আত্মবিশ্বাসহীনতায় প্রকট হচ্ছে আত্মার দেউলিয়াত্ব, তবুও বিশ্বাস আগের মতই নিশ্চল..
[এই লেখাটির চরিত্রগুলো বাস্তব হওয়ায় নাম বদলে কাল্পনিক নাম ব্যবহার করছি]
একটা ব্যক্তিগত লাইব্রেরী গড়ার প্রচেষ্টা আমার দীর্ঘদিনের; সেই লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছি সেই ২০০০ সাল থেকে, কিন্তু ৯বছরের প্রচেষ্টাটা রিভিউ করতে গেলে দেখবো, কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যমাত্রা থেকে আমি অনেকটাই পিছিয়ে আছি। এজন্য মূল দায়টা অবশ্যই আমার, তবে সেজন্য আমার চেষ্টা আর কমিটমেন্ট- এ দুটো ব্যাপারে তেমন একটা প্রশ্নের অবকাশ নেই। পিছিয়ে পড়ার মূল কারণ, আমার সংগ্রহের বইগুলোর নিশাদলের মত উদ্বায়ী পদার্থে পরিণত হওয়া; স্পষ্টভাবে বললে, প্রতিনিয়ত বই বেহাত হওয়া অথবা চুরি যাওয়া। আজ বই হারানোর সেইসব গল্প লেখারই একটা চেষ্টা নিচ্ছি।
আমার লাইব্রেরী থেকে বই নিয়ে আর ফেরত দেয়নি, এমন তালিকা করলে প্রথম নামটি আমার স্কুলবন্ধু তমালের।
জাফর ইকবালের 'দুষ্টু ছেলের দল' বইটা পড়তে নিয়েছিল সে ২০০১সালে; অদ্যাবধি সেটা ফেরত পাইনি, যদিও তার সাথে আমার নিয়মিতই যোগাযোগ আছে, এবার ঈদেও একসাথে অনেক আনন্দ করেছি ; সত্যি বলতে কী, সেই বইয়ের কথা এতদিনে আমিও ভুলে গিয়েছিলাম। এই লেখাটা লিখতে গিয়ে মনে পড়লো।
স্কুলজীবনের আরও ২বন্ধু হচ্ছে সোহেল আর সোহাগ। সোহেলের পছন্দ ছিল হুমায়ূন আহমেদ; আমার ছোট আপা হু.আ এর অনুরাগী হওয়ায় আমাদের বাসায় তার বইয়ের বেশ বড় একটা সংগ্রহ ছিল; সোহেল পড়তে নিয়ে কত বই যে নিজের করে নিয়েছে ও হয়ত ভুলেই গেছে। এতে অবশ্য আমার লাইব্রেরীর কোন শ্রীহানি ঘটেনি, তবে সোহাগের কারণে কিছুটা ক্ষতি হয়েছেই।
আমার বেশ কয়েকটা বিদেশী ভাষার বই ও পড়তে নিয়েছিল, যে কোন কারণেই হোক সেগুলো আর চাওয়া হয়ে উঠেনি। এরপর ক্লাশ টেনে উঠলে ওর বাবার বদলি হয়, ওরা গাজীপুর চলে আসে। আমার বই চাইতে একদমই খেয়াল ছিলনা তখন। ব্যস, সোহাগের সাথে সাথে বইগুলোও বিদায় নিল।
কলেজ জীবনটা মোটামুটি নিরামিষভাবেই কেটেছে।
ঢাকায় নতুন এসে এডজাস্ট করতেই অনেকদিন সময় লেগে গেছে, ফলে কলেজে আমার তেমন কোন বন্ধুমহল ছিলনা, এর মাঝেও বই হারানো থেমে থাকেনি, তবে স্কুলের তুলনায় হারানোর হারটা যে বেশ কম, এটা সত্যি। কলেজে আমার ঠিক সামনের বেঞ্চে বসত কাঞ্চন- প্রায় সবধরনের বইই পড়ত সে। একবার আমার কাছ থেকে বারট্রাণ্ড রাসেলের বেশ কয়েকটা বই পড়তে নিয়েছিল- ফেরত দিতেও ঝামেলা বাধায়নি; ঝামেলা বাধিয়েছি আমি নিজেই। রাসেলের পাশ্চাত্য দর্শনের ইতিহাস বইটা পড়াশেষে সে ফেরত দেয় কেমিস্ট্রি প্র্যাকটিকাল ক্লাশে ; আমরা তখন সল্ট এনালাইসিস করে করে একেকজন রাদারফোর্ড হচ্ছি। আমি আনমনে বইটা পাশের টেবিলে রেখে কাজ করে যাচ্ছিলাম; কাজ শেষে ক্লাশ থেকে বেরিয়ে গেলেও বইটা যে রুমেই ফেলে এসেছিলাম সেটা মনে পড়েছিল ২দিন পরে।
ফলে বইটা আর পাওয়া হয়নি। কাঞ্চনের সঙ্গে বইসংক্রান্ত পরবর্তী গোলযোগটা ঘটে সানরাইজে কোচিং করার সময়। সেবার সে রাহুল সাংকৃত্যায়নের ভোলগা থেকে গঙ্গা বইটা পড়তে নিয়েছিল। এই বইটার সঙ্গে আমার একটা ব্যক্তিগত স্মৃতি জড়িত ছিল- বইটা আমাকে মানিকগঞ্জের একজন বয়স্ক মানুষ উপহার দিয়েছিলেন এইচএসসি তে ভাল রেজাল্ট করায়; মজার ব্যাপার হচ্ছে লোকটি আমার পূর্বপরিচিত নন, একটা ছেলে ভাল রেজাল্ট করেছে সেই খুশিতেই তিনি আমাদের বাড়ি খুজে বের করে বইটা দিয়ে গিয়েছিলেন। এই বইটা হারানোর পর তাই বেশ দু:খ পেয়েছি।
কাঞ্চন এখনো বুয়েটেই আছে, অন্য ডিপার্টমেন্ট হওয়ায় এত কম দেখা হয় যে হঠাৎ দেখা হওয়ার পর সরাসরি ৪বছর আগে পড়তে দেয়া একটা বইয়ের কথা জিজ্ঞাসা করতে অস্বস্তি লাগে কেমন।
সবচেয়ে বেশি বই হারিয়েছি বুয়েটে এসে। এখনো হারাচ্ছিই, থামছেইনা। প্রথম হারানো বই কার্ল মার্কসের জীবন ও চিন্তা; বইটা পড়তে নিয়েছিল পাশের হলের রুমন, আমরা তখন ফাস্র্ট ইয়ার। সেসময়ের বিশ্বকাপ আর পরীক্ষা পেছানো মিছিলের ফলাফলে অনির্দিষ্ট কালের জন্য হল ভ্যাকেন্ট হওয়াটা এখনো হয়ত অনেকেরই স্মরণে আছে।
সেই হল ভ্যাকেন্ট অন্য অনেক কিছুর সঙ্গে ঐ বইটিও লাপাত্তা করে দিয়েছে। কলেজ জীবনের আরেক বন্ধু শিমন; বুয়েটেও একই ডিপার্টমেন্ট আমরা । তাই ফাস্র্ট ইয়ারে আমার বন্ধু বলতে ছিল ঐ শিমনই, কিন্তু পরবর্তীতে বহুবিধ নীতিগত বিরোধে ওর সঙ্গে বন্ধৃত্বটা নষ্ট হয়ে গেছে; ওর কাছে এখনো আমার বেশ কয়েকটা বই আছে, চাওয়া হয়না। তবে বই হারানোর কথা বললে, বিশেষভাবে মোনায়েম ভাইয়ের কথা বলতে হবেই। তিনি আমার ৫বছরের সিনিয়র হলেও সম্পর্কটা বন্ধৃত্বপূর্ণই।
আমার ঠিক কতগুলো বই তার হস্তগত হয়েছে, তার সঠিক পরিসংখ্যান আমার জানা নেই। নিজে তো নিয়েছেনই, তার এক কলিগও এসে বই নিয়ে গেছেন। এর বাইরে বই হারানোর আরেকটা মজার অভিজ্ঞতা মনে পড়ছে। ছেলেটার নাম শফিক, আমার রুমমেটের বন্ধু, আমার এক ইয়ার জুনিয়র। অন্য ভার্সিটির হলেও বই পড়াসূত্রে ওর সংগে বেশ আন্তরিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল।
দেখা যেত, হলে আসলে বন্ধুর চেয়ে আমার সঙ্গেই আলাপ হত বেশি। গত বইমেলায় কেনা বইয়ের একটা মাঝারি অংশ সে পড়তে নেয় একদিন; সেদিনের পর ওকে আর হলে দেখিনা; ওর বন্ধুটিও রুম পাল্টে অন্যরুমে চলে গেছে, ফলে হারানো বই ফিরে পাবার আশা আর নেই বললেই চলে।
৯বছরে কত ভিন্নভাবে কত বই যে হারিয়েছে, সবকিছু মনেও নেই, আর অনেক হারানোর রহস্য আমি জানিওনা। আমি নিজে একসময় পাবলিক লাইব্রেরী থেকে বন্ধুদের দিয়ে বই চুরি করাতাম, সেটাকে মহৎ কাজই বলবো, কিন্তু ক্রমাগত নিজের লাইব্রেরী থেকে বই খোয়াতে খোয়াতে এখন ভাবি বই চুরি করাটা একদমই উচিৎ ছিলনা। এবারকার বইমেলা থেকে "শাশা' নামের একটা বই চুরি করেছিলাম সন্দেশ প্রকাশনী থেকে।
তার পরদিন সকালেই পাটকেলটি হজম করতে হয়েছে আমায়, কারণ ঐদিনই হলে রুমের ভেতর থেকে আমার মোবাইল, মানিব্যাগ, ভার্সিটি আইডি, এটিএম কার্ড চুরি হযে যায়। বুঝতে পারি, ইটের জবাবে পাটকেল নয়, আস্ত একটা পর্বতই হজম করে ফেলেছি। তবুও লাইব্রেরী গড়তে শুধুমাত্র কেনার উপরেই নির্ভর করতে ইচ্ছা করেনা, সুযোগ পেলে একটু আধটু হাতটান দিলে ভান্ডার তো সমৃদ্ধই হবে। তাছাড়া কালোটাকা যেভাবে সাদা করার আইন আছে, তেমনি কালো বই-সাদা বই তত্ত্ব দিয়ে চুরি করা বইগুলো জায়েজ করার একটা বিধান তৈরি করবো কিনা ভাবছি। ভয় শুধু একটাই, বই খোয়াতে খোয়াতে ততদিনে লাইব্রেরীটাই না খুইয়ে ফেলি আবার।
............................
[আজকে হঠাৎ খেয়াল করলাম আমার বইয়ের সংগ্রহ বেশ কমে গেছে; তাই পুরনো স্মৃতি ঘাটতে ঘাটতে কয়েকটি বই খোয়ানোর কাহিনী পড়ে গেল। । । স্বপ্ন এখনো সতেজ নি:শ্বাস নেয় লাইব্রেরীর বিস্তৃত অবয়ব জুড়ে}
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।