছেন যে আমি এমন একটি লেন্সের কথা বলছি যেটি দিয়ে ক্ষুদ্র কীট-পতঙ্গ, ফুল, ক্ষুদ্র প্রান, ছোট ছোট অক্ষর গুলিকে খুব চমৎকার ভাবে বড় করে ধারণ করা সম্ভব। এই লেন্সগুলিকে আমরা ম্যাক্রো কিংবা মাইক্রো বলে থাকি। অনেক টেলি লেন্স দিয়েও কিন্তু এই কাজটি করা সম্ভব। তবে টেলি লেন্সের মূল কাজ হল দুরের কিছুকে ম্যগ্নিফাই করে কাছে নিয়ে আসা।
মাইক্রোর উদ্দেশ্য কিন্তু তা নয়। মাইক্রোর আসল কাজ হল কোন প্রান বা বস্তুর ছবি কাছে গিয়ে তোলা যাকে আমি বড় আকারে উপস্থাপন করতে পারি। তো, এই কাজটি শুনতে বেশ আগ্রহ জাগানিয়া মনে হয় তবে যখন একটি মাইক্রো লেন্স নিয়ে মাঠে নামা হয় তখন এই কাজটি বেশ শ্রম-নির্ভর হয়ে দাঁড়ায়। আর এর জন্য বেশ কিছু সামগ্রী সাথে নিতে হয়। যেমন ট্রাইপড, ফ্ল্যাশ, রিমোট ইত্যাদি।
বুঝতেই পারছেন এই বিদ্যা এমনি এমনি দখল করা সম্ভব নয়। চর্চা ছাড়া এতে সাফল্যের সম্ভাবনা কম। নাইকনের কিট লেন্স কিন্তু এই ব্যাপারে একদম খারাপ নয়। এটি সাবজেক্টের বেশ কাছে যেতে সক্ষম। তবে এটি তো আর ডেডিকেটেড মাইক্রো লেন্স নয়।
এটা দিয়ে দুধের স্বাদ ঘোলে মেটে তবে মন ভরেনা। এর চাইতে যদি মোটামুটি অল্প দামে একটা মাইক্রো লেন্স কেনা যায়, তাহলে তো সোনায় সোহাগা!
সত্যি বলতে কি যারা কেবল ছবি তোলা শুরু করেছেন কিংবা যারা স্থির আলোকচিত্রের বিচিত্র জগতে শুধু বিচরণ করেই মুগ্ধতার স্বাদ পান তারা কমবেশি সকলেই মাইক্রো চিত্র দেখে বিস্মিত হন। আর নিজে কোন না কোন সময় এই ধরণের ছবি তোলায় উদ্যোগী হতে চান এবং সময়, শ্রম, অর্থ তিনটিই বিনিয়োগ করতে চান। আমিও তার বাইরে নই। ২০০৯ সালের শেষ দিকে একটি মাইক্রো লেন্স কেনার সাধ জাগে আমার।
তবে বাজেট কম, মানে একেবারে সস্তায় কি পাওয়া যায় সেটি ভেবেছি প্রথম। এইজন্য নেট ঘাঁটতে ঘাঁটতে হঠাৎ সন্ধান পাই একটি লেন্সের যার নাম শিরোনামেই দেখা যাচ্ছে। যেহেতু ই-বে থেকে কিনব কাজেই ই-বে গিয়ে লেন্সটির চেহারা আর দাম দুটোই পছন্দ হয়ে যায়। তবে লেন্সটি কেনার আগে স্বাভাবিকভাবেই কয়েকটি ওয়েবসাইটে ধর্না দিলাম। যারা নাইকনের লেন্স কিনতে চান তাঁদের জন্য একটি বিশ্বস্ত সাইট হল গিয়ে বিয়র্ণ ররস্লেট সাহেব।
ভদ্রলোক নরওয়ে বাসী। খুব বেশী লেখেন টেখেন না, বয়েসও হয়েছে। কিন্তু উনার সাইটটি নাইকন লেন্সের জন্য খনি বলা যায়। তো সেখানে এই লেন্স সম্পর্কে খুব ভাল ভাল কথা লিখিত হওয়ায় কিনে ফেলতেই হল লেন্সটি।
নাইকনের এই বিশেষ লেন্সটি বাজারে আসে গত শতকের ষাটের দশকের মাঝামাঝি।
পুরো লেন্সটি মেটালের তৈরি, অক্ষয় যাকে বলে। দেখতে খুব সুন্দর তা বলা যাবেনা, তবে একদম বেঢপ আকৃতিরও নয়। এর ফোকাস রিঙটি যখন ঘুরাই, বেশ লাগে, খুব মোলায়েম। আবার ফোকাস রিঙ ঘুরালে লেন্সের সম্মুখ ভাগ অনেক সামনের দিকে এগিয়ে যায় যা সব মাইক্রো লেন্সেরই বৈশিষ্ট্য। বিয়র্ণের ভাষ্যমতে অসাধারণ শার্প এবং অনন্য রঙ উপহার দেয় এই লেন্সটি।
এই দুটি কথাই অক্ষরে অক্ষরে সত্যি। আমি নিজে অন্য কোন মাইক্রো লেন্স ব্যাবহার করিনি, তাই তুলনামূলক বিশ্লেষণ করতে পারবনা। তবে এই লেন্সের রঙ অন্তত আমার কিট লেন্স ১৮ ৫৫ কিংবা ৫৫ ২০০ ভিআর এবং ৩৫ ১.৮ এ পাইনি। আর এর আউট অফ ফোকাস জায়গাগুলি এত মসৃণ ভাবে অদৃশ্য হয়ে যায় যে কি বলব! শার্পনেস, রঙ, আউট অফ ফোকাস- এই তিনটি ক্ষেত্রেই মোটামুটি বিজয়ী হিসেবে লেন্সটিকে আমরা ধরে নিতে পারি।
এমনি মাইক্রো বৈশিষ্ট্য ছাড়া সাধারণ লেন্স হিসেবে অল রাউন্ড বিচারে লেন্সটি কেমন এটি যদি কেউ জানতে চান তাহলে বলব, ভালই তো।
এপারচার থেকে ঠাহর করাই যায় যে এই লেন্স লো-লাইটের জন্য নয়। পোরট্রেট খুব খারাপ হবেনা হয়ত, কারন ক্রপ ক্যামেরায় এই লেন্সের ফোকাল লেন্থ পোরট্রেট তোলার জন্য আদর্শ বলা যেতে পারে। আমি এখন পর্যন্ত এই লেন্স দিয়ে ল্যান্ডস্কেপ তুলিনি, তাই বলতে পারছিনা কেমন ওঠে। আমাদের বোধ করি ভুলে গেলে চলবে না যে এটি একটি বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে নির্মিত লেন্স। কাজেই এটি সর্ব রোগ-সংহারি নয়, হতে পারেনা।
আমি নিজে এই লেন্স নিয়ে ফুল আর মৌমাছি ছাড়া অন্য তেমন কিছুর ছবি খুব বেশী তুলিনি কিন্তু যেটুকু তুলেছি তাতে এই লেন্সের কার্যকারিতা আমার নিজেকে সন্তুষ্ট করেছে খুব।
এই লেন্স কিন্তু ১:১ পর্যন্ত ম্যাগ্নিফিকেশন দেয়না। এর দৌড় সর্বোচ্চ ১:২ পর্যন্তই। তবে তাতে অসুবিধে নেই। এই লেন্সের যে শার্পনেস, তাতে ইদানিং ২৪ মেগাপিক্সেলের যে সকল ক্যামেরা নাইকন বাজারজাত করছে সেসবের জন্য এই লেন্স একদম নিখুঁত ফলাফল দেবে মনে হয়।
এই লেন্স নাইকনের যে কোন বিগিনার ডিএসএলআর এ মাউন্ট হবে। মিটার দেবেনা, মিটারের কাজটা ম্যানুয়ালই সারতে হবে। অর্থাৎ সাটার স্পিড, এপারচার, আইএসও এগুলি নিজেকে নির্ধারণ করতে হবে আর তারপর ফোকাস ম্যানুয়ালি সারতে হবে। জ্বালা কিন্তু কম নয়। এরপরে আছে ক্যামেরাকে ট্রইপডের ওপর বসানো, ফ্ল্যাশ বসানো, তারপর ধাম ধুম করে ট্রিগার কিংবা সাটার প্রেস করা অথবা রিমোট ব্যাবহার।
ঠিকঠাক ব্যাবহার করা প্রাথমিকভাবে কঠিন মনে হলেও, একবার এই বিদ্যা সামান্য দখল করতে পারলেই মোটামুটি কেল্লা ফতে।
নাইকন সর্বপ্রথম এসএলআর মাইক্রো লেন্স বাজারজাত করে ১৯৬১ সালে। তার মানে তারা এই ক্ষেত্রে প্রায় পঞ্চাশ বছরের খেলোয়াড়। পাকা খেলোয়াড় বললেও ভুল হবেনা। নাইকনের সব মাইক্রো লেন্স শার্পনেসের জন্য খ্যাত।
পার্থক্য যেটুকু সেটা কালার রিপ্রোডাকশন, আউট অফ ফোকাসের মসৃণতা এবং কিছু টেকনিক্যাল খুঁটিনাটিতে। যেমন হালের লেন্সগুলি ভিআর এবং অটোফোকাস সমৃদ্ধ, হালের লেন্সগুলি ১:১ ম্যাগ্নিফিকেশন যুক্ত তবে এইসব লেন্স কিন্তু প্লাস্টিক, নির্মাণগুন খুব খারাপ তা হয়ত বলা যাবেনা, তবে হাত থেকে ফসকে পরে গেলে ভাঙার সম্ভাবনা অনেক বেশী। বাজারে নানান ফোকাল লেন্থের মাইক্রো লেন্স সহজলভ্য। ৪০, ৫৫, ৬০, ৮৫, ১০৫,২০০ কিংবা ৭০-২০০ জুম ইত্যাদি। ফোকাল লেন্থ মাইক্রো অঙ্গনে জরুরী এক অনুষঙ্গ।
৪০, ৫৫ কিংবা ৬০ ফোকাল লেন্থ দিয়ে আমি ফুলের ছবি কিংবা কপির কাজ কিংবা কোন স্থির বস্তুর ছবি তো ভালই তুলতে পারব কিন্তু প্রাণের ছবি? ছোট কীট পতঙ্গের ছবি? সাবজেক্টের সাথে লেন্সের সম্মুখভাগের ফোকাল দূরত্ব কম হওয়াতে আমাকে সাবজেক্টের এত কাছে গিয়ে ছবি তুলতে হবে যে মুহূর্তের মধ্যে ভয় পেয়ে কিংবা আমার নড়াচড়ার সাড়াশব্দে পতঙ্গ উধাও হতে সময় লাগবেনা, তারপর বসে বসে নিজের চুল ছিঁড়তে ইচ্ছে করবে। মাইক্রো ছবির ক্ষেত্রে ভাল ফোকাল দূরত্ব হচ্ছে ১০৫ কিংবা ২০০, এরকম ফোকাল দূরত্ব তে অন্তত সাবজেক্ট এবং ক্যামেরার ইমেজ প্লেনের মাঝে খানিকটা স্পেস মেলে। তবে এইসব লেন্সের দাম কিন্তু কম নয়। আর এদের সেকেন্ড হ্যান্ড মূল্যও কমেনা তেমন। ভালো ডিল পাওয়া খুব কঠিন।
তাহলে বাজারে মাইক্রো লেন্সের এত বৈচিত্র্য সহজলভ্য হলে কেন কেউ ১৯৬৫ সালের একটা অখ্যাত ম্যানুয়াল লেন্স কিনতে যাবে? যে লেন্সের ম্যাগ্নিফিকেশন ১:২ নয়, যে লেন্সে ভিআর নেই, অটো ফোকাস হয়না, মিটার হয়না, ফোকাল দূরত্ব কম, যে বিশেষায়িত লেন্স দিয়ে পতঙ্গের ছবি তোলাটাও কঠিন- সেই লেন্স কেন কেউ কিনতে যাবে? এক্ষেত্রে আমাদের একটা জিনিষ কিন্তু মনে রাখতে হবে। কোন লেন্সই নিখুঁত হতে পারেনা। যে মানুষটি অসাধারণ শার্প ছবি তুলতে চায়, অনন্য কালার রিপ্রোডাকশন পেতে চায়, মসৃণ আউউ অফ ফোকাস ছবির জন্য চাতক পাখির মতন চেয়ে থাকে, যে মানুষটি ফুলের ছবি তুলতে চায়, স্থির বস্তুর ছবি তুলতে চায়, লেন্সের কাছে স্থায়িত্ব প্রত্যাশা করে এবং দামটাও নাগালের মাঝে পেতে চায় তাঁদের তো কিছু ব্যাপারে ছাড় দিতেই হবে। যেমন ১০০ থেকে ১৫০ ডলারে আর কোন লেন্স কি আপনি বাজারে পাবেন? আর তাছাড়া একটি এক্সটেনশন টিউব থাকলেই আপনি ম্যাগ্নিফিকেশন ১:১ করতে পারবেন, মিটার ম্যানুয়ালি করলে সময় লাগে বেশী তবে স্থির বস্তু ধারণ করার ক্ষেত্রে সময় তেমন ব্যাপার নয়। ফোকাসের ব্যাপারে অনেকে মাইক্রো লেন্সে ম্যানুয়ালি ফোকাস করার কথাই বলেন।
কারণ অনেক অটো ফোকাস লেন্স রয়েছে যেগুলি ঠিকমতন ফোকাস করতে না পেরে কেবল হান্ট করতে ব্যাস্ত থাকে। এতে মুহূর্ত এবং পতঙ্গ সবই হাওয়ায় মিলিয়ে যায়! তাহলে দেখা যাচ্ছে, শুধু ফোকাল দূরত্ব এর সীমাবদ্ধতা ছাড়া তেমন বড় কোন দুর্বলতা আসলে এই লেন্সের নেই। আর যে সীমাবদ্ধতা গুলি আছে সেগুলিকে মেনে নিয়েই কিন্তু আমাদের ছবি তুলতে হবে। নইলে আর ছবি তোলার চ্যালেঞ্জ থাকল কোথায়?
এবার কিছু ছবি যুক্ত করে দিই।
ক।
খ)
গ)
ঘ)
ঙ)
চ)
ছ)
জ)
ঝ)
ঞ)
ট)
ঠ)
ড)
ঢ)
ণ)
(লেন্সটি এই মুহূর্তে আমার হাতে নেই, তাই লেন্সের ছবিটি নেট থেকে ধার নিতেই হল। মাস খানেক পর এই ছবিটির বদলে আমার নিজের ছবি যুক্ত করতে চাই। এখানে এই লেন্স দিয়ে তোলা কিছু ছবি যুক্ত করতেই হল যাতে পাঠক লেন্সের ইমেজ গুন সম্পর্কে খানিক ধারণা পেতে পারেন। সচলে অনেক গুণী চিত্রগ্রাহকদের ছড়াছড়ি। আমি একজন শিক্ষানবিস মাত্র।
যদি লেখায় কোন ভুল থাকে তবে তা ধরিয়ে দিলে উপকৃত হব। লেন্স নিয়ে আলোচনা এই প্রথম। যদি এই আলোচনা কারোর ভাল লাগে তবে আমার অন্যান্য লেন্স নিয়েও আলোচনা করার ইচ্ছে রয়েছে। সেক্ষেত্রে ভুল ত্রুটিগুলি সংশোধন করাটা ভীষণ দরকার। ধন্যবাদ)
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।