সরু মাস্তুলের ছায়া পানিতে তরঙ্গ লেগে টলে কেন
বহু অপেক্ষার পরে মূত্র এসে লবণের
প্রশমন গায় কেন
বেঁচে থাকাটাকে আমি ফুলে উঠে ঘেমে যেতে দেখে
যে রকম লবণ লাগার কথা বলে থাকি
(স্নান ঘরে সোনার বোতাম)
দেখে দেখে বলে যাই অঙ্গলীনা জামা
তুমি মোর প্রাণের সম্রাট,
তুমি নীল ডোরা শাদা মেজেন্টায় ঘনীভূত হবে
তুমি ও প্রোলোগ মিলে একত্রে উপমা ক’রো
উপমিত একটি টেবিল
যখন ছলনা ক’রে চিঠি শব্দ নিয়ে করে ধুলা-ধুলা খেলা
তখন জানি না কিছু খালি দেখি ধুলাটাই মুখ্য আর ঘোলা
(সারাটা জীবন যদি উবে যায়) যে তখন
কড়া স্তবাধার
নিয়ে বালিকারা যায় মায়ের মতন কারও চুল ছুঁয়ে ছুঁয়ে
চিঠির গুঢ়ার্থ তারা জানে বেশ আদ্যোপান্ত আর
কিছুটা গোপন তবে ‘কিন্তু’ বলা অভ্যাসের মতো
বেশ মাদকতাময়।
(নভেরা ৩; শামীম কবীর)
শামীম কবীরের (১৯ এপ্রিল ১৯৭১-২ অক্টোবর ১৯৯৫) কী পরিচিতি দেয়া যায়? যখন সে সব প্রচল বিশেষ্য ও সর্বনামের শত্রু ! স্বেচ্ছামৃত্যুর কিছু পরে প্রকাশিত ‘শামীম কবীর সমগ্র’ কোনোভাবেই মৃত্যু বা কবি সম্পর্কিত একাডেমিক কৌতূহলীদের প্রশ্নের জবাব দেবে না বরং তৈরি করবে নতুন নতুন আরও অনেক প্রশ্ন। সেসব প্রশ্নের মুখোমুখি হওয়ার মতো ন্যূনমাত্রার শুদ্ধও তো আমরা নই। কবিতা আর জীবনকে এমন আপোষ, এমন ক্ষয়, এমন মুমূর্ষুতার দিকে নিয়ে গেছি যে অনধিক তিনশ পৃষ্ঠার ‘শামীম কবীর সমগ্র’ আমাদের অনেকদিন পর্যন্ত পরিহাস করে যেতে পারবে।
২.
প্রথম কবিতা পান্ডুলিপি ‘চব্বিশ’-এ খেয়াল করব আর সব লোকের ভিড়ে সে ক্রমশ হতেছে আলাদা।
তার অসুখ চোখের পড়ার মতন। বিদ্যমান কাব্যভাষায় তার অরুচিও জাজ্বল্য। নিজের অন্তর্গত দহনকে শুধু বিকল্প শব্দ দিয়ে কীভাবে অন্যের স্পর্শগ্রাহ্য করা যায় তার উদাহরণ শামীম কবীরের কবিতা। শামীম কবীর পড়তে পড়তে কখনওবা মনে হয় তাঁর আরাধ্য যেন অনুপম শব্দমদ। আমরা তো জানি সব মাদকতাই যুগপৎ সুন্দর এবং বিধ্বংসী।
শামীমের শব্দবাহিনী অমরতার জন্যে যাচ্ছে মরণের পানে। আর কোনো গতি নেই। এই পতন। এই নির্বাণ। সৌন্দর্যের আদিখনির সন্ধানে চলেছিল এক কবি।
যে সৌন্দর্যের সিদ্ধি মৃত্যুতে।
চব্বিশ, রোগশয্যার আলোবাদ্য, মনে হচ্ছে যাচ্ছে রেল, কোথায় দেবো রাজস্ব ইত্যাকার কবিতা পান্ডুলিপিগুলো একার্থে কবিতার পরম্পরা, অন্যার্থে কবিতার চূড়ান্ত ছত্রখানতার নিদর্শন। ক্ষুধার্তের জ্বালায় শামীম চারিয়ে দেন ব্লেডভোজনের সুস্বাদু গল্প। কুমারীর অহমে তাই লেপ্টে যায় চন্দ্রখোঁড়ার দাগ। দূরে বাইশ খণ্ড ধ্যান পেতে বসে আছে ঋষি খর্পর।
ফলত দেবতার ঢোল গান হারালেও খোঁড়া নর্তকীর পায়ে শুরু হয় তীব্র নাচ। অ্যাস্ট্রোলোবান গিলে খায় শ্বেত বামনের বিলোড়ন। এক সম্পন্ন নাও চলেছে নিরুদ্দেশে; তার মাস্তুলের ঘা'য়ে ঘা'য়ে ভেঙে যায় চাঁদ। সমকাম, প্রাশনের সুর, ডাক্তারখানা, কম্বুকন্ঠা ষড়জ, উভলিঙ্গ ফুল, ডুবন্ত মাঝি, জাগ্রত পাল। নীলিমা শিকার করে সেথায় একদল প্রেত নামছে নাইতে।
একলা এক কবি। শুধু দ্রষ্টা। এতসব জীবন-মরণমাখা ছবির স্রষ্টা হয়েও তাঁর করার নেই কিছু। তাই সে ‘গোপনে, ত্বকের নিচে খুব নিরুপায় এক আহত শিকারি নামের মোহন ফাঁসে জড়ায় তিমির। ’ (কোথায় দেবো রাজস্ব; শামীম কবীর)
আর তাঁর গদ্য।
আর তাঁর ডায়েরি। আর তাঁর চিত্রকলা। কিছু বলার নেই। তবু বলা যায় এ হলো বিকল্প গদ্য, বিকল্প ডায়েরি, বিকল্প চিত্রকলা। চব্বিশ বছর যাবৎ সে যেন একটি অর্জনের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করে চলেছিল।
ম্যানসাইজ আরশি। বিবরে সূর্যাস্ত।
কত সিন্ধু, কত দিগন্ত; মাত্র সাত লাইনের গদ্যে-
‘একদিন রাতে গেরস্থ ভাবলো যে কার্যাবলী পাল্টাতে হয়। সে তার মোরগটাকে ডাকলো। আর সারারাত শিয়রের পাশে বসিয়ে শিক্ষা দিলো তাকে।
সকাল বেলায় মোরগটাকে ছেড়ে গিয়ে গেরস্থ তার দোতলার মেঝেতে সিঁড়িমুখে একটা ধামা এনে রাখলো।
মোরগটির এখন কাজ হচ্ছে সারা পাড়া ঘুরেফিরে খুঁদ বিচি-টিচি এইসব ঠোঁটে তুলে বয়ে আনা আর সিঁড়ি ভেঙে উঠে ধামাটায় জমা দেয়া। এখন মোরগটির এইমাত্র কাজ। সকাল থেকে সন্ধ্যায়। ’
(মোরগ; শামীম কবীর) ।
কবিতা, গদ্য, ডায়েরি, চিত্রকলা-সব মাধ্যমেই শামীম কবীর নিজস্বতায় উজ্জ্বল ও অভিশপ্ত। সে দুটো গভীর চোখে দেখেছে জীবনের ফ্যাকাশে গালগল্পে আমরা কেমন রক্তাল্প করে তুলেছি কবিতাকে, সমূহ শিল্পকে। তাই সে মৃত্যুকে তাঁর শিল্পের অদ্বৈত করে তুলেছিল। এক অনন্য দুরভিগমনের রেখা তাঁর ভেতর কে যেন বিছিয়ে গেছে জন্মেরও আগে। ফলত তাঁর প্রগাঢ় উপলব্ধি,‘...যে কারোর, মৃত্যু মানে অন্য কারোর মঙ্গলের শুরু বা মঙ্গলই।
’
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।