এডিট করুন
আমি যখন ক্লাস নাইনে পড়ি তখন আমার বাবা একদিন আমারে হুমায়ুন আজাদের ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইল বইটা আইনা দেয়। হুমায়ুন আজাদের লেখা প্রথমে পড়ছিলাম দৈনিক ইত্তেফাকে। উনার পাক সার উপন্যাসটা ইত্তেফাকে ছাপাইছিল। পাক সারের ফিনিশিংটা পইড়া আমার চোখে পানি আইয়া গেছিল। যাই হোক হুমায়ুন আজাদের ছাপ্পান্ন হাজার পইড়া আমার মাথা ঘুরা আরম্ভ করল।
জীবনে আরেকবার মাথা ঘুরছিল "সবিনয় নিবেদন" পইড়া। মেয়েদের রজস্বলা হবার বিষয়টা আমি তখন প্রথম জানি। ক্লাস নাইনে পড়ি তখন। জিনিসটা আমারে এমন আঘাত করছিল যে মনে হইছিল, এইটা অবিচার। কেন মেয়েদের এইরকম একটা অসুবিধায় পড়তে হবে।
সৃষ্টিকর্তা বা আল্লাহ বা ভগবান বা ঈশ্বর যাই বলেন না কেন তার প্রতি আমার একটা ক্ষোভ জইমা গেছিল মেয়েদের প্রতি এই অবিচারের কারণে। বয়স তখন কম। সবিনয় নিবেদন বইটা পড়া শেষ কইরা আমি বাসার গুয়ের ট্যাংকিতে ছিড়া ফালা ফালা কইরা বইটারে নিক্ষেপ করি। এরপর যহন ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইল পড়লাম তহন আমি বইটাতে কয়েকটা লাইন দাগাইয়া রাখছিলাম। "৩০৩ রাইফেল" সংক্রান্ত লাইনটা দাগাইছিলাম মনে পড়ে।
অনেক আগের পড়া তাই ঠিক লাইনটা মনে নাই। তাই উদ্ধৃতি দিলাম না। তা এছাড়া আরো কয়েকটা লাইন পইড়া, অনুচ্ছেদ পইড়া আমার মাথা আবার গেল। বইটাতে দেখবেন একটা অনুচ্ছেদ আছে, লেখক গুলিস্তানে দাঁড়ায় আর মানুষ দেখতে থাকে আর ভাবে সকল মানুষই সঙ্গম হতে উৎপন্ন। আমি বইটা যখন পড়া শেষ করলাম তখন প্রায় সন্ধ্যা সাতটা বাজে।
রাস্তার গিয়া দাড়াইলাম। আমারও তখন রাস্তার মানশষগুলার দিকে তাকাইয়া মনে হইতে লাগল ঐ কথাগুলি। এরপরে নারী বা অবিশ্বাস, তারপরে কোরআন হাদীসের অনুবাদ এইসব পইড়া আমার মাথা আরো বাড়ি খাইল। বাসায় ইঞ্জিল তৌরাতের বাংলা ছিল। ওইগুলানও পড়ছিলাম কিছু কিছু।
কিন্তু এতকিছুর পরও আমার মনে হইতে লাগল কই যানি একটা ফাক আছে। যাই হোক এরপর অনেক দিন গেল। ইন্টারে পড়ি। ততদিনে আমার বন্ধু বান্ধবগো কয়েকটারে হুমায়ুন আজাদ পড়াইছি। বিলু আপার কাহিনী পইড়া আর গুলিস্তানের চোখ দিয়া দেইখা এরাও আমার মত মাথা নষ্টে পরিণত হইল।
আমরা তহন নাস্তিক। ডাইরেক্ট কই, বাংলাদেশের গোলযোগের একটা উৎস হইল এই মসজিদগুলান। সবগুলি মসজিদ ভাইঙ্গা ফালানি উচিত। মসজিদের পিছে যে খরচ হয় তা দিয়া স্কুল করলে অনেক ভাল হইব সবার লাইগা। আমার এক বন্ধুরে আমি একদিন কোরানের একটা লাইন পইড়া প্যাচ ধরানির চেষ্টা করতাছি।
দুস্ত আমার মনে খুব আঘাত পাইল। আমার ঘর থিকা বাইর হইয়া রাস্তার পাশে একটা নির্মীয়মান দালানের ছাদে ( আমরা কইতাম ব্যাংকের ছাঁদ ) গিয়া একা একা বইয়া রইল। আমি আর আমার আরেক বন্ধু ( এইডারে আমিই নাস্তিক বানাইছিলাম ) ওরে গেলাম খুজতে, যে ব্যাংকের ছাদের কোন কুনায় বইয়া রইছে। আমরা দেখলাম বেচারা একা একা বইয়া রইছে মন খারাপ কইরা। তয় কথা হইল, আমাগোরে ও মারতেও আহে নাই, গালিও দেয় নাই।
আমরা ওর মান ভাঙ্গানির লাইগা গেলাম না। দেখতাছিলাম ও কতক্ষণ এমনে একা একা বইয়া থাকে। ফলাফল, পরেরদিন ওই বেটাও নাস্তিক হইয়া গেল। আমাগো থিকা ও আরো এক কাঠি সরেস। ভরা মজলিশে চিল্লাইয়া উঠে।
তা বহুতদিন গেছে। গঙ্গা যমুনার অনেক পানি গড়াইছে। আমি আরো অধিক জ্ঞান লাভের আশায়, বেদ উপনিষদ সব কিনলাম। বাবারে নিয়াই কিনছি। বাসায় বেদের দুইটা খন্ড ছিল আগে আর উপনিষদ ছিল।
আমি পড়ার সময় দাগাদাগি করি। তাই আবার কিনলাম। বাবা কয় এহন এইসব বুঝবি না। এইগুলা কিনা কি করবি। আমি কই এহন না শুরু করলে করুম কহন।
এইরকম বাপে পুতে তর্ক করি। আমি কই, জ্ঞান অর্জন দরকার, কারণ আমি যহন কোন জিনিস পুরাপুরি বা ভালভাবে জানুম তহন আমার কাছে এইটা একটা অস্ত্রের মত হইব। আমার ঐ অভিমানী দুস্তের একটা ডায়ালগ আছে, "জ্ঞান হইতাছে একটা অস্ত্র যা দিয়া তুমি আঘাত করতে পার আবার একটা ঢাল যা দিয়া তুমি আত্মরক্ষা করতে পার। " আমি অস্ত্র চাইছিলাম। কারণ আমার স্বভাবই হইল বান্দরামী।
খুচানিতেই মজা। ব্লাকমেইল হইল একটা শিল্প।
আমার বাপের কিছু কথা কই এহন। উনি প্রথম জীবনে, সেই ক্লাস ফাইভ থিকাই মসজিদের ইমামতি করতেন। আমার দাদা আছিল মাওলানা।
আমার দাদীর বাবা আর চাচা দুইজনে ছিলেন পায়ে হাইটা হজ্ব করা মানুষ। অত্যন্ত সংরক্ষণশীল পরিবারে ছেলে আমার বাপে। কিন্তু উনি জীবনের একটা পর্যায়ে আইসা কেমনে কেমনে জানি নাস্তিক হইয়া গেলেন। তহন আমি ক্লাস সেভেনে পড়ি সম্ভবত। জুম্মা ছাড়া আর কোন সময় মসজিদে যাই না।
কারণ কই জানি পড়ছিলাম, পরপর তিন জুম্মা বাদ গেলে অন্তরে সীলমোহর লাগাইয়া দেয়া হয়। তা বাবা তো বাবাই। নাস্তিক হইলেই কি আর না হইলেই কি। আমার কাম আমি করি, মনে চাইলে মসজিদে যাই, না চাইলে যাই না। এমনকি আমার নাস্তিক বাপেও শুক্রবারে আমারে মনে করাইয়া দেয়, "বাবু নামাজ পড়তে যাবি না, সময় হইয়া গেল তো।
" আমি কই বাবা চল মার লগে। বাবা কয়, " নাহ আমি আর পড়ুম না, অনেক পড়ছি, তোর বয়সে আমি আছিলাম জুম্মার নামাজের ইমাম। " আমার বাচ্চা মনে এতে কোন ক্ষোভও জাগে না, খারাপও লাগে না। আমি আমার মতে নামাজ পড়তে যাইতাম, মিলাদ শেষে জিলাপী খাইতে খাইতে বাড়ি আইতাম, মাঝে মাঝে ছোট বোনটার লাইগা জিলাপী নিয়া আইতাম। কোন জটিলটা ছিল না।
আমার বাপে প্রায়ই হুজুরগো লগে বাহাস বাজাইয়া দিত। হুজুররা কোনমতেই সুবিধা করতে পারত না। কারণ জ্ঞান হইতাছে একটা অস্ত্র। ঢালটাও যদি শক্তিশালী না হয় তাইলে পেরে উঠা যায় না। এরপর বহুতদিন গেল, আমি আমার অস্ত্র তৈরী নিয়া আমার বাপের সাথে কথা কইতাছি।
কিন্তু ততদিনে আমার বাপের নতুন উপলব্ধি হইছে, একটা শক্তি আছে। কিছু একটা আছে। এইটা আল্লাহ ভগবান ঈশ্বর যাই হোক না কেন এইটা আছে। আর আমার বাপে প্রায়ই একটা কথা কয়, "তোমার আল্লাহ আর আমার আল্লাহ এক না। তোমার আল্লাহ রাগী, আমার আল্লাহ অন্যরকম।
" আল্লাহর একটা নাম আছে রাগী। উনি আমারে কইল, এই শক্তির রুপ একেকজনের কাছে একেক রকম। নামাজই পড় আর পূজাই কর, সবগুলি হইতাছে ওই শক্তিরে উপলব্ধি করার একটা চেষ্টা। মূর্তিপুজা মানে তো মূর্তিপূজা না। জিনিসটা হইল মনোযোগরে কেন্দ্রীভূত করার লাইগা একটা মূর্ত রুপ দান, কিন্তু আসল জিনিসটাই তো বিমূর্ত।
আমি কই তুমি এইসব কি কও। বাপে আমারে কইল, "তোমার পথ তোমার কাছে। " আমার ধারণা আমার, তোমার ধারণা তোমার। তবে হ্যাঁ, একটা কাজ কখনই করবা না বাবা, সেইটা হইল কারো মনে কষ্ট দিবা না। আমার আস্ত্র তৈরী করার সূচনাতেই আমি একটা ধাক্কা খাইলাম।
বাপে কইল, যত যাই বল, একটা নীতি লাগে, যা দিয়া তুমি অন্য কিছু বিচার করবা। খোদায় বিশ্বাস করাটাও একটা নীতি, না করাটাও একটা নীতি। একজনের খোদা আরেকজনের সাথে মিলব না। কিন্তু তাই বইলা কখনও কাওরে আঘাত করবা না। মানুষের মনে কখনো কষ্ট দিবা না।
যাই হোক, যে ধর্মেরই হোক ভাল খারাপ সব মিলাইয়াই আমাদের সমাজ। ধর্ম হইতাছে সমাজটারে চালানির একটা নীতিমালা। সব নীতিমালাতেই ফাক ফোকড় থাকে। মানুষ আপনিই সেইগুলা নিজের প্রয়োজনে ঘষামাজা কইরা নেয়। এহনকার বাংলাদেশের ইসলাম আর সেই রসুলের আমলে ইসলামে অনেক তফাৎ।
কারণ সমাজের সাথে মানুষ তার আপন প্রয়োজনে আপন স্বার্থে আপনিই সব বদলাইয়া নিব। মা তার সন্তানরে ভালবাসে আপন স্বার্থে ( উপনিষদের এই কথা প্রায়ই বাবা কয় )। কাউরে আঘাত কইরা তুমি যা করবা তা হইল, একটা বিশৃংখলা তৈরী করবা আর সবচেয়ে বড় কথা একজন মানুষরে যে খুনও করে নাই, চুরিও করে নাই তার মনে তুমি আঘাত দিবা।
আমি আর কি কমু।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।