পৃথিবীর অনেক কিছুই আমি দেরিতে দেখেছি। অনেক কিছুই আমি দেরিতে শিখেছি। আমার পৃথিবী সব সময় অন্য হাত ধরে এগিয়েছি। আমি অনেক দেরিতে সেখানে পৌঁছেছি। কিন্তু এরপরও আমার তেমন লাভ হয়নি।
যথারীতি আমার পৃথিবী আমার চাইতে এগিয়ে এবং তার অনেক পেছনে আমি। এমন করে বহু বছর কেটে গেছে। এখন প্রায় প্রতিদিনই আমি নতুনের মুখোমুখি হই। যা আমার সমসাময়িক পৃথিবী পার করে ফেলেছে অনেক আগেই। আমার জন্য সহজটা ঠিক সহজ হয়ে আসেনা।
না সাফল্য, না স্বপ্ন, না প্রেম। কোনটাই না। প্রেম আমার জীবনকে ছুঁয়েছে বারবার। আমার ছোঁয়া হয়নি তাকে। কারণ, আমি জেনেছি অনেক দেরিতে।
শিখেছি অনেক পরে।
দুই.
প্রেম আমাকে অনেক সহজে ছুঁয়ে যায়। যদিও বিষয়টা সবসময়ই একতরফা ছিল। কেউ আমার দিকে ভুল করেও তাকালো, আমার শরীর ঠান্ডা হয়ে যায়। শীতল প্রেম ছুঁয়ে যায় আমাকে।
আমি বাসে সিটে বসে আছি কোন মেয়ে এসে পাশে দাঁড়ালো, এক্সকিউজ মি একটু চাপবেন? সঙ্গে সঙ্গে ধুমড়ে মুচড়ে যায় ভেতর আমার। আলোর চেয়ে দ্রুত গতিতে পাশের সিটে বসে যাই। প্রয়োজনে সিট ছেড়ে দিতে ইচ্ছে হয়। যতটা সম্ভব সচেতনভাবে চেপে বসি তার যাতে সমস্যা না হয়। মনে হয়, সে কেন বলে না আপনি একটু কষ্ট করে দাঁড়িয়ে যাবেন? আমার বসতে সমস্যা হচ্ছে।
কেউ বিশ্বাস করুক আর না-ই করুক আমি হাজার মাইল দাঁড়িয়ে যেতে রাজী। শুধু তার ইচ্ছা বা অনুমতির অপো।
সঙ্গে মাথায় ভনভন করে কাল্পনিক সব কাহিনী। ঘটনা কি? মেয়েটা আমার পাশে বসল কেন? সিট পেয়ে এসেছে নাকি না পেয়ে? চারদিক তাকিয়ে খালি সিট খুঁজে দেখি। কোথাও খালি সিট খুঁজে না পেলে সব কিছুই অর্থহীন মনে হয়।
সিট পায়নি বলে এখানে বসেছে। অন্য কোন উদ্দেশ্য নেই। সিট পেলে তো কথাই নেই। জন্মের স্বার্থকতা পর্যন্ত খুঁজে পাই ।
তিন.
এবার তার প্রসঙ্গে আসি।
তাকে প্রথম দেখায় আমার বুক পাথর হয়ে গিয়েছিল। আমি সব সময় জেনেছি কষ্টে মানুষ পাথর হয়। এই প্রথম বুঝেছি সুখও মানুষকে মাঝে মাঝে পাথর করে। পৃথিবীর সাতটি আশ্চর্যের কোনটাই দেখার সুযোগ হয়নি আমার। এমনকি দেশের বাইরে কোথাও যাইনি।
আমি অনেক প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দুচোখ ভরে দেখেছি। এখন বলাটা বাড়াবাড়ি হয়ে যায় তবুও দ্বিধাহীন হয়ে বলতে পারি, সাত আশ্চর্য হোক অথবা যে কোন প্রাকৃতিক সৌন্দর্যই হোক তাদের অন্যপাশে তাকে রাখা হলে আমি কোন দিকে পলকহীন তাকিয়ে থাকবো। তা নিয়ে হয়তো আমাকে ভাবতে হবে না সিদ্ধান্ত এখনই জানিয়ে দেয়া যায়, প্রকৃতিকে হয়তো তারই অপার সৌন্দর্যের এক প্রতীকের কাছে সম্মুখ সমরে হারতে হতে পারে। কি জানি, হয়তো এটা বেশি আবেগের কথা হয়ে গেলো। কিন্তু কি বলব, ঠিক এই জায়গাতে আমি বারবার অসহায়।
সৌন্দর্যের গভীরতা আমাকে টেনে নিয়ে যায় অনেক দুর। সেখানে থেকে ফেরা কষ্টের। কখনো কখনো ফেরা সম্ভবও হয়না।
জীবনের প্রত্যেকটি অংশের মতো এটাও ধারাবাহিক অর্থাৎ এখানে প্রেম থাকে তবে তা অবশ্যই একতরফা। আমার দিক থেকেই।
এখানে অবশ্য একতরফা না হওয়ারও কোন কারণ নেই। সে বিবাহিতা। অদ্ভুত সুন্দর একটা সন্তানও আছে। স্বামী দেখতে যেমনই হোক, ধনী। পৃথিবীতে আর কি প্রয়োজন? প্রেম নিয়ে আমি কখনই নির্দিষ্ট নিয়মকানুনের ধার ধারিনী।
আমার কাউকে ভাল লাগতেই পারে। তার ভাল লাগুক চাই না লাগুক। এই একতরফা প্রেমকে অনেকটা অযথাই বলা যায়। কোন যথার্থতা নেই এখানে। পৃথিবীর সব প্রেমে পরিনতি থাকবে, এমন নিয়মতো কেউ করেনি।
করে থাকলেও আমি মানিনা। তাই আমার প্রেম চলে যায় নিজের মতো করে। শীতের সময়ের গাছের মতো। পাতাহীন, সবুজহীন, সজীবতাহীন। তার সাথে আমার কখনোই কথা হয়নি।
আর হবেও না হয়তো। তার কন্ঠ শুনি প্রতিদিন। শুনতে হয়। তার উল্টোদিকের বাসাটাই তো আমার। তাই এই প্রেম সহজে মরেনা।
শুধু আমি মরি বারবার। প্রতিদিন। আমি তাকে দেখি প্রতিদিন। সে আমাকে দেখেনা। আমি তার কন্ঠ শুনি।
সে শোনেনা আমারটা। আমি তাকে সাজাই আমার মতো করে। দিন রাত ভাবনায় সে। অথচ সে আমাকে ভাবেনা। এতে যদিও আমার কোন দুঃখ নেই।
নেই আপে। আমার ভালবাসাতো। সহজও সহজ হয়ে আসবে না। মাঝে মাঝে নিজের ভাবনা নিয়ে ভাবি। ছিঃ কি ভাবছি আমি? লজ্জা হয়।
তবে সেটা বেশীণ টেকে না। আমি ভালবাসি। ভালোবাসা বলে কথা এর সামনে কিছুই টেকেনা। টিকতে পারে না।
চার.
স্বাভাবিক রীতিতে চলতে থাকে দিনগুলো।
কখনো ভাবনা, কখনো স্বপ্ন, কখনো বাস্তবতা নিয়ে। কিন্তু সব দিন স্বাভাবিক যায়না। একদিন রাত করে বাড়ি ফিরি। অবাক হই বাড়ীর সামনে পুলিশ। বাইরে অনেক উৎসুক মানুষের ভীড়।
কি হয়েছে? জিজ্ঞাসা করে কারো কাছে কোন উত্তর পেলাম না। বাড়ীতে ঢুকে শোনালাম তাদের বাসার কাজের মেয়ে মারা গেছে। স্বাভাবিক ঘটনা মনে করে চুপ করে ঘরে ঢুকি। বাইরে চিৎকার চেঁচামেচি। হঠাৎ একটি কথা আমার কান স্তব্দ কর দেয়।
কাজের মেয়েটা হয় আত্মহত্যা করেছে। অথবা তাকে হত্যা করা হয়েছে। পরের অংশটুকু শুনে আমি মোটামুটি শক্তি হারিয়ে ফেলি। মাথাও তেমন কাজ করছে না বলে মনে হচ্ছে। কি করব? ভেবে না ভেবেই হুট করে বেরুলাম।
সবার জোরালো দাবি, তাকে হত্যা করা হয়েছে। তাকে মেরেছে গৃহকর্তী। নিজের অজান্তেই অনেকটা চিৎকার করে বলে ফেললাম, অসম্ভব। কেন বললাম? তা বুঝতে পারছিনা। কিন্তু মন চাইছে সব পাল্টে দেই।
মনে হচ্ছে, আমি স্বপ্ন দেখছি। অসহ্য স্বপ্ন। আমি তীব্রভাবে চাইছি, জলদি ঘুম ভাঙ্গুক আমার।
পাঁচ.
আমি কখনই তাদের ঘরে যাইনি। এবার সাহস করে দরজার সামনে দাঁড়ালাম।
প্রচুর ভীড়। খুঁজে বের করলাম তাকে। তার চেহারায় অপরাধী ভাব আছে কিনা খোঁজার চেষ্টা করলাম। কিন্তু তার অপরাধী চেহারা খুঁজে বের করার বদলে সেখানে তার সুন্দর মুখখানি ছাড়া আর কিছুই চোখে পড়ল না। জীবনের যতটা সময় পার করেছি অনেক অনেক বড় কথা বলেছি মন্যুষত্ব নিয়ে।
মানবতা নিয়ে। আজ আমার মাঝে এর কিছুই খুঁজে পাচ্ছি না। একটা নিঃস্পাপ কাজের মেয়ে মারা গেছে। যদি সে মেরেও থাকে কিছুতেই মা করা যায়না তাকে। একটা মেয়ে সামান্য খাবারের জন্যই তো কাজ করে।
কিন্তু সেই মেয়ের জন্য আজ আমার বিন্দু মাত্র দুঃখ হচ্ছে না। যে ধরনের মৃত্যু সবসময় আমাকে ছুঁয়ে গেছে। তার সামান্য স্পর্শও নেই আজ আমার ভেতরে। আমি এর চেয়ে বেশী কষ্ট পাচ্ছি তার অসহায় মুখ দেখে। জিজ্ঞাসা করতে ইচ্ছে করছে, তুমি কি কষ্ট পাচ্ছ?
মানুষের আনাগোনা, অগোছালো মন্তব্যে আমার কান প্রায় পঁচে যাচ্ছে।
মাথার ভেতর শুধু ভনভন করছে প্রশ্ন। তুমি কি কষ্ট পাচ্ছ? এই সব সহ্য করতে না পেরে ঘরে এসে শুয়ে পড়লাম। ভাবনা, দুশ্চিন্তা, তার পরিনতি সব মিলিয়ে আমাকে বিষন্ন করে তুলেছে। ঘুম জড়িয়ে আসে। ভারী হয়ে আসছে চোখের পাতা।
ছয়.
হঠাৎ হৈ চৈ শুনে ঘুম ভাঙ্গলো। উঠে তাকালাম। বাইরে বেরুলাম। একটি কথা শুনে থমকে গেলাম। কেউ একজন বলছে, লাশটা ভালভাবে গাড়ীতে তোল।
'লাশ' শব্দটা শুনে প্রথমবারের মতো অনুভব করলাম মানবতা। এবার মৃত্যু নামটার পাথর বুকে চাপল। সৌন্দর্যের অথবা প্রেমের কি তাহলে পরাজয় ঘটল মানবতার কাছে? কি জানি?
লাশ নিয়ে চলে গেল পুলিশ।
আমি আমার ভেতরে দুটো অস্তিত্বের সন্ধান পেলাম। একদিকে প্রেম আর অপার সৌন্দর্য অন্যদিকে মানবতা।
আমি কাকে চাই আমি জানি না।
সাত.
আজ প্রায় পাঁচদিন। কাজের মেয়ের রহস্যজনক মৃত্যু নিয়ে পত্রিকার পাতা সরব। মোটামুটি এক ধরনের সত্য হয়ে দাঁড়িয়েছে এটা হত্যা। সবাই জানে এটাই ঠিক।
আমিও হয়তো জানি। কিন্তু আমি মানিনা। মানতে পারিনা। সে এমন কাজ করতে পারেনা। আমার খুব কষ্ট হচ্ছে।
সে এমন কেন? আমার খুব ইচ্ছে তার মুখ থেকে একবার শুনি, এটা সত্য না। একদিন একজন আমাকে সব জানালো। প্রতিদিনই কেউ না কেউ জানায় এটা হত্যা। আমি চুপ করে শুনি। সকলকেই বলি, ময়না তদন্ত রিপোর্ট আসুক দেখা যাবে।
কেউ তাচ্ছিল্যের সঙ্গে জানায়, টাকা হলে সব হিসেব পাল্টে দেওয়া যায়। এটাতো সামান্য ময়না তদন্ত। তাদের যেহেতু অনেক টাকা আছে ফলাফল তাদেও মতই আসবে। আমি নিজেকে বোঝাই। কষ্ট করে বোঝাই।
রিপোর্টে হত্যা আসলেও ভুল হবে। আমি তাকে যেমন দেখেছি, তাতে সবই অসম্ভব। এতো সুন্দও যে মানুষটা, সে কি এমন কাজ করতে পারে? পারে না।
কিন্তু আমাকে যদি প্রকৃতই স্বীকার করতে হয়, তবে হয়তো কষ্ট হলেও মেনে নিতে হবে সে একটা করেছে এবং এটা হত্যা-ই।
আট.
একদিন খুব সকালে পত্রিকা খুললাম।
কাজের মেয়েটার ছবি পাশে ময়না তদন্তের প্রকাশিত রিপোর্ট। রিপোর্ট এসেছে আত্মহত্যার। অদ্ভুত এক বিজয়ের হাসি হাসলাম। বিশ্ব জয় করার আনন্দ ছুঁয়ে গেল আমাকে। হঠাৎ থমকে গেলাম মেয়েটার ছবিটা হঠাৎ যেন নড়ে উঠল।
প্রচন্ড রাগী চোখে তাকিয়ে আছে সে। হঠাৎ যেন কথা বলে উঠলো, ছিঃ করুণা হয় তোমার জন্য।
কথাগুলো তীব্রভাবে আমার হৃৎপিন্ড ভেদ করে ভেতরে চলে গেল। অনেক ভেতর। যেখানে বাহ্যিক সৌন্দর্য বনাম মানুষ ও মানবিকতার প্রকাশ্য দ্বন্দ চলমান।
যেখানে সংখ্যালঘু হিসেবে মানবতার দিনযাপন চলে খুব দুঃসহভাবে।
নয়.
আজ অনেক সময় পরের কথা। কেউ একজন আমাকে চেনে অসাধারণ করে। যে আমাকে স্থান দেয় মানুষের চেয়েও কিছুটা উপরে। সে হঠাৎ জিজ্ঞাসা করল, আচ্ছা তুমি কি তোমার চোখ দুটো দান করে যাবে? আমি 'না' জানালাম।
সে অবাক হল। পাল্টা জিজ্ঞাসা করল, তুমি এত কিছু করতে চাও মানুষের জন্য, তুমি কি চাওনা কেউ একজন পৃথিবীর সৌন্দর্য দেখুক? আমি চুপ করে রই। সে বিরক্তি নিয়ে বলল, জবাব দিচ্ছ না কেন?
আমি খুব আস্তে জানালাম, না চাই না। সে সশব্দে করে ফোনটা রেখে দিল। আমি রিসিভার কানে ধরে বসে রইলাম।
আমার এ আচরন তার বিশ্বাসে ফাটল ধরিয়েছে। সে আমাকে মহান কিছু ভেবে এসেছে অনেকটা দিন। আজ আমার এই অন্য রূপ তার পছন্দ হয়নি। হয়তো সে দুঃখও পেয়েছে। পাওয়ারই কথা।
বিশ্বাস ভেঙ্গে গেলে এমনই হয়।
আমার কি করার আছে। আমি তাকে কি করে বোঝাই এ চোখ দুটো ভাল না। এ চোখ শুধু বাইরের সৌন্দর্য দেখে। এটা দিয়ে মানুষ দেখা যায় না।
দেখা যায়না মানুষের ভেতর। তাহলে কি লাভ চোখ দিয়ে? কি করে বোঝাই তোমায় এ চোখ দিয়ে শুধু আলো দেখা যায়। আলোটা বোঝা যায় না। আর তাকে এটাও জানানো হয়নি যে তার চেনা আমি'র সাথে এখনকার আমি’র পার্থক্য এখন অনেক। অনেকটা বদলে গেছি আমি।
যদিও এই পরিবর্তনটা আমিও টের পেয়েছি বহুদিন পরে। জেনেছি অনেক দেরিতেই।
কারণ, এই পৃথিবীর অনেক কিছুই আমি জানি অনেক পরে। শিখি অনেক পরে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।