নোয়াখালী জেলার সবখানেই এখন মাদকের হাট। নেশায় ভাসছে এ অঞ্চলের উঠতি তরুণ ও যুবসমাজ। জেলা সদর এবং বাণিজ্যকেন্দ্র চৌমুহনী, নয়টি উপজেলা ও পৌর সদরসহ ছোটখাটো সব বাজারেই চলছে রমরমা মাদক ব্যবসা। পুলিশের নাকের ডগায় এবং প্রকাশ্যেই চলে মাদকদ্রব্য বিক্রি ও মাদকাসক্তদের আড্ডা। কিন্তু কোনো প্রতিকার নেই।
বরং বিভিন্ন থানায় এক ডজন পুলিশ কর্মকর্তাও মাদকাসক্ত হয়ে পড়েছেন। পুলিশি অভিযানে মাঝেমধ্যে মাদক ব্যবসায়ীরা গ্রেফতার হয়। কিন্তু বের হয়ে আবার পুরোদমে চালায় ব্যবসা। পুলিশের শিথিল অভিযান এবং দিন দিন মাদক ভয়াবহ রূপ নেয়ায় ছাত্র-যুবকদের নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন এ জেলার অভিভাবকরা।
জানা যায়, ধর্মীয় ঐতিহ্যের জেলা নোয়াখালীতে ছাত্র-যুবকদের জন্য একসময় সন্ধ্যার পর ঘরের বাইরে থাকা নিষিদ্ধই ছিল।
সন্তানরা মাদকাসক্ত হতে পারে, তা ছিল কল্পনারও বাইরে। কিন্তু অতীতের সেই মূল্যবোধের বালাই নেই এখন নোয়াখালীর ছাত্র-যুবকদের মধ্যে। ফেনসিডিল, গাঁজা হেরোইনসহ বিভিন্ন ধরনের নেশাদ্রব্যে আসক্ত যুবকরা ভেঙে দিয়েছে সামাজিক মূল্যবোধ। উপায়ান্তর না দেখে অভিভাবকরাই এখন এড়িয়ে চলেন বেপরোয়া সন্তানদের। পুলিশ ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফত্তর সূত্র জানায়, নোয়াখালী জেলায় মাদক আসে ভারত থেকে কুমিল্লা ও ফেনী হয়ে।
ট্রেন ছাড়াও উপকূল, বনফুল, সুগন্ধাসহ বিভিন্ন বাস এবং ট্রাকযোগে আসে ফেনসিডিল, গাঁজা, হেরোইনসহ নানা মাদকদ্রব্য। জানা যায়, জেলা শহর
মাইজদী এবং বাণিজ্যকেন্দ্র চৌমুহনীতে রয়েছে দুটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট। মাইজদী এবং সেনাপুর এলাকায় ইসমাইল, খুরশিদ, কানন, হারুন, আবু হুক্কু, সনজিদ, হাসান, মিলন, সুমনসহ রয়েছে ১৯ সদস্যের শক্তিশালী সিন্ডিকেট। মাইজদীবাজারে সোলায়মান, চৌমুহনীতে জাহাঙ্গীর ও শাহজামাল সুনের নেতৃত্বে রয়েছে ১৩ সদস্যের সিন্ডিকেট। এছাড়া প্রতিটি উপজেলায় রয়েছে পৃথক পৃথক চক্র।
থানা পুলিশের সঙ্গে রয়েছে এদের সার্বক্ষণিক যোগাযোগ। এমন অভিযোগ জনসাধারণের। জানা যায়, সুধারামসহ বিভিন্ন থানায় এসআই এবং এএসআই পর্যায়ের এক ডজন কর্মকর্তা এখন মাদকাসক্ত এবং একাধিক ওসি মাদক ব্যবসার সঙ্গে সম্পৃক্ত। ফলে জেলার সর্বত্র বেপরোয়া গতিতে বিস্তৃত হচ্ছে মাদক ব্যবসা। জেলা শহর মাইজদীতে মধুপুর, জেলখানা রোড, নতুন বাসস্ট্যান্ড, দত্তেরহাট, হরিনায়ায়ণপুর, নোদার মসজিদ মোড়, লালপুর ও শ্রীপুরে প্রকাশ্যে বিক্রি হয় মাদক।
জেলা সদরের দক্ষিণে একলাসপুরে কয়েক স্থানে প্রতিদিন সন্ধ্যায় লাইন পড়ে যায় মাদকসেবীদের। চৌমুহনীর গনিপুরের টক্কারপুল থেকে চোরবাড়ী পর্যন্ত, কলেজ রোড টেম্পো স্ট্যান্ড, বাদিরতলা সুরুজ মিয়ার স্কুল, আটিয়াবাড়ির পুল, দক্ষিণ বাজার গোডাউন, চৌরাস্তা, আমিনেরবাড়ী, ভাণ্ডারবাড়ী, করিমপুর গোরস্তান ও সিরাজ মিয়ার পুল মাদক কেন্দ্র হিসেবেই পরিচিত। সোনাইমুড়ী থানার সামনেই বিক্রি হয় মাদক। এছাড়া বজ্রাবাজার, বড়াইনগর, চনগাঁ, বাংলাবাজার, জয়াগবাজার, আমিশ্যাপাড়া, দেউটিবাজার, মুহুরীগঞ্জ, নান্দিয়াপাড়া এবং সোনাইমুড়ী মৌচাক মার্কেটে হাত বাড়ালেই পাওয়া যায় নেশাদ্রব্য। এসব স্থানে বিঠান সাহা, পারুল বেগম, রিপন, কালা এবং জসিম মাদক ব্যবসায়ী হিসেবে সবারই পরিচিত।
চাটখিল উপজেলায় পূর্ববাজার হাতুড়িয়া বাড়ী, পশ্চিমবাজার হাসপাতাল সড়ক, খিলপাড়া সড়ক মোড়, বদলকোট, সকাল-সন্ধ্যা মিষ্টি দোকান, শাপলা বোর্ডিং, মেকড়াচর, দশগরিয়া, সাহপুর, সাতের দীঘিরপাড়, সোমপাড়া, খিলপাড়া ইয়াছিন হাজীর বাজার, আটপুকুরিয়া, জনতাবাজার ও হালিমাদীঘির পাড় মাদকদ্রব্য বিক্রির চিহ্নিত স্থান। চাটখিল উপজেলার এসব স্থানে মাদক ব্যবসায় জড়িত হালিম ও তার স্ত্রী এবং দুই সন্তান জাকির ও মানিক, পাংকা চৌধুরী, বাবু, হামিদ, টিনা হাজী, মীর হোসেন, নুরুল ইসলাম, মোহাম্মদ উল্লাহ ও তার পরিবার, আলম, বেলাল, মিজান, পুরী, মিলন, কোনাবাড়ির বেলাল, কাউছার, জামাল, বোতল ফারুক ও লেদা হাজারী।
কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার বসুরহাট নতুন ও পুরনো বাসস্ট্যান্ড, টেম্পো স্ট্যান্ড, রিকশা স্ট্যান্ড, সিএনজি স্টেশন, সিনেমাহল রোড, সরকারি মুজিব কলেজ এলাকা, শুটকি বেপারীর বাড়ি এলাকা, বেচু মিয়া প্রকাশ ভেজালবাড়ী, হাসপাতাল গেট, চাপরাশিরহাট বাস ও টেম্পো স্ট্যান্ড, পেশকারহাট রাস্তার মাথা, ঈদগাহ মার্কেট বামনী পূর্ববাজার, পশ্চিমবাজার সুকানীটেক, বাংলাবাজার বাস টার্মিনাল, চৌধুরীবাজার, শান্তিরহাট পূর্ববাজার ও আবু মাঝিরহাট, চৌধুরীরহাট, পাটওয়ারীরহাট ও পণ্ডিতের হাট, কোম্পানীগঞ্জে মুনীর আহমদ, মাছ কামাল, ঘুড়ি মানিক, গরু সবুজ, গাঞ্জা মালেক, শুটকি সাগর ও হুমায়ুন, বামনীর নুরল হুদা, বাংলাবাজার ইসকন্দর, পৌরসভার বকুল ও শাহীন জড়িত মাদক ব্যবসার সঙ্গে। সুবর্ণচর উপজেলায় ছমিরহাট মাদকের জন্য বিখ্যাত। হাতিয়ায় মাদক যায় ঢাকা থেকে স্টিমারযোগে সরাসরি তমরুদ্দিবাজারে।
এখানে প্রধানত মুচি সম্প্রদায় মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত বলে জানা গেছে। এছাড়া বনদস্যু ও জলদস্যুদের জন্য যেসব মাদক যায়, তা এখন হাতিয়ার উচখালীতে যুবকদের মাঝে বিস্তার লাভ করেছে বলে স্থানীয় পুলিশ জানিয়েছে।
সেনবাগ উপজেলার কানকিরহাটবাজার, কুতুবেরহাট, ছমিরমুন্সীর হাট, ঈদগড়িয়া ও ছাতারপাইয়ায় রয়েছে মাদক বিক্রয় কেন্দ্র। এসব স্থানে শামসুমিয়া, বাদশা, জাহাঙ্গীর, কামাল হোসেন, কাশেম ও নুরু, আবুল কাশেম, নুরুজ্জামান, ভুট্টু, আবুল হাশেম, বিউটি আক্তার, আমির হোসেন ও হারুন করে যাচ্ছে মাদকের রমরমা ব্যবসা, এছাড়া নোয়াখালী জেলার সোনাপুর, রাজগঞ্জ, কেন্দুরবাগ ও চন্দ্রগঞ্জবাজারে মাদকের ভয়াবহতায় অভিভাবকরা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন। জেলার সর্বত্র বেপরোয়া গতিতে মাদকের বিস্তার ঘটলেও পুলিশ এ নিয়ে উদ্বিগ্ন নয়।
জানা যায়, গোয়েন্দা সংস্থাগুলো নোয়াখালীর মাদক বিষয়ে আর মনিটরিং করছে না। এনএসআই’র একজন কর্মকর্তা জানালেন, সর্বত্র মাদক ছড়িয়ে পড়ায় এ নিয়ে আর ফাইল তৈরির প্রয়োজন পড়ছে না। কারণ এখানে সাধারণ মানুষও জানেন কারা মাদক ব্যবসা করে। জেলাজুড়ে এ ভয়াবহতা সম্পর্কে জানতে চাইলে পুলিশ সুপার হারুন-উর-রশিদ হাজারী আমার দেশকে বলেন, মাদকের সংবাদ পেয়ে পুলিশ সব সময় অভিযান চালাচ্ছে। অনেকে গ্রেফতার হয় আবার জামিন নিয়ে এসে অপকর্ম শুরু করে।
মাদকের বিষয়ে তিনি কোনো ছাড় দিতে রাজি নন উল্লেখ করে বলেন, এর ভয়াবহতা রুখতে হলে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা দরকার। তবে তিনি মাদকাসক্ততার সঙ্গে পুলিশ কর্মকর্তাদের সম্পৃক্তার বিষয়টি অবগত নন বলে জানান। নোয়াখালী শহরের উদ্বিগ্ন অভিভাবক অ্যাডখোকেট আবদুর রহমান বলেন, নোয়াখালীতে মাদকের যে ভয়ঙ্কর বিস্তৃতি, সে ব্যাপারে পুলিশ এবং প্রশাসন সিরিয়াস না হলে সমাজে মারাত্মক বিপর্যয় সৃষ্টি হবে।
Click This Link
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।