সাংবাদিক
কিউবা, সাম্প্রতিক একটি অভিজ্ঞতা
শান্তনু দে
এবছরের শেষেই হওয়ার কথা ছিল কিউবার কমিউনিস্ট পার্টির ষষ্ঠ কংগ্রেস।
হচ্ছে না। আপাতত স্থগিত রাখা হয়েছে।
কারণ, কিউবার কমিউনিস্ট পার্টির উপলব্ধি, এটি শুধু একটি গুরুত্বপূর্ণ ইভেন্ট-ই নয়, বরং তার চেয়েও অনেক বেশি কিছু। এরসঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে কিউবার জীবনের স্পন্দন।
বিপ্লবের লক্ষ্যে স্থিত থেকে ঐতিহাসিক অভিমুখকে নিরূপণ করার মহান সৃজনশীল প্রক্রিয়া।
যদি কংগ্রেসকে এই সত্যে পৌঁছতে হয়, যদি সমস্যার সমাধানে পৌঁছতে হয়, যদি কিউবাকে এগোতে হয় ভবিষ্যতের দিকে — তবে এর নীতি-অভিমুখকে ঠিক করতে হলে সামনের সারিতে পার্টির সঙ্গেই তাবৎ মানুষের অংশগ্রহন সমান জরুরী।
এমনটাই মনে করেছে কিউবার কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সপ্তম প্লেনারি অধিবেশন।
প্রথমে তাই পার্টির অভ্যন্তরে শেষ করতে হবে প্রস্তুতির কাজ। তারপর সেই নীতি-অভিমুখের খসড়া নিয়ে আপামর মানুষের মধ্যে নিবিঢ় প্রাণবন্ত আলোচনা।
আলোচনা-সমালোচনা-প্রস্তাবের সেই নির্যাস নিয়ে এই মহান প্রক্রিয়া শেষ হলে, একমাত্র তখনই হতে পারে কংগ্রেস।
আর সেকারণেই আপাতত স্থগিত কিউবার কমিউনিস্ট পার্টির ষষ্ঠ কংগ্রেস। ২৯জুন পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সপ্তম প্লেনারি অধিবেশন নিয়েছে গুরুত্বপূর্ণ এই সিদ্ধান্ত।
মানুষের কাছ থেকে প্রস্তাব-পরামর্শ নেওয়ার প্রশ্নে কিউবার অভিজ্ঞতা কী? বিপ্লবের পঞ্চাশ বছরে কিউবার কাছে এনিয়ে রয়েছে যথেষ্ট অভিজ্ঞতা। জাতীয় স্তরে সাম্প্রতিকতম অভিজ্ঞতাটি কী?
২০০৭এর ২৬জুলাই ক্যামাগুয়েতে রাউল কাস্ত্রোর ভাষণ।
সেপ্টেম্বর, অক্টোবর মাস দু’টিকে কিউবার কমিউনিস্ট পার্টি উৎসর্গ করে তৃণমূল স্তরে আলোচনার জন্য। যার মূল কথাই ছিল, শুধু ২৬জুলাইয়ের ভাষণ নিয়ে আলোচনা নয়। ওই ভাষণের সীমাবদ্ধতাকে ভেঙে প্রয়োজনে চাই আরও বৃহত্তর আলোচনা। মানুষ উৎসাহিত হয়ে খোলামনে সমস্ত বিষয়ে তাঁদের মতামত প্রকাশ করেন। যা ছিল দেশের নেতৃত্বের কাছে পরবর্তী পদক্ষেপের জন্য খুবই প্রয়োজনীয়।
অক্টোবরে মানুষের মধ্যে আলোচনা শেষ হলে ওই বছরই নভেম্বর মাসে যাবতীয় তথ্য সংগ্রহের কাজ শেষ করা হয়। তৈরি করা হয় ওই বিপুল কাজের একটি সারসংক্ষেপ।
এবং ডিসেম্বরে, চূড়ান্ত প্রতিবেদনটি নিয়ে আলোচনা হয় পার্টিতে।
অভিজ্ঞতা কী?
সওয়া কোটির দেশে এই স্টাডি-মিটিংগুলিতে অংশ নেন ৫১লক্ষেরও বেশি মানুষ। যাঁরা সবমিলিয়ে ৩২লক্ষ ৫৫হাজারটি মন্তব্য করেন।
দেন ১৩লক্ষ ১হাজার ২০৩টি সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব। যার মধ্যে প্রায় অর্ধেক, ৪৮.৮শতাংশই ছিল সমালোচনামূলক।
‘আর এই মহান কাজের ফলাফলকে কিন্তু অতল গর্তে ফেলে দেওয়া হয়নি’, জানিয়েছেন রাউল।
কিউবার কমিউনিস্ট ও মানুষের সামনে এখন বিরাট দায়িত্ব, বিরাট চ্যালেঞ্জ।
‘ব্যাপকতর জনগণের অংশগ্রহনের’ মধ্যে দিয়েই আজকের এই সমস্যাগুলিকে চিহ্নিত করতে চায় কিউবার কমিউনিস্ট পার্টি।
যাতে, যে সামজতান্ত্রিক সমাজের জন্য জন্য তাঁরা ব্যাকুল, তারজন্য দেশের বর্তমান ও ভবিষ্যতকে নির্মাণ করতে পারে। নিতে পারে এমন একটি অর্থনৈতিক মডেল, যা পথ দেখাবে দেশের জীবনকে, দেশবাসীর কল্যাণে। যা সুনিশ্চিত করবে দেশের অপরিবর্তনীয় সামাজিক-রাজনৈতিক জমানাকে, যা কি না প্রকৃত স্বাধীনতার জন্য একমাত্র গ্যারান্টি।
জাতীয় জীবনের সঙ্গে সম্পৃক্ত অর্থনৈতিক পরিস্থিতির সঙ্গে জড়িত সমস্যা ও উত্তেজনার অভিব্যাক্তিগুলিকে চিহ্নিত করতে ইতোমধ্যেই শুরু হয়েছে গবেষণা-সমীক্ষার কাজ। এরমধ্যে যেমন রয়েছে দ্বৈত মুদ্রা ব্যাবস্থা থেকে মুক্ত হতে আর্থিক একীকরণের জটিল প্রক্রিয়া, তেমনই রয়েছে বিনা পারিশ্রমিকে কাজের অবসান, অন্যায্য ভরতুকির অবসান, এবং সমাজতান্ত্রিক নীতির ওপর ভিত্তি করে — ‘প্রত্যেককে তাঁর সামর্থ্য অনুযায়ী, প্রত্যেককে তাঁর শ্রম অনুযায়ী’ মজুরি প্রদান।
‘একটি আনুষ্ঠানিক কংগ্রেস এই স্ট্র্যাটেজিক বিষয়গুলির গভীরে গিয়ে আলোচনা করে না, কিংবা দেয় না ভবিষ্যতের জন্য কোনও রূপরেখার নির্দেশ। ’ বলেছেন কিউবার কমিউনিস্ট পার্টির সেকেন্ড সেকেটারি রাউল কাস্ত্রো। ‘অন্যভাবে বললে এটি একটি পাহাড়প্রমান কাজ, বিশাল দায়িত্ব। চিহ্নিত করতে হবে মূল সমস্যাগুলিকে, যার জন্য অবধারিতভাবেই সময় জরুরী। ’
কেন্দ্রীয় কমিটির সপ্তম প্লেনারি অধইবেশনে তা গৃহীত হয়েছে।
পরে ব্যাখ্যা করে নোট আকারে তা প্রকাশও করা হয়েছে। যাতে বলা হয়েছে, ‘প্রথমে তাবৎ পার্টির প্রস্তুতির কাজ শেষ করা জরুরী। তারপর আপামর মানুষের সঙ্গে সার্বিক আলোচনা, এবং যখন এই মহান প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ হবে, তারপরেই একমাত্র কংগ্রেস। ’
‘সেটিই হবে প্রকৃত কংগ্রেস, যেখানে সমস্ত সমস্যাগুলি আলোচনা হবে কমিউনিস্টদের মধ্যে, মানুষের মধ্যে। ’ বলেছেন রাউল।
‘আমরা যদি সত্যিই একটি প্রকৃত কংগ্রেস করতে চাই, বর্তমানের এই পরিস্থিতিতে যদি সমস্যাগুলিকে সমাধান করতে চাই, যদি এগোতে চাই ভবিষ্যতের দিকে, তবে তা এরকমই হওয়া উচিত। এটি হওয়া উচিত মানুষের, যার অগ্রণী বাহিনী হিসেবে সিদ্ধান্ত নেবে তার পার্টি। ’ বলেছেন রাউল।
দেশের সামনে তাৎপর্যপূর্ণ চ্যালেঞ্জগুলি, বিশেষত অর্থনীতি ও জাতীয় প্রতিরক্ষাকে অটুট রাখার গুরুত্ব প্লেনামে সবিস্তারে আলোচনা হয়েছে। আমন্ত্রিত হিসেবে উপস্থিত ছিলেন মন্ত্রিসভার সদস্য, প্রদেশগুলির ফার্স্ট সেকেটারিসহ কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য নন গণ সংগঠনগুলির এমন নেতৃবৃন্দ।
কিউবার কমিউনিস্ট পার্টির পঞ্চম কংগ্রেস হয়েছিল ১৯৯৭এর ৮-১০অক্টোবর। গত বছর এপ্রিলে পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির ষষ্ঠ প্লেনারি অধিবেশনে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় এবছরের শেষেই হবে ষষ্ঠ কংগ্রেস।
এরমধ্যে তিন-তিনটি মারণ ঝড় বয়ে গিয়েছে কিউবার ওপর দিয়ে। যাতে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ১হাজার কোটি ডলার। ৩০আগস্ট, ‘গুস্তাভ’ দিয়ে শুরু।
৯নভেম্বর ‘পালোমা’ দিয়ে শেষ। আর এই মাত্র বাহাত্তর দিনে, কিউবা হারিয়েছে তার মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের (জি ডি পি) ২০শতাংশ। এরসঙ্গেই রয়েছে বিশ্বায়িত অর্থনৈতিক ও আর্থিক সঙ্কটের কারণে ঘোর অনিশ্চয়তা, এরমধ্যেই যার অবধারিত প্রভাব পড়েছে কিউবার অর্থনীতিতে। প্লেনারি অদিবেশনে কিউবার অর্থ ও পরিকল্পনা মন্ত্রী মারিনো মুরিল্লো জর্জ দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতির কথা সবিস্তারে ব্যাখ্যা করেন। বলেন, এবছর প্রথম ছ’মাস অর্থনীতিকে এক কঠিন সমস্যার মুখে পড়তে হয়েছে।
ফলে প্রথমে জি ডি পি বিকাশের হার ৬শতাংশ থাকবে বলে মনে করলেও, এখন তা কমে ১.৭শতাংশে থাকবে বলে মনে করছে হাভানা। একদিকে বিশ্বায়িত অর্থনৈতিক ও আর্থিক সঙ্কটের প্রভাব, অন্যদিকে গত বছরের তিন-তিনটি বিধ্বংসী ঝড়ের বিপুল ক্ষয়ক্ষতি। পরিস্থিতি সামাল দিতে একরকম বাধ্য হয়েই ছাঁটাই করতে হয় বরাদ্দ। আন্তর্জাতিক বাজারে দাম পড়ে যাওয়ার কারণে তাৎপর্যপূর্ণভাবে কমেছে রপ্তানির পরিমাণ। যেমন গত বছর প্রতি টন নিকেল যেখানে বিক্রি হতো ২১হাজার ডলারে, এখন তা প্রায় অর্ধেক কমে হয়েছে ১১হাজার ৭০০ডলার।
পর্যটন ক্ষেত্র এক অদ্ভূত স্ববিরোধিতার মুখোমুখি কিউবা। পর্যটক বেশি আসছে। কিন্তু আয় কম হচ্ছে। কারণ, মার্কিন ডলারের সঙ্গে অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ মুদ্রার বিনিময় মূল্য কমে গিয়েছে। কমছে আমদানির পরিমাণও।
জটিল হয়েছে আর্থিক পরিস্থিতি।
কিউবা কী করছে?
‘আমাদের আয়ের সঙ্গে ব্যয়ের বোঝাপড়া করতে হবে। ’ বলেছেন রাউল। বলেছেন, ‘আমি অর্থনীতিবিদ নই। কিংবা বিপ্লবের পরে অর্থনীতির দায়িত্বেও ছিলাম না।
কিন্তু আমি বুঝি, কেউই, তা সে কোনও ব্যক্তিই হোক, কিংবা কোনও দেশ, আয়ের চেয়ে অঢেল খরচ করতে পারে না। ’
‘দুই আর দুইয়ে যোগ করলে সবসময় চার-ই হয়। পাঁচ নয়। আমি বরাবর বলে আসছি। কিন্তু এখন আমায় বলতেই হচ্ছে, দুই আর দুইয়ে যোগ করলে সবসময় চার-ই হয় না।
তিন-ও হয়। ’ বলেছেন রাউল। প্লেনামে কঠোর আত্মসমালোচনার সুরেই তিনি বলেছেন, ‘আমাদের বলতেই হচ্ছে, ত্রুটিপূর্ণ সমাজতান্ত্রিক ব্যাবস্থা, আমাদের দুর্বলতার কারণেই ‘দুই আর দুইয়ে যোগ করলে তিন হচ্ছে। ’
কিউবার লক্ষ্য তাই দুই আর দুইয়ে চার করা।
তিনি বলেছেন, ‘আমাদের ঘাটতি রাখা যাবে না।
দুর্যোগ মোকাবিলায় রাখতে হবে তহবিল। সেইসঙ্গে উৎপাদন বিকাশে দিতে হবে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার। ’
কীভাবে সম্ভব?
‘আমাদের জনগণ জানেন কঠিন সময়ে কীভাবে ঘুরে দাঁড়াতে হয়। ’ প্রত্যয়ী ঘোষণা রাউলের। বলেছেন, ‘যখন মানুষকে এই বাস্তবগুলি জানানো হবে, তাঁরা আমাদের চেয়ে ভালো বুঝবেন।
এবং সচেতনভাবেই এই সমস্যাগুলি সমাধানে অংশ নেবেন। ’ তিনি এই প্রসঙ্গে প্রথম কয়েক মাসে অতিরিক্ত বিদ্যুৎ খরচের প্রসঙ্গ টেনে আনেন। সেইসঙ্গেই এই সমস্যা মোকাবিলায় প্রশাসনিক পদক্ষেপের প্রতি মানুষের ইতিবাচক প্রতিক্রিয়ার কথা জানান।
‘সেকারণে পার্টিকে আরও শক্তিশালী করা আজ ভীষণ জরুরী। গুরুত্বপূর্ণ এই সংগ্রামে নিতে হবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ও নিয়ন্ত্রণ।
নির্মল, অচঞ্চল থেকে অতীতের চেয়ে অনেক বেশি প্রত্যয় নিয়ে অবিচলিত হৃদয়ে মোকাবিলা করতে হবে আজকের চ্যালেঞ্জকে। ’ বলেছেন রাউল।
সেইসঙ্গেই অধিবেশনে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে দেশের প্রতিরক্ষা পরিস্থিতি নিয়ে। অধিবেশনের আহ্বান, ‘এতটুকু অবহেলা নয় প্রতিরক্ষাকে’।
২৬জুলাই জাতীয় প্রতিরক্ষা পরিষদের বৈঠকের রিপোর্ট অধিবেশনে সবিস্তারে ব্যাখ্যা করা হয়।
খতিয়ে দেখা হয় ২০০৩এর ১৫জুলাই পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির বিশেষ অধিবেশনে গৃহীত লাইন মেনে দেশের প্রতিরক্ষা ক্ষমতা বাড়ানোর লক্ষ্যে ২০০৩-’০৮ পদক্ষেপগুলি। ওই বিশেষ অধিবেশনে বলা হয়, কিউবার ওপর মার্কিন আগ্রাসনের হুমকি বেড়েই চলেছে। এবং এঘটনা ভবিষ্যতে ঘটতে পারে। এটি ছিল সেই সময়, যখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইরাকে প্রাথমিক জয়ের মৌতাতে আবিষ্ট। ২০০৩এর ১মে, মার্কিন রণতরীতে দাঁড়িয়ে বুশের ঘোষণা, ‘অভিযান সফল’।
এর কুড়ি দিন বাদেই কিউবার বিরুদ্ধে আক্রমণাত্মক এবং আগ্রাসী ঘোষণা। যেখানে ‘কিউবায় ক্ষমতা হস্তান্তরের সমন্বয়কারী’ নিয়োগের কথা পর্যন্ত ঘোষণা করা হয়। পরে এই নামে মার্কিন বিদেশ দপ্তর একটি পদও তৈরি করে। নিয়োগ করে লাতিন আমেরিকা বিষয়ক একজন দুঁদে কর্তা ক্যালব ম্যাককারিকে।
২০০৪এ ব্যাসন স্ট্র্যাটেজিক মহড়া, ২০০৬এর ১জুলাই পঞ্চম প্লেনারি অধিবেশন এবখ প্রতিটি কাজের নিরন্তর নজরদারি ও অগ্রগতি সরজমিনে দেখতে প্রদেশ ও পৌরসভাগুলিতে নিয়মিত সফরের নিট ফল — জাতীয় নিরাপত্তা ব্যবস্থায় কিউবা পেয়েছে আশাতীত সাফল্য।
রাউল বলেছেন, ‘এই ইতিবাচক ফল আসলে প্রত্যেকের ভালো কাজের ফসল। আবার ভালো অভিজ্ঞতাও বটে। তিনি বলেন, সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর কিউবা খুবই কম সমরাস্ত্রের অধিকারী হয়েছে। মুখ্যত জোর দেওয়া হয়েছে যেগুলি রয়েছে, সেগুলির আধুনীকিকরণের ওপর। আমাদের বিজ্ঞানী, বিশেষজ্ঞ এবং শ্রমিকদের প্রয়াসকে ধন্যবাদ।
ধন্যবাদ বিপ্লবী সশস্ত্র বাহিনী ও অর্থনীতিকে। তবে প্রকৃত অর্থনৈতিক সম্ভাবনাগুলিকে মনে রেখে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে আরও শক্তিশালী করার কাজে গুরুত্ব দিতে হবে। ’
ব্যাসন স্ট্র্যাটেজিক মহড়া এবার হবে বছরের শেষে। বর্তমান পরিকল্পনা অনুয়ায়ী প্রতি চার বছর অন্তর এটি করার কথা। প্রাথমিক পরিকল্পনা ছিল ২০০৮এর নভেম্বরে।
কিন্তু প্রবল ঝড়ের কারণে তা আর সম্ভব হয়নি।
দু’বছর আগে ২৬জুলাই ক্যামাগুয়ের ভাষণে রাউল কাস্ত্রো বলেছিলেন, আমাদের ফিরতে হবে জমিতে, চাই আরও উৎপাদন।
সেসময় কিউবার মোট কৃষিজমির প্রায় অর্ধেকই ছিল পতিত জমি, অথবা চাষ না হওয়া জমি। সেদিনের ডাক ছিল, একে সাধারণ চেহারা দিতে হবে, সর্বজনীন করতে হবে — তাৎক্ষনিক উদ্ভাবন ছাড়াই যতটা সম্ভব দ্রুত গতিতে — রাষ্ট্র ও কৃষির প্রতিটি অভাবনীয় উৎপাদনের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে — কঠোর পরিশ্রম, সঙ্গে প্রেরণা-উদ্দীপনাকে যোগ করে কাটাতে হবে দেশের চাহিদা পূরনে রাষ্ট্রের ব্যর্থতাকে।
রাউলের ডাকে সাড়া দিয়ে এক লক্ষ ১০হাজার আবেদনপত্র জমা পড়ে।
এরমধ্যে এবছর আগস্ট পর্যন্ত ৮২হাজার আবেদনপত্র সরকার অনুমোদন করেছে। জমির দলিলও বন্টন করেছে। আয়তনে যা ৬লক্ষ ৯০হাজার হেক্টর, অন্যভাবে বললে পতিত জমির ৩৯শতাংশ। যদিও, জমি বিলি করা হয়েছে লিজে। দশ এবং পঁচিশ-বছর মেয়াদী লিজে।
এবং এই সময়ে অব্যবহৃত সরকারী অনাবাদী ওই জমি অন্য কাউকে বিক্রি করা যাবে না, কৃষি ছাড়া অন্য কাজে ব্যবহার করা যাবে না এই শর্তে।
এইমুহূর্তে ‘জোরকদমে চলছে লিজে-জমি দেওয়ার কর্মসূচী। যা ইতোমধ্যেই বাড়িয়ে দিয়েছে খাদ্য উৎপাদনকে। বাড়িয়েছে কর্মসংস্থান। কমিয়েছে আমদানি নির্ভরতা।
’ এই আগস্টে একথা জানিয়েছেন কিউবার কৃষি মন্ত্রকের রাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যালসিদেস লোপেজ। যেমন লিজে-জমি পাওয়া ৮২হাজার কিউবাবাসীর মধ্যে জুলিও সিজার একজন। লাস তুনিসের শহরতলির বাসিন্দা জুলিও সিজার লিজে পেয়েছেন ১১.৩হেক্টর পুরোপুরি পতিত জমি। আর সেই অনাবাদী জমিতেই এবছর ১৩টন তামাক ফলিয়েছেন সিজার। বিক্রি করেছেন রাষ্ট্রকে।
আগামী বছর তা বাড়িয়ে ২৩টন করা লক্ষ্য।
যদিও, রাউল বলেছেন, আমাদের বিশ্বাস এটা সামান্যই। চাই আরও সংগঠিত উদ্যোগ। এবং এটিই আমাদের সর্বোচ্চ স্ট্রাটেজিক অগ্রাধিকার।
কিউবায় রয়েছে প্রায় আড়াই লক্ষ কৃষক পরিবার।
রয়েছে প্রায় ১১০০টি সমবায়। যাঁরা সবাই মিলে তিনভাগের একভাগেরও কম জমিতে উৎপাদন করেন দেশের প্রয়োজনের সত্তর শতাংশ খাদ্যশস্য।
রাউল কাস্ত্রোর লক্ষ্য, অভ্যন্তরীণ কৃষি উৎপাদন বাড়ানো, আমদানির ওপর নির্ভরতা কমানো। যেমন ২০০৭সালেই কিউবাকে আমদানি করতে হয়েছে তার প্রয়োজনের ৪০ শতাংশ খাদ্যশস্য, ২০০কোটি ডলারের বিনিময়ে।
জমির এই লিজ কর্মসূচীতে ভূমিহীন কৃষকরা প্রত্যেকে ৩৩একর জমির জন্য আবেদন করেছেন।
এবং লিজে জমি পেয়েছেন। পাশাপাশি, যাঁদের জমি রয়েছে, তাঁরা নিজেদের জমির অংশকে বাড়িয়ে ৯৯একর জমি দশ বছরের জন্য লিজ পেয়েছেন। মেয়াদ শেষ হলে তাঁদের আবার দশ বছরের জন্য লিজের আবেদন করতে হবে। অন্যদিকে, সমবায় ও সরকারী সংস্থাগুলি তাদের খুশিমতো জমির আবেদন করেছেন এবং পেয়েছেন। তাদের জন্য লিজের মেয়াদ পঁচিশ বছর।
মেয়াদ শেষ হলে তাদেরকেও পুনরায় লিজের জন্য আবেদন করতে হবে।
তবে, কৃষকসহ সমবায় ও সরকারী সংস্থাগুলি সরাসরি সরকার ও ক্রেতাকে তাদের উৎপাদিত সামগ্রী বিক্রি করতে পারবে।
বিপ্লবের পঞ্চাশ। গত শতকের ছয়ের দশকে পর এই দ্বীপরাষ্ট্রে বৃহত্তম জমি বন্টন। কিউবার কমিউনিস্ট পার্টির মুখপত্র গ্রানমায় প্রকাশিত প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, দেশের খাদ্য উৎপাদনে গতি আনতেই এই পদক্ষেপ।
১৯৫৯-এ, বিপ্লবের শেষে বিশাল পরিমাণ জমির জাতীয়করণ এবং তার মধ্যে একটি বিরাট অংশ ক্ষুদ্র কৃষকদের মধ্যে বন্টনের পর, এরকম বিরাট অংশের জমি গত পাঁচ দশকে আর কখনও বন্টন করা হয়নি।
অবশ্য, কিউবা বিপ্লবের সবচেয়ে বৈপ্লবিক সাফল্য — কমিউনিস্ট পার্টি গঠন। বিপ্লব-পরবর্তী কিউবায় বিভিন্ন বিপ্লবী গোষ্ঠীগুলির যৌথ উদ্যোগে গড়ে ওঠা একক বৃহত্তম কমিউনিস্ট পার্টি সেদেশের রাজনৈতিক শক্তি বিন্যাস তো বটেই, বিশ্বেও এক অভূতপূর্ব নজির। কিউবার বাস্তবতার সঙ্গে তা অবশ্য মোটেই বেমানান নয়।
অবশ্য ফিদেলের জন্মের আগেই কিউবায় জন্ম হয়েছিল মার্কসবাদী-লেনিনবাদী পার্টির।
সেটা ১৯২৫। আমেরিকা থেকে মাত্র নব্বই মাইল দূরে একরত্তি দ্বীপরাষ্ট্রে হয়েছিল মার্কসবাদী-লেনিনবাদী পার্টির প্রথম কংগ্রেস। ১৬-১৭আগস্ট। মূলত হাভানা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র জুলিও অ্যান্তোনিও মেল্লার নেতৃত্বে সেদিনই কিউবায় মার্কসবাদী-লেনিনবাদী পার্টির আত্মপ্রকাশ।
আজ কিউবা বিপ্লবের পাঁচ দশক।
কিন্তু এই উর্বর লড়াকু জমিতে সমাজ পরিবর্তনের আন্দোলনের সূত্রপাত ১৮৯২তে। কিউবার ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ব, বিখ্যাত কবি হোসে মার্তি ও কার্লোস বেলিনোর মতো প্রতিবাদী মানুষের নেতৃত্বে। জন্ম নিয়েছিল কিউবার বিপ্লবী পার্টি (পি আর সি)। এরপরেই মেহনতী মানুষের আন্দোলন দানা বাধতে থাকে। নানা রূপে।
শ্রেণী শোষণের জেরে তা আরও তীব্র হয়। ধীরে ধীরে যা ছড়িয়ে পরে সমাজের এক থেকে অপর প্রান্তে। জুলিও অ্যান্তোনিও মেল্লার মাধ্যমে পরিণত শ্রমিক আন্দোলন ও ছাত্র আন্দোলনে সেদিন সঞ্চারিত হয় সমাজতন্ত্রের ধ্যান-ধারণা। গঠিত হয় কমিউনিস্ট গ্রুপ। তারই সূত্র ধরে ১৯২৫এ মার্কসবাদী-লেনিনবাদী পার্টির প্রথম কংগ্রেস।
এরপর ২৬জুলাই আন্দোলন, ১৩মার্চ রেভেলিউশনারি ডিরেক্টরেট ও পিপলস্ সোসালিস্ট পার্টির মধ্যে ক্রমশ গড়ে ওঠা ঘনিষ্ঠ কর্মকান্ডই মতাদর্শগতভাবে ও কর্মসূচীগত ঐক্য গড়ে তোলে। কমিউনিস্ট পার্টির পুনর্গঠনে এটিই ছিল মূল ভিত্তি। তিনটি গোষ্ঠী খুব স্বাভাবিক পরিণতিতেই ১৯৬১’র গোড়ায় গড়ে তোলে ইন্টিগ্রেটেড রেভেলিউশনারি অর্গানাইজেশন। সেবছর ২৬জুলাইয়ের সমাবেশে ফিদেল ‘ইউনিফায়েড পার্টি অব দি কিউবান সোসালিস্ট রেভেলিউশন’ গঠনের কথা ঘোষণা করেন।
১৯৬৫’র ১অক্টোবর আরও একধাপ এগিয়ে গঠন করা হয় কিউবার কমিউনিস্ট পার্টি (পার্তিদো কমিউনিস্তা ডি কিউবা বা পি সি সি)।
গঠন করা হয় পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটি ও পলিট ব্যুরো। পার্টির প্রথম ও দ্বিতীয় সম্পাদক নির্বাচিত হন যথাক্রমে ফিদেল ও রাউল কাস্ত্রো। ১৯২৫এ আগস্টে প্রথম কমিউনিস্ট পার্টি গঠনের মাধ্যমে বৈপ্লবিক আন্দোলনের যে নতুন স্তরে প্রবেশ করেছিল কিউবা, ১৯৬৫’র অক্টোবরে অনেক পথ পাড়ি দিয়েই তার প্রত্যাশিত পরিণতিপ্রাপ্তি।
আর নতুন করে গড়ে ওঠা পি সি সি’র সাংগঠনিক ত্রুটি-বিচ্যুতিগুলি কাটিয়ে আজকের সংহত রূপ নেয় প্রথম কংগ্রেস থেকে। ১৯৭৫এর ১৭-২২ডিসেম্বর হাভানায় পার্টির প্রথম কংগ্রেস নানাদিক থেকে স্মরণীয়।
পার্টি ও সরকারের দিক থেকেও। যা সমাজতন্ত্র নির্মাণে এক সর্বোচ্চ পর্যায়ের সূচনাকে চিহ্ণিত করে। প্রথম কংগ্রেস যেমন প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার রূপরেখা নিয়ে আলোচনা করে, তেমনই সিদ্ধান্ত হয় দেশের নতুন সংবিধান নিয়ে। এরপর ১৯৮০’র ১৭-২০ডিসেম্বর হাভানার কনভেনশন প্যালেসে দ্বিতীয় কংগ্রেস। পরবর্তীয় ১৯৮৬তে তৃতীয় কংগ্রেস হয় দু’ভাগে।
প্রথমে ১-৭ফেব্রুয়ারি। পরে ওই বছরেরই ১-২ডিসেম্বর। এরপর ১৯৯১তে সান্তিয়াগো দি কিউবা শহরে ১০-১৪অক্টোবর ঐতিহাসিক কংগ্রেস। যার মূল লক্ষ্যই ছিল কিউবায় সমাজতন্ত্রকে রক্ষা করা। এই কংগ্রেস দেশের জনগণ মার্কসবাদ-লেনিনবাদের নীতি এবং মার্তির আদর্শ পরিত্যাগ না করে বরং সামজতান্ত্রিক মতাদর্শের বিশুদ্ধ রূপকে কাজে পরিণত করতে তাঁর সামর্থ্য ও দৃঢ় প্রত্যয়ের কথা সশব্দে ঘোষণা করে।
শেষে ১৯৯৭তে ৮-১০অক্টোবর পার্টির পঞ্চম কংগ্রেস।
‘কংগ্রেসকে স্থগিত রাখার সিদ্ধান্তের অর্থ আদৌ এর প্রস্তুতির কাজকে অসাড় কিংবা অবশ করে দেওয়া নয়, বরং পার্টির সর্বোচ্চ নেতৃত্বের কমিটিতে পুনর্নবীকরণের মতো জরুরী পদক্ষেপগুলি নেওয়া আজ জরুরী। ’ বলেছেন রাউল। ‘অনিন্দসুন্দর কমরেডদের নিয়ে গঠিত হয়েছিল বর্তমান কেন্দ্রীয় কমিটি। কিন্তু এঁদের মধ্যে অনেকেই আর তাঁদের দায়িত্ব বহন করতে পারছেন না, যা তাঁরা বহন করছিলেন বারো বছর আগে, পাঁচ বছরের মেয়াদের জন্য যখন তাঁরা নির্বাচিত হয়েছিলেন, তখন।
এবং যা কংগ্রেসের বিলম্বের কারণে অনেকটা দেরি হয়ে গিয়েছে। ’
কিউবার কমিউনিস্ট পার্টির গঠনতন্ত্রের ৪৬নম্বর ধারায় বলা আছে, ‘দু’টি কংগ্রেসের মাঝে, পার্টি নীতির গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলি নিয়ে জাতীয় সম্মেলন ডাকতে পারে কেন্দ্রীয় কমিটি। জাতীয় সম্মেলনের হাতে রয়েছে কমিটিতে নতুন সদস্যদের যুক্ত করা, প্রয়োজনে সুবিধা মনে করলে কাউকে তাঁর পদ থেকে সরিয়ে অথবা মুক্তি দেওয়ার পূর্ণ কর্তৃত্ব। সম্মেলনে অংশগ্রহনকারীর সংখ্যা, কীভাবে তাঁরা নির্বাচিত হবেন, জাতীয় সম্মেলনের প্রস্তুতির কাজ সমাধা করার নিয়ম-বিধি চূড়ান্ত করবে পলিট ব্যুরো। ’
‘গঠনতন্ত্রের এই ধারা মেনেই কেন্দ্রীয় কমিটির সপ্তম প্লেনারি অধিবেশন জাতীয় সম্মেলন ডাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
মূলত কমিটিগুলিতে নতুন নেতৃত্ব নির্বাচনের লক্ষ্যে। অন্যদিকে কেন্দ্রীয় কমিটি, পলিট ব্যুরো, সম্পাদকমন্ডলী থাকবে কংগ্রেসের প্রস্তুতির কাজ জারি রাখা ও শেষ করার দায়িত্বে। ’
ঋণ স্বীকার : কিউবার কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির মুখপত্র ‘গ্রানমা’, কিউবার কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির তাত্ত্বিক ও রাজনৈতিক পত্রিকা ‘কিউবা সোসালিস্টা
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।