বিমান আবিষ্কারের কথা আমরা প্রায় সবাই জানি। নীল আকাশে ডানা মেলে পাখির স্বাচ্ছন্দ্য বিচরণ দেখে মানুষের ইচ্ছা হলো আকাশে ওড়ার। নানা পরীক্ষা, বিচিত্র অভিজ্ঞতার ধাপ পেরিয়ে একদিন মানুষের ইচ্ছা বাস্তবে রূপ পেল। ১৯০২ সালে আমেরিকার রাইট ভ্রাতৃদ্বয় অরভিল রাইট ও উইলবার রাইট একটু উন্নতমানের গ্লাইডার তৈরি করে ১০-১২ সেকেন্ড আকাশ ভ্রমণ করে সামান্য দূরত্ব পেরুতে সক্ষম হন। এতে হয়তো একটু ওড়ার আনন্দ ছিল কিন্তু উদ্দেশ্যের সফলতা ছিল না।
কিন্তু যে তথ্যটি আমরা জানি না, সেটি হলো পৃথিবীর প্রথম বিমানবন্দরের নাম কী এবং কোথায়। পৃথিবীর প্রথম, পুরনো বিমানবন্দরটি আমেরিকার রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসি থেকে মাত্র ১২ কিলোমিটার উত্তরে কলেজ পার্ক মাঠটি। এটিই ছিল প্রথম রানওয়েযুক্ত বিমানবন্দর। এর আগে যে জায়গাটিতে রাইট-ভাইয়েরা বিমান ওঠানামা করাতেন, উড্ডয়নের নানাবিধ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতেন সে জায়গাটি উত্তর ক্যারোলিনার কিটি হক।
তখন কিটি হক ছিল বিস্তীর্ণ ঘাসের মাঠ। কোনো রানওয়ে না থাকায় কিটি হককে বিমানবন্দরের মর্যাদা দেওয়া হয়নি। রাইট ভাইদের অধ্যবসায় ও অনুশীলনের কোনো কমতি ছিল না। সহজভাবে ওঠানামা করে মানুষ যাতে নির্বিঘ্নে শূন্যে পাড়ি জমাতে পারে— এ নিয়ে অনবরত পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও গবেষণা চালিয়ে যেতে লাগলেন দুজনে। কিটি হকের সাফল্য ও অভিজ্ঞতাকে ভালোভাবে কাজে লাগতে দুই ভাই চলে আসেন ডেটনের এক পশুচারণ ক্ষেত্রে।
মালিক টোরেন্স হফম্যানের কাছ থেকে মাঠটি ব্যবহারের অনুমতিও পেয়ে যান। ১৯০৫ সালে নানাবিধ পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে বিমানশৈলীর প্রভৃতি উন্নতিসাধন করেন দুজনে। রাইট ভাইদের তখন জগেজাড়া খ্যাতি। এবার নিজেরাই বিমান তৈরির কারখানা খুলে বসলেন। রাইট এয়ারক্রাফট কোম্পানি।
১৯০৮ সালে ভার্জিনিয়ার ফোর্ট মেয়ারে গড়ে উঠল বিমান তৈরির কারখানা। বিমান চালনার ক্ষেত্রে রাইট ভাইদের তখন এমন সুখ্যাতি যে, তত্কালীন আমেরিকার সেনাবাহিনীর দুজন সেনা অফিসারকে প্রশিক্ষণ দিচ্ছিলেন দুই ভাই। উদ্দেশ্য দক্ষতার সঙ্গে বিমান চালানো। যে বিমানটি ব্যবহার করে প্রশিক্ষণের কাজ চলছিল সেটি ছিল রাইট ভাইদের কোম্পানির তৈরি বিমান। প্রশিক্ষণের জায়াগাটি ছিল ফোর্ট মেয়ার।
কিন্তু জায়গাটি বিমান প্রশিক্ষণের উপযুক্ত ছিল না। বেশ ছোট জায়গা বলে প্রশিক্ষণ কাজে নানা অসুবিধার সম্মুখীন হতে হয়েছিল।
শুরু হলো উপযুক্ত একটা জায়গার খোঁজ। যে জায়গাটি খুঁজে পাওয়া গেল সেটি সেই মেরিল্যান্ডের কলেজ পার্কের মাঠ। জায়গাটির পশ্চাত্ভূমিও সুন্দর।
হাতের কাছেই মাত্র ১২ কিলোমিটার দূরত্বে ওয়াশিংটন ডিসি। যোগাযোগের কোনো অসুবিধা নেই। সবচেয়ে বড় কথা, এমন বিশাল একটা মাঠ কোথায় আর পাওয়া যাবে? বিমান ওঠানামার জন্য একেবারে উপযুক্ত জায়গা। দু’ভাই বিস্তীর্ণ অঞ্চলটি পরিদর্শন করে খুশি মনে বাড়ি ফিরলেন। ঠিক হলো এখানেই গড়ে তোলা হবে আগামী দিনের বিমানবন্দর।
মেরিল্যান্ড এগ্রিকালচারাল কলেজের প্রায় দেড় কিলোমিটার উত্তরে। বাল্টিমোর এবং ওহিও রেলপথ উত্তর পাশে, আর দক্ষিণে পেটোম্যাক নদীর পূর্বমাথা।
শুরু হলো জমি অধিগ্রহণের প্রক্রিয়া। ১৯০৯ সালের ২৫ আগস্ট ১৬০ একর জমি লিজ নেওয়া হলো। বিস্তীর্ণ এলাকার ঝোঁপঝাড়, জঙ্গল, গাছপালা, আবর্জনা পরিষ্কার করে প্রথমেই তৈরি করা হলো বিমান রাখার উপযুক্ত ছাউনি বা শেড।
যা বর্তমানে হ্যাঙ্গার নামে পরিচিত। তৈরি হলো একটা লম্বা রানওয়ে। পূর্ব-পশ্চিম বরাবর ২৩৭৬ ফুট লম্বা রানওয়ে। ১৯০৯ সালের ৬ অক্টোবর রাইট ভাতৃদ্বয় বিমান চালিয়ে প্রথম অবতরণ করলেন এখানে। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত দুই আমেরিকান সেনা অফিসার এই কলেজ পার্ক বিমানবন্দর থেকে ওই বছর অক্টোবর মাসেই আকাশে বিমান ওড়ালেন।
বিমান ওঠা-নামার কাজ যেমন চলতে থাকল তেমনি বিমান ক্ষেত্রটিকে পাকাপাকি বিমানবন্দরে রূপ দেওয়ার কাজও চলতে থাকল। মার্কিন সেনাবাহিনী এ কলেজ পার্ক বিমান ক্ষেত্রটিকেই বেছে নিলেন সেনাবাহিনীর বিমান প্রশিক্ষণ ক্ষেত্র হিসেবে। তার জন্য অবশ্য ভাড়া দিতে হতো মাসে ৩২৫ ডলার। কলেজ পার্ক বিমানবন্দরের নাম জড়িয়ে আছে হেলিকপ্টার প্রশিক্ষণের জন্যও। ১৯২০ সাল থেকে এখানেই হেলিকপ্টার ওঠা-নামার নানাবিধ প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়।
এরপর ১৯২২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে প্রথমবারের মতো সার্থক হয় হেলিকপ্টার উড্ডয়ন।
রাইট ভাতৃদ্বয় বিমান চালিয়ে এখানে প্রথম অবতরণের দিনটিকে আমরা উদ্বোধনের দিন ধরে নিতে পারি। অর্থাত্ ৬ অক্টোবর, ১৯০৯ সাল। এবার ফিরে দেখা যাক মেরিল্যান্ড বিমানবন্দরের গুরুত্ব আর কোন কোন ক্ষেত্রে। ১৯১৮ সালের ১২ আগস্ট এ বিমানবন্দর থেকেই প্রথম এয়ার মেইল সার্ভিস চালু হয়।
এখান থেকেই রেডিও তরঙ্গ মারফত বিমান চলাচল ও অবতরণের পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলে। এখানে এখনো দেখা যায় ব্যক্তিগত মালিকানাধীন বহু বিমান। এখানে গড়ে উঠেছে ‘ফ্রেন্ডস অব কলেজ পার্ক এয়ারপোর্ট। ’ যাদের কাজ জনসাধারণের মধ্যে দেখতে আসা শত শত দর্শকের মধ্যে পুরনো হলেও কলেজ পার্কের ঐতিহাসিক গুরুত্ব প্রচার করা। সে জন্যই প্রতিবছর উত্সবের আয়োজন করা হয়।
বিমানবন্দরের প্রথম যুগের কন্ট্রোলরুমটি এখনো সেরকমই আছে, তাকে অত্যাধুনিক কক্ষ হিসেবে তৈরি করা হয়নি। অন্যদিকে এ কক্ষের গা ঘেঁষেই আরেকটি কক্ষে রয়েছে যেখানে এই বিমানবন্দরের বহু স্মৃতিবিজড়িত জিনিসপত্র সংরক্ষণ করা আছে। আজকের অত্যাধুনিক, নিয়ন প্রজ্বলিত-মায়াবী আলো ঝলমলে বিমানবন্দরগুলোর কাছে মেরিল্যান্ড তার বনেদিয়ানায়মাথা উঁচু করে স্বমহিমায় এখনো উজ্জ্বল।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।