সত্য সমাগত, মিথ্যা অপসৃত...............।
১২ বছরের ইতালিয়ান মেয়ে লুবনা আভান্তি। বাবা ভিটো আভান্তি ব্যবসা নিয়ে ব্যস্ত আর মা লরা আভান্তি ব্যস্ত সমাজে নিজের স্ট্যাটাস রক্ষায়। লুবনার সঙ্গী নেই কেউ। এমনি সময়, ক্রমবর্ধমান অপহরণের ভয়ে আর খানিকটা স্ট্যাটাসের খাতিরে লুবনার জন্য নিয়োগ দেয়া হল এক বডিগার্ড- ইমরুল হাসান।
কেমন করে ভীনদেশী যুবক হাসান আর ছোট্ট মেয়ে লুবনার বন্ধুত্ব হলো তাই দিয়ে এ কাহিনী শুরু। এ কাহিনী অসম দুই মানুষের নিষ্কাম ভালবাসার, এ কাহিনী ভালোবাসার মানুষকে হারিয়ে তীব্র বেদনায় আক্রান্ত হবার, এ কাহিনীর নির্মম প্রতিশোধের।
মাসুদ রানা সিরিজের পাঁড় ভক্ত যারা, তারা মাত্রই জানেন, এ কাহিনী ‘অগ্নিপুরুষ’ গল্পের। সিআইএ এর মুখের সামনে থেকে সোভিয়েত মিগ ছিনতাই করে আনায় (চারিদিকে শত্রু), সিআইএ আর মোসাদ মৃত্যুর পরোয়ানা নিয়ে পাগলা কুকুরের মত খুঁজে বেড়াচ্ছে মাসুদ রানাকে। বস মে. জে. রাহাত খানের পরামর্শে তাই রানা আত্মগোপনে চলে আসে ইতালীতে, পুরানো বন্ধু রেমারিকের আস্তানায়, সদ্য মৃত মার্সেনারি ইমরুল হাসানের ছদ্মবেশে।
এখানেই সময় কাটাবার জন্য নামমাত্র পারিশ্রমিকে লুবনার বডিগার্ডের চাকরিটা নিয়ে নিল সে। চাইছিল চুপচাপ কাটিয়ে দেবে সময়টা। কিন্তু, পাগলী মেয়েটা আস্তে আস্তে দখল করে নিলো রানাকে। অগোচরে কখন যে ওরা বন্ধু হয়ে গেল, স্নেহের কাঙাল মেয়েটা কখন যে তাকে এক অমোঘ বাঁধনে বেঁধে নিল, অসংখ্য মিশনের সফল স্পাই মাসুদ রানা টেরটিও পেল না! ভালবেসে লুবনা তাকে একটা ইংরেজী অনুবাদকৃত কোরান শরীফ দিল। আর উপহার দিল একটা ইতালীয়ান গান- “এক সময় থেমে যাবে সমস্ত কোলাহল, ঘুমিয়ে পড়বে ধরণী।
আকাশের সবচেয়ে উজ্জ্বল তারাটা মিটমিট করলে বুঝবে আমি তোমায় ডাকছি। সে রাতে তুমি জেগে থেকো, বন্ধু, ঘুমিয়ে পোড়ো না। আর, হ্যাঁ, ফুলের গন্ধ পেলে বুঝে নিয়ো আমি আসছি। আর যদি কোকিল ডাকে, ভেব আমি আর বেশী দূরে নেই। তারপর হঠাৎ ফুরফুরে বাতাস এসে তোমার গায়ে লুটিয়ে পড়লে, বুঝবে আমি এসেছি।
সে রাতে তুমি জেগে থেকো, বন্ধু, ঘুমিয়ে পোড়ো না। ”
ভালই কাটছিল দিনগুলো, হাসি-আনন্দে। হঠাৎ একদিন, সত্যি সত্যিই অপহরণের শিকার হলো লুবনা। ছয়মাস সব ধরনের ট্রেনিংয়ের বাইরে থাকা মাসুদ রানা উপস্থিত থেকেও ঠেকাতে পারলো না। দু’জন অপহরণকারী তার হাতে মারা গেলেও অন্য দু’জনের গুলিতে গুরুতর আহত হল সে।
বাঁচার আশা ছেড়ে দিলেন ডাক্তারেরা। হাসপাতালের বেডে শুয়েই রানা শুনতে পেল লুবনাকে মেরে ফেলা হয়েছে, মৃত্যুর আগে বাচ্চা হয়েছে রেপের শিকার! প্রতিশোধের আগুন মাসুদ রানার ভেতরে বেঁচে থাকার তীব্র আকূতি তৈরী করে দিল। ডাক্তারদের ধারনাকে ভুল প্রমান করে বেঁচে উঠলো রানা।
দুঃখী মেয়েটার মৃত্যুর জন্য এবার তার প্রতিশোধ নেবার পালা। বন্ধু রেমারিকের পরামর্শে চলে গেল গোজো, রেমারিকের শ্বশুর বাড়ি।
উদ্দেশ্য প্রতিশোধ শুরুর আগে শরীরটাকে ঝালিয়ে আবার আগের মত ক্ষুরধার করে তোলা। কিন্তু, ঐ গানটা তাকে ঘুমাতে দেয় না। আপন মনে সে বলে ওঠে, “জেগে আছি, আমি জেগে আছি। ” এভাবেই শেষ হয় প্রথম পর্ব।
দ্বিতীয় পর্ব শুধুই ঘৃনার, প্রতিজ্ঞা আর প্রতিশোধের।
গোজোতে এক মাসের নিবিড় অনুশীলন মাসুদ রানাকে আগের মতই ইস্পাতে পরিণত করে। সেখানে তার প্রেমে পড়ে ভায়োলা। কিন্তু মাসুদ রানা , “একা। টানে সবাইকে কিন্তু বাঁধনে জড়ায় না। ” তারপরেও গোজো থেকে ফিরবার আগে ভায়োলা তাকে দিয়ে আবার গোজোতে ফিরে আসবার প্রতিজ্ঞা করিয়ে নেয়।
স্পেনে ফিরে লুবনা অপহরণের সাথে জড়িত প্রতিটি ব্যক্তির বিরুদ্ধে নির্জলা যুদ্ধ ঘোষনা করে রানা। বন্ধু রেমারিক আর গগলের কাছ হতে একগাদা অস্ত্র নিয়ে শুরু হয় তার মিশন। ছোট পুঁটি হতে শুরু করে বড় রুই-কাৎলা কেউই রেহাই পাবে না তার হাতে। আর তাই করতে গিয়ে সে আবিষ্কার করে এ অপ্রিয় সত্য। লোভী উকিল লোরানের পরামর্শে বাবা ভিটো আভান্তি নিজেই মাফিয়াকে দিয়ে লুবনাকে অপহরণ করায়! উদ্দেশ্য, লুবনার নামে করা ইন্সুরেন্সের টাকা দিয়ে ডুবতে বসা ব্যবসাকে আবার চাঙা করে তোলা।
কিন্তু, লুবনার মৃত্যু সবকিছুকে এলোমেলো করে দেয়। লোরান মারা যায় রানার হাতে, আর ভিটো আত্মহত্যা করে। রানার হাতে একে একে মারা যায়, অগাস্টিন, এলি, বেরলিংগার। ইতালীয়ান মাফিয়ার ভীত কেঁপে ওঠে। কিন্তু, রানার হাত হতে নিস্তার নেই।
লুবনার জন্য এখনো তার হৃদয়ে রক্তক্ষরন; এখনো সেই গানটা তাকে ঘুমাতে দেয় না। ডন বাকালাও এ অপহরণের সাথে জড়িত ছিল। অতএব, সবশেষে মৃত্যুর পরোয়ানা মাথায় নিয়ে রানা বাকালার দূর্গে ঢুকে পড়ে। ধূলোয় মিশিয়ে দেয় অত্যাচারের প্রাসাদ। গুরুতর আহতাবস্থায়ও পিষে মারে বাকালাকে।
প্রতিশোধ শেষ হয় রানার। অজ্ঞান হয়ে যাবার আগে বিড়বিড় করে রানা বলে ওঠে, “এবার আমি ঘুমাব, লুবনা, এবার আমি ঘুমাব। ”
বইয়ের শেষে মাফিয়ার হাত হতে মাসুদ রানাকে রক্ষার জন্য তার মৃত্যুর একটা ক্যামোফ্লেজ তৈরী করা হয়। পত্রিকায় ছাপানো হয়,”এদেশের মিষ্টি এক মেয়ে একটা গান উপহার দিয়েছিল বাংলাদেশের এক দুঃসাহসী যুবককে। ........এই পবিত্র ভালবাসার মর্যাদা রক্ষা করতে গিয়ে মৃত্যুবরণ করেছে সেই বিদেশী যুবক।
”
বইটি ডাউনলোড করুন এখান থেকে।
[link|http://rahi4u.com/Boi-PuSToK/download3.php?file=-|| Masud Rana ||-/Agnipurush [Part I].pdf|প্রথম খন্ড]
[link|http://rahi4u.com/Boi-PuSToK/download3.php?file=-|| Masud Rana ||-/Agnipurush [Part II].pdf|দ্বিতীয় খন্ড]
প্রাসঙ্গিক তথ্যঃ
১. ১৯৮৬ সালে প্রথম প্রকাশিত হয় দুই খন্ডের এই বই। মাসুদ রানার অন্য বইগুলোর মত ('ধ্বংসপাহাড়' ছাড়া) এই বইটাও বিদেশী কাহিনীর ছায়া অবলম্বনে লেখা। মূল বইটা হলো এ.জে. কুইনেলের ম্যান অন ফায়ার(Man on Fire(1980)- A.J. Quinnell)। সেবা প্রকাশনীর অন্যান্য বইগুলোর উৎস জানতে দেখুন, জানজাবিদের এই পোষ্ট।
হলিউডে বেশ কয়েকটা মুভী নির্মিত হয়েছে এই কাহিনীর উপর ভিত্তি করে। সর্বশেষ ২০০৪ সালে একটি নির্মিত হয়। নাম ভূমিকায় ছিলেন ডেঞ্জেল ওয়াশিংটন আর ডাকোটা ফ্যানিং। তবে, মূল কাহিনীর আবেদনের ধারেকাছে ও যায় নি মুভীটা।
২. হুমায়ুন আহমেদের উপর আমার ফ্যাসিনেশন কমে যাবার জন্য এই বই অনেকাংশেই দায়ী।
একই কাহিনী নিয়ে হুমায়ুন লিখেছিলেন “অমানুষ” এবং দূর্ভাগ্যবশতঃ ওটাই আমি আগে পড়েছিলাম ’৯৬ তে। ক’দিন পরেই ‘অগ্নিপুরুষ’। নিঃসন্দেহে মাসুদ রানার কাছে ‘অমানুষ’ এর জামশেদ নস্যি মাত্র। যাইহোক, পরবর্তীতে তারাশংকরের ‘কবি’ পড়ে আমার হুমায়ুন ফ্যাসিনেশন পুরোই চলে যায়।
৩. কোনরকম বাছবিচার ছাড়াই বলা যায় যে, এটি মাসুদ রানা সিরিজের শ্রেষ্ঠতম বই।
সেবা প্রকাশনীর আলোচনা বিভাগে এই বইয়ের চেয়ে বেশী আলোচনা আর কোন বই নিয়েই হয় নি। অসংখ্য পাঠক বলেছেন, এই বই তাঁদেরকে কাঁদিয়েছে। মাসুদ রানার মৃত্যু অনেকেই মেনে নিতে পারেন নি। প্রশ্নের পর প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছেন লেখক কাজী আনোয়ার হোসেন।
৪. কাজী আনোয়ার হোসেনের (সবার প্রিয় কাজী দা) অনন্য কীর্তি সেবা প্রকাশনী, যার মাধ্যমে বাঙলাদেশের পেপার ব্যাক শিল্পকে তিনি একাই টেনে নিয়ে গেছেন বহুদুর।
আর এই জনপ্রিয়তার পেছনে তাঁরই সৃষ্টি মাসুদ রানার অবদান অস্বীকার করা যায় না কোনমতেই। অগ্নিপুরুষের লুবনাকে তিনিও নিজের প্রিয় হিসেবে বলেছেন। সাক্ষাৎকারটি পড়ে দেখতে পারেন
৫. 'সাউদিয়া ১০৩' নামে একটা বই আছে মাসুদ রানা সিরিজের- মধ্য নব্বইয়ের দিকে প্রকাশিত। ওটাকে 'অগ্নিপুরুষ- দ্বিতীয় পর্ব' বলা যেতে পারে।
৬. বয়সের কারনে কাজী দা এখন আর লিখেন না।
সম্পাদনা করেন। এটা জানার পর থেকেই আমার মাসুদ রানা পড়া বন্ধ। আমার কথা হলো, বছরে একটি হলেও মাসুদ রানা তাঁর নিজ হাতে লিখা উচিৎ।
৭. লুবনা, মাসুদ রানাকে যে গানটি উপহার দিয়ে গিয়েছিল, সেই গানটি পরে বাঙলায় রূপান্তরিত হয়। অসামান্য জনপ্রিয় এই গানে কন্ঠ দেন রুনা লায়লা।
গানের কয়েকটি পংক্তি-
যখন থামবে কোলাহল/ঘুমে নিঝুম চারিদিক/আকাশের উজ্জ্বল তারাটা/মিটমিট করে শুধু জ্বলছে/বুঝে নিও তোমাকে আমি ভাবছি/তোমাকে কাছে ডাকছি/ঘুমিয়ে পোড়ো না বন্ধু আমার/জেগে থেকো সেই রাতে...........
পংক্তিগুলো পেয়েছি এখান হতে।
………………………………………………
……………………………………………..
আগের লেখা।
জীবনে যা পড়েছি-৭ (নিমাই ভট্টাচার্যের মেমসাহেব)
জীবনে যা পড়েছি-৬ (শীর্ষেন্দুর দূরবীন)
জীবনে যা পড়েছি-৫ (মানিকের পুতুল নাচের ইতিকথা)
জীবনে যা পড়েছি-৪ (তারাশংকরের কবি)
জীবনে যা পড়েছি-৩ (পথের পাঁচালী)
জীবনে যা পড়েছি-২ (লোটাকম্বল)
জীবনে যা পড়েছি-১ (লা মিজারেবল)
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।