শেষ লাইনের বেশ ক‘টি শব্দ পড়া যাচ্ছে না। মনে হয় চিঠি লেখার সময় আবেগাপ্লুত হয়ে প্রচুর কান্না করেছে। তার প্রমান শেষের কয়েকটা আধমুছা শব্দ। অনেকদিন পর প্রিয়জনকে লিখতে এতটা ইমোশনাল হবারই কথা। হয়তো চিঠি শেষ করতে গিয়ে চোখের অবাধ্য জল ধরে রাখতে পারেনি।
চোখের কয়েক ফোটা নুন্তা জল বেশ ক‘টি শব্দকে চপ্ষে দিয়েছে। তবু চিঠির শেষে প্রেরকের নামের শেষ অক্ষরের ‘ ি ’ কার দেখা যাচ্ছে স্পষ্ট।
ইতোমধ্যে চিঠিটা বেশ ক‘বার পড়েছে নিলয়। অনেকদিন পর হঠাৎ তার চিঠি পেয়ে নিলয় দিশেহারা হয়। সেই পুরাতন, অথচ বহুচেনা কাছের মানুষের হাতের লেখা আজ বহুদিন পর পরদেশে বহু পোষ্ট অফিসের নির্মম শিলছাপ পিটে নিয়ে শেষ পর্যন্ত তার হস্তগত হয়েছে।
এই একটা হলদেখাম নিলয়ের ভেতরে এতটা নাঁড়া দেবে, হৃদয়ের বোনা সুতোয় এতটা মায়াটান হবে, এতটা কর্মবিমুখ করে ভাবজগতে নিয়ে যাবে ! তা কখনো ভাবেনি। নিলয় চিঠি পড়ছে আর মর্মাহত হচ্ছে। তার লেখা চিঠিতে নিলয়ের সাথে জড়িত অনেক মুহুর্ত অত্যন্ত শৈল্পিক ভাষায় ব্যক্ত করেছে। চিঠি পড়ে নিলয় বারবার ফেলে আসা দিনের স্মৃতি আওড়াতে লাগলো।
জানিস নিলয়, আজ এই মুহুর্তে আমার খুব মনে পড়ছে তোর কথা, তোর সাথে অতিবাহিত সোনামোড়া দিনগুলোর কথা।
আচ্ছা নিলয়, তোর মনে আছে! আমাদের প্রথম পরিচয়ের মুহুর্তটি। আমি কিন্তু একটু ভুলিনি সেদিনের কথা।
কলেজে তুই ছিলি খুব গম্ভ^ীর টাইপের ছেলে। অন্য ছেলেদের মতো তুই গলা ছেড়ে মেয়েদের সাথে আড্ডা দিতিস না। সবসময় কেমন আনমনা, ভাবুক মনে বসে থাকতি।
পড়া লেখায় তুই যথেষ্ট ভালছাত্র ছিলি বলে যে কোন স্যার ক্লাসে এসে আগে তোর সাথে কথা বলতো। জানিস, তখন আমার খুব ঈর্ষা হতো, আমি কেন পড়া লেখায় তোর মতো ভাল হতে পারিনি ভেবে।
একদিন বৃষ্টির কারণে আমার কলেজে আসতে দেরী হলো। আমি পেঁৗঁছার মিনিট পনেরো আগেই ক্লাস শুরু হয়েগেছে। ফলে ক্লাস চলা অবস্থায় আমি ক্লাসে প্রবেশ করতে পারছিলাম না।
তাই আমার দু‘বান্ধবী রাফেয়া ও জুলিয়াকে নিয়ে পাশের খালী রুমে ক্লাস শেষ হওয়ার জন্য অপেক্ষা করতে যাচ্ছিলাম। রুমের দরজা পর্যন্ত গিয়ে ভেতরে তোকে দেখে দাঁড়ালাম, মনে হলো আজ তুইও দেরী করে এসেছিস। তুই টেবিলে ঝুকে কি একটা বই পড়ছিলি মনদিয়ে। তাই আমাদের অবস্থান খেয়াল করিসনি। আমরা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষন তোকে অবলোকন করলাম।
তারপর দু‘বান্ধবীর পরামর্শে তোকে ভয় দেখিয়ে চমকে দেয়ার সিদ্ধান্ত হলো। তখন আমি গলার সর পাল্টিয়ে নাজমা ম্যাডামের স্বরে ভারী গলায় তোকে ডাকলাম
- “ এই ছেলে ” !
তুই খেয়াল করলি না। মন ডুবিয়ে সেই বইটার মধ্যে মাথা ঢুকিয়ে দিয়েছিস। তুই আমার ডাকে সাড়া না দিলে আমার রাগ হলো। আবার আমি একইভাবে তোকে ডাকলাম
Ñ “ এই ছেলে, এদিকে এসো ”
আমার ডাক শুনে তুই এবারও মাথা তুলে আমার দিকে তাকালি না।
কিন্তু তোর ঝুকে থাকা মুখের দিকে তাকিয়ে বুঝলাম তুই মনে মনে হাসছিস ঠোঁট চেপে ধরে। তখন আমার রাগ আরো মাথাচড়া দিয়ে বেড়ে গেলো তুই আমাকে উপেক্ষা করছিস দেখে। তাই এবার প্রায় উত্তেজিত কন্ঠে ঠিক নাজমা ম্যাডামের স্বরে তোকে ডাকলাম
- “এই ছেলে, এদিকে এসো, কি কথা কানে যায়না ” ?
ঠিক তখনই তুই -“ জি আম্মা, আমাকে ডেকেছেন ”? বলে আমার দিকে দৌঁড়ে এলি। হঠাৎ তোর মুখে তোর চেয়ে বয়সে ছোট একটা মেয়েকে আম্মা ডাক শুনে আমার দু‘বান্ধবী তো হাসিতে গড়াগড়ি। আর আমি লজ্জায় রেগে কান্না করে দিলাম।
জানিস নিলয়, তুই আমাকে সেদিন কত বড় লজ্জা দিয়েছিলি ! কিন্তু সেটা এখন ভাবলে এত ভাললাগে যে, বুঝিয়ে লিখতে পারবো না। তোর মতো একটা গম্ভ^ীরটাইপের ছেলে অপরিচিত একটা মেয়েকে এভাবে আনন্দদায়ক লজ্জা দিতে পারে! ভেবে খুব পুলকিত হলাম। তুই কী সাংঘাতিক ছেলে রে, বাব্বাহ !
সেদিন আমি তোর সাথে প্রচন্ড রাগ করেছিলাম আমাকে “ আম্মা” ডাকার অভিযোগে। তারপর রুম থেকে আমার বান্ধবীদের বার করে দিয়ে তোকে জিজ্ঞেস করলাম
- এই যে মিষ্টার, আপনি আমাকে “ জি আম্মা ” ডেকেছেন কেন ! আমি কি দেখতে ---- ?
আমার প্রশ্ন শুনে তুই বই বন্ধ করে আমার দিকে তাকিয়ে হাসতে হাসতে বললি
Ñ আপনি যে আমাকে “ এই ছেলে ” বলে ডেকেছেন ?
এরপর তুই আরো বললি
- আমরা একই কলেজে, একই ক্লাসে পড়ার সাথী। আপনি আমাকে এই যে ভাই বা যে কোন ভাবে ডাকতে পারতেন, কিন্তু আপনি তা না করে ডেকেছেন “ এই ছেলে ” বলে।
তাই আপনাকে ----- ।
- আসলে বুঝতে পারিনি আপনি আমার দু‘জন বান্ধবীর সামনে এভাবে লজ্জা দেবেন ! তাছাড়া আমি নিজে থেকে কিন্তু আপনাকে “এই ছেলে” বলে ডাকিনি। বান্ধবীদের পরামর্শেই আপনাকে একটু চমকে দিতে চয়েছিলাম। কিন্তু আপনাকে চমক দিতে গিয়ে আপনি যে আমাকে একেবারে “ বুল্ড আউট ” করে দিলেন! তাও আবার আমার বান্ধবীদের সামনে ! এখন ওরা বিষয়টি পুরো কলেজে দেয়ালের কানে কানে পৌঁছে দেবে। আমি কাল থেকে আর কলেজে আসতে পারবো না।
কলেজে আসলে আমাকে সবাই জগতের “আম্মা” বানিয়েই ছাড়বে। প্লিজ! আমাকে এ লজ্জা থেকে বাচান !
- সত্যি লজ্জা পেয়েছেন ? তবে দুঃখিত, মাফ চাইছি ,
হাসতে হাসতে “ আসেন ” বলে তোর পাশে বসার জন্য নিমন্ত্রন জানিয়ে আমার হাতের দিকে তাকিয়ে হাত বাড়িয়ে দিলি। আমি তোর হাতে হাত রেখে পাশে বসলাম।
সেই যে তুই আমার হাত ধরে তোর পাশে বসিয়েছিলি, আর ছাড়িসনি। শেষ পর্যন্ত তোর প্রেমের গর্তে আমাকে ডুবিয়েই ছাড়লি।
তোর মতো একটা গম্ভ^ীরটাইপের ছেলে কিভাবে আমার মতো একটা বিচ্ছু টাইপের মেয়েকে সহজে বশ্্ করতে পারলি ! ভাবলে খুব হাসি পায়।
আচ্ছা নিলয়, তুই কি এখন বুঝতে পারছিস যে, আমি এখন তোর বিরহে কান্নার নদীতে ভাসছি! নিলয়, আমি কখনো ভাবিনি যে, তুই আমাকে এভাবে একাকরে চলে যাবি। আচ্ছা পৃথিবীর কত মানুষ তো কতো যায়গায় যাচ্ছে , সবার মনের মানুষ কি আমার মতো কষ্ট পায় কাছের মানুষকে হারিয়ে ! আমার মনে হয় পৃথিবীতে মনের মানুষ হারিয়ে আমার মতো কষ্ট আর কেউ পাচ্ছে না।
সবচেয়ে বড় কথা কি জানিস নিলয় ! তুই চলে যাওয়ার পূর্ব মুহুর্ত পর্যন্ত আমি একটু অনুভব করতে পারিনি যে, তোকে হারালে আমি এতটা একাহয়ে যাবো , শূণ্য হয়ে যাবো। মনে হয়েছিল-এইতো, নিলয় আজকে কাজের ব্যস্ততার কারণে আমার সাথে দেখা করতে পারেনি, কাল সকালেই চলে আসবে।
কিন্তু তুইতো আর আসলিনা। কত সকাল তো চলেগেছে ! এখন তোকে হারিয়ে মনে হচ্ছে- পৃথিবীতে আমার আপন বলতে , বন্ধু বলতে, সর্বোপরি ভালবাসা বলতে যা ছিল, তার সবই তুই, এবং তুই চলে যাওয়ায় আজ আমি বড্ড একা হয়ে গেলাম।
নিলয়, তুই কাছে থাকা অবস্থায় তোকে যে এতটা গভীরভাবে ভালবাসতাম, তা একটুও অনুভব করতে পারিনি। কিন্তু আজ তোর অনুপস্থিতি আমাকে বলে দিচ্ছে যে, পৃথিবীর যে নারীটি তোকে সবচেয়ে বেশী ভালবাসে, সে আর কেউ নয়, আমি-ই। এবং তোর অনুপস্থি—তি আমাকে বড় অসহায় করেছে।
ভালবাসার মানুষ যে এতটা নির্ভরযোগ্য, তা তোকে দূরে হারিয়েই বুঝতে পারছি।
দীর্ঘদিন পরে হঠাৎ মৌরির চিঠিটা নিলয়ের ভেতর-বাহির যেমন উলট পালট করে দিচ্ছে, তেমনি দু‘জনের হারানো স্মৃতিকেও করেছে বেদনা বিদূর। নিলয় মৌরির চিঠি পড়ছে আর কল্পনায় চিঠির উত্তর লিখছে-
মৌরি, হ্যাঁ বুঝতে পারি, তুই আমাকে হারিয়ে যতটা একা হয়েছিস, আমিও তোকে হারিয়ে আজ বড় শূণ্যতা অনুভব করি। প্রবাসে ব্যস্ত জীবনের ফাকে ফাকে কখনো তোকে মনে পড়লে খুব কষ্ট পাই, কাজে মন বসাতে পারি না। আনমনা হয়ে ভাবি, ইচ্ছে করে এই মুহুর্তে ফিরে যেতে।
কিন্তু সেটা কেবল ইচ্ছার মধ্যে সীমাবদ্ধ। প্রবাস জীবনে কত ইচ্ছাকে যে কবর দিতে হয়, তা তুই বুঝবি না।
জানিস মৌরি, আজ তোর চিঠিটা পেয়ে আমি খুশীতে, আনন্দে, বিষাদে, খরষে, কষ্টে, সুখে বারবার খুন হচ্ছি। আমার সব উলট পালট হয়ে যাচ্ছে। ভালবাসার স্মৃতি এত মধুর হয় ! এত ভাবায়, এত হাসায়, এত কাঁদায়, এত আনন্দ দেয়, এত বিষ দেয় যে, আমি নিজেকে ঠিক রাখতে পারিনা ।
আচ্ছা মৌরি, তোর মনে আছে ! তোকে নিয়ে বিকেলে সমুদ্রের নরোম হাওয়ায় বালিচরে বসে বাদাম চিবুতে চিবুতে গল্প করার কথা! সিলেট জৈন্তাপুরে খাসিয়া উপজাতির সাথে বেড়ানোর কথা। সেই খাসিয়া উপজাতি থেকে আমরা তাদের ভাষায় অনেক কথা শিখেছিলাম। সিলেট থেকে ফিরে প্রায় এক সাপ্তাহ পর্যন্ত আমরা সে ভাষার চর্চা রেখেছিলাম। পরে ধীরে ধীরে এক সময় খাসিয়াদের সমস্ত ভাষা আমরা ভুলে যাই।
মনে আছে ! বান্দারবনের সর্বোচ্ছ পাহাড়ের চুড়া থেকে নামতে গিয়ে তোর পা পিঁছলে পড়ে গিয়ে ভিষন ব্যাথা পেয়েছিলি।
কী সাংঘাতিক সে দৃশ্য! আমি কোনদিন ভুলতে পারবো না। তুই এমন বিচ্ছু যে, আমার কথা না শুনেই সে পাহাড়ের চুড়ায় উঠেছিলে। পরে কাঁদতে কাঁদতে মনের মানুষের কথা না মানার জন্য কি আফসোস তোর ! আসলে তুই না একটা পাগলি, বিচ্ছু মেয়ে ! নইলে এমন কেউ করে !
মৌরি মনে আছে ; ঢাকায় তোকে নিয়ে হোটেলে রাত্রী যাপনের কথা ! আমি চোখ বন্ধ করলেই দেখতে পাই-
হোটেলের বিছানায় আমি শুয়ে আছি। তুই চেয়ার টেনে আমার মুখোমুখি বসলি। আমার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে গল্প বলছিলি।
তোর মুখে গল্প শুনতে শুনতে আমি কখন ঘুমিয়ে পড়ি খেয়াল নেই। আমি খুব ঘুম কাতুরে তাইনা !
হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে যায় আমার কপালে তোর নরোম ঠোঁটের ষ্পর্শে। চোখ খুলে দেখি তুই আমার পাশে বসে আছিস। আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম
- ক‘টা বাজে ?
- এইতো ২টা মাত্র।
কি অদ্ভুত মেয়ে তুই ! আমি রাত ১১টায় শুয়েছিলাম।
তুই ২টা পর্যন্ত না ঘুমিয়ে আমার পাশে বসে থেকে মাথার চুল টেনে, মুখে চুমো দিয়ে আদুরে ছোট্ট শিশুকে ঘুম পাড়ানোর মতো রাত জেগে আমাকে ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছিলি। তারপর জিজ্ঞেস করলাম
- তুই ঘুমাবি না ?
তুই আমার প্রশ্নের কোন উত্তর না দিয়ে চেয়ার ছেড়ে এবার বিছানায় আমার পাশে এসে গা ঘেঁষে বসলি। আমি তোকে দু‘হাতে টেনে নিজের বাহুর মধ্যে জড়িয়ে বুকে বুক লাগিয়ে তোর ঠোঁটে, মুখের সর্বাঙ্গে চুমো দিতে দিতে তোর ঠোঁট-মুখ লাল করে দিয়েছিলাম। তুকে ভালবাসার আদর সোহাগ, মমতায় ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলাম। আমার আকষ্মিক আদরে তুই আবেগাপ্লুত হয়ে ভালবাসার নদীতে ডুবে যাবার আমন্ত্রন জানালি।
আর তোর নরোম ঠোঁটে আমার ঠোট চুষতে চুষতে আমাকে প্রায় দেউল করে দিলি। এবার আমি বিছানা থেকে উঠে বসে তোর কপালে একটা চুমো দিয়ে বললাম
- না লক্ষীটি, তুই আমার ভালবাসা, মহৎ বন্ধু, তবে স্ত্রী নয়, তাই আমি আমার ভালবাসা, মহৎ ও পবিত্র বন্ধুর দেহে অপবিত্রতার নষ্ট স্বাক্ষর করতে পারবোনা।
ঠিক তখনই ডিমলাইটের আলোয় খেয়াল করলাম তোর বুকের কয়েকটা বোতাম খোলা। আমার সামনে পূর্নাঙ্গ নিবেদিতার মতই তুই আমাকে জোর করে জড়িয়ে ঠোঁটে, চোখে, মুখে অনবরত চুমো দিতে দিতে প্রায় পাগলের মতো ঘন ঘন নিশ্বাস ফেলছিলি। আমার নিষেধাজ্ঞার প্রতি তোর কোন খেয়ালই নেই।
তবু আমি তোকে বুঝাতে চেষ্টা করলাম
- না লক্ষীটি ! এসব করার ইচ্ছে থাকলে তোকে অনেক আগেই গ্রহন করতে পারতাম।
আসলে মৌরি সে রাতে তুই যেভাবে মাতাল হয়েছিলি, সেভাবে যদি আমিও নিজেকে ধরে রাখতে না পারতাম, তাহলে আমাদের সম্পর্কের মধ্যে বড় একটা দাঁগ পড়েযেতো, বড় একটা ভুল হয়ে যেতো আমাদের অব্যক্ত ভালবাসার সাদা চুক্তিনামায়। জানিস‘তো, অসময়ে বৃষ্টি ফসল নষ্ট করে। যদিও তুই বিষয়টা বুঝতে না পেরে আমার উপর রাগ করেছিলি। কা পুরুষসহ কয়েকটা খারাপ মন্তব্য করেছিলি।
কিন্তু মৌরি জানিস, আমি যদি সে রাতে তোর পূর্ণস্বাদ গ্রহন করতাম, তবে আজ তুই আমাকে চিঠি লিখতি না, চিঠি লেখার আন্তরিকতা তোর থাকতো না। এবং সে রাতে যদি দু‘জনে মিলে সে ভুলটা করে ফেলতাম তাহলে আজকে আমিও তোর প্রতি এতটা দূর্বল থাকতাম না, তোর প্রতি আমার আর কোন আকষণ থাকতো না।
সে রাতে আমি তোকে বিশেষ কিছু বলিনি। আজ বলছি - যে বাগান আমার নিজস্ব, সে বাগানে আমি যে ফুল যতœ করে ফোঠাবো, সে ফুলের ঘ্রাণ আমি গ্রহন করবো ঠিকই, কিন্তু সে ফুল আমি কখনো পায়ে পিষ্ট করে নষ্ট করতে পারবো না। আর আমার নিজস্ব বাগানের সে ফুল হচ্ছিস তুই-ই মৌরি।
এতক্ষন পর্যন্ত নিলয় চিঠিটা হাতে নিয়ে ভাবছিল সেই ফেলে আসা দিনের স্মৃতিগুলো। আর মনেমনে চিঠির জবাব দিতে গিয়ে নিজের চোখেও জল এলো। এবার নিলয় চেয়ার ছেড়ে শুয়ে পড়লো বিছানায়। বুকের উপর চিঠিটা দু‘হাতে মেলে ধরে পরবর্তী পেরাটা পড়তে লাগলো।
নিলয়, আমার চিঠি খুব এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে তাইনা ! আসলে নিলয়, তোর কাছে লিখতে বসলে আমার কোন কূলকিনারা থাকেনা।
স্মৃতির অতলান্তে তলিয়ে যাই। আচ্ছা, ভালবাসার ¤মৃতি মানুষকে এভাবে এলোমেলো করে দেয় কেন ? বলতে পারিস! ভালবাসার স্মৃতি মানুষকে এভাবে তাড়া করে কেন ! তোর স্মৃতির বোঝা যে আমি আর বইতে পারছিনা নিলয় ! আমি যে নিজেকে আর সামাল দিতে পারি না।
উহ! নিলয়, একটা কথা মনে পড়েছে। আচ্ছা, তুই কি এখনো ধূমপান করিস ? এখন তো আমি দেখছিনা , আমার অজান্তে যদি তুই ধুমপান করিস, তাহলে আমি খুব কষ্ট পাবো। তোর কি একটা বিশ্্ির অভ্যেস ছিলো।
বেশী ধুমপান করতিস। ধূমপানে তোকে খুব স্মার্ট লাগতো ঠিক , কিন্তু ধুমপান মানুষের কলিজা নষ্ট করে দেয়। তাই তুকে ধুমপান থেকে ফিরিয়ে আনার জন্য আমি উদ্যোগ নিয়েছিলাম। বিশেষ দরকারী কথা আছে বলে একদিন ওয়ার সিমে্িট্র পার্কে নিয়ে গিয়েছিলাম। ওয়ার সিমেট্রির নাবিকদের সমাধীস্থান সংলগ্ন বাগানে আমার কোলে মাথা রেখে শুয়ে শুয়ে তুই গল্প বলছিলি।
আর আমি ধুমপানের বিষয়ে কথা বলার জন্য সুযোগ খুঁজতে নিজেই তোর পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বার করে একটা সিগারেট ধরিয়ে তোর ঠোঁটে গুজে দিলাম। তুই আমাকে বড় একটা ধন্যবাদ দিয়েছিলি। কিন্তু তুই তখনো বুঝতে পারিসনি আমি কেন গায়ে পড়ে তোর ঠোঁটে সিগারেট তুলে দিচ্ছি। তুই যখন আমার কোলে মাথা রেখে সিগারেট থেকে লম্বা ধূঁয়া ছড়াচ্ছিলি, তখন ধুঁয়ার দূর্গধ্যে আমার নাক বন্ধ হওয়ার উপক্রম। তবু সহ্য করেছিলাম কিছুক্ষন।
তারপর তোর মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললাম
- নিলয়, ধুমপান করলে তুকে দারুন লাগে।
- হবে হয়তো।
- আচ্ছা , এ দারুন বিষয়টা কি ছেড়ে দেয়া যায় না ?
- মানে ?
- মানে খুব সহজ, আমি চাই না তুই ধুমপান করিস।
- কিন্তু কেন ?
- তুইতো জানিস নিলয়, ধুমপান করলে ফুসফুসে ক্যান্সার হয়। তাছাড়া বৈজ্ঞানি গবেষনায় দেখা গেছে যে, একটা সিগারেট পান করলে একজন মানুষের কমপক্ষে তিন সেকেন্ট আয়ু কমে যায় ?
- তাই নাকি ! তুইতো অনেক কিছুই জানিস দেখছি।
- আসলে তুকে ধুমপান থেকে ফিরিয়ে আনার জন্য ধুমপানের উপর একটু চিন্তা করছিলাম।
- তার মানে তুই আমাকে ধুমপান থেকে মুক্ত করেই ছাড়বি ?
- চেষ্টা করছি সেটাই।
- যদি না ছাড়ি ?
- বললেই চলে ! তুকে ছাড়তেই হবে।
নিলয়ের “ যদি না ছাড়ি ”প্রশ্নের উত্তরে মৌরি “ বললেই হবে ” বলে উড়িয়ে দিলেও বিষয়টা একটু ভাবিয়ে তুলেছে। কি যেন চিন্তা করছিলো মনেমনে।
নগদ কোন বুদ্ধি আবিস্কার করার চেষ্টা করলো মৌরি। তাৎক্ষনিক একটা উপস্থিত বুদ্ধি পেয়ে মৌরি এবার বলা শুরু করলো
- আচ্ছা নিলয়, তুই দৈকিন কয়টা সিগারেট খাস ?
- ১৭ টা।
- আর আমাকে দৈনিক কয়বার চুমো দিস ?
-৫১ বার, প্রতিদিন হাফ সেন্সুরী পার করি।
- এখন তোর কাছে কোনটা প্রিয় ! আমাকে চুমো দেয়া, নাকি সিগারেট টানা ?
নিলয় এবার সত্যিকার অর্থে বিপদে পড়েগেলো। তার খুব দূর্বল জায়গায় হাত দিয়েছে মৌরি।
নিলয় বুঝতে পারছে আজকে তাকে এ দু‘টি থেকে যে কোন একটি ছাড়তে হবেই। কিন্তু নিলয় এক কোটিবার ধুমপান ছাড়তে রাজি, কিন্তু একটি বারের জন্যও মৌরিকে চুমো দেয়া ছাড়তে পারবে না। কিন্তু ধুমপান ছাড়াটাও কি এত সহজ! অনেক দিনের পুরাতন স্বভাব। তাছাড়া সিগারেট হচ্ছে নিলয়ের টেনশানের গোপন বন্ধু। নিলয় এখন মহাবিপদে।
সাপে ব্যাঙ ধরার মতো অবস্থা। না পারছে ছাড়তে না পারছে গিলতে।
মৌরির প্রশ্নে কোন উত্তর না দিয়ে নিলয় ভাবছে দেখে মৌরি নিলয়ের কষ্ট বুঝতে পারে। কিন্তু মৌরি চাচ্ছে নিলয় ধুমপানমুক্ত হোক। তাই সে আজ নিজেকে শক্ত করে নিলয়ের প্রতি নিষ্ঠুর আচরন করছে।
ভালবাসার মানুষকে নিজের মতো তৈরী করতে কখনো নিষ্ঠুরও হতে হয়। তবে এ ক্ষেত্রে খেয়াল রাখতে হবে যেন বিপরীত ফল না হয়। মৌরি একটু ভেবে নিয়ে আবার নিলয়কে উদ্যেশ্য করে বলছে
- আমি জানি নিলয়, ধুমপান ছাড়তে তোর কষ্ট হবে। কিন্তু কোন ধূমপায়ীর ঠোঁটে আমার ঠোঁট স্পর্শ করুক তা আমি চাই না।
হঠাৎ কোন রকম ঘোষণা ছাড়া মৌরির এ কঠিন উচ্চারণে নিলয় বিশ্মিত হয়।
ভেতরে ভেতরে রেগে গেলেও তা প্রকাশ করতে পারছে না মৌরির কাছে। তাই বাধ্য ছেলের মতো মৌরির কথার উপর সমর্থন করে বলল
- ঠিক আছে, তোর কথায় থাকবে। আমি ধুমপান ছাড়তে পারবো কিন্তু তোকে ----------!
- কি, কথা শেষ করলি না যে ?
- সব কথা কি শেষ করতে হয়, তুই বুঝে নে।
- হ্যা, বুঝে নিলাম। কিন্তু তুই আমার উপর রাগ করেছিস।
প্লিজ নিলয়, একটু হাসতো !
মৌরির এমন আদুরে এবং সোহাগী কন্ঠের কথায় নিলয় আর রাগ ধরে রাখতে পারেনি। ঠিকই মৌরির কাছে হেরে গিয়ে হেসে বললো
না , রাগ করিনি, বলেই আবার হেসে উঠলো আর হাত থেকে আধাখাওয়া সিগারেটটা দূরে ছুঁড়ে মারলো।
জানিস, সেদিন তুই ধুমপান ছেড়েদিয়েছিস দেখে আমি কী যে খুশী হয়েছিলাম ! বুঝিয়ে বলতে পারবো না। তবু আমি তোকে চেক দিতাম। তোর বন্ধুর মাধ্যমে রিপোর্ট নিতাম, তুই ধুমপান করিস কিনা।
কিন্তু শেষ পর্যন্ত তুই আমার কথাই রেখেছিলি। আর ধূমপান করিসনি। আমার একটা কথা তুই রেখেছিস দেখে আমার তো খুশেিত প্রান যায়যায় অবস্থা। খুব কাছের প্রিয় মানুষকে নিজের মতো করে তৈরী করতে পারার আনন্দ কত যে গৌরবের, সে আমি জানি নিলয়। তুই সিগারেট ছেড়ে দিয়েছিস সেটা বড় ব্যাপার ছিল না, আমার কাছে বড় ব্যাপার ছিল তুই যে, আমার কথায় সিগারেট ছেড়েছিস সেটাই।
তবে নিলয়, আজকে তুকে আর বারণ করছি না। আসছে ৩ রা মার্চ তোর জন্মদিনে এক প্যাকেট “ মার্ল বুরো লাইট ” উপহার। তবে কথা দিতে হবে, বিদেশে এটাই তোর শেষ সিগারেট টানা। যতদিন বিদেশে থাকবি, ততদিন আর সিগারেট টানতে পারবি না। তবে তুই যেদিন দেশে ফিরবি, আমি সেদিন এয়ারপোর্টে তোর জন্য অপেক্ষা করবো।
সেদিন তোর জন্য রাখবো তোর প্রিয় ফুল একগুচ্ছ “ হাøাহেনা ” এবং এক প্যাকেট “ ব্যানসন এন্ড হেজ্যাজ”। ঐ একপ্যাকেট সিগারেট থেকে তুই কেবল একটা সিগারেট টানতে পারবি। বাকী পুরো প্যাকেটটা দিয়ে দিতে হবে বিমান বন্দরের যে কোন একটা ঝাড়–দার অথবা যে কোন একটা কুলিকে। এর পরবর্তী সময়ে তুই কখন সিগারেট টানতে পারবি বা না পারবি, তা আমি বলে দেবো। তোর সিগারেটের দায়িত্বটা আমার উপর ছেড়ে দে‘রে নিলয়।
নিলয়, এই মুহুর্তে আমার খুব লজ্জা করছে একটা বিষয় মনে পড়ে যাওয়ায়। আচ্ছা; সে রাতে আমাকে কোন ভুতে পেয়েছিলো কে জানে! আমি কী বিশ্রি অবস্থা করেছিলাম পাগলের মতো। সে রাতে তুই না হয়ে অন্য কেহ হলে আমাকে লুটেপুটে খেতো। তবে সে রাতে তুই যদি আমাকে গ্রহন করতি, তবু আমি অসন্তুষ্ট হতাম না। আমি আসলে সে রাতে পুরোপুরিই তৈরী ছিলাম তোর জন্য।
আর তাই মাতাল হয়ে সমস্ত বৈধতার সংবিধান ভুলে গিয়েছিলাম। তবে সে রাতে তুই নিজের ইচ্ছায় ঠকেছিস। আসলে তুই বোকা টাইপের ভাল ছেলে। এমন সুযোগ কেউ মিস্ করে নাকি ! অথচ সে রাতে হোটেল কাউন্টারে আমাকে তোর স্ত্রীই পরিচয় দিয়েছিলি।
নিলয় আর নিজেকে সামাল দিতে পারছে না।
মৌরির চিঠি যতই পড়ছে ততই সে এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। মিলে যাচ্ছে পেছনে ফেলে আসা স্মৃতির মধ্যে। মৌরি চিঠিটা এমনভাবে লিখেছে যে, তাদের ঘটে যাওয়া ঘটনার একটা দাড়ি কমাও বাদ পড়েনি। এমন নিপুন চিঠির জবাব দেয়ার মতো শক্তি নিলয়ের নেই। নিলয় চোখের সামনে চিঠিটা মেলে ধরে।
কিন্তু সে চোখে পড়ছে অন্যপাঠ -
মৌরি, তোর সব কথাই আজ মনে পড়ছে। আর মনে পড়ছে বলেই আমি এতটা কষ্ট পাচ্ছি। হঠাৎ তোর চিঠিটা আমার পুকুরের শান্ত জলে ঢেউয়ের মত করে আমার সমস্ত সত্বায় আন্দোলিত করছে। তোর চিঠি যে আমাকে এতটা দূর্বল করে দেবে আমি ভাবতে পারিনি।
মৌরি, যে সব কথা আমার মনে আছে কিনা জানতে চেয়েছিস, সব মনে আছে।
আচ্ছা তুই-ই বল, এসব কি কেউ ভুলতে পারে! জানি তুইও ভুলতে পারবি না। আসলে মৌরি, তোকে কোনদিন হারাতে চাইনি বলে সে রাতে তোকে গ্রহন করিনি সমস্ত দেহ দিয়ে। কারন- আমরা জানি যে, আমাদের মতো বন্ধু পৃথিবীতে খুব মুষ্টিমেয়। অথচ তুই কোনদিন মুখ ফোটে আমাকে ভালবাসার কথা বলিসনি, তেমনি আমি ও কোনদিন তোকে বলিনি যে, মৌরি আমি তোকে চাই। অথচ ঠিকই অনুভব করতে পারি যে, তুই না হলে আমার চলে না, এবং আমি না হলে তোর চলবে না।
আমরা যেন একে অন্যের পরিপূরক।
কিন্তু দেখ, কী অদ্ভুত সম্পর্ক আমাদের। বুকের ভেতরের কোথাও কী নিভিড় একটা আন্তরিক টান, যে টান একদিন তোর সমস্ত সংকোচ, লজ্জা, বাধা, বিপত্তি নশ্চাৎ করে দিয়ে সমস্ত উন্মাদনায় আমার কাছে নিয়ে আসতো, আর তা সামান্য আহ্বানে মাত্র। আর সেই বন্ধুত্বের আন্তরিকতার গোপন আগুন আজ আমাদের দু‘জনকেই ভালবাসার দহনে দগ্ধ করছে।
নিলয় আবার বিছানা থেকে চিঠিটা হাতে তুলে নেয়।
চিঠির সারা পৃষ্ঠায় বারকয়েক হাত বুলিয়ে কেমন যেন গভীরভাবে মৌরির স্পর্শ পাচ্ছে। মনে হচ্ছে এ মৌরির চিঠি নয় স্বয়ং মৌরিই এখন নিলয়ের চোখের সামনে ভাসছে। মনে হচ্ছে নিলয়ের চোখে চোখ রেখে অকৃতিত্রিম ভালবাসা মেখে হাসছে আর দু‘গালে দু‘টি সুন্দর টোল পড়ছে এবং তা পরক্ষনে মিলিয়ে যাচ্ছে। চোখের জল মুছে নিয়ে নিলয় আবার পড়া শুরু করলো-
জানিস নিলয়, প্রতিটি মানুষের একটা নিজস্ব জগত থাকে। আমারও একটা নিজস্ব জগত আছে।
আমি নিজেকে নিয়ে ভাবি আমার নিজস্ব সময়ে। আমার ভাবনার সমস্ত আকাশ জুড়ে তুই মেঘের মতো ছায়া বিলিয়ে উড়ে বেড়াস। আমার খুব ভাললাগে তখন। আমার নিজস্ব জগতে বারবার তোকে আবিস্কার করি। আর তোকে নির্মান করি নিজস্ব শৈল্পিকতায়।
জানিস নিলয়, তুই যখন চলে যাবার জন্য আমার কাছ থেকে শেষ বারের মতো বিদায় নিচ্ছিলি, তখনো আমি বুঝতে পারিনি যে, আমার কি হতে যাচ্ছে বা আমি কি হারাতে যাচ্ছি। কিছুক্ষন পর যখন তুই আমার থেকে বিদায় নিয়ে ধীরে ধীরে পা বাড়িয়ে চলতে লাগলি, তখনই খেয়াল করলাম আমার পায়ের তলা থেকে মাটি সরে যাচ্ছে। এই প্রথম আমি কিছু একটা হারানোর ব্যাথা গভীরভাবে অনুভব করলাম। আসলে হারানোর প্রকৃত ব্যাথা সে পায়, যে নিজস্ব বুকের কোন কিছু হারায়। তুই আমার সম্পত্তি নয় , সম্পদ।
আচ্ছা নিলয় , তোর সেই মুদ্রাদোষটা কি এখনো আছে ? তুইনা কথায় কথায় প্রায়শ “ হবে হয়তো ” বলতিস। প্রথম প্রথম শুনে আমার কি রকম যেন লাগতো। পরে অবশ্য তা স্বাভাবিক হয়ে গিয়েছিল। একদিন দুষ্টুমী করে তোর সেই মুদ্রাদোষ ধরে দিয়ে বলেছিলাম -
- জানিস, তোর একটা বড় মুদ্রাদোষ আছে ?
- আমার মুদ্রাদোষ ! “ হবে হয়তো ”, কিন্তু কি দোষ বলতো শুনি !
- তুই প্রত্যেক কথায় বলিস “ হবে হয়তো ”
- হ্যাঁ, “ হবে হয়তো ”
নিজের মুদ্রাদোষের কথা স্বীকার করে হু হু করে হেসে উঠলি। একটু ভেবে নিয়ে আবার বললি
- মুদ্রাদোষ কি শুধু আমার ! তোর ও আছে।
তোর মুখে আমার মুদ্রাদোষের কথা শুনে অবাক না হয়ে পারিনি। কারন আমি কোনদিন নিজের মুদ্রাদোষ ধরতে চেষ্টা করিনি। তার পর নিজের মুদ্রাদোষের বিষয়টা উড়িয়ে দিয়ে বললাম “ তুই বললেই হবে ”! আমার কোন মুদ্রাদোষ নেই
- আচ্ছা, কি বলতো আমার মুদ্রাদোষ ?
- নিজেই ভেবে দেখনা একবার
- ভাবতে হবেনা। আমার কোন মুদ্রাদোষ নেই ,আমি জানি ।
- আছে , আছে ,
- “ তুই বললেই হবে ” !
- হবে হয়তো ! তোর মুদ্রাদোষ হচ্ছে এই যে বললি- “ তুই বললেই হবে ” !
- যাহ “ তুই বললেই হবে”?
হ্যাঁ মৌরি, আজ তোর চিঠি পড়ে আমি বারবার পরাজিত হচ্ছি।
একদিন সোনালী বিকেলে সমুদ্রের বিশাল বালি চরে বসে ঘন্টার পর ঘন্টা ধরে আড্ডা, প্রতি শুক্রবারে সন্ধায় বেড়াতে যাওয়া, মিষ্টি মেলায় বসে তোর প্রিয় খাবার “ মিষ্টি দধি” খেতে খেতে মিষ্টি দধি সম্পর্কে আমার ব্যাঙ্গাত্বক মন্তব্য শুনে সেই “ মিষ্টি দধি ”খাওয়া ছেড়ে দেয়া, ফ‘য়েজ লেকে পাহাড়ী অরণ্যে বসে তোর লম্বা চুল গাছের সাথে গিট দিয়ে তোকে কাঁদানো , কম্পিউটারে গ্যামস খেলতে গিয়ে বারবার আমি হেরে যাওয়ায় কম্পিউটার তোর পক্ষে পক্ষপাতিত্ব করছে বলে দোষ দেয়া, আমার ব্যাচেলার ঘরে এসে কাপড় ধুইয়ে দেয়া, আমায় রান্না শেখানোসহ অসংখ্য স্মৃতি আমাকে দূর্বল করতে পারবেনা ভেবেছিলাম। কিন্তু তোর এই একটা চিঠি আমার সবকিছু মনে করিয়ে দিচ্ছে , আর বলছে এসব ভুলে থাকা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।
মৌরি, আমি বারবার হেরে যাচ্ছি। অথচ আমিই ছিলাম তোকে নিয়ে সেসব স্মৃতির নির্মাতা। তোর চিঠি পড়ে আজ ছোট ছোট অনেক কথা, অনেক মুহুর্ত, যেখানে তোর আর আমার হাসি, কান্না, আনন্দ, বেদনা মিশ্রিত ছিল, তা সবই মনে পড়ছে।
বৈশাখী মেলায় দু‘জনে নাগরদোলায় চড়ার সময় বাতাসে তোর চুল উড়ার দৃশ্য দেখছিলাম বলে তুই লজ্জা পেয়ে নাগরদোলা থেকে নেমে গিয়েছিলি। কর্ণফুলী ব্রিজে দাঁড়িয়ে নদীতে ডিল ছুড়ার প্রতিযোগিতায় আমার কাছে হেরে গিয়ে তোর কি যে অভিমান ! কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে দু‘জনে ঘোড়ার পিটে চড়তে গিয়ে ঘোড়ার তীব্র দৌড়ে যখন ঘোড়ার পিট থেকে ছিটকে পড়েগেলাম দু‘জন, তখনই আমাদের নিয়ে মানুষের কি হাসাহাসি! একসাথে এতজন লোক আমাদের নিয়ে হাসাহাসি করছে দেখে তুই লজ্জায় চোখ মুখ লাল করে ফুফিয়ে কেঁদে দিলি। আর তোর কান্না দেখে আমি হাসি থামাতে পারছিলাম না। এমন বিরক্তিকর অবস্থায় এতজন মানুষের সাথে আমিও তোকে নিয়ে হাসছি দেখে তুই আচঁলে মুখ ঢেকে ছিলি এবং লোকলজ্জা উপেক্ষা করে সবার সামনেই আমার বুকে আঁচড়ে পড়লি।
নিলয়, শেষ করতে গিয়ে আরেকটা কথা মনে পড়লো।
একদিন বাসায় পেঁয়াজ কাটতে গিয়ে আমার চোখে পানি দেখে তুই বলেছিলি “তোমারে আখোউ মে আচুঁ আস্যা নেহী লাগ্তা ” ( তোমার চোখে জল ভাললাগছে না )। সেদিন আমার চোখে জল তোর পছন্দ হয়নি বলে আমাকে পেঁয়াজ কাটতে দিসনি , অথছ সেই তুই-ই আজ আমার চোখে নুন্তা জলের নদী বইয়ে দিয়ে চলে গেছিস অ-নে-ক দূরে।
জানিস নিলয়, আজ তোকে লিখতে গিয়ে এমনই হাজারো স্মৃতি মনে পড়ছে। সেই ফেলে আসা দিনের হাসি,কান্না, আনন্দ, বেদনা সোহগ, প্রীতি ও ভালবাসার ছোট ছোট মুহুর্তগুলো বুকের এ্যলবামে জড়ো হয়ে আজ আমার বুকই যেন ভালবাসার স্মৃতি ক্যান্ভাস। এই শেষ করার আগে কথা দে নিলয়, আমার স্মৃতি ক্যানভাস থেকে তুই কোনদিন হারিয়ে যাবি না।
এরশাদ হাফিজ
লেখক - সম্পাদক।
অওজ গঅওখ
অৎংযধফ ঐধভরু . চ.ড়.নড়ী হড়: ৩৮৯০. যড়ষু সধশশধয . ক. ঝ. অ. ঞবষ : ৫৩১২৮৪০ / ৫৩২৪৭৩৪.
ঋঅঢ : ০২-৫৩৭৮৫২৯.গড়ন : ০৫৭৫৯৬৩৪৬
ঊ-গঅওখ: ধৎংযধফংধনঁলনধহমষধ@ুধযড়ড়.পড়স
ম
ক্কা আসার পর বিভিন্ন প্রবাসী ভাইদের মুখে তায়েফ সম্পর্কে বিভিন্ন কথা শুনে তায়েফ দেখার প্রতি একটা দূর্বলতা সৃষ্টি হয়েছিল। যার সাথেই কথা বলি, সেই বলে তায়েফ দেখতে খুব সুন্দর,চমৎকার পরিবেশ, তায়েফ সড়ক ভিষন ভয়ংকর এবং অদ্ভুত ধরনের সুন্দরসহ বিশেষনের পর বিশেষন দিয়ে তায়েফ শহর দেখার প্রতি আমাকে লোভী করে তুলে।
মক্কা থেকে মাত্র ৮০ কিঃমিটারের ব্যবধানে তায়েফ মক্কা থেকে সম্পূন্র্ ভিন্ন। মক্কায় সর্বদা পিটপোড়া গরম, অথচ মক্কার পার্শ্ববর্তী জেলা তায়েফ বছরে কমপক্ষে তিনবার ঋতু বদল হয়।
গ্রীশ্ম, শতি, এবং বর্ষা। অনেকটা বাংলাদেশের আবহাওয়ার মতো। আর মাত্র ৮০ কিঃমিটারের ব্যবধানে তায়েফ মক্কা থেকে আট হাজার (৮,০০০) ফুট উপরে। এরকম বিভিন্ন কথা শুনে আকাশ ছোঁয়া পাহাড়ভূমি তায়েফের প্রতি লোভ সামলাতে না পেরে মনেমনে তায়েফ যাওয়ার জন্য একটা সুযোগ খুঁজতে লাগলাম।
বাংলাদেশ থেকে আসার সময় আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু আরিফ তায়েফে আবস্থানরত তার বড় ভাই তৌহিদের জন্য বেশ কিছু হাদিয়া দিয়েছিলো।
সে হাদিয়া নেয়ার সুবাদে তৌাহদ ভাই মক্কা এসে আমার সাথে দেখা করেন। এবং তায়েফে বেড়াতে যাওয়ার জন্য আমন্ত্রন জানান। সে হিসেবে তায়েফে যাওয়ার একটা আমন্ত্রনও ছিল তৌহিদ ভাইয়ের পক্ষথেকে।
সৌদি আরবে এসে প্রথমবারের মতো মক্কায় ঈদ করলাম। ঈদের ঝামেলা কমলে কোথাও বেড়ানোর জন্য মন উতলা হয়ে উঠে।
তৌহিদ ভাইয়ের নিমন্ত্রনের কথা মনে পড়লে তায়েফে যাওয়ার সিন্ধান্ত নিয়ে বন্ধু কাসেমকে বললাম। তায়েফ কথাটা শুনে সে আমার সাথে যাওয়ার জন্য এক পায়ে খাড়া। এবার তৌহিদ ভাইয়ের কাছে ফোন করে আমরা তায়েফে আসছি জানালাম। তৌহিদ ভাই ভিষন খুশী হলেন আমরা আসছি জেনে। ফোন রেখে দেয়ার আগে বললেন-তায়েফে প্রচন্ড ঠান্ডা, শীতের পোষাক নিয়ে আসবে কিন্তু।
নির্ধারত দিনে সকাল ১১.৩০ মিনিটের সময় আমি ও কাশেম হাজির হলাম পবিত্র হারাম শরীফের বাবুস সালাম (সালাম গেইট) এর সামনে। সেখান থেকে ট্যাক্সি যাবে। তায়েফ ২০ রিয়াল ভাড়া। আরো দু‘জন যাত্রী নিয়ে ট্যাক্সিটি ঠিক ১২টার সময় যাত্রা শুরু করে। মক্কা থেকে বেশ ক‘টি লম্বা লম্বা টানেল পেরিয়ে সমতল রাস্তায় ট্যাক্সি দ্রুত বেগে এগিয়ে যাচ্ছে।
১৫ মিনিটের মধ্যে মক্কা সীমানা অতিক্রম করে ট্যাক্সিটি তায়েফ রোড় ধরে এগোচ্ছে। যেতে যেতে আমি ও কাশেম এদিক ওদিক তাকাচ্ছিলাম ট্যাক্সির গ্লাস থেকে। চতুর্র্দিকে বিরাট বিরাট খালী মাঠময় মরুভূমি আর মরুভূমি। প্রচন্ড রোদে খা-খাঁ করছে। রোড়ে, মাঠে, বন বনানীহীন পাথরের পাহাড়ে মরিচিকার ঝিলিক আমাদের দৃষ্টিকে অভিভুত করেছিলো।
ট্যাক্সি দ্রুতবেগে এগোচ্ছে। আমরা এদিক ওদিক বারবার তাকাচ্ছি নতুন জায়গা বলে। কতটুকু গিয়ে নজরে এলো সামনে বিরাট উঁচু উঁচু পাহাড়। এবং আমাদের রোড়টি এঁকেবেঁকে সেই উচুঁ পাহাড়ের দিকে এগিয়েছে। ইতিমধ্যে ট্যাক্সির গতি ১৪০ থেকে কমিয়ে ১০০ তে আনা হয়েছে।
ট্যাক্সি ধীর গতিতে ঢালু রাস্তা হয়ে ঘুরে ঘুরে উপরের দিকে উঠতে লাগলো। উপরের দিকে উঠতে উঠতে ট্যাক্সিটি এমনভাবে কাত হয়েছে যে, মনে হয় এই এখন উল্টে পেছনের দিকে পড়ে যাবে। আমরা দু‘জনেই ট্যাক্সির হাতল খুব শক্ত করে ধরেছিলাম। লতার মতো পেঁচিয়ে উপরের দিকে বেয়ে যাওয়া রাস্তাটি আসলেই দেখতে ভিষন সুন্দর, চমৎকার, ভয়ংকর এবং অদ্ভুত আধুনিক। উদাহারন হিসেবে বলা যায় রাস্তাটি ঠিক পত্রিকার গোলক ধাঁধার মতো।
এখানকার প্রায় শিশুপার্কে হুবহু এ রাস্তাটি আছে। সাহসী এবং এ্যডভ্যান্সার প্রিয় দর্শনার্তীরা শিশু পার্কের এ রাস্তাটিতে আগ্রহ নিয়ে চড়ে।
আমাদের ট্যাক্সিটি যখন একের পর এক পাহাড় ঘুরে উপরের দিকে উঠে যাচ্ছে, তখনই কাশেম ভিষন ভয় পেয়ে আমাকে চেপে ধরলো। বুঝতে পারলাম কাশেম ঘাবড়াচ্ছে। তার ভয় দেখে এবার আমি ট্যাক্সির হাতলে ভর করে বসা থেকে সামান্য দাঁড়িয়ে পেছনে ফেলা আসা পথের দিকে তাকালাম।
সত্যি বলতে কি! এবার আমিও ভয় পেলাম। এত অল্প সময়ে আমরা পাহাড়ের এত উপরে উঠেছি তা খেয়াল করিনি। এখান থেকে দূরে তাকালে নজরে পড়ে উচুঁ উচুঁ পাহাড় সারী, যেখানে তরতাজা মেঘের ভেলারা আশ্রয় নিচ্ছে পাহাড়ের অসমতল পিটে। আর কিছু মেঘ পাহাড়ের সাথে ধাক্কা লেগে মোমের মতো চষে পড়ছে। এদৃশ্য ভিষন সুন্দর এবং চমৎকার আনন্দদায়ক।
এ মনোমুগ্ধকর দৃশ্যটি সংরক্ষনের জন্য তাৎক্ষনিকভাবে অটোপ্রিন্ট ক্যামেরা দিয়ে কয়েকটা ছবি তুললাম। ট্যাক্সি চলন্ত অবস্থায় তুলা ছবি বলে ততটা সুন্দর না হলেও প্রাকৃতিক দৃশ্যটির গুনে ছবিটি খারাপ হয়নি।
সর্বোচ্ছ পাহাড়টির চুড়ায় উঠে আবার পেছনের দিকে তাকালাম। বেশী দূর দেখা যাচ্ছেনা। মনে হচ্ছে এ যেন শীতকালিন কুয়াশাচ্ছন্ন মনোরম সকাল।
এবার চোখ ঘুরিয়ে নিচের দিকে তাকালাম। নিচ থেকে সারিবদ্ধভাবে উপরের দিকে উঠে আসা ট্যাক্সিগুলোকে মনে হচ্ছিল এক ঝাঁক পিঁপড়ার দল লাইন ধরে একটা ¯িপ্রং এর নিচ থেকে ঘুরে ঘুরে উপরের দিকে উঠে আসছে। এভাবে জমাট বাঁধা বড় বড় অনেক পাহাড় বেয়েই আট হাজার (৮,০০০) ফুট উপরে উঠে আবার সমতল রোড়ে চলছে ট্যাক্সিটি।
এই যে ¯িপ্রং এর মতো ঘুরে ঘুরে উপরের দিকে উঠে আসা রোড়টির নাম ও কিন্তু সেরকম। অর্থাৎ এ রোড়ের নাম হচ্ছে তায়েফ রিং রোড়।
তবে এ রোড়ে সবধরনের গাড়ী চলতে পারেনা। শুধু জি,এম,সি‘র ট্যাক্সি গুলো চলার অনুমতি আছে। বাকী সবধরনের ছোট বড় গাড়ী চলাচলের জন্য “ আল হাদা ” নামক আরেকটি রোড় আছে। এ রোড়টি ঢালু ও সমতল। তবে এ রোড়ে অনেক দূর থেকে ঘুরে যেতে হয় বলে সময় লাগে ৩ ঘন্টা।
আর রিং রোড়ে সময় লাগে মাত্র ১ ঘন্টা।
দুপুর ১ টার সময় আমরা তায়েফ ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।