আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

দেশপ্রেমিক ধনিক শ্রেণী ও দরিদ্রতম মুক্তিযোদ্ধারা



দেশপ্রেমিক ধনিক শ্রেণী ও দরিদ্রতম মুক্তিযোদ্ধারা ফকির ইলিয়াস ================================== সংবাদটি খুব বড় নয়। তবে তার গভীরতা বড়। দেশপ্রেমিক জাতীয় ধনিক শ্রেণীর বিকাশের দিকে নজর দিতে সরকারকে পরামর্শ দিয়েছেন প্রবীণ রাজনীতিবিদ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির (ন্যাপ) সভাপতি অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদ। (দৈনিক আমাদের সময়, ২ নভেম্বর ২০০৯)। তিনি বলেছেন, বাংলাদেশে বর্তমানে ক্রমবর্ধমান হারে লুটেরা বুর্জোয়া শ্রেণী ভেঙে গণতান্ত্রিক বুর্জোয়া শ্রেণীর উদ্ভব হচ্ছে।

অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদের মতে, রাষ্ট্রীয় সহায়তা ব্যক্তি পুঁজির বিকাশের মাধ্যমে জাতীয় পুঁজি গঠন সম্ভব। তিনি বাংলাদেশে শিল্পায়ন, বিনিয়োগ এবং জাতীয় অর্থনৈতিক কর্মকান্ডকে বাধাগ্রস্ত না করারও অনুরোধ করেছেন। তার এই বক্তব্যটি পড়ে আমার বারবার মনে হয়েছে, কিংবদন্তিতুল্য এই রাজনীতিক ধনিক শ্রেণীর একটি নতুন শ্রেণীবিন্যাস করতে চেয়েছেন। তিনি সেই শ্রেণীকে সাধারণ মানুষের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে চেয়েছেন। তার এই আহ্বান সম্পর্কে আলোচনার আগে ধনিকদের শ্রেণীচরিত্র বিষয়ে কিছু আলোকপাতকরণ আবশ্যক মনে করি।

একাত্তর পূর্ববর্তী সময়ে এই ভূখন্ডে কারা ছিল ধনিক শ্রেণী? এবং তাদের মূল কর্মকান্ডের স্বরূপ কেমন ছিল? এ বিষয়টি রাষ্ট্রের মানুষের মোটেই অজানা নয়। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের ধনিক শ্রেণীর একটি সখ্য সব সময়ই বিরাজিত ছিল। ছিল ব্যবসা-বাণিজ্যে, লেনেদেনে, দান খয়রাতে, এমনকি রাষ্ট্রীয় লবিং পর্যায়েও। যারা নিতান্তই শ্রমজীবী মানুষ ছিলেন, তারা এই ধনিক শ্রেণীর নিষ্পেষণের শিকার ছিলেন সবদিক থেকেই। ফ্যাক্টরি, ইন্ডাস্ট্রি, কলকারখানা পরিচালনায় এদের মৌলিক মিল সেটাই প্রমাণ করে।

আমরা জানি বাংলাদেশের মহান মুক্তিসংগ্রামেও যারা নেতৃত্ব দিয়েছিলেন এরা ছিলেন মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে উঠে আসা নেতৃত্ব। এর কারণ কি? কারণ পশ্চিমা শোষণের শিকার পূর্বের বুর্জোয়া শ্রেণী কখনই হয়নি। পশ্চিম পাকিস্তানের 'আদমজী'রা পূর্ব পাকিস্তানে জুট মিল করেছে এই অঞ্চলের ধনীদের সায় নিয়েই। ফলে বৈষম্য ছিল ধনী ও দরিদ্রের। মহান মুক্তিসংগ্রাম সাধিত হয়েছিল সেই লুটেরা শ্রেণীকে তাড়ানোর জন্যই।

আর এর নেতৃত্ব এসেছিল তৃণমূল থেকে। একজন শেখ মুজিব, একেকজন সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন আহমদ, এএইচএম কামরুজ্জামান, এম. মনসুর আলীরা ছিলেন সেই শোষিত মানুষের কণ্ঠস্বর। এই অঞ্চলের মানুষের প্রত্যয়ের প্রতিভূ। মহান মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিতও হয়েছিল সেই আলোকে। আর এই সশস্ত্র যুদ্ধটি করেছিল কারা? হাফপ্যান্ট কিংবা লুঙ্গি পরে, গায়ে ছেঁড়া গেঞ্জি নিয়ে যারা পাকিস্তানি হানাদারদের বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল এদের প্রকৃত পরিচয় কি? এরাই মুক্তিসেনা।

এরাই গেরিলা। তারা আদেশ পালনে এতটাই ব্রতী ছিলেন যে, সে সময়ে একটি স্বাধীন মাতৃভূমি ছাড়া আর কিছুই তাদের আরাধ্য ছিল না। বাঙালির বিজয় এসেছিল সেই চেতনায়। সেই আলোর দীপ্তি ছড়িয়ে। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে গোটা দেশেই ভেঙে পড়ে অর্থনৈতিক অবকাঠামো।

এ সময়ে একটি সুবিধাবাদী চক্র ফায়দা তোলার চেষ্টায় লিপ্ত হয় ধ্বংসস্তূপের উপরে দাঁড়িয়ে। বাহাত্তর থেকে পঁচাত্তরের পনেরো আগস্ট, সময়টুকু মাত্র সাড়ে তিন বছর। এই সময়ে বিভিন্নভাবে রাষ্ট্রীয় ভিত কাঁপিয়ে তোলার চেষ্টা করা হয়। যারা একাত্তরে পরাজিত হয়েছিল সেই শক্তিটি কলকাঠি নাড়তে থাকে সর্বশক্তি দিয়ে। ঘটে যায় পনেরোই আগস্টের নির্মম হত্যাযজ্ঞ।

লুটেরা ধনিক শ্রেণী যারা কিছুটা ঘাপটি মেরে বসেছিল, তাদের জন্য আসে যথেষ্ট সুযোগ। এরা এক ধরনের পেশিশক্তি, ধর্মান্ধতা, মানুষের মৌলিক ক্ষমতা হরণ- প্রভৃতির আশ্রয় নিয়ে রাষ্ট্রের অর্থনীতিতে নিজস্ব বাহু প্রতিষ্ঠায় লিপ্ত হয়। এমনকি গণতন্ত্রের নামে চলে এক ধরনের লুটেরা মনোবৃত্তি প্রতিষ্ঠার প্রতিযোগিতা। সেই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশে এ সময়ে গড়ে উঠেছে মূলত একটি ভোগবাদী ধনিক শ্রেণী। এরা সব লজ্জার মাথা খেয়ে রাষ্ট্রীয় ব্যাংকের অর্থ আত্মসাৎই শুধু নয়, জনগণের মৌলিক অধিকার অংশেও তাদের দাঁত বসাচ্ছে এবং বসিয়েছে।

আজকের বাংলাদেশে 'জাতীয় ধনিক শ্রেণী; কিংবা 'দেশপ্রেমিক ধনিক শ্রেণী' আমরা কাদের বলব? এর সংজ্ঞা কি? গেল পনেরো বছরে বাংলাদেশে আবাসন, ব্যাংক, চিকিৎসা ক্লিনিক, ফোন কোম্পানি, বীমা, মিডিয়া, রফতানিজাত সামগ্রী, গার্মেন্টস প্রভৃতি সেক্টরে বেশ নতুন 'মহাজন' এর মুখ আমরা লক্ষ্য করি। এরা কারা? এদের পরিচয় কি? লক্ষ্য করলে দেখা যাবে এরা কোন না কোনভাবে প্রধান কোন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত, সম্পৃক্ত। তাদের প্রতিষ্ঠানগুলোও সেই সব দলের তাঁবেদারি করে যাচ্ছে। রাষ্ট্রের জনগণকে খুব অবাক হয়ে দেখতে হয়, রাষ্ট্রীয় সুবিধা নেয়ার জন্য এই 'দেশপ্রেমিক ধনিক শ্রেণী' কিন্তু সব সময়ই একই সুরে কথা বলে। এই প্রসঙ্গে আমি কিছু প্রশ্ন রাখতে চাই।

যারা কোটি কোটি টাকা মুনাফার পরও রাষ্ট্রীয় কর ঠিকমতো দেয় না আমরা কি তাদের দেশপ্রেমিক জাতীয় ধনিক শ্রেণী, বলব? যারা অধিক মুনাফা অর্জনের পরও গার্মেন্টস শ্রমিকের মালিক বেতন ভাতা দেয় না বরং শ্রমিকের রক্তে নিজ হাত রঞ্জিত করে আমরা এদের 'দেশপ্রেমিক ধনিক শ্রেণী' বলব? গোটা বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর কোষাগারে বড় জোগান আসে ট্যাক্সের টাকা থেকে। বাংলাদেশে অনেক বড় বড় নামকরা ডাক্তার আছেন যারা মাসে কোটি টাকা আয় করেন। এরা ট্যাক্স দেন না। এভাবে অনেকগুলো প্রাইভেট সেক্টরই রয়ে গেছে ট্যাক্স আওতার বাইরে। এটা জাতীয় লজ্জা।

এটা জাতির লজ্জা। লুম্পেন ধনতন্ত্রের প্রবক্তা হয়ে যারা কোন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে মিশে ফায়দা নিতে চায়, প্রকৃত রাজনীতিবিদদের উচিত ছিল এদের বয়কট করা। তারা এদের বয়কট তো করেনই-নি বরং এদের কাছ থেকে চাঁদা নিয়ে নিজ নিজ দলের সাংসদ বানিয়েছেন। মন্ত্রিত্ব দিয়েছেন। পুঁজিবাদী কোন সভ্যদেশে এমন লেনদেনের নজির নেই।

অথচ ব্যাংলাদেশে তা প্রতিষ্ঠানিক রূপ পেয়েছে। এখন প্রশ্নটি হচ্ছে এই, একটি উজ্জ্বল স্বপ্ন নিয়ে যে হতদরিদ্র মানুষটি সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ করেছিল, তার ভাগ্য কেমন আছে কিংবা তার অবস্থার কি পরিবর্তন হয়েছে? না, তার কোন পরিবর্তনই হয়নি। বরং সেই সব মানুষ এখন দরিদ্রতম হিসেবে দিনাতিপাত করছে। কোথাও কাজ করেও এরা ন্যায্য শ্রমের মূল্যটুকু পাচ্ছে না। অথচ এই ধনিক শ্রেণী সামান্য মনোযোগী হলে দুস্থ মুক্তিযোদ্ধা, মেধাবী ছাত্র, বিধবা নারী কিংবা অনাথ কিশোর-কিশোরীর জন্য অনেক কিছুই করতে পারত।

যারা রাষ্ট্রীয় টাকায় আমদানি করার গাড়ি নিতে ঐক্যবদ্ধ হয়, যারা ট্যাক্স না দেয়ার জন্য জোটবদ্ধ হয় এদের কাছ থেকে গরিবের কল্যাণে কি-বা আশা করা যেতে পারে? মুক্তির যে সংগ্রাম বাংলাদেশে চলছে এই সংগ্রাম নিরন্তর। আর এই সময়ে দেশের প্রতিটি মানুষই মুক্তিযোদ্ধা। অবাক করা সত্য হচ্ছে এই আপামর মানুষ কয়েক লাখ 'দেশপ্রেমিক ধনিক শ্রেণী'র হাতে জিম্মি। এরাই নির্ধারণ করে তেল, পেঁয়াজ, নুনের দাম। এরা শুধুই নেয়, নিতে জানে।

দেয়ার বেলায় তাদের দু'হাত কাঁপে। অথবা দেয় রাজনীতিকে পুঁজি করে। এখানে আরও কিছু বিষয় নিয়ে কথা বলা যায়। দেশের বীর মুক্তিযোদ্ধাদের কল্যাণে গঠিত হয়েছিল '' বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট''। এই ট্রাস্টটি দেশের এই ধনিক শ্রেণীর প্রত্যক্ষ সহযোগিতা পেতে পারত।

কিন্তু তা না করে এই ট্রাস্টকেও ব্যবহার করা হয়েছে রাজনৈতিক ঢাল হিসেবে। এখনও করা হচ্ছে। ভোগবাদীরা সব সময়ই চতুর। তারা জানে কখন কোন শিকার ধরে নিজের আখের গুছিয়ে নিতে হয়। বাংলাদেশের এই ধনিক শ্রেণী তেমনটিই করেছে।

তাদের মাঝে সততা ও নিষ্ঠার অভাব দুর্বল করে তুলেছে রাষ্ট্রের অর্থনীতির ভিত। বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটি যেসব শহীদের রক্তের বিনিময়ে বিজয় অর্জিত হয়েছে তাদের একটি অন্যতম স্বপ্ন ছিল ধনের সুষম বণ্টন। আর সে জন্যই গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও জাতীয়তাবাদ ছিল স্বাধীনতার চার মূলস্তম্ভ। সেই অঙ্গীকার জাতি এখন অস্বীকার করছে। একটি অংশ নানা ধুয়া তুলে চার মূলনীতির উদারতাকে ম্লান করে দেয়ার চেষ্টা করছে।

আর জাতি হিসেবে বাঙালি পরাজিত হতে শুরু করেছে সেই থেকেই। বুর্জোয়া কিংবা পেটি বুর্জোয়া পোষ্য ধনিক শ্রেণী নির্মাণ করে কোন দল কিংবা সরকারই একটি জাতির উন্নতি সাধন করতে পারে না। যারা বিত্তবান, যারা ধনশালী তাদের রাষ্ট্রীয় আইন, অবকাঠামো মেনে চলতে হবে। সততা দিয়ে রাষ্ট্রের মানুষের কল্যাণে নিয়োজিত হতে হবে। গণমানুষের সার্বিক দীনতা দূর করতে না পারলে ধনিক শ্রেণীকে পৃষ্ঠপোষকতা ব্যাপক কোন পরিবর্তন আনবে না, আনতে পারে না।

নিউইয়র্ক, ৪ নভেম্বর ২০০৯ -------------------------------------------------------------------- দৈনিক সংবাদ। ঢাকা। ৬ নভেম্বর ২০০৯ শুক্রবার প্রকাশিত ছবি - গ্রেটা ভেন ডোরনাভেল্ট

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।